ছায়া মানব- ২ ১.

0
558

ছায়া মানব ২

১.
বাইরে তুমুল বর্ষণ। থেকে থেকে বজ্রপাতে মুখরিত পরিবেশ। সেদিকে খেয়াল নেই পঁচিশ বর্ষীয়া মেয়েটির। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে গভীর ধ্যানে। বুকের সাথে মিশে রয়েছে একখানা পোশাক।
হন্তদন্ত হয়ে একজন পুরুষ তার দিকে এগিয়ে আসে। রাগী বয়ানে উচ্চারণ করে,
‘‌অহনা, পাগল হয়ে গেলে নাকি? এভাবে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে যে।’

ব্রুক্ষেপ নেই অহনা নামক মেয়েটির।‌ বৃষ্টি বিপন্নতায় উদ্ভ্রান্ত সে। হঠাৎ শীতে তার চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে আসে। কাঁপতে থাকে ভীষণ। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো তাকে,’কি করছ তুমি? চলে এসো ভেতরে।’

আরিশের কথায় কিছুটা ধ্যান ফিরল অহনার। কিন্তু তবুও সে নড়ছে না। থেকে থেকে কাঁপছে খুব। চোখের পলকেই তার শীতল শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়তে চাইলে দেরী করল না আরিশ। তাকে পাঁজাকোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। চৈতন্য হারিয়েছে অহনা‌। শরীরটাও ভেজা বলে তার কাঁপুনি থামছে না। কি করবে সে এখন? একজন পুরুষ কি করে তার পোশাক পরিবর্তন করে দেবে? বাড়িতে যে আর কোনো সদস্য‌ও নেই। সবাই নিমন্ত্রণে গেছে। আসতে অনেক রাত হবে। আরিশ এদিক ওদিক পায়চারি করছে। এই মুহুর্তে তার বুদ্ধি জাগ্রত হচ্ছে না। এমন সময় দেখল আয়শা এসে গেছে। নিদারুণ সময়ে তার উপস্থিতি আরিশের চিন্তা দূর করল। মাকে দ্রুত অহনাকে সাহায্য করার কথা বলল।

খুব জ্বর এসেছে মেয়েটার সাথে কাঁশিও। আরিশের ঘুম উড়ে গেছে। এক মুহুর্তের জন্যও সে শান্তিতে নেই। ঔষধ খাইয়ে যত্ন নিয়ে তাকে শুইয়ে দিল। নিজে শিয়রের কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অহনা জ্বর কাতুরে কন্ঠে বারবার কাউকে ডাকছে। শব্দ গভীর হলো,’মাহতিম’। এটা নতুন কিছু নয়। একটু অসুস্থ হলেই তার ঘোরলাগা কন্ঠে এই একটা নাম‌ই উচ্চারিত হয়। আরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৌনভাবে উচ্চারণ করল,’আমি কি ঐ স্থান কখনোই নিতে পারব না?’
পরপর‌ই অহনার নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকায়। অপরূপ সুন্দরী এক নারী। দেখতেই ইচ্ছে করে প্রতি ক্ষণে। হৃদয় মেলানোর ইচ্ছেটাও তীব্র। কিন্তু ছোঁয়া বারণ। আরিশের মন আঁকুপাঁকু করছে। কিছুতেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। বুকের ভেতরে থাকা সত্ত্বাটার ডাকে সাড়া দিয়ে লজ্জাজনক কাজটার জন্য নিচু হলো। অহনার ঘুমন্ত মুখশ্রীর একদম কাছে নিয়ে গেল নিজের বেহায়া মনটাকে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল অহনার কপালে। কেঁপে ওঠল অহনা। শরীরে ছেয়ে গেল এক অদ্ভুত অনুভূতি। আরিশ তৎক্ষণাৎ নিজেকে সরিয়ে আনলো। অহনাকে এই প্রথম স্পর্শ করতে পেরে তার বুকের ভেতরে হাতু’ড়ি পে’টা শুরু হয়েছে। খুব দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে হৃদয়টা। মনে হচ্ছে এই বুঝি বাইরে বেরিয়ে আসবে। আরিশ বুকটা চেপে ধরে। অনুশোচনা হচ্ছে তার। অহনার অজান্তে যে অন্যায়টা করে বসলো, সেটা কি আদৌ করা উচিত ছিল? দ্রুত অহনার শিয়র থেকে ওঠে যেতে চাইল আরিশ। কিন্তু অহনা তার হাত চেপে ধরল,
‘যেও না! আমাকে ছেড়ে যেও না।’
আরিশ ওঠতে পারল না। অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল,
‘আমি আছি তোমার পাশেই। একদম কোথাও যাব না।’

হঠাৎ আরিশের নজরে এলো অহনার দিনলিপিটা। খুব যত্ন করে সেটা নিজের সাথেই রাখে সবসময়। কি এমন আছে এটায়? আরিশের খুব জানতে ইচ্ছে করে‌। কোন মোহনীয় বাঁধন থেকে সে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারে না? হয়ত অহনা কখনোই সেটা পড়ার অনুমতি তাকে দেবে না। তাই অনুমতি ব্যতীত‌ই দিনলিপিটা হাতে নিল। আজ সে পড়বে। অহনার অতীতটাকে সূক্ষ্মভাবে জানবে। তারপর প্রতিটা দিনের ঘটনা সে অনুভব করবে। এতেই হয়ত অহনাকে কাছে পাওয়ার কোনো মন্ত্র পেয়ে যাবে!
______________________________________________
একবার হাতের ঘড়ির দিকে তো অন্যবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটছে অহনা। একটু পরপর দৌড়‌ও দিচ্ছে। ক্লাস টেস্ট চলছে অথচ সে এখনো পৌঁছতেই পারেনি। অনেক দেরী হয়ে গেল, প্রায় বিশ মিনিট। এমন মুহুর্তে পরিস্থিতি আরো জটিল করে দিয়ে জুতাটাও ছিঁ’ড়ে গেল। চিন্তিত হয়ে পড়ল অহনা। কি করবে এখন? কোনো উপায় না পেয়ে জুতা ঠিক করার জন্য মাজরাস্তায় কারিগরি শুরু করে দিল। কিছুতেই কোনো উপায় হলো না। এদিকে গাড়ির হর্ন বাজতেই পেছন ফিরে তাকাল‌। গাড়ি থেকে মাথা বের করে কেউ একজন বলল,’রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও।’
অহনা কর্ণপাত করল না। অনেকক্ষণ পরে কিছুই করতে না পেরে জুতাজোড়া হাতে নিয়েই দাঁড়াল। আজ খালি পায়েই যেতে হবে। কদম বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ বলল,’রাস্তাটা কি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নাকি?’

অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে পেছনে তাকাল। সুদর্শন, সুঠাম দেহের অধিকারী একজন পুরুষ। তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেই পুনরায় লোকটি বলল,’কথা কি কানে যায়নি? এভাবে রাস্তা আঁটকে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?’

অহনা আচমকা জুতোটা লোকটার মুখের সামনে ধরে বলল,’দেখুন, ছিঁ’ড়ে গেছে। তাই ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম।’

লোকটা কিছুটা দূরে সরে আসে,
‘ তাই বলে রাস্তায় বসে? কান্ডজ্ঞান নেই নাকি?’

‘ কথা বাড়াতে চাই না। যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যান। আমি আমার কাজ করি।’

ড্রাইভার এসে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’স্যার, দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
লোকটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। পরক্ষণেই অহনাকে বলল,’ম্যানার শিখে তারপর রাস্তায় বের হবে।’

রেগে গেল অহনা। তপ্ত হয়েই বলল,’আপনি ম্যানার শিখবেন। যত্তসব বড়লোকি গ্যাঞ্জাম। নিজেকে কি ভাবেন কী? রাস্তাটা আপনি কিনে নিয়েছেন? আমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসে পড়ব। দরকার হলে রাস্তা আঁটকে সারাদিন বসে থাকব। তাতে আপনার কি? হুহ!’
বলেই খালি পায়ে হেঁটে যায়। কয়েক সেকেন্ড পরেই আড়চোখে দেখল লোকটা আছে কিনা। সাথে সাথেই আবার চোখ সরিয়ে নেয়। লোকটা হতভম্ব হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। যেন অহনার হাঁটার স্টাইলটা রপ্ত করে নিচ্ছে। মনে মনে বলল,’মেয়ে মানুষ দেখলেই বাহানা দিয়ে কথা বলতে ছাড় দেয় না এই বড়লোকরা।’

কলেজ প্রাঙ্গনে গিয়েই সে আরো বিরক্ত হলো। অনেকে তাকে দেখে হাসছে। অহনার দাঁত কিড়মিড় করে ওঠল। জুতা ছিঁড়তেই পারে। তাই বলে এমন দাঁত কেলিয়ে হাসার কি আছে? মুখ ভেঙচিয়ে ক্লাসরুমে গেল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে এসেছে। ক্লাসরুমের দরজার সামনে যেতেই শিক্ষকের মুখোমুখি। শিক্ষক ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’তুমি এই ডিপার্টমেন্টের?’

অহনা ঢোক গিলে বলল,’জ্বী স্যার!’

‘দেরী করে এসেছ। পরীক্ষা দাওনি।’

‘ জুতা ছিঁড়ে গিয়েছিল।’

‘কিনে নিতে পারতে!’

অহনা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,’মনে ছিল না। আমি তাহলে কিনে আসি। ধন্যবাদ আপনাকে, মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।’

বলেই পেছন ফিরে যেতে চাইলেই শিক্ষক ডেকে বলল,’পাঁচ মিনিট পর দেখা করবে।’

অহনার উত্তরের অপেক্ষা না করেই শিক্ষক অফিসে চলে গেল। পেছন পেছন গেল অহনা। গিয়েই আরেক দফা অবাক হয়। যে ছেলেটাকে রাস্তায় কথা শুনিয়েছিল সে এখন অফিসে। অহনা কিছুটা হাসার চেষ্টা করে তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
শিক্ষকের হাজারটা ঝাড়ি খেয়ে ফিরে এলো ক্লাসে। মন খারাপ করে বসে ছিল। এমন সময় ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক ক্লাস নিতে আসে। অহনার মনোযোগ ছিল না সেদিকে। বকা খেয়ে কাতর সে। বসেই ছিল। শিক্ষকের নজর প্রথমেই তার দিকে গেল। প্রিন্সিপাল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ওনার নাম বর্ষণ চৌধুরী। ইনি আজ থেকে তোমাদের ক্লাস নেবেন। বাকিটা তোমরা পরিচয় হয়েই জেনে নেবে। আশা করি ওনার সার্ভিসে কোনো সমস্যা হবে না।’

প্রিন্সিপাল চলে যেতেই অহনা চোখ তুলে তাকাল নতুন শিক্ষকের দিকে। তার চোখ ছানাবড়া। সবাই বসা অবস্থায় থাকলেও সে আচমকা দাঁড়িয়ে যায়। বর্ষণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,’তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?’

অহনা কোনোরকমে বলল,’না স্যার! কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হবার কথাই নয়। শুধু একটু ভয় পেয়ে গেলাম।’

‘ভয় পেতে হবে না। আমি তোমাদের শিক্ষক। এখন বসে পড়ো।’

অহনা বসে যায়। তবে শিক্ষককে কথা শোনানোর মতো বাজে কাজটা করে খুব অশান্তি হচ্ছে তার। বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। অজুহাত দেখিয়ে বাইরে চলে এলো। এখানে খোলা হাওয়ায় শান্তির নিঃশ্বাস নেয়। মনে মনে কয়েকবার কথা শুনিয়ে দেয় বর্ষণ স্যারকে।
ক্যাম্পাসে গিয়েই জুনিয়র একটা মেয়ের সাথে দেখা। নাম তমা। অহনার সাথে খুব ভাব মেয়েটার। তার সাথে বসেই কিছুক্ষণ গল্প করে। গল্পের এক সময় বলল,’অজুহাত দিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়েছি। বর্ষণ নাকি ঘর্ষণ নামের একটা নতুন শিক্ষক আজ জয়েন করল‌।’

তমা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,’তাতে কি হয়েছে?’

‘ আর বলো না। ওনাকে দেখে মনে হয়েছিল আস্ত একটা রা’ক্ষস। কেমন রা’ক্ষসের মতো বড়ো বড়ো কান, ইয়া বড়ো নাক, বাঘের মতো শরীর, চোখগুলো যেন মাকড়সার ডিমের মতো। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমাকে গিলে নেবে।’

‘ আর কিছু?’

পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠল। পেছনে তাকাতেই দেখল শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছে। যার নামে এতক্ষণ বলছিল সেই বর্ষণ স্যার এখন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here