ছায়া মানব ২
২০.
পড়ন্ত বিকেলটাকে আকর্ষণীয় করতেই প্রকৃতির বুকে সূর্যের লুকোচুরি খেলা। তারই ধারাবাহিকতায় উপভোগ করছে মাহতিম। হঠাৎ করেই যেন তার মন-প্রাণ প্রশান্তি অনুভব করছে। কতগুলো পায়রা ঝাঁক বেঁধে ওড়ে গেল তার মাথার উপর দিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদূরে তাকাল। মাহতিমকে অনুসরণ করেই যে অহনা আর নূর ছাদে এসেছে তা তারা গোপন রাখার ফন্দি করল। খুব হুঁশিয়ারি ভঙ্গিতে তারা ছাদে পা রাখল। নূর অহনাকে চুপি চুপি নিচু হতে বলল। অহনা নিচু হতেই নূর তার কানে কানে বলল,’তুমি মাহতিম ভাইয়ের চোখ চেপে ধরবে। আমিতো ছোট তাই পারব না। তুমি পেছন থেকে ধরলে আমি সামনে দাঁড়াব, মজা হবে তাই না?’
অহনাকে আপত্তি জানানোর সুযোগটুকুও না দিয়ে নূর মুখে হাত চেপে ধরে রওনা দিল। মাহতিমের পেছনে যেতেই সে মৃদু হাসল। পেছনে কে আছে, সেটা জানতে তার দেরী হলো না। কারণ এই গুণটা তার মধ্যে বিদ্যমান। আর্মি ট্রেইনিংয়ের সময় সেনাপ্রধান ফাত্তাহ তাকে শিখিয়েছিল। কানকে সজাগ রাখতে এবং কারো গন্ধ অনুভব করে তার উপস্থিতি টের পাওয়া শিখিয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে বুঝে গেল অহনা এবং নূর এসেছে। তবে সে টু শব্দও করল না। সেও আপনমনে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। অনেকটা এগিয়ে আসতেই নূর অহনাকে ইঙ্গিত করে মাহতিমের চোখ ধরার জন্য। অহনা ইতস্তত করছিল তবে নূরের জোর করায় অবশেষে প্রস্তুত হলো। পেছন থেকে মাহতিমের চোখ চেপে ধরল। অহনার স্পর্শ পেতেই মাহতিম বিচলিত না হয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। কিছু দেখতে পাচ্ছেনা এমন ভঙ্গি করে অহনার হাতজোড়া চেপে ধরল। নূর মুখ চেপে হাসল। সে সামনে এসে দাঁড়াল। মাহতিম ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,’মোহনা তাই না? নাকি বড়ো ভাই? উমম্ নিহা? কে বলোতো। আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছুই।’
অহনা কোনো উত্তর করল না। তার ভীষণ মজাই লাগছে। মাহতিম আর দুষ্টুমি করল না। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’অহনা আর নূর।’
সাথে সাথে অহনা হাত সরিয়ে নেয়। নূর হাততালি দিয়ে বলল,’তুমি জিতে গেছ ভাইয়া। আমি যখন বড়ো হব তখন অহনার জায়গায় আমি তোমার চোখ ধরব। এখন ইকটু ছোট।’
‘অহনা তোমার থেকে বড়ো। তাই ওকে আপু বলে ডাকবে ঠিক আছে?’
‘লম্বায় ইকটু বড়ো। তাতে কী হয়েছে? ও তো তোমার সমান। আমি অহনা বলেই ডাকব।’
তারা রেলিং ধরে দাঁড়াল তিনজন। অহনা আর মাহতিম পাশাপাশি দাঁড়ালো। মাহতিমের অন্যপাশে নূর এক হাত ধরে আছে। নূর বলল,’ভাইয়া, বিয়ের পর তুমি আমাকে অনেক চকলেট দেবে তাই না? আমার মিলি আপু বলেছে বিয়ের পর বর সবকিছু দেয়।’
‘তুমি এখনো ছোট। ছোটরা বিয়ের কথা বলেনা। বড়ো হলে দেখবে তোমার জন্য রাজকুমার সাদা ঘোড়ায় চেপে আসবে তোমায় নিতে। শুধু চকলেট নয় আরো অনেক গিফট দেবে, দেখে নিও।’
‘তোমাকে তো রাজকুমারের মতোই লাগে। একটা সাদা ঘোড়া কিনে নাও তাহলেই হবে। আমিতো এমনিতেই খুব মিষ্টি, সাজলে আরো সুন্দর লাগে।’
অহনা হাসল নুরের কথায়। বেশ বুদ্ধি মেয়েটার। ধবধবে সাদা গায়ের রং সাথে গোলাপী রঙের পাতলা টিশার্ট এবং জিন্স পরিহিত অবস্থায় তাকে সত্যিকারের রাজকুমারী বলেই মনে হচ্ছে। শহরের পরিবেশে বড়ো হওয়ার তার ধ্যান-ধারণার এতোটা উন্নতি। অথচ গ্রামের এমন ছোট্ট মেয়ের মাথায় বিয়ে শব্দটাই এখনো অপরিচিত। কথাগুলো চিন্তা করে হাসলো অহনা। হঠাৎ করেই নূর অহনাকে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা অহনা, তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?’
কথাটা শোনার সাথে সাথেই অহনা মাহতিমের মুখের দিকে তাকাল। ছোট্ট একটা মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন অন্তত আশা করেনি। মাহতিম কিছুটা কোমল হয়ে বলল,’ছোটদের এমন বিষয়ে কথা বলা উচিত নয়। তুমি বড়োদের কথা বলছ কেন?’
‘ আমাকে তোমরা এখনো ছোট মনে করো? ক্লাস টুতে পড়ি আমি। যাই হোক, তুমি এসব বুঝবে না। বলেও লাভ হবে বলে মনে হয়না। আমাদের ক্লাস টপার রাশমিরও বয়ফ্রেন্ড আছে। শুধু আমারই নেই। আমিতো মাহতিম ভাইকে বিয়ে করব তাই বয়ফ্রেন্ড করিনি কাউকে।’
‘এই পিচ্চি, এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এতোটা? এটা কিন্তু লিমিট ক্রস হয়ে যাচ্ছে। তোমার এখন ভালোমতো পড়াশোনা করার বয়স, তুমি কিনা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কথা বলছ। আর কখনো এসব বলবে না। তুমি ছোট, ছোটর মতো থাকবে, ঠিক আছে?’
মাহতিমের সাবধানী বাণী। তবে নূর গ্রাহ্য করল না। যুগের অধঃপতন বাচ্চা মেয়েটার ওপর। অহনা আর মাহতিম দুজনই একসাথে ঠোঁট মিলিয়ে হাসল। নূরের সেটা সহ্য হলোনা।
নিহা অনেকটা সময় নিজের ঘরে কাটিয়েছে। মাহতিমের সাথে কথা হওয়ার পর থেকেই মনটা বিষণ্ণ। তবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। নেভি ব্লু জিন্সের সাথে কালো শার্ট গায়ে দিয়েছে। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। শার্টের সামনের দুইটা বোতাম খোলাই রাখল। বাইরে বের হতেই কারো নাক টানার শব্দ পেল। পাত্তা না দিয়েই সে রওনা দিল। কিন্তু বর্ষণের ঘর পাড় করার সময় মনে হলো তার ঘর থেকেই শব্দ আসছে। নিহা থমকে দাঁড়ায়। দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল বর্ষণ কাঁদছে। তবে শব্দ গভীর নয়। গলা খাঁকারি দিতেই বর্ষণ নিজেকে সামলে নেয়। চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে। নিহাকে দেখে নিয়ে বলল,’ভেতরে আসো।’
নিহা ভেতরে ঢুকেই কিছুটা অবাক। ঘরের অবস্থা ততটা গোছানো নয়। বইগুলো চারিদিকে ছেটানো। নিহা আগ বাড়িয়ে বলল,’তোমার মনের অবস্থা ঠিক নেই সেটা আন্দাজ করতে পেরেছি। কিন্তু জানা নেই কোন কারণে। আমাকে বলো, মনটা হালকা হবে। কষ্ট হলে কাউকে বন্ধু ভেবে সবটা বলতে হয় এতে সমাধান বা সান্ত্বনা পাওয়া যায়। তুমি যদি বলতে চাও তবে বলো। জোর করব না।’
বর্ষণ গলা ঠিক করে বলল,’তেমন কিছু না।’
‘ঠিক আছে, বলতে না চাইলে আর কী করব। ভালো থেকো, আমি আসি।’
নিহা যাওয়ার জন্য উদ্ধত হতেই বর্ষণ বলল,’তুমি পরিবর্তন হয়ে গেলে নাকি?’
‘কোন বিষয়ে?’
‘আসলে আগে একটু অন্যরকম দেখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে স্বাভাবিক।’
‘তা অবশ্য ঠিক। ভাবলাম, জোর করে বা পাগলামো করে কিছু পাওয়া যায় না। ভেবেছিলাম ভালোবাসি অথচ ভালোবাসার মানুষটাই ঠিক করে দিল, আমি ভুল। আমি ভালোবাসিনি। তারপর অনুভব করতে শুরু করলাম। নিজেও এখন জানি, এতদিন ভালোবাসিনি। এসব পাগলামো বা ভীমরতি বলতে পারো।’
‘যাক ভালোই হলো। তবে এই উন্নতি করলোই বা কে?’
‘মাহতিম।’
মাহতিমের কথা শুনতেই বর্ষণ মৃদু হাসল।
‘আমার ভাই হয়ে সে প্রতারণা করল।’
নিহা কিছুটা অবাকের সুরেই জিজ্ঞেস করল,’কী করেছে সে? এখন বলবে না একদম কিছু হয়নি, বন্ধু ভেবে বলো। প্রমিস করছি, আমি এতদিন যা বোকামি করেছি সেসব আর করব না। পারলে ক্ষমা করে দিও। আর জ্বালাতন করব না। এই মুহুর্তে বন্ধু মনে করে সবটা বলো।’
বর্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল,’একজনকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভাইকে বললাম, আমাকে সাহায্য করতে। কিন্তু জানতাম না তাদের মধ্যে আগেই কিছু ছিল। ও আমার ভাই হয়ে ধোঁকা দিল। ভাই যদি বলে দিত তাহলে আমি হাসিমুখে মেনে নিতাম। অথচ কাল রাতে যা দেখলাম। আমার সহ্য হয়নি।’
নিহা মাহতিমের কাঁধ স্পর্শ করে,
‘শান্ত হও। কী দেখেছ জানি না। তবে খুব বেশি আ’ঘাত পেয়েছ সেটা বুঝতে পারছি। একটা কথা কী জানো, ভালোবাসা কখনো জোর করে হয়না। হয়ত মেয়েটাও তোমাকে চায় না।’
পরপরই চোখ কপালে তুলে বলল,’মাহতিমের চরিত্র এমন বলে আমি মনে করিনা। সে একজনকে ভালোবাসে তাও তোমার পছন্দের দিকে নজর দিল কেন? তোমার পছন্দের মেয়েটি কে বলোতো?’
‘অহনা। আমাদের বাড়িতে যে থাকে।’
‘মেয়েটা ভীষণ সুন্দরী। তাই হয়ত সবার নজরে পড়ছে।’
নিহা আর কিছু বলল না। বর্ষণকে দেখল কিয়ৎক্ষণ। আগে কখনো এমনভাবে দেখেনি। আজ দেখল। মনে হলো চোখ দুটো ভালোবাসা পেতে চায়।
নিহার এমন ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকা দেখে বর্ষণ কিছুটা অবাক হলো। অসাবধানতাবশত তার চোখ পড়ল নিহার গলদেশ এবং দুরের মধ্যবর্তী স্থানে। নিহাও বিষয়টা টের পেয়ে শার্টটা টেনে নেয়। পেছন ফিরে বলল,’আসছি আমি।’
আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। দ্রুত প্রস্থান করল।
মাহতিম অনেকটা সাহস নিয়েই অহনার হাত ধরল। ভীষণ চমকে উঠল অহনা। ল’জ্জা ফুটে উঠল চোখে-মুখে। ল’জ্জায় যখন দুজনই মাখামাখি ঠিক তখনই নূরের চোখ গেল সেদিকে। রাগে ফেটে পড়ল। অহনাকে বলল,’আমি নিচে যাব। তুমি কি আমার সাথে যাবে?’
অহনা কিঞ্চিত মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ!’
মাহতিম হাতটা ছাড়ছে না। এদিকে নূর নিজেকে সংযত করতে পারল না। অহনার এক হাত টেনে ধরে,
‘এসো আমার সাথে।’
নিচে চলে গেল অহনা। লাজুক হাসল মাহতিম। সন্ধ্যা হয়ে এলো। পাখিরাও নিজ ঘরে ফিরতে ব্যস্ত। মাহতিম চলে গেল।
সবাই বৈঠকখানায় খোশগল্পে মগ্ন। একপাশে বসে ফোন টিপছে নিহা। বর্ষণ নিজের ঘর থেকে এখনো বের হয়নি। মাহিনূরের সাথে আনিফা সংসারের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করছিল। অহনা আর মোহনা এখনো নিচে আসেনি। মাহতিমও সবার সাথে এসে বসলো। নূর ঠিক তার পাশ ঘেঁষে বসলো। মাহতিম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অথচ নূর তার হাত সরিয়ে নিল।
‘তোমার সাথে রাগ করেছি।’
‘কেন? কোনো ভুল করেছি কী?’
‘অন্যায় করেছ আমার সাথে। তোমার উচিত হয়নি এমনটা করা।’
অহনা আর মোহনাও ইতিমধ্যে নেমে এসেছে। পাশাপাশি বসলো তারা। অহনার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো নূর। আনিফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কাকিয়া, অহনা কে হয় মাহতিমের? কেন সে আমাদের বাড়ি থেকে যাচ্ছে না?’
আনিফা নূরের কথায় অসন্তুষ্ট হলো,
‘এটা কেমন কথা নূর। ও আমাদের বাড়িরই একজন সদস্য। তোমার আপু হয়। এমন কথা বলছ কেন?’
‘না, ও আমাদের কেউ না। ওকে চলে যেতে বলো।’
অহনা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। উঠে যেতে চাইলেই আনিফা বলল,’ওর কথায় কিছু মনে করোনা। বাচ্চা মেয়ের কথায় তুমি রাগ করোনা।’
নূর আনিফার কথার পিঠেই বলল,’ও জানতো আমি মাহতিমকে বিয়ে করব। তাও মাহতিমের হাত ধরল কেন? ওর উচিত হয়নি এমনটা করা।’
মাহতিম তখন পানি খাচ্ছিল। নূরের কথা শুনে মুখ ফসকে পানি পড়ে তার পুরো শার্ট ভিজে গেল। অহনা ল’জ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। মেয়েটা যে সবার সামনে এটা বলে দেবে তারা আশা করেনি। দুজনেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আনিফা নূরকে চুপ থাকতে বলল,’বড়োদের সামনে কেমন কথা এসব? নিজের ঘরে যাও নূর! বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই।’
‘ আগে বলো, ও কেন মাহতিমের হাত ধরবে?’
আনিফা প্রশ্নবোধক চোখে মাহতিমের দিকে তাকাল। মাহতিম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,’ঐ আসলে… আম্মা… আমি!’
‘ থাক আর কিছু বলতে হবে না। নূর, তুমি ঘরে যাও। বড়োদের মাঝে আর একটাও কথা নয়।’
‘অহনাকে যেতে বলো। দোষ ও করেছে।’
অহনা কোনোরকমে দাঁত-মুখ খিঁচে উঠে গেল। দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে গেল। মনে হয় না আর কারো চোখের দিকে তাকাতে পারবে। মাহতিম কোনোরকম বাহানা দেওয়ার সুযোগ পেল না। যেতে নিতেই আনিফা বলল,’এখানেই বসো।’
নূর রেগে উঠে গেল। বাচ্চা মেয়েদের রাগলেও মায়া লাগে। যাই হোক, তারও খারাপ লেগেছে। নিহা ওর হাতে হাত রেখে চলে গেল।
আনিফা মুখ গুমোট করে রইল। মাহতিম দুই হাঁটু এক করে মায়ের পাশে ভেজা বেড়ালের মতো বসে। একবারও তাকাচ্ছে না। মাহিনূর আর মোহনা মা-ছেলের মাঝে থাকল না। তারাও চলে গেল। আনিফা মাহতিমের মুখোমুখি বসলো। কঠিন গলায় বলল,’মুখ ওপরে তুলো।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্প সম্পর্কে জানতে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership