ছায়া মানব ২ ৩.

0
236

ছায়া মানব ২

৩.
লোকটাকে আরো কিছু শোনাতে যাবে তার আগেই খেয়াল করল, লোকটা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অহনা সরে গিয়ে বলল,’অমন সভ্যের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

‘ সভ্য বলে। সরি দেখতে পাইনি।’

‘ চোখ দুটো নাকে নিয়ে ঘুরলে দেখবেন কি করে?’

এর‌ই মাঝে একটা ছেলে এসে বলল,’কিও মেমে… এখানে কি? লাইন মারছ নাকি?’

লোকটা বলল,’ আরে তেমন কিছু না। মেয়েটা ওল্টাপাল্টা বকছে।’

অহনা রেগে যায়। নাক ফুলিয়ে হাত উঁচিয়ে উত্তর দিল,’আমি ওল্টাপাল্টা বকছি? আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, আপনি একটা ছা’গল। যার নাম মেমে..’
ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে গেল অহনা।
দু’জন যুবক বোকা বনে গেল। অহনার কথা গায়ে না মেখে তারা নিজেদের কাজে চলে গেল।
_
সকাল আটটা বাজতেই রাবি কল করে অহনাকে। তাকে তৈরি হয়ে থাকতে বলে। কিছুক্ষণের মাথায় মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হয় সবাই। রাবি, তমা, ওসমান, ফারাহ, অহনাসহ পাঁচজন। হৈচৈ করেই তারা গন্তব্যস্থানে পৌঁছায়।
বনভোজনের জন্য কলহবিহীন এই জায়গাটা তাদের বেশ পছন্দ হয়। প্রথমেই ওসমান গিটারে টুংটাং শব্দ শুরু করে। অনেকটাই মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। ওসমানের কন্ঠস্বর অত্যন্ত মায়াবী। তার এই কন্ঠস্বরের জন্য‌ই অনেক মেয়ে তাকে মন দিয়ে বসেছে।
অহনার মন নেই গানের দিকে। গান তার ভালো লাগে না ততটা। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে বাহারী গাছ-গাছালী। একটা শাল গাছ দেখে সেটা স্পর্শ করে। অজানা এক ভালো লাগা থেকে সে সেটাতে খোদাই করে নিজের নাম লেখে।
তারা আবারো হাঁটতে শুরু করে। উঁচু-নিচু অনেকটা জায়গা অতিক্রম করে প্রায় ক্লান্ত। একটা জায়গায় বসে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু অহনার বিপত্তি দেখা দিল। সে বসে থাকবে না। ফারাহ বারকয়েক প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বলল,’আমাদের আর শক্তি নেই। তুই পারলে পুরো জঙ্গল ঘোর। আমাদের এখানেই কিছু সময় থাকতে দে। বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’

‘ ঠিক আছে, তোরা না হয় রেষ্ট নে। আমি এদিকটায় যাই।’

রাবি বাধা দেয়,’না, তুই যাবি না। কখন কোন বিপদ আসে কে জানে? একসাথে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দল থেকে বের হ‌ওয়ার কথা চিন্তাও করিস না।’

‘ উঁহু! আমি কাছেই আছি। কয়েকবার ডাকলেই শুনতে পাব। চিন্তা করিস না।’

‘ পারমিশন দিতে পারব না। মা-বাবার একমাত্র মেয়ে তুই। ভুল করেও যদি তোকে হারিয়ে ফেলি তাহলে আমাদের আর বাড়ি ফিরতে হবে না?’

‘কাছেই যাব আমি।’

অহনা কারো কথা শুনল না। ক্যামেরাটা নিয়েই পাড়ি জমালো শাল গাছের ফাঁকে ফাঁকে। ছবি তোলার এক পর্যায়ে খেয়াল করল কেউ গাছে কিছু একটা খোদাই করে লিখেছে। আগ্রহ বশত অহনা সেটার কাছে গেল। কারো নাম চোখে পড়ল। স্পষ্ট হরফে লেখা ‘মাহতিম’। শব্দটা ভীষণ ভালো লেগে যায় অহনার। নিজের নামটা আর মাহতিম নামটা কয়েকবার আওড়ে নিল।
মৃদু হেসে পেছনে ফিরে গন্তব্যের দিকে তাকাতেই সব অগোছালো মনে হলো। কিছুই মনে পড়ছে না। ঠিক কোন দিক থেকে এসেছিল ভুলে গেছে। ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। ভয় হতে থাকে প্রচন্ড। গভীর অরণ্যে নিজের জেদের কারণেই আঁটকে গেল। জেনেছিল এখানে কেউটের খুব আনাগোনা। অহনার হৃদয় কেঁপে ওঠে‌। ভীষণ সাহস করার জন্য নিজেকেই দায়ী করে। এদিক ওদিক ছুটে কয়েকবার জায়গা চেনার চেষ্টা করে কিন্তু উপায় হয় না। মাথায় হাত দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে। কোথাও কেউ নেই।

অপরদিকে তার বন্ধুমহলের‌ও চিন্তা হয়। অনেকটা সময় গড়িয়েছে, কিন্তু অহনা এখনো আসছে না। ওসমান রেগে যায়,’কারো কথা না শুনে চলে গেল। কোথায় আছে কে জানে। কি করে খুঁজব এবার?’

রাবি বলল,’আমি দক্ষিণ দিকটা একটু দেখে আসি। ওসমান পশ্চিমে যা। তমা, ফারাহ আমাদের জন্য অপেক্ষা কর।’

ফারাহ নিজেও যেতে চাইল কিন্তু ওসমান নিয়ে গেল না। তারা অহনার খোঁজে দক্ষিণ, পশ্চিমে চলে গেল। তাদের‌ও নিরাশ হতে হলো। কিছুতেই পেল না। অহনার কোনো হদিস না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো তারা। ফারাহ, তমা ওদের সাথে অহনাকে না দেখে ভয় পেয়ে যায়। একা একটা মেয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেলে তারা বাড়ি গিয়ে কি জবাব দেবে? চারজনের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।

অহনা একটা শাল গাছের নিচে বসে পড়ল। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। এই মুহুর্তে তার জ্ঞান শূন্য। কিছুতেই পথ খুঁজে পাচ্ছে না। দলের নিকট না পৌঁছাতে পারলে তারা যদি তাকে রেখেই বাড়ি চলে যায় তখন সে কী করে ফিরবে? ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে রয়েছে। চোখ ছলছল করছে। কান্না করে দেবে কিছুক্ষণের মাঝেই। এর‌ই মাঝে প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়। ভিজে জবুথবু হয়ে যায় অহনা। কপাল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানির ফোঁটা পড়তে থাকে। শীতের মৌসুমে এই বৃষ্টিপাতে ঠকঠক করে কাঁপছে অহনা। সাদা টিশার্ট ভিজে একাকার। টিশার্টের আড়ালে পরা অন্তর্বাস চিটচিটে হয়ে এসেছে। সাদার ভেতরে খুব গভীরভাবে কালো পোশাকটা দেখা যাচ্ছে।

অহনা প্রচন্ড ঠান্ডায় যখন মরিমরি, তখন‌ই কারো শিষ বাজানোর শব্দ পায়। মুখ তুলে তাকাতেই একজন মানুষকে দেখতে পায়। দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। ভেজা কন্ঠে ডাকে,’এই যে শুনছেন?’

লোকটা এদিকেই তাকাল। অহনার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসে। কাছে আসতেই বুঝতে পারে, এটা একটা ছেলে। বয়স আনুমানিক সাতাশ হবে হয়ত। দীর্ঘ, চ‌ওড়া কাঁধ, সুদর্শন ভীষণ। অহনা অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল,’আপনি?’

অহনা অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত। ছেলেটা দু’কদম সামনে আসে। প্রথমেই তার চোখ যায় অহনার পোশাকের দিকে। গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা পোশাকের ভেতরটা স্পষ্ট। পেট, পিঠের সাদা অংশ পানির ছোঁয়া পেয়ে উন্মুক্ত হয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নিল ছেলেটা। কখনো ভাবতে পারেনি কোনো মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখবে। মনে মনে কয়েকবার কথাও শুনিয়ে দেয় মেয়েটাকে। এমন পাতলা পোষাক গায়ে দেওয়ার কী মানে। সালোয়ার কামিজ পরলে কি সৌন্দর্য কমে যাবে? অন্যদিকে দৃষ্টি সংযত করেই বলল,’তুমি এখানে কেন? এই গভীর জঙ্গলে কী করছ?’

অহনা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। অহনাকে বাঁচাতেই ছেলেটা তাকে স্পর্শ করে। দু’বাহু গলিয়ে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করে। অহনার কাঁপুনি ওঠে যায়। নিজেকে ছেলেটার বাহুর রোষানল থেকে ছাড়িয়েই বলল,’আমি ঠিক আছি।’

‘ঠিক থাকলে কি এই অবস্থা হতো? তোমার সাথে কে কে এসেছিল? কোথায় যাবে তুমি? বলো, আমি পৌঁছে দেব।’

‘আমার বন্ধুদের সাথে এসেছি। ওদের খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘ সামান্যতম বুদ্ধি নেই তোমার? দল থেকে আলাদা হলে কেন?’

‘ একদম কথা শোনাবেন না আমাকে। আপনার থেকেও বেশি বুদ্ধি আমার। জঙ্গলেতো আর মানচিত্র হাতে নিয়ে ঘুরিনি তাই ভুল করেছি।’

‘যাই হয়ে যাক, মুখের কথা অন্তত ফুরাবে না তোমার। অনেকটাই বাঁচাল। এখন চলো!’

‘ আপনি আমাকে বকছেন? আমি যাব না।’

ছেলেটা পুনরায় দৃষ্টি নত করল। কিছু একটা ভেবে বলল,’এমন পোশাক পড়ো কেন যেটা বিপদের সময় আরো বিপদ বাড়ায়?’

অহনা নিজের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ল’জ্জায় পড়ে যায়। পোশাকটাকে ঠিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এর ফলে ছিপছিপে হয়ে গায়ের সাথে লেগে থাকে সেটা। ছেলেটা মুখে অদ্ভুত এক ভঙ্গিমা করে নিজের শার্ট খুলতে থাকে। অহনা আঁতকে ওঠে। কিছুটা দূরে সরে ভয়াতুর কন্ঠে বলে,’আপনি এটা কি করছেন? দেখুন, আমার কাছে আসবেন না একদম। এটা একদম ঠিক নয়।’

ছেলেটা শার্ট খুলে অহনার দিকে এগিয়ে আসে। অহনা চিৎকার করে ওঠে,’সরে দাঁড়ান আমার থেকে।’

ছেলেটা কোনো কথা না বলে অহনার গায়ে জড়িয়ে দেয় শার্টটা। পুনরায় ওর থেকে দূরে সরে যায়। অহনা অবাক হয়ে যায়। কী না কী ভেবে বসেছিল, এ তো উল্টো হলো। ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে এই মুহুর্তে। বোকা বোকা ভাব ধরে বলল,’সরি!’

‘ আমি বুঝতে পেরেছি কি ভেবেছিলে? যাই হোক, কিছু করলেও এখানে কৈফিয়ত দিতে হতো না। দোষটা তোমার নিজের। এমন পোশাক পরিধেয় অবস্থায় কোনো ছিঁচকে ছেলে তোমায় দেখলে ক্ষণিকেই তার কামনা বাড়তো। কিছু একটা করে বসতো। বাধা দেওয়ার মতো শক্তি তোমার থাকতো না। তাই এবার থেকে বের হলে বোরকা পড়ে বের হয়ো, যেন কেউ এমন বাজে অবস্থায় তোমাকে না দেখে। আমিও যে একদম সাধু, তা কিন্তু নয়। তবুও নিজেকে হেফাজত করেছি। এখন চলো আমার সাথে।’

অহনা মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো হেলদোল নেই তার। ছেলেটা রাগে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে,
‘ সমস্যা কি তোমার? কথা কানে যায় না?’

‘ বকেছেন আপনি। আপনার সাথে যাব না।’

‘ ঠিক আছে। যেতে হবেনা। আমিই চলে যাচ্ছি। বায়!’

অহনা আঁতকে ওঠে,
‘‌আরে কোথায় যাচ্ছেন? আপনি আমাকে ফেলে যেতে পারেন না।’

‘তুমি নিজেই আসতে চাইলে না।’

‘কেন যেতে চাইব। দোষ করে একবারও সরি বলেছেন? সরি বললেই আমি যাব।’

‘ কোন দোষের প্রেক্ষিতে সরি বলতে যাব? বলব না।’

‘ঠিক আছে। চলে যান, আমিই যাব না।’
বুকের সাথে দু’হাত ভাঁজ করে অহনা অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু একটা। পাতার ভেতর থেকে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। ঢোক গিলে দেখার চেষ্টা করল সেটা। মুহুর্তেই বেরিয়ে আসলো একটা কেউটে সাপ। অহনার বুক কেঁপে ওঠে। প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। কেউ নেই। ছেলেটাও চলে গেল। সাপটা এগিয়ে আসে অহনার দিকে। অহনা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here