ছায়া মানব ২
১০.
চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করতেই অহনার পুরো শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। চেনা কিছু ঘ্রাণ নাকে লাগতেই কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। মোহনা ওকে টেনে নিয়ে যায়। বৈঠকখানায় মামুন এবং আনিফা বসে আছেন। হাতে চায়ের কাপ। অহনাকে দেখেই আনিফা জিজ্ঞেস করল,’কে ও?’
মোহনা তড়িঘড়ি বলল,’আমার নিউ ফ্রেন্ড অহনা। তোমাদের সাথে পরিচয় করাতে আনলাম।’
আনিফা অহনাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,’বাহ্! খুব মিষ্টি দেখতে। ভেতরে আসো অহনা।’
পুরো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে অহনার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ভীষণ আকর্ষণীয় প্রতিটি আসবাবপত্র। অহনা যখন বিভোর হয়ে সব দেখছিল তখনই খেয়াল করল সিঁড়ি বেয়ে নামছে বর্ষণ। বর্ষণকে মোহনাদের বাড়িতে দেখে অহনার চক্ষু চড়কগাছ। সে মোহনার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা আড়াল হয়ে। বর্ষণ নিচে নামতেই আনিফা জিজ্ঞেস করল,’এই অবেলা কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ একটু বাইরে, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাব।’
বর্ষণ চলে যেতেই পুনরায় পেছন ফিরে তাকাল। অহনাকে দেখে অনেকটাই অবাক হয়। বাইরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আনিফা জিজ্ঞেস করল,’কিরে, যাবি না?’
‘না, বাড়িতে কিছু কাজ রয়েছে।’
অহনাকে দেখিয়ে বলল,’ও এখানে কেন?’
‘মোহনার বন্ধু। সে কথা ছাড়। তুই বলেছিলি আজ তোর পছন্দের মেয়েকে আমাদের সাথে পরিচয় করাবি। কই আনলিনাতো। কবে আনবি?’
‘খুব শিঘ্রই।’
মোহনা অহনাকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়। বর্ষণও বাহানা দিয়ে অহনার পিছু নেয়। মোহনা নিজের ঘরে ঢুকতেই পেছন থেকে বর্ষণ অহনার হাত টেনে ধরে। অহনা ঝাপটা দিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নেয়,
‘আপনি নিজের লিমিট ক্রস করছেন।’
‘ সরি! তোমাকে থামানোর জন্যই ধরেছি। তুমি কি কিছু ভেবেছ? জানি, ঐসময় রাগের বশে বলে ফেলেছ। এখন নিশ্চয় মত পাল্টে ফেললে। আমি কোনো খারাপ ছেলে নই। যথেষ্ট ভদ্র আমি।’
‘আপনি এই বাড়িতে থাকেন জানলে কখনোই আসতাম না। আমার পথ ছাড়ুন।’
‘আমি কি দেখতে খারাপ? কেন আমাকে তোমার পছন্দ না?’
‘ আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।’
‘ মিথ্যে বলছ। তুমিতো কাউকেই পাত্তা দাওনা শুনলাম।’
‘ শুনে থাকলে আপনি সুযোগ নিতে আসছেন কেন?’
‘ আমি সবার মতো নই।’
মোহনা অহনাকে তার সাথে না দেখে খুঁজতে বের হয়। দরজার পাশেই অহনা এবং বর্ষণকে দেখে খুঁটিয়ে দেখে বলল,’তোমরা কী করছ?’
অহনা আমতাআমতা করে বলল,’পরিচিত হচ্ছিলাম তোমার ভাইয়ের সাথে।’
‘ ওহ। ওর সাথে কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করো না। এদিকে এসো, তোমাকে অনেক কিছু দেখানোর আছে।’
বর্ষণকে পাশ কাটিয়ে অহনা মোহনার ঘরে যায়। বর্ষণ বাইরের অহনার বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে।
মাহতিম কোনো মিটিং নিয়ে কথা বলছিল। আশিশ যেতে রাজি নয়, মাহতিমকেই ম্যানেজ করে নিতে বলল। মাহতিম হ্যাঁ বলার সাথে সাথেই জয়ন্তের কল আসে। কল ধরতেই জয়ন্ত বলল,’বিশ মিনিটের মধ্যেই আসো, সবাইকে বলে দিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হবে তোমাকে। তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
মাহতিম হ্যাঁ বলে দিল। দ্রুত তৈরি হয়েও গেল। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বাইরে বের হতেই দেখল বর্ষণ বারবার মোহনার ঘরের দিকে উঁকি মারছে। মাহতিম বর্ষণের কাছে যেতেই সে কিছুটা চমকে ওঠে। চলে যেতে চাইলেই মাহতিম প্রশ্ন করে বসে,’তুমি এখানে?’
‘ কিছু না। এমনি আসলাম।’
‘ এমনি মানে! মোহনা কোথায়?’
মাহতিম মোহনার ঘরে উঁকি দিতেই অহনাকে দেখতে পেল। ভুল দেখেছে ভেবে চোখ কচলে পুনরায় দেখল। সত্যিই সে অহনাকে দেখতে পাচ্ছে। এবার বিষয়টা পরিষ্কার! বর্ষণ কেন উঁকি দিচ্ছে ঠিক বুঝে গেল। কিছুটা হিংসেও হলো। বর্ষণ মাহতিমের চোখ এড়াতে চলে যায়। এদিকে মাহতিম খুব খুশি। সেও বর্ষণকে পাহারা দিয়ে মোহনার ঘরে উঁকি মারল। হঠাৎ করেই অহনার চোখাচোখি হয়ে যায়। ভীষণ বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় অহনা। সে ঠিক দেখল নাকি ভুল দেখল বুঝে ওঠতে পারছে না। কেমন সন্দিহান হয়ে চারিদিকে চোখ বুলালো। অহনার চোখ ফাঁকি দিয়ে মাহতিম লুকিয়ে পড়ল। অহনা ভুল দেখছে ভেবে পুনরায় মোহনার সাথে গল্পে মন দেয়। মাহতিম পুনরায় অহনাকে দেখতে যায়। সাথে সাথেই তাদের চোখ যায় একে অপরের দিকে। অহনা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। বারবার মাহতিমকে দেখছে কেন সে? সে কি এখানেই আছে? অনেকটাই বিভ্রান্ত সে। মোহনাকে বলল,’তুমি বসো, আমি একটু আসছি।’
বলেই ঘর থেকে বাইরে বের হলে। চারিদিকে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। কেমন একটা পরিচিত গন্ধ নাকে আসলো। তাও বুঝতে পারল না সঠিক মানুষটি কে! অহনা যখনই পুনরায় ফিরে যাবে তখনই মাহতিম তার সমানে এসে দাঁড়ালো। অহনা চমকে ওঠে। মাহতিমকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুম মনে করে। কিছুটা পিছিয়ে যায়। মাহতিমও তার সম্মুখে আসে। পেছনের দেয়ালের সাথে অহনার পিঠ ঠেকে যায়। মাহতিম তার একদম কাছে এগিয়ে আসে। অহনার দু’পাশে দেয়ালে হাত রাখে। বিভোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অহনার ওপর। অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’এটা আপনি? আমি সত্যি দেখছি?’
মাহতিম নিশ্চুপ! কোনো কথা না বলে অহনার আরো কিছুটা সামনে যায়। তাদের মধ্যে দূরত্বটা কিঞ্চিত। অহনার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। নিজেকে সামলাতে পারছে না। পা দুটো অসাড় হয়ে এসেছে। কিছুতেই নড়ছে না। অহনার ঠোঁটজোড়া মৃদু নড়ে ওঠে। গোলাপি ঠোঁটজোড়া মাহতিমের নজরে আসতেই তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলে গেল। নিজেকে উন্মাদ মনে হলো। ইচ্ছে করছিল, কোমল ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিক কিংবা নিজের মনের সাথে মিশিয়ে নিক। সমস্ত অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে সে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়! অহনার মায়াময় মুখশ্রী তাকে দূরে যেতে দিচ্ছে না। আরো এগিয়ে যেতে বলছে বেহায়া মন। মাহতিম অহনার দিকে ঝুঁকে যেতেই ও চোখ বন্ধ করে নেয়। নিজেকে এক চুলও নড়াতে পারছে না। মাহতিমের গরম নিঃশ্বাস তার মুখে বারি খাচ্ছে। নিজেকে উদ্ভ্রান্ত লাগছে।
‘তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
মোহনার ভাবুক প্রশ্ন শুনে চোখ খুলল অহনা। কাউকেই দেখতে পেল না সে। একটু আগেই মাহতিম ছিল। এখন কোথাও মিলিয়ে গেল। অহনা দ্রুত খুঁজছে লাগল মাহতিমকে। চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখল। কোথাও মাহতিমের কোনো চিহ্ন নেই। নিজের মনকে বুঝালো, নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু স্বপ্ন কি এতটাই বাস্তব মনে হয়? মোহনা পুনরায় প্রশ্ন করল,’কি হলো?’
অহনা হকচকিয়ে উত্তর দিল,’আমাকে যেতে হবে। অপেক্ষা করছে ওরা।’
‘ তুমিতো বললে ম্যাচে থাকো তাহলে কে অপেক্ষা করছে?’
‘ আমি একা থাকি না। সিনিয়র দুজন আপুর সাথে থাকি। তাদের সাথে থাকলে অনেক কিছু মানতে হয়, তুমি এসব বুঝবে না। আমাকে যেতে হবে।’
‘ অল্প সময়েই তোমাকে খুব আপন লেগেছে। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।’
‘কিছু করার নেই, আমাকে যেতেই হবে।’
‘ ঠিক আছে যাও তবে। চিন্তা করো না। কান্না করে হলেও তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার সাথে রেখে দেব পুতুল রানী।’
অহনা হেসে ওঠল। তার হাসিতে ঠোঁট প্রশস্ত হলো আড়ালে থাকা মাহতিমের। সেও আনমনে হেসে ওঠল।
অহনা বলল,’তুমি কতটা সুন্দরী কখনো ভেবেছ? খুবই মিষ্টি। আমাকে এবার যেতে হবে মিষ্টি পরী!’
‘যাবেতো। এতো অধৈর্য কেন?’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’ঠিক আছে, চলে যাও। গিয়ে কল করো আমায়।’
অহনা যাওয়ার আগে কয়েকবার চারিদিকটা দেখল। চারিদিকটায় কেমন মাহতিমের গন্ধ ভেসে আসছে। অহনার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অহনা নিচে নেমে আনিফার থেকে বিদায় নিল। চলে যেতে উদ্ধত হতেই আনিফা বর্ষণকে ডাকল। ডাকার আগেই যেন সে হাজির।
‘ বলো আম্মা!’
‘ অহনাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দে। গাড়ি থাকতে মেয়েটা কষ্ট করে সিএনজি খুঁজবে কেন? যা, ওকে দিয়ে আয়।’
বর্ষণের খুশি দেখে কে! ভীষণ উত্তেজনা নিয়েই বলল,’অবশ্যই আম্মা! আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
অহনা আপত্তি জানিয়ে বলল,’না আন্টি, আমি যেতে পারব। ওনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’
‘ একদম না করবা না। তোমার ভাইয়ের মতোই তো বর্ষণ। ওর সাথেই যাও।’
ভাই শব্দটা শুনতেই বর্ষণের কাঁশি ওঠে গেল। মায়ের কথায় তার রাগ মাথায় ওঠে গেল। ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল।
এদিকে মাহতিম মায়ের আদেশ শুনে অনেকটাই ক্ষুব্ধ। সে চাইছিল না বর্ষণ অহনাকে নিয়ে যাক। কয়েকবার আল্লাহর কাছে বলল,’অহনা যেন কিছুতেই ভাইয়ের সাথে না যায়। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!’
কিন্তু অহনা আনিফার কথা ফেলল না। সে রাজি হলো বর্ষণের সাথে যেতে। মাহতিমের মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে মেনে নিতে পারল না। বর্ষণ এবং অহনা বের হতেই সে অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। ওদের পেছন পেছনই বের হলো। আনিফা পেছন থেকে ডাকল। অল্প কথায় বলে দিল,’কাজ আছে আম্মা!’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম