ছায়া মানব ২
৩৫.
রাত দুইটার কাছাকাছি। অহনা হাঁসফাঁস করছে। হঠাৎ বর্ষণ গাড়ি থামিয়ে দেয়। পেট্রোল শেষ হয়ে এসেছে। এতরাতে কোনো দোকানপাট খোলা নেই। অনেকটাই চিন্তিত হয়ে পড়ে তারা। বর্ষণ মামুনকে কল করে। বারবার ওয়েটিংয়ে বলছে। অনেকটা বিরক্ত হয়েই অহনাকে বলল,‘নেমে এসো।’
অহনা আতঙ্কে জর্জরিত। এই মুহুর্তে দিশেহারা সে। বর্ষণের কথার সাথে সাথেই সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। রাস্তার মৃদু আলোতে অহনার মুখশ্রী বর্ষণের চোখে পড়তেই সে মাথা নিচু করে ফেলে। বুকের ভেতর কিছুটা ব্যথা অনুভূত হলো। দ্রুতই সে গাড়িতে কিছু খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একটা চশমা। দ্রুত সেটা চোখে লাগিয়ে আশপাশটা দেখল। সে এখন অন্যের বাগদত্তা। তবুও অহনার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। অহনা তাজ্জব বনে গেল। এই বিপদের মূহুর্তে ছেলেটার ভীমরতি হলো না কী? কিছু বলল না। বর্ষণ খেয়াল করল একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বর্ষণ তড়িঘড়ি তার কাছে গেল। লোকটা অহনা এবং বর্ষণকে একসাথে দেখেও না দেখার ভান ধরে চলে যেতে চাইল। বর্ষণ তাকে থামাল। লোকটা বিরক্তি প্রকাশ করে,
‘কী হইছে ভাই?’
‘আশেপাশে কোনো গ্যারেজ আছে?’
‘সামনে গিয়ে বামে মোড় নিন। পাঁচ মিনিটের রাস্তা।’
লোকটা আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করল না। মনেই হচ্ছে, তার এতরাতে বের হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। লোকটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করল না বর্ষণ। অহনাকে বলল,
‘ভেতরে যাও। ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?’
অহনা পারে না অবশ্য। তবুও বলল,
‘পারব।’
ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল অহনা। বর্ষণ পেছন থেকে গাড়ি ঠেলে গন্তব্যে নেওয়ার চেষ্টা করল। প্রায় আট মিনিট পর থেমে যায়। গ্যারেজ কোথায় আছে জানা নেই। পাশাপাশি অনেকগুলো দোকান আবিষ্কার করল। অহনাকে নেমে আসতে বলে সেদিকে রওনা দিল। একটা দরজায় টোকা দিতেই একটি পনেরো-ষোলো বছর বয়সী ছেলে এসে দরজা খুলে দিল। ছেলেটি চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল,‘কী চাই।’
বর্ষণ কিছু বলার আগেই অহনা বলল,‘আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে।’
ছেলেটা কোনো কথা বলল না। জগু নামক কাউকে ডেকে বলল,
‘ভাই ওঠেন। কাজ পড়ছে।’
বর্ষণ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়, যে সে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। জগু লোকটা বর্ষণের থেকে বিষয়বস্তু জেনেই কাজে লেগে পড়ল। পাশাপাশি কয়েকটা কথাও বলল। বর্ষণ কথা বলায় তেমন কর্ণপাত করল না। সে বারবার কল করছে মামুনকে। অনুজকেও কল করে পায়নি। সবার ফোনকল ব্যস্ত।
প্রায় পনেরো মিনিট পর গাড়ি ঠিক করে লোকটা বলল,
‘ঠিক হয়ে গেছে। এবার আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।’
তারা দেরী করল না। দ্রুতই বেরিয়ে পড়ে।
মামুন স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করেছে। এখনো তাদের কেউ কিছু জানায়নি। জয়ন্তের কাছে খবরটা যেতেই সে বেরিয়ে পড়ল। মামুনও দেরী করেনি। জয়ন্তের সাথেই সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মামুন চিন্তিত! এদিকে বাড়ি থেকেও হাজারবার কল করা হচ্ছে। কোনো উত্তর দিতে পারছেন না তিনি। এক পর্যায়ে জয়ন্তের কাছে কল আসে। সে তৎক্ষণাৎ কলটা রিসিভ করতেই অনুজের গলা ভেসে আসে,
‘হ্যালো স্যার!’
‘আগে বলো, মাহতিমের কী হয়েছে? ও এখন কেমন আছে? কী হয়েছিল ওর?’
অনুজ বেশ খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,‘আপনাদের কে খবর দিল?’
‘সেটা জানা জরুরী নয়। কী হয়েছে সেটা বলো?’
‘আসলে হঠাৎ এক্সি’ডেন্ট বলা যায়। পাহাড়ি বাঁক নিতে ভুল করেছি। দোষটা আমারই, আমি সামলাতে পারিনি। তার পরিপ্রেক্ষিতে গাড়িটা খাদে পড়ে গেল।’
‘তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে?’
‘সবাই সুস্থ আছি। শুধু মাহতিম..!’
‘পুরো কথাটা শেষ করো। ওর কী হয়েছে?’
‘হাসপাতাল আছে। ও বলেছিল কাউকে না জানাতে, তাই জানাইনি।’
‘বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়েছে?’
‘আপাতত না। তবে অনেকটা জখম এবং মাথায় আঘাত পেয়েছে।’
জয়ন্ত কিছুটা রেগে যায়,
‘এতো অসাবধান হলেই কী করে? আমি আসছি এক্ষুনি।’
মামুন কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েই বাড়িতে কল করে। মাহতিম সুস্থ আছে জেনে অনেকটাই শান্ত হয় সবাই। বর্ষণের কল ব্যাক করে অনুজ। সবটা খুলে বলল। অহনার হৃদয়ে যেন একটু শুষ্কতার আশা মিলল। সাথে সাথে বলল,‘আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘বেশি না, এক ঘন্টা।’
অহনা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফোনটাও নিয়ে আসেনি।
বর্ষণ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। নির্জন রাস্তা হওয়ায় এক ঘণ্টার রাস্তা তারা চল্লিশ মিনিটেই অতিক্রম করে। অনুজকেও কল করে আবারো ঠিকভাবে লোকেশন নিয়ে তারা হাসপাতাল পৌঁছে যায়।
মাহতিম চঞ্চল। ফোনটা পড়ে যাওয়ায় কল করতে পারছে না। ডাক্তারও বলেছে রেষ্ট নিতে। হঠাৎ বর্ষণকে দেখে সে উঠার চেষ্টা করে। বর্ষণ তাকে বিচলিত হতে না করে। মাহতিম হেসে বলল,‘আর কেউ আসেনি?’
বর্ষণ রসিকতা করে বলল,‘আর কারো কি আসার কথা ছিল?’
‘বাবা আসেনি?’
‘আসবে সকাল হওয়ার আগেই। তবে আর একজন এসেছে।’
বলেই বর্ষণ মাহতিমকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। মাহতিম আধশোয়া অবস্থায় বসা। মুহুর্তেই তার চক্ষুদ্বয় শীতল করে দিয়ে অহনার আগমন ঘটল। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অহনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল মাহতিমকে। মাহতিম মৃদু আওয়াজ করল,
‘মেরে ফেলবে মনে হচ্ছে।’
অহনা চঞ্চল বয়ানে বলল,‘সেটাই করা উচিত।’
মাহতিমও গভীর প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে অহনাকে আগলে নেয়। হৃদয়ের মনিকোঠায় দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। অসময়ে বর্ষণের মতোই অহনার আগমণ। সে এসে মাহতিমের শ্বাস-প্রশ্বাস নতুন করে শুরু করল। তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা নিবারণ করল।
মাহতিম অহনাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও সে সরলো না। কাঁদছে ভীষণ! মাহতিম সান্ত্বনা দিতে বলল,‘আমি আছিতো। কাঁদছ কেন?’
অহনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,‘তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাই।’
‘দেখো, একদম সুস্থ আছি। তোমার ভালোবাসা এবং গুরুজনের দোয়ায় আমি বেঁচে ফিরলাম।’
‘কী করে এসব হলো? কতটা ব্যথা পেয়ে গেলে? তোমার কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না।’
অহনা হু হু করে ওঠল। মাহতিম ওর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,‘অনুজের জন্যই আজ বেঁচে ফিরলাম নতুন করে। খাদে পড়ে যাচ্ছিলাম। ও নিজের জীবন বাজি রেখে আমাকে বাঁচালো। না হয়, এতক্ষণে…. তোমার উচিত তাকে ধন্যবাদ জানানো, তার জন্যই তুমি তোমার বাচ্চার বাবাকে পেলে।’
‘ধ্যাঁত!’
অহনা পিটপিট করে তাকাল মাহতিমের দিকে। তার চক্ষুদ্বয় লাল। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে-পায়েও তাই। অহনা আলতো করে ছুঁয়ে দিল মাহতিমের সমস্ত ক্ষতস্থান।
‘একটু আগেও তোমায় ভেবে দমবন্ধকর অবস্থা হয়েছিল। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচতাম কী করে?’
মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,‘আগেই বলেছি, তুমি যোদ্ধার প্রিয়তমা! তুমি ভেঙে পড়লে, ভেঙে পড়বে প্রতিটি সাধারণ মেয়ে। তোমাকে সাহসী হতে হবে। আমি না থাকলেও তোমাকে কঠোর হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।’
অহনা রেগে যায়,
‘একদম চুপ। যোদ্ধা হও আর যাই হও, তোমাকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। তোমার কিছু হলে আমিই মরে যাব।’
‘আমরা দুজনই গত হয়ে গেলে, আমাদের বাচ্চাদের সামলাবে কে?’
‘আবারো ফাজলামো করছ। বিয়েই হয়নি, আর বাচ্চা!’
‘তুমি চাইলেই হবে। আগে বিয়েটা করে নিই।’
অহনা মাহতিমের বুকে মৃদু কিল বসালো। মাহতিম আর্তনাদ করে ওঠে,
‘খুব ব্যথা পেয়েছি।’
অহনা ভয় পেয়ে যায়। মাহতিমের বুকে হাত দেয়,
‘সরি! আমি বুঝতে পারিনি। বেশি ব্যথা পেয়েছ?’
মাহতিমের চিৎকার কিছুটা বাইরেও যায়। দ্রুত অনুজ এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ বাইরে ছিল। বর্ষণকেও মাত্র দেখতে পেল। জানে, ভেতরে অহনা আছে তবুও মাহতিমের নিনাদ কানে যেতেই এগিয়ে এলো। অহনাকে মাহতিমের এতোটা কাছে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাহতিম সাথে সাথেই অনুজকে বলল,‘প্রেম করছিলাম, তুই কি এখানেও আমাকে একা থাকতে দিবি না?’
‘সরি দোস্ত! আমি ভেবেছি ব্যথা পেয়েছিলি।’
অনুজের চোখ গেল অহনার দিকে। এক মুহুর্তের জন্য সেও থমকে যায়। বাংলাদেশী মেয়েদের সে এতটাও সুন্দরী মনে করেনা। তবে অহনা অন্যরকম। তার মধ্যে ভালোলাগাটা একটু বেশিই। মায়াবী মুখশ্রী! সবদিক থেকেই যেন তার রূপ ঝলসানো। এই প্রথম কোনো নারীমূর্তিকে তার এতোটা ভালো লেগে গেল। মুহুর্তেই নিজের আবেগ বুঝতে পেরে মাথা নিচু করল। তোলপাড় সৃষ্টি হওয়া বুকটাকে কোনোরকমে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল। তবে ঘোর কাটল না।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership