ছায়া মানব ২
৩৭.
মাহতিম অহনার চাঞ্চল্যতা টের পেল। জানালাটা বন্ধ করে দিয়েই বলল,‘এত ভয় কেন পাও? আমি থাকতেও কি তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে?’
অহনার চোখ ছলছল। উতলা মনকে বোঝাতে পারে না সে। আধো আধো কন্ঠে বলল,
‘জড়িয়ে ধরো।’
অহনার কথার সাথে সাথেই মাহতিম ওকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অহনা। মাহতিম ওর চোখের পানি মুছে দেয় আলতো করে। কিছুটা হাসানোর জন্য বলল,‘আর কয়েকদিন পরেই ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর আমার সিরিয়াল। যদি আমি বড় হতাম, তবে আগে আমারই বিয়ে হতো।’
অহনা মুখ ওপরে তুলে বলল,‘তুমি বড় ছেলে হলে আমাকে পেতে কী করে? আমিতো এই বাড়ির ছোট ছেলের প্রেমে পড়লাম। সে অনুযায়ী তুমি নিহাকে…’
কথা শেষ করতে পারল না অহনা। তার আগেই মাহতিম ওর ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল। নিজেকে সে সামলাতে পারেনি। অহনার লাল টুকটুকে ঠোঁটের দিকে নজর যেতেই সে ভাবনা হারিয়ে ফেলে। অনিচ্ছাকৃত ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে নিয়ে নেয়। অহনা খানিকটা অবাক হলেও পরবর্তীতে সায় দেয়। নিজেও মাহতিমের সাথে তাল মেলায়। দীর্ঘ চুম্বনের পর তারা সরে দাঁড়ায়। মাহতিম দ্রুত বলে ওঠল,‘সরি! তোমার অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল।’
অহনা আড়ষ্ট হয়ে বলল,‘এবার নিজের ঘরে যাও। সারাদিন আমার ঘরের কোণে থাকা কি তোমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে? লজ্জা করেনা?’
‘লজ্জা? সেটা আবার কী?’
‘দিনদিন কেমন ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছ। এখন কি লজ্জা নিয়ে ক্লাস করাব নাকি আমি?’
‘দরকার হলে তাই করবে। আমি অবুঝ! তোমার উচিত আমাকে শিখিয়ে দেওয়া। আহিরাণী! শিখিয়ে দেবে?’
‘হাতটা বাড়াও।’
মাহতিম সাথে সাথেই হাতটা বাড়িয়ে দেয়। অহনা এক মুহূর্তও দেরী না করে আর হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।
‘এটাকেই প্রাকটিক্যালি লজ্জা বলে। পেয়েছ লজ্জা?’
মাহতিম মৃদু স্বরে বলল,‘অনেক বেশিই পেয়েছি।’
‘আরও লজ্জা দেব? সামলাতে পারবে?’
মাহতিম ক্ষণকাল ভেবে তার বুকের দিকে ইশারা করে বলল,‘এখানে দাও, সামলাতে পারব।’
অহনা চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জাজনক কথায় নিজেই ল’জ্জায় পড়ে যায়। পালানোর পথ খুঁজতেই মাহতিম তাকে জাপটে ধরে,
‘দেখো, বাতাস থেমে গেছে।’
‘দেখতেই পাচ্ছি। বাতাসের আর কী দোষ! তোমার কাণ্ড দেখে নিজেরাই লজ্জায় পালিয়েছে।’
‘তার মানে কী দাঁড়াল?’
‘তুমি জানো!’
মাহতিম অহনার আঙুলের ভাঁজে আঙুল মিশিয়ে বলল,‘তুমি যখন ভয় পাও তখন প্রকৃতিও তোমাকে ভয় দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে তোমাকে দুর্বল করে দিতে চায়। ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তুমি যখন ভয় ছেড়ে লজ্জায় মিশে যাও, ভালোবাসা পেতে মরিয়া হয়ে উঠো, স্পর্শ পেয়ে বাস্তব থেকে দূরে সরে যাও তখনই প্রকৃতি হার মেনে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারাও ভালোবাসাকে সমর্থন করে। বুঝেছ?’
অহনা মুঠোবদ্ধ হাতের দিকে তাকাল,
‘হুম। তুমি পাশে থাকলে সকল সুখ চিরসত্য।’
‘রাতে বের হবে?’
অহনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,‘কোথায়?’
‘নির্জন কোনো জায়গায়। যেখানে একান্তে অনেকটা সময় কাটাতে পারব।’
‘বাড়ির লোক জানলে?’
‘কিছু হবে না। সবাই জানে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। দেখে ফেললে একটু লজ্জা পাব হয়ত, তাছাড়া কিছু হবে না। তুমি তৈরি থেকো। আমি আসব রাতে। এখন যাই!’
‘ঠিক আছে।’
মোহনা আর নিহা বৈঠকখানায় বসে ছিল। হঠাৎ করেই একটা কল আসে। ভিন্ন নাম্বার দেখেও মোহনা কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে বিহানের কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই ফোনটা কেটে দিল। সাথে সাথেই নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে দিল। এক মুহুর্তও দেরী না করে সিমটাও খুলে ছুঁড়ে ফেলল। নিহা কিছুই না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার চক্ষু চড়কগাছ। একটা কলের জন্য কেউ এমন আচরণ করে?
এমন সময় দরজায় কলিং বাজতেই মোহনা ধীর পায়ে দরজার সামনে যায়। দরজা খুলতেই চোখে পড়ে ইমন মির্জাকে। কপাল সপ্তাকাশে তুলে বলল,‘আপনি এখানে হঠাৎ? কিছু চাই?’
আনিফাও বের হয়ে এলো। মোহনার এমন কথা শুনে কিছুটা রেগে যায়,
‘মেহমানের সাথে এভাবে কথা বলে? ইমন, তুমি ভেতরে আসো।’
ইমন এক নজর মোহনার দিকে তাকিয়ে তাকে পাশ কেটে ঘরে প্রবেশ করল। মোহনা দরজা বন্ধ করে দিয়েই তার পেছন পেছন এগিয়ে এলো। ইমন কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল,‘মাহতিম স্যার আসতে বলেছেন।’
আনিফা হেসে বলল,‘স্যার বলছ কেন? তোমরা তো আমাদের আত্মীয়ই। মাহতিম জোরে গেলে দু বছরের বড় হবে তোমার, ভাই বলেই ডাকবে।’
‘ঠিক আছে। আসলে আমাকে বলা হয়েছে আপনাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান। তাই বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব দিল।’
মোহনা তাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। ইমন ঘাবড়ে যায়। দু’কদম সরে গিয়ে দাঁড়ায়। মোহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,‘আপনি আমাকে দেখে যেভাবে হজম হয়ে যাচ্ছেন, মনে হচ্ছে বিশেষ প্রকারের ভয়ঙ্কর প্রাণী আমি।’
ইমন হালকা কেশে বলল,‘আমি আসলে মানুষের থেকে একটু দূরে থাকা পছন্দ করি।’
আনিফা থাকল না বেশিক্ষণ। বলল,‘মোহনা ওকে সবটা বুঝিয়ে দে। একদম উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। আমি যাই।’
মোহনা সায় দিয়ে বলল,‘যাও।’ পরপরই ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আপনাকে আমি যতবার দেখেছি ভীতুই দেখেছি। বাবার আঁচল, সরি টাই ধরে হাঁটেন। এক কথায় পুরুষত্বহীনতায় ভুগছেন।’
ইমনের নাকের পাটা লাল হয়ে আসে। কেন জানি শব্দটা তার পছন্দের ঠেকল না। বলল,‘আপনি আমাকে অপমান করতে পারেন না। আমি এখানে কাজে এসেছি। আমার নয় আমার কাজের প্রশংসা হওয়া উচিত ছিল।’
‘আপনাকে দেখলেই রাগ হয়। সবসময় কথা এড়িয়ে যান। ঠিক আছে, এবার নিজের কাজ করুন।’
মোহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে চশমা ঠিক করল। ইমনও অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের চশমা ঠিক করে নেয়। মোহনা ভেবেছে তাকে অনুকরণ করছে। আরো কিছুটা রাগ ঝেড়ে বলল,‘আপনি আমাকে ফলো করছেন তাই না? চশমা খুলুন।’
ইমনের ব্রু জোড়া কুঁচকে আসে। সে কথা বলা ততটা পছন্দ করেনা। তাও আবার এটা মেয়ের সাথে, সম্ভব হচ্ছে না যেন। বলল,‘চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পাব না। আমি শুধু সবটা হিসেব-নিকেশ করতে এসেছি। আজকে কাজ শুরু হবে না। আশা করি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।’
‘করব না কোনোরকমের সাহায্য। আপনার বাবা আসতে পারল না? আপনাকেই কেন পাঠাল। আপনিতো নিজে নিজে এখনো চলতেই পারেন না।’
ইমন কোনো কথা বলল না। সে তার বন্ধুর কাছে শুনেছে, মেয়েদের সাথে কখনো কথায় টেকা যায় না। তাই কথা না বাড়ানোই উত্তম মনে করল। সে অন্যদিকে ফিরে কলম-খাতা নিয়ে দেখতে থাকল। মোহনা চটে গেল। বিহানের ওপরে আসা রাগ সব ইমনের ওপর গিয়ে পড়ল। বেচারা বুঝতেই পারেনি মোহনার এমন অহেতুক কথার পেছনের কারণ। মোহনা পা দ্বারা জোরেসোরে একটা শব্দ করে নাক টেনে ইমনের পাশ ঘেঁষে যেতেই টি টেবিলের কোণায় বাড়ি খায়। পড়ে যাওয়ার আগেই ইমন তাকে ধরে ফেলে। মোহনার হাতটা ইমনের বুকে গিয়ে থামল। মোহনা অপ্রস্তুত, সাথে বিব্রত! নিজ অবস্থা ধরে রেখে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে রইল ইমনের মুখের দিকে। হাতটা তার বুকের ওপর থাকায় টের পেল হৃদস্পন্দন! মোহনা দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়,
‘ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে না থেকে ছাড়ুন আমাকে।’
ইমনের হুঁশ ফেরে। কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতেই সে মোহনাকে ছেড়ে দেয়। সাথে সাথেই তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মোহনা। ইমন ঘামছে ভীষণ! কোনো মেয়ে কখনো তার এতটা কাছে আসেনি। আজ যদি আর এক মুহূর্তও মোহনার স্থায়িত্ব বেশি হতো তবে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত।
মোহনা জোরেসোরে চিৎকার করে ওঠে। আনিফা এগিয়ে আসে সাথে মাহতিমও আসে। জিজ্ঞেস করতেই মোহনা বলল,‘ঐ ছেলেটার জন্য আমি পড়ে গেলাম। ইচ্ছে করে আমাকে ফেলে দিয়েছে। ভ্যাবলা কোথাকার।’
ইমন মাথা নত করে ফেলে। এমন অবস্থা সে কল্পনাও করেনি। বিষয়টার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। পরপরই বলল,‘আমি খেয়াল করিনি।’
‘বাজে ছেলে কোথাকার। আমার লাইফেই কেন এসবের এন্ট্রি হয় কে জানে।’
আনিফা মোহনার হাত চেপে ধরে তাকে আড়ালে নিয়ে যায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,‘একবার ওর মুখের দিকে দেখ। ছেলেটা ভয় পেয়ে আছে। ওর মতো ছেলে তোকে আঘাত করেছে সেটা অন্তত আমি বিশ্বাস করব না। একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে হয়ত।’
মোহনা ভীষণ অবাক। চোখের পানি কিছুটা মুছে ভেজা কন্ঠে বলল,‘তুমি ঐ বাইরের ছেলেটার পক্ষ নিচ্ছ? তুমি আমার আম্মা? বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘চুপ কর, ও শুনলে কষ্ট পাবে। তুই ইমনের সম্পর্কে কিছু জানিস না বলেই রেগে যাচ্ছিস। ছেলেটার মনের অবস্থা শুনলে তুই নিজেকে সামলাতে পারবি না। অথচ ছেলেটা সব সামলে নিচ্ছে।’
‘আমি কিছু শুনতে চাই না। আমার বিরক্ত লাগছে সব।’
বলেই পাশে থাকা কাঁচের ফুলদানি দূরে ছুঁড়ে মারল। উন্মাদের মতো আচরণ দেখে ইমনও ঘাবড়ে যায়। যেচে এসে বলল,‘আমি ক্ষমা চাইছি। আপনি শান্ত হোন।’
মোহনা তার গলা চেপে ধরে। মাহতিম অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। হঠাৎ করে মোহনার আচরণে সবাই ভয়াতুর।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership