ছায়া মানব ২
৮.
বাড়িতে ফিরতেই মাহতিম বর্ষণকে এড়িয়ে চলে। তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। লম্বা করে শাওয়ার নিয়ে মাহতিম নিজের খাটে এসে বসল। মাথায় হাত দিয়ে একটু আগের বিষয় চিন্তা করল। অহনার সাথে সে বর্ষণকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কেন? সেটাও তার অজানা মনে হচ্ছে। ভাইয়ের প্রতি তার অহেতুক আচরণ তাকে পুনরায় ভাবিয়ে তুলল, সে ভুল করছে। মাহতিম দ্রুত শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। বর্ষণও ভাইয়ের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। তখন বাড়ি আসতেই তাকে সারাদিনের কাহিনী জিজ্ঞেস করায় মাহতিম বলেছিল,’আমাকে বিরক্ত করো না ভাই। ভালো লাগছে না তোমার সাথে কথা বলতে।’
বলেই তখন ফোঁস ফোঁস করে চলে গেল। এখন মাহতিম এসে বর্ষণের ঘরে উঁকি দিল। দেখল সে গোসল করে এসে আপনমনে হাসছে। মাহতিম অবাক হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেল। বর্ষণ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,’তুই হঠাৎ!’
মাহতিম কিছু একটা ভেবে বলল,’ভাই তুমি নিজে নিজে হাসছিলে কেন? বুঝতে পারলাম না।’
বর্ষণ ওঠে দাঁড়াল। নিজেকে অনেকটা গম্ভীর রেখেই বলল,’কই নাতো!’
‘ আমি স্পষ্ট দেখলাম। তুমি কিছু ভাবছিলে আবার আনমনে হাসছিলে। এটা কি ঐ মেয়েটার জন্য?’
বর্ষণ মুখ তুলে তাকায়। অনেকটাই জড়ানো কন্ঠে বলল,’কোন মেয়ে?’
‘ যাকে আজ সকালে এবং বিকেলে গাড়ি করে পৌঁছে দিলে? মেয়েটাকে চেনো? তোমার গার্লফ্রেন্ড?’
‘ তেমন কোনো ব্যাপার না।’
‘ তাহলে ব্যাপারটা কী?’
বর্ষণ কিছুটা নিভল, বলল,’মেয়েটাকে ভালো লাগে আমার।’
মাহতিমের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠল। কেমন এক অদ্ভুত খারাপলাগা খুঁজে পেল নিজের মাঝে। কেন এমন হচ্ছে তার সাথে? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। পরক্ষণেই বলল,’ওহ ভালোতো।’
বর্ষণ মুখ শুকনো করে বলল,’এটা ততটাও সোজা নয়। দশ্যি একটা মেয়ে। আমার ভালো লাগলেও তার মধ্যে কোনো অনুভূতি দেখিনি আমার জন্য। খামখেয়ালি স্বভাবের একদম। কাউকেই গুরুত্ব দেয়না। ওর জন্যই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কারণ শিক্ষক হয়ে থাকলে আমি কখনোই ওর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব না।’
‘কিই? একটা মেয়ের জন্য তুমি চাকরি ছাড়লে? এখন কী করবে তুমি?’
‘ আমার কাজের অভাব হবে না।’
‘ যাই হোক। যা ভালো মনে করো, তাই করবে। আসলে আমি এসেছিলাম সরি বলতে, একটু আগে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম।’
‘আমি কিছুই মনে রাখিনি। চল বাইরে যাই।’
দুজনে কথা বলতে বলতে বাইরে যায়। মাহতিমের মনমরা খুব। কিছুটা হলেও খারাপ লাগছে তার। তবুও মন থেকে ঝেড়ে নিল সব অনুভূতি। মাহতিমকে ভাবুক দেখে বর্ষণ বলে ওঠল,’আমাকে একটু সাহায্য করবি?’
‘কেমন সাহায্য?’
‘ মেয়েটার নাম অহনা। ম্যাচে থাকে শুনলাম। ওকেই বিয়ে করব। তুই একটু ম্যানেজ কর। বাবাকে বল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে।’
‘এতদিন তো বললে বিয়ে করবে না। এখন নিজে থেকেই বলছ? মেয়েটাকে কি সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে? ভালোবাসো কি?’
‘জানি না। তবে ওর থেকে সুন্দর মেয়ে আর কখনো দেখিনি। আমার ওকেই লাগবে। বিয়ে করলে ওকেই করব।’
‘ কোনোভাবে কি তাকে ভোলা যায় না?’
মাহতিমের এহেন প্রশ্নে বর্ষণ চমকে ওঠে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,’তুই কি চাস না?’
‘তেমনটা বলিনি। আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত।’
দুজনেই পুনরায় বাড়ি ফিরে গেল। মাহতিমের মনটা কু গাইছে। সে শান্ত থাকতে পারছে না। মাথা ব্যথাটাও বেড়ে গেছে। কিছুটা একটা ভেবেই সে মেসেঞ্জারে গেল। আগ্রহবশত মেসেজ রিকুয়েস্ট চ্যাক করল। সেখানে অহনা তামিয়া নামক একটা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলো। আইডিতে ঢুকেই অহনার দুষ্টুমিতে ভরা হাজারো ছবি দেখে তার মনটা শীতল হয়ে যায়। অনেকগুলো ছবি নিজের মোবাইলে সেভ করে নেয়। বলতে গেলে কয়েক হাজার। মাহতিমের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ তার মনেই ছিল না তার ভাই অহনাকে পছন্দ করে। মুহুর্তেই তার বিচলিত মনটা কয়েকবারের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবুও অহনাকে উত্তর দিল,’কিছু বলবে?’
সাথে সাথেই উত্তর এলো,’যে আমার কথাই রাখতে পারেনা সে কী করে দেশের এবং জাতির কথার মূল্য দেবে?’
মাহতিম হাসল কিছুটা, উত্তর দিল,
‘দেশ এবং জাতির জন্য মাঝে মাঝে কিছু প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গতে হয়। এতে অবশ্য পাপ হয় না। আমি অপারক ছিলাম।’
‘ আমার খারাপ লেগেছিল, সেটা কি আপনি বুঝেননি?’
‘ অনেক কিছুই বুঝি কিন্তু উপায় হয়ে ওঠে না সামলানোর। আমি দুঃখিত! কথা দিয়েও দেখা করতে পারিনি। মিটিং ছিল তাই চলে গেলাম। জানোতো, যেকোনো মুহুর্তেই ডাক আসে।’
‘ একটু জানিয়ে দিতে পারতেন, আমি বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম।’
‘তোমার কোনো নাম্বার আমার কাছে ছিল না। তবে আমরা পুনরায় দেখা করতে পারি। আমার ভাই সম্পর্কে কিছু কথাও বলতে চাই।’
‘নাম্বার চাইলেই নিতে পারতেন। যদিও আমি দিতাম না, কিন্তু আপনার খুঁজে নেওয়া উচিত ছিল। আর আপনার ভাই কে? আমি কি তাকে চিনি? কিসের কথা বলবেন?’
‘সেটা দেখা হলেই বলব। কাল আপাতত সময় নেই। কাল পরদিন দেখা করব তাহলে। তুমি অপেক্ষা করো। এবার কিন্তু আসবই।’
অহনা ঠোঁট টিপে হাসল। উত্তর দিল,’তবে তাই হবে।’
মাহতিম বুঝতেই পারেনি সময় এতোটা গড়িয়ে গিয়েছে। দশটা বেজে গেল। মোহনা এলো তাকে ডাকতে। তাকে খুব খুশি দেখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল। পরক্ষণেই মাহতিম যখন মনমরা হয়ে গেল তখন তার খটকা লাগল। মোবাইল দেখার চেষ্টা করল ঝুঁকে। তার আগেই মাহতিম ফোনটা বন্ধ করে দেয়,’কী চাই?’
মোহনা সরে গেল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’দেওয়ার মতো কিছু আছে নাকি তোমার কাছে? আম্মা খেতে ডাকছে, দ্রুত আসো।’
বলেই চলে গেল। মাহতিমও ফোন রেখে খেতে গেল। খাওয়ার মাঝখানেই বর্ষণ মাহতিমকে খোঁচা দিয়ে বলল,’কিছু বল।’
মাহতিম সেটা খেয়াল না করলেও আনিফা করল,
‘ কী হচ্ছে কী? কিসের কথা চলছে?’
‘ কিছু না আম্মা।’
আনিফা হঠাৎ করেই মামুনকে বলল,’কিছু কি ভেবেছ?’
মামুন খাওয়ায় মনোনিবেশ করেই বলল,’এখনো না। আপাতত ভাবছি না আর। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। বাকিটা তোমার ছেলের ইচ্ছে।’
বর্ষণ সাথে সাথেই বলল,’আমি রাজি।’
মাহতিম, আনিফা, মোহনা, মামুন সবাই অবাক। সবাই বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব লজ্জার কথা বলে ফেলল বোধহয় বর্ষণ। মাথা নিচু করে নিল, বলল,’না মানে, তোমরা সবসময় জোর করো, তাই ভাবলাম মেনে নিই। একদিন না একদিন বিয়েতো করতেই হবে না তাই? আবার আম্মা একা হাতে সব সামলান বলে আমারও কষ্ট হয়। তাই আম্মার কষ্ট কমাতেই বাড়িতে কাউকে আনা দরকার।’
মোহনা ফট করেই বলে ওঠল,’তো কাজের মেয়ে নিয়ে আসো! মানা কিসের? তার জন্য বিয়ে করতে হয়?’
আনিফা খুশিমনেই বর্ষণের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,
‘হঠাৎ আজ অন্য সুর? কাউকে পছন্দ হয়েছে?’
বর্ষণের কাঁশি ওঠে যায়। আনিফা পানি এগিয়ে দেন। বর্ষণ সেটা খেতে খেতেই মাহতিমের দিকে তাকাল। তাকে বারবার ইশারা দিচ্ছে কিছু বলতে। মাহতিম চুপ করে রইল। এক পর্যায়ে না খেয়েই ওঠে গেল। সবাই তাজ্জব বনে গেল। বর্ষণ উপায় না পেয়ে বলল,’আছে একজন।’
মোহনা চট করেই বলল,’এটা বলতে এতো ঢং কেন?’
মামুন কঠিন চোখে মোহনার দিকে তাকাতেই সে থেমে যায়। নিচের দিকে চোখ দিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। মামুন বলল,’একদিন মেয়েটাকে বাড়িতে আনো। তারপর কথা এগোবে।’
‘অবশ্যই বাবা।’
কথাটাতো বলে দিল কিন্তু অহনাকে কী করে সে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসবে? তা কি আদৌ সম্ভব? ভাবনায় পড়ে গেল বর্ষণ। মনে মনে চিন্তা করল, কাল যে করেই হোক অহনাকে তাদের বাড়ি আসার জন্য রাজি করাবে। তবে সবকিছু একটু তাড়াতাড়িই ভেবে ফেলছে বলে তার মনে হলো। তাড়াহুড়ো করা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু এছাড়া যে উপায় নেই।
মাহতিমের চোখে ঘুম নেই। অহনার ছবিগুলো ঝুম করে বারবার দেখছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছূতেই ভুলতে পারছে না অহনার মায়াবী মুখশ্রী। বারবার মনে পড়ছে তাকে। ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে দেখে আসুক।
_
সকাল সকাল বর্ষণ তৈরি হয়ে নিল। ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে সে বের হয়ে গেল। আজ আর নাস্তাও করল না। বিষয়টা পুরোটা খেয়াল করল মাহতিম। কিছুই না বলে সেও বের হয়ে যায়। দুজনেই নাস্তা না করায় আনিফা ক্ষেপে যায়। তবে কিছুই করার থাকে না।
অহনাকে প্রতিদিনের মতো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ষণের আরো কিছুটা সাহস হলো। গাড়িটা সোজা অহনার সামনে দাঁড় করালো। পরিকল্পনা তার, আজ যে করেই হোক, তাকে মনের কথা বলে দেবে। যা হবে শেষে হবে, এখন সে ভীষণ সাহসী, সুপুরুষ। আজ বলবেই সে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম