ফুলকৌড়ি (২৬)কপি করা নিষিদ্ধ। #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
187

#ফুলকৌড়ি
(২৬)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ঘন্টাখানেক আগের মুখরিত হলুদের অনুষ্ঠানটা হঠাৎই যেনো নীরব বিস্বাদ থমথমে পরিবেশে ছেয়ে গেলো।মন ভালো নেই কারও।দূর্বল বিষন্ন মানসিকতায় আকস্মিক ইভানের প্রস্তাব পেতেই,মনেমনে বিস্মিত হলেন তাহমিনা বেগম।তবে ভগ্নহৃদয়ের দূর্বলতায় চোখমুখের এক্সপ্রেশনে সেটা প্রকাশ করতে পারলেন-না।নীরবে চেয়ে রইলেন ইভানের সুদর্শন আশাবাদী মুখের দিকে।কি বলবেন হঠাৎই জেনো ভেবে পেলেন না।সবদিক থেকে নিভানকে উনার খুব পছন্দ ছিলো।ছেলেটার আচার ব্যবহার কথাবার্তা চালচলন,সর্বোপরি ছেলেটার দৃঢ় ব্যক্তিত্বে বরাবরই মুগ্ধ হতেন।সব মায়েরাই তো চায় নিজের কন্যার জন্য এমন উপযুক্ত ছেলে।সেখানে নিভানের গায়ের রঙটা উহ্য করে দেখেন-নি কখনো।
সেই হিসাবে একসময় তিনি মনেমনে তন্ময়ীর জন্য নিভানকে,খুব পছন্দ করতেন।এটাও চাইতেন,মেয়ের জামাই হিসাবে নিভান হোক।এরকম উপযুক্ত ছেলে সহজে মেলে না।মনের কথা একসময় গিয়ে ছেলেকে-ও জানিয়েছিলেন তিনি।সেদিন তৃনয় বিভিন্ন কারন দেখিয়ে সাফ না করে দিয়েছিলো।তন্মধ্যে তন্ময়ীকে নিজের বোনের নজরে দেখে নিভান।নিজেদের কথার মধ্যে যদি কখনো তন্ময়ীর প্রসঙ্গ আসে কথাবার্তা-ও সেরূপ বলে নিভান।সেখানে তন্ময়ীর জন্য তার-কাছে প্রস্তাব রাখা বিব্রতকর।আশা করাটাও আরও লজ্জাজনক।ভাবাটা-ও উচিত নয়।তৃনয় একথা বলার পর তিনি মনের মধ্যে গড়া ইচ্ছে,আশা, সব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।আর সেই নিভানদের বাড়িতে,তন্ময়ী ইভানের বউ হয়ে গেলে কখনোই অসুখী হবে!ভালো থাকবে-না।এটা তিনি ভাবতেই পারেন না কখনো।তবু-ও তন্ময়ীর হয়ে ইভানের প্রস্তাবটা তিনি যেনো কখনোই আশা করেননি।নিজের মেয়ের সবদিক থেকে ইভান অনেক উঁচুতে।সেখানে কি আশা রাখা,আকাশ কুসুম ভাবার মতো।আরও সেই মেয়ের আজ হলুদের অনুষ্ঠানে বিয়ে ভেঙে গেছে।সেখানে আরও আশা রাখা তো উচ্চাকাঙ্খা।উনাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির জন্য উচ্চবিলাসিতা।

‘আন্টি,কিছু বলুন?

ঝাপ্সানো চোখে কয়েকবার দুর্বলচিত্তে পলক ঝাপটালেন তিনি।আরও কিছুসময় বিচক্ষণতার সহিত ভাবলেন।ফের চোখ বুঁজে মৃদু-ভাবে মাথা উপর নিচ কয়েক-বার ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন।তবে মুখ দিয়ে কোনো টুশব্দ-ও উচ্চারণ করলেন না।চাইলেন না যেনো কথাই বলতে।সম্মতি পেতেই ইভানের বুকে এতোসময়ে জমে থাকা শক্তপোক্ত ভয়াবহ পাথরটা যেনো মূহুর্তেই সরে গেলো।মাথা নিচু করে জোরেশোরে নিঃশ্বাস ফেললো সে।সেই নিঃশ্বাস ফেলার দৃশ্যটুকু জহুরি নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন,তাহমিনা বেগমের পাশে বসা নীহারিকা বেগম। তখনো ছেলের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি।উনার ইভান,প্রস্তাব রেখেছে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য।এটা যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না উনি।উনার পাশে দাঁড়ানো স্বান্তনা রহমান, মান্যতা,মৌনতারও একই অবস্থা।অবিশ্বাস্য নজর।অথচ কৌড়ির মন গাইছে অন্য কিছু।তন্ময়ী আপু কি সেই মেয়ে,যাকে নিয়ে ইভান ভাইয়া বরাংবার তারসাথে এটাওটা বলে গেছে?না হাওয়া বউ হিসাবে দাবী করেছে।তবে কি আজ তন্ময়ী আপুর বিয়ে ভাঙার পিছনে ইভান ভাইয়া দ্বায়ী!তাই যদি হয় তবে কাজটা মোটেও ঠিক করেননি ইভান ভাইয়া।অসন্তুষ্টচিত্তে ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে, মূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিলো সে।

পাশে দাড়নো ডালিয়া বেগমও যেনো বিগতসময় ধরে নাটক দেখছিলেন,উনার মুখাবয়বে সেটা এতোসময় প্রকাশ পাচ্ছিলো।তবে ইভান বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই তিনি আশ্চর্যিত হলেন,কপাল কুঁচকে ফেললেন বিরক্তিতে।এরকম একটা কান্ড ইভানের থেকে কখনোই তিনি আশা করেন নি।ছেলেযে বাপের মতো দয়ালু স্বভাব পেয়েছে বেশ বুঝলেন।তবে কি দেখে এই ছেলে, সদ্য বিয়ে ভেঙে যাওয়া ওই মেয়েকে নিজের সঙ্গীনি করতে চাইছে বুঝে আসলোনা উনার।একে মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা।ইভানের ফর্সা রঙের পাশে কখনোই মানাবেনা।সেখানে মেয়ের বাপ তো নেই,আরও না আছে বাপের রেখে যাওয়া কোনো প্রতিপত্তি।এরকম একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে ইভান বিয়ে করবে!
জোয়ার্দার বাড়ির বউ বানাবে!জাহিদ হাসান জোয়ার্দারের ছেলের বউ!এতো রুচিহীন হয়ে গিয়েছে ছেলেটা।তাহমিনা বেগমের কাছে ইভানের রাখা প্রস্তাবে কেউ কিছু না বললেও,তিনি যেনো আর চুপ থাকতে পারলেন না।মুখ খুলবেন এমন ভাবনাটা মাথায় এনে, মুখে কিছু বলতে যেতেই হাতে টান পড়লো উনার।পাশে তাকাতেই দেখলেন,দীবা শক্তকরে হাত টেনে চেপে ধরেছে।চোখ বড়বড় করে,মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে ইশারা করছে কিছু না বলতে।তিনি তবুও মানতে চাইলেননা।কিছু বলবে বলে উদ্যোক্ত হতেই,দীবা আরও শক্তকরে হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো।

‘প্লিজ আম্মু,এখানে কোনোরূপ সিনক্রিয়েট করো-না।ওর লাইফ ওকে বুঝতে দাও।ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ঠ বড় হয়েছে।ওর ভালোমন্দ কিসে ও সেটা খুব ভালোভাবে বোঝে।তাই ও কিসে ভালো থাকবে সেটা ওকে বুঝে নিতে দাও।অন্তত ওর বেলায় নিজেদের সিদ্ধান্ত ওর উপরে না ঝাপিয়ে,ওকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দাও।তোমার মতোকরে বুঝতে যেয়ে ওর জীবনটা এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করোনা।প্লিজ আম্মু!

মেয়ের কথার দেওয়া সুক্ষ খোঁচাটা বেশ উপলব্ধি করলেন ডালিয়া বেগম।কোন কারনে মেয়েটা এমন খোঁচা দিয়ে কথা বললো,এটাও বেশ বুঝলেন।বিরক্তও হলেন বৈকি।এতো ভালো ঘরবর দেওয়ার পর-ও মেয়ে সুখে নেই।নাকি সে ইচ্ছে করে সুখে থাকতে চাইছে না এটা তিনি কি বুঝতে পারছেন না!অবশ্যই পারছেন!তবে নিজের পেটের মেয়েযে জোর গলায়-ও তো কিছু বলতে পারেন না।আর বললে-ও,আগে শুনলে-ও এখন আর শুনতে চায়না মেয়েটা।বিরক্তিতে খেঁকিয়ে উঠে তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দীবা আবার-ও হাত চেপে ধরে বললো।

‘এখানে বড়মামাও উপস্থিত আছেন,এটা মাথায় রেখো।

মেয়ে তাকে হুমকি দিচ্ছে, অসন্তুষ্ট নজরে মেয়ের পানে তাকিয়ে পিছনে ফিরলেন তিনি।বড়ভাই উনার কয়েক কদম পিছনে হুইলচেয়ার বসা।ছোটো বেলা থেকেই এই বড়ভাই নামক মানুষটাকে তিনি যেমন সমীহ করে চলেছেন,তেমন ভয় পেয়ে চলেছেন।উনার মুখেমুখে বা উনার সামনাসামনি কথা বলার,তর্ক করার স্পর্ধা করেননি এমনকি সাহস দেখেননি কখনো।মেয়ের হুমকিতে সত্যিই তিনি দমে গেলেন,আর মুখ খুললেন না।তবে মেয়ের প্রতি বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন।

সম্মতি পেতেই তাহমিনা বেগমের পাশে বসা মায়ের পানে দূর্বল একটা চাহুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইভান।মনেমনে আশা রাখলো,মা নিশ্চয় তাকে বুঝবে।আর সে বোঝালে,অবশ্যই বুঝবে।তাহমিনা বেগমের সম্মতির খবর পুরো হলুদ অনুষ্ঠানের সর্বজনের কাছে ছড়িয়ে পড়লো।অনুষ্ঠানের আমেজ,পুরোপুরি ভাবে না ফিরলেও থমথমে পরিবেশ কিছুটা কাটলো।তন্ময়ীর পাশে গিয়ে তার বান্ধবী আর কাজিনেরা বিভিন্নভাবে তাকে বোঝাতে লাগলো।নিভান-ও এতোসময়ে তৃনয়ের সাথে কথা সেরে নিয়েছে।তৃনয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো ইভান নিভান দুজনের প্রতি।সেটা শুনে মনেমনে ইভানের প্রতি আরও অসন্তুষ্টতা বাড়লো নিভানের।ইভানের থেকে কোনো অংশে সে তৃনয়কে মনে করেনা।
বন্ধু কম নিজের ভাইয়ের নজরে দেখে সে।সেই বন্ধুর এরকম একটা অসম্মানিত,অসহায় পর্যায়ে দেখা সত্যি কি মন থেকে মেনে নেওয়া যায়!এতোসময় অন্য কেউ হলে তাকে কি যে করতো নিভান।সে তো তন্ময়ীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবর শুনতেই,বরপক্ষের বিরুদ্ধে একশান নেওয়ার ব্যবস্থা করছিলো।কিন্তু দোষ তো সেই নিজের ঘাড়েই চেপে বসেছে।এখন তাকেই সুস্থ সুন্দরভাবে দু’দিকেই সমাধান করতে হবে।না-হলে অন্যায় করা হবে।অন্যায় তো তার ভাইদ্বারা এমনিতেই হয়ে গেছে।সেখানে ভান আর তৃনয় দু’জনেই তার নিজের মানুষ।কাছের প্রিয় মানুষ।আর সেই প্রিয় দু’জন মানুষের মধ্যে একজনের দোষ ঢাকতে গিয়ে আরেকজনের উপর অবিচার করতে হচ্ছে তাকে।এটাই সে মন থেকে মানতে পারছে না।তবে এই ছাড়া উপায়ও নেই যে তার।

তাহমিনা বেগমের সম্মতি জাহিদ সাহেবকে জানাতেই তিনি নিজের স্ত্রী, ভাই এমনকি বাড়ির সবাই ডেকে পরামর্শ করলেন।সেখানে উনার সম্মতিই প্রাধান্য দিলো সবাই।তবে মনেমনে নীহারিকা বেগম একটু অসন্তুষ্ট হলেন,ছেলের এহেন কান্ডে।বড় ছেলেকে না বিয়ে দিয়ে ছোটো ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত,উনার মনটাকে একটু অসন্তুষ্ট করে দিলো।তবুও সেটা তিনি বহিঃপ্রকাশ আনলেন না।ডালিয়া বেগমও একটু খুচখুচ করলেন, তবে মন খুলে নিজের মনের দ্বিমত প্রকাশ করতে পারলেন না।অতঃপর জাহিদ সাহেব তন্ময়ীর মায়ের সাথে এবং তার বাড়ির মুরুব্বিদের সাথে কথা বললেন।একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলো,বিয়ের ডেট যেদিনই সেদিনই বিয়ে হবে।আর আজ হলুদের অনুষ্ঠানও বহালই থাকবে।এই সিদ্ধান্তে সবাই সন্তুষ্ট হলেও,তন্ময়ী সন্তুষ্ট হতে পারলো না।সবার সম্মুখ দিয়ে ছুটে চলে গেলো সে ক্ষনিকের পরিচিত রাংলোবাড়ির ঘরটায়।ইভান নিস্পৃহ নজরে দেখলো,তন্ময়ীকে ছুটে যেতে।মন ছটফটিয়ে উঠলো তার।তবে অসাড় ভঙ্গিতে নিশ্চুপ দাড়িয়ে রইলো সে।কেনো জানি মন মস্তিষ্কে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।অনুতপ্ততায় হাত পা যেনো অচল অনুভব হলো তার।একটা ফাঁকা টেবিলের চেয়ারে বসে পড়লো সে।ইভানের সেই নিস্প্রভ দৃশ্যটা নিভান দূর থেকে লক্ষ্য করলো নিভান।ভাইয়ের নিস্পৃহতায় বুকের ভিতরটা তারও পুড়লো।ব্যথিত হলো। তবে মেয়েটার পরিস্থিতির কথা ভাবলেই ইভানের প্রতি ভিষণ রাগও হলো তার।ইভানের দিলে এগোলো নিভান।গিয়ে বসলো ইভানের সামনাসামনি চেয়ারে।তীক্ষ্ণ নজরে ইভানের মাথা নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বললো।

‘তুমি এরকম একটা ব্লান্ডার করবে এটা কখনোই আমি ভাবিনি ইভান!তুমি যেমনটা ছিলে না কেনো,তোমার কাছ থেকে এতোটাও হীনমন্যতা আশা করে-নি আমি। কখনো না।আমার ভাই এমনটা করবে!হাও ইজ দিস পসিবল?

নিভান এসেছে টের পেয়েও মাথা উচু করেনি ইভান।
দাদাভাই যে তার উপর ভিষন রেগে আছে,এটা বেশ অনুভব করতে পারলো সে।আজ তার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো তবে এতোসময় বাজে অবস্থা হয়ে যেতো তার।সেসব ভেবেই মুখ উচু করে সামনে তাকানোর সাহস করিনি সে।তবে নিভানের রুক্ষ গলার কথাগুলো শুনতেই অসহায় মুখ করে তাঁরদিকে চাইলো।কন্ঠে খাদ নামিয়ে বললো।

‘দাদাভাই প্লিজ।

‘এই দাদাভাই প্লিজ কিসের!এই তুই যেটা চেয়েছিস,না কখনো বলা হয়েছে।এই বল, না বলেছি আমি কখনো?
বাবা না বললেও,আমি কখনো না বলেছি?তুই মুখ ফুটে না চাইলে-ও,আমি বুঝতে পারলেই সেটা নিজ থেকে দেওয়ার ট্রায় করেছি তোকে।তবে কেনো এরকম একটা হীন কাজটা করলি ইভান?আমাকে একটাবার জানাতিস।তৃনয়ের কাছে আমার সম্মানের কথাটা একবার-ও ভাবলি না?তোর যখন তন্ময়ীকে এতোটাই পছন্দ তবে আমাকে কেনো সেটা বললিনা?কেনো এমনটা করে মেয়েটাকেসহ ওর পরিবারকে অসম্মানিত করলি?আমার ভাইয়ের প্রতি আমার অটুট বিশ্বাসটা কেনো এভাবে নষ্ট হতে দিলি?

দাদাভাই ভিষন রেগে আছে এটা তার তুইতোকারি কথায় স্পষ্ট বুঝলো ইভান। এখন যদি কথা না বলে চুপ থাকে।তবে তন্ময়ীকে পাওয়ার আশাও ক্ষীন হয়ে দাড়াবে।তাই না চাইতেও মুখ খুললো ইভান।

‘ও সামন্য একটা বিষয় নিয়ে ভুল বুঝে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছে।যার ফলস্বরূপ এরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হয়েছে।আর এই পরিস্থিতির জন্য যদি আমি দ্বায়ী হয়ে থাকি,তবে তার কিছু অংশীদ্বারও ও।আর তুমিও শুধু ওর পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে কিছুতেই ভুল বুঝতে পারো-না আমাকে। ওকে আমি বলেছিলাম,বাড়ি থেকে যদি কোনো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে আমাকে জানাতে।ও সামান্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে, নিজমনে ক্ষোভ পুষে রেখে ইচ্ছেকৃতভাবে জানায়নি আমাকে।আর সামন্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে,ও এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার থেকে দূরে সরে যেতে পারে-না।ও চাইলে-ও আমি সেটা হতে দিতে পারিনা।আর সেটা আটকাতে আমার এই পদক্ষেপটা নিতে হয়েছে।যার ফলস্বরূপ এই পরিস্থিতি।
ওকে বা ওর পরিবারকে অপমান অপদস্ত করার কোনোরূপ ইচ্ছে আমার ছিলো না।

রাগে টনটন হয়ে যাওয়া কপাল মূহুর্তেই কুঁচকে গেলো নিভানের।বললো—তোদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো?

‘না।

‘তবে?এসব কথা হওয়ার কারন ?

নিজেদের মধ্যে ঠিকঠাক হওয়া না হওয়ার সম্পর্কটা ছোটো পরিসরে বিবরণ দিল ইভান।আর সেই সম্পর্কের থেকে এই পরিস্থিতি কিকরে গড়ালো এটাও বললো।সেটা শুনে নিভান শক্তগলায় বললো।

‘তন্ময়ীর বোঝাবোঝিটা একদম ভুল নয় আর না সেই ভাবনামতো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল।বরং তোমার ওই মেয়েটার সাথে মাখামাখিটাই মাত্রাধিক ছিলো।আর যে কেউ ওসব দৃশ্য দেখলে,তন্ময়ী যেটা ভেবেছে, বুঝেছে।সেটাই বুঝবে,সেটাই ভাববে।নিশ্চয় আমার নজরও ভুল কিছু দেখেনি!আমার ব্রেইন ও ভুল কিছু ভাবেনি!

‘তুমি আমার চরিত্র নিয়ে অবিশ্বাস করতে পারো না দাদাভাই!তন্ময়ীর মতো তোমার দেখায় ভুল না থাকতে পারলেও,ভাবনায় বিস্তার ভুল ছিলো।

‘কিন্তু কার্যকলাপ তো তুমি তেমনটাই করেছো ইভান।সেখানে আমাদের নজর যেমনটা দেখবে,আগে সেরূপ ভাবনাই তো ভাববে।তাই না?

‘না তাই না!আমাদের দেখাও কিছু কিছু সময় ভাবনাতে গিয়ে ভুল হয়। ওই মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো-না দাদাভাই।আমার ক্লাসমেট ছিলো,তবে ওরসাথে আগে সেভাবে পরিচিত ছিলাম না আমি।ওর বয়ফ্রেন্ডও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো,ওরসাথে রিলেশনের পর মেয়েটাকে চিনেছি আমি।ওদের রিলেশনশিপের পরে বিভিন্ন সূত্রে আমি জেনেছি মেয়েটার একাধিক বয়ফ্রেন্ড ছিলো।এমনকি আমি নিজ চোখেও দেখেছি,শহরের বিভিন্ন নামীদামী কফিশপে রেস্টুরেন্টে মেয়েটার যাতায়াত।বন্ধুকে জানিয়েছিলাম,বিশ্বাস করে নি।ও ঢাকার বাহির থেকে পড়তে এসেছে, বিধায় শহর ঘোরাঘুরি ততোটাও হয়না ওর।বিধায় ওর নজরে মেয়েটার কার্যকলাপগুলো সেভাবে পড়েনি।যার ফলসরূপ ও আমার কথা বিশ্বাস করেনি।কিন্তু মেয়েটা দেখতে হ্যান্ডসাম আর বড়লোক বাপের ছেলে পেলেই পিছনের বয়ফ্রেন্ডটাকে,জীবনে চেনেনি দেখেনি এমনভাবেই ছুড়ে ফেলে দেয়।আমি সেই সুযোগটা নিয়ে আমার ফ্রেন্ডকে প্রুফ করতে চেয়েছিলাম মেয়েটা ভালো নয়।নেহাল ভিষন ভালো ছেলে দাদাভাই।আর ও ওরকম একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক এগোবে।মেয়েটাও দিনের পর দিন তাকে ঠকিয়ে যাবে।এটা আমি মানতে পারিনি, চাইনি কখনোই।যারজন্য মেয়েটার সাথে, তোমার আর তন্ময়ীর ভাষায় একটু মাখামাখি করতে হয়েছিলো আমাকে।এখানে দোষ আমার নেই,এটা আমি বলছিনা।তবে আমার কাছে বিষয়টা না জেনে এমন বাড়াবাড়ি তন্ময়ী করবে এটা আমি ভাবিনি।

‘বাড়াবাড়ি নয়।ওর জায়গা থেকে ও সম্পূর্ণ ঠিক।ভুলটা তুই করেছিস!সম্পর্কে না জড়ালে-ও,মেয়েটার দূর্বলতা নীরব সম্মতিতো তোরসাথে ছিলো।সেখানে অন্য একটা মেয়ের সাথে তোকে ওভাবে দেখলে তো ভুল বুঝবেই।

‘তুমিও তন্ময়ীর মতো কিছুতেই আমাকে বুঝতে চাইছো-না দাদাভাই।আচ্ছা ভাবো,এখন যদি কৌড়ি জানতে পারে।তুমি দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে।এখন বিয়ে কেনো করতে চেয়েছিলে,কৌড়ি কারন তো আর জানেনা।দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে, এটাই তার মুখ্য বিষয়।তুমি তার ভুল ভাঙানোর আগে সে যদি এটাও জানতে পারে,দীবাআপু তার স্বামী সংসার ছেড়ে এবাড়িতে পড়ে আছে শুধু তোমাকে পাওয়ার আশায়।এবার পরিস্থিতি যদি আমার মতো হয়।মনে করো কৌড়ি রাগে অভিমানে তোমাকে ছেড়ে অন্যত্র জায়গায় বিয়ের সম্মতি জানালো।তুমি কি করবে?

সবসময়ে শান্ত থাকা নিভানের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।কপাল অস্বাভাবিক কুঁচকে রাগতস্বরে বললো–‘মানেটা কি,এখানে এসব কথা আসছে কোথা থেকে?

মনেমনে ক্রুর হাসলো ইভান।যে যেই বিষয়ে ভুক্তভোগী তাকে সেই বিষয়ে বুঝিয়ে দূর্বল করতে হয়।নাহলে কি আর সে বোঝে অন্যের ব্যথা,দরদ।ইভান চটজলদি উত্তর দিলো।—তুমি আমাকে বুঝতে চাইছো না তাই আসছে।প্লিজ দাদাভাই এসব বাদে এখন তন্ময়ীকে একটু মানাও না।আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা ফেলবে না।

কথা কানে গেলেও,ভাবনা কৌড়িতে চলে গেলো নিভানের।মেয়েটা কি তার পরিস্থিতিটা না বুঝে তাকেও ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে?ভাবতেই বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হলো।হাসফাস হয়ে উঠলো নিঃশ্বাস।নজর এলোমেলো হয়ে কৌড়িকে খুঁজলো।খুঁজে পেলেও।ওই-তো তার থেকে সামন্য দূরত্বে মায়ের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।মান্যতা আর মৌনতাও দাঁড়িয়ে আছে পাশে।অপলক কিছুসময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ালো নিভান।সেটা দেখে ইভানের মুখে-ও মৃদু হাসি ফুটলো।দাদাভাই মেনে গিয়েছে মানে তন্ময়ীকেও মানাতে আর সময় লাগবে-না।বিয়েটা একবার ভালোই ভালো হয়ে যাক,তারপর সে বুঝে নেবে।

ঘরের দরজা এঁটে বসে আছে তন্ময়ী।সে কিছুতেই ইভানকে বিয়ে করবে-না।মা কি-করে তার মতামত না নিয়ে,ইভানের প্রস্তাব সসম্মানে গ্রহণ করলো!তন্ময়ীকে তার হাতে তুলে দেওয়ার সম্মতি কি করে জানালো। ওই অসভ্য ছেলেটার জন্য আজ তার জীবনে এমন পরিনতি।কতোশত মানুষের সামনে নিজের চরিত্র নিয়ে কথা উঠলো।আপমান অপদস্ত হতে হলো।আর সেই ছেলেটাকেই সারাজীবনের সঙ্গীনি হিসাবে তাকে গ্রহন করতে হবে!কিছুতেই না।ইভানের সঙ্গীনি সে কখনোই হতে চায়না।কখনোই না।দু-হাটু মুড়ে জড়োসড়ো হয়ে ফ্লোরে বসা তন্ময়ী,এবার দু-হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হু-হু করে কেঁদে দিলো।মাথায় চললো এলোমেলো সব ভাবনা।

‘তনু,দরজাটা খোল।কিচ্ছু হয়নি সোনা। ভাই সব ঠিক করে দেবে।তবু-ও উল্টো পাল্টা কিচ্ছু মনে আনার চেষ্টা করিস না পাখি।এই তনু,দরজাটা খোল’না পাখি।কথা শোন না বোন আমার।

দরজার ওপাশে দাঁড়ানো প্রিয় মানুষগুলোর ভয়ার্ত গলার কথাগুলো,ডাকগুলো সবটাই কানে এলো তন্ময়ীর।তবে একটা টুশব্দও উচ্চারণ করলো না সে।শুধু কেঁদেই চললো।নাজুক মনে হঠাৎই প্রশ্ন বাসা বাঁধল,সবাই তার ভাবনায় চিন্তিত,আতঙ্কিত!অথচ তার মা একবারও এলেন না।তাকে ডাকলেনও না!তবে কি মা বিশ্বাস করে নিয়েছেন,উনারা যেটা বলেছেন সেটাই সত্য।ভাবনা যতোই দৃঢ় হলো তন্ময়ীর কান্নার দৃঢ়তার তোড়জোড়ও ততোই বড়লো।একসময় তৃনয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো নিভান।তখনো লাগাতার তৃনয় এটা-ওটা বলে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছে।নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে থামতে বললো।ফের নিজে মৃদুশব্দে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো।

‘তন্ময়ী,দরজা খোলো।আমি কথা বলতে চাই তোমার সাথে।

নিভানের ভারিক্কি গলার স্বর পেতেই কান্না হালকা হয়ে এলো তন্ময়ীর।তবে নড়লোনা সে।উঠবেওনা আর দরজাও কিছুতেই খুলবেনা সে।নিশ্চয় ওই বেয়াদবটা নিভান ভাইয়া কে তার হয়ে সাফাই গাইতে পাঠিয়েছে।সে মরে যাবে তবুও কিছুতেই ওই বেয়াদবটাকে বিয়ে করবে-না।খুট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে মুখ তুলে সেদিকে চাইলো তন্ময়ী।নিভানকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেললো সে।নিভান, মেয়েটার এলোমেলো অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে তন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফের নরম গলায় বললো।

‘আমি কখনো মৌনতা আর মান্যতা থেকে আলাদা করে দেখিনি তোমাকে।এতো বছরের সম্পর্কে হয়তো আমার আচারনে তুমি বুঝতে পেরেছো।জানিনা আমার সম্পর্কে তোমার ধারনা নিজের ভাইয়ের মতো কি-না।

মাথা উঁচু করে তাকালো তন্ময়ী। মায়াবী টলমলে কাজলকালো চোখ দু’টো বলে দিচ্ছে সে নিজের ভাইয়ের মতো বিশ্বাস,ভরসা করে নিভান কে।সেদিকে তাকিয়ে নিভান বললো।

‘তবে আজ সেই ভাই বোনের সম্পর্কের বিশ্বাস, ভরসা ভঙ্গ করতে চলেছি কি-না আমি জানি-না।তবে আমার দ্বারা তোমার অমঙ্গল কোনো হতে পারে এটা কখনোই আমি ভাবতে পারিনা।

একটু থামলো নিভান।সত্যিই স্বার্থপরের মতো এককভাবে চেয়ে ফেলছে সে।তবুও বললো—তোমার মতো ইভানও কষ্ট পাচ্ছে তন্ময়ী।আমি জানি, ও তোমাকে অসম্মান করেছে।তবে পরিস্থিতিতে পড়ে যে করেছে এটা তুমিও জানো।ইভানকে তুমি কতোটা চেনো,জানো আমি জানিনা।তবে আমার ভাইকে আমি জানি,ও কখনো একটা মেয়েকে অকারণে অসম্মান করার মতো ছেলে নয়।আর কাওকে কথা দিয়ে তাকে ঠকানো,আমি অন্তত এই অবিশ্বাসটুকু আমার ভাইয়ের প্রতি কখনো করতে চাইনা।হয়তো চেয়েও অবিশ্বাস করতে পারবো-না।যদিও স্বার্থপরের মতো বলা হয়ে যাচ্ছে।তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে একথা-গুলো মুখ দিয়ে বের করতে পারতাম কি-না জানিনা।তবে সত্যি বলতে আমরা সবাই আমাদের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে দূর্বল স্বার্থপর।তাই,আমার ভাইয়ের জন্য তোমার কাছে তোমাকে চাইতেই হচ্ছে।

তন্ময়ীর অবাককরা দূর্বল চাহুনীর দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো নিভান।বললো–আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে তোমার,তাই না?আমি জানি তোমার দিকটা না ভেবে আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি।তবুও বলবো,ওকে ফিরিয়ে দিওনা তুমি।আমার বোন হয়ে আজীবন আমাদের সাথে থেকে যাও।

শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে নিল তন্ময়ী।সেটা দেখে ফের নিভান বললো–এবার তুমি ভেবে দেখো,তুমি কি করতে চাও।তোমার সিদ্ধান্ত যদি এরপর না হয়।তবে তুমি ভেবো-না,ইভান তোমাকে কোনোপ্রকার ডিস্টার্ব করবে না।

নিভান তপ্তশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে আবার বললো—তুমি ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।আমরা বাহিরে সবাই তোমার অপেক্ষায় আছি।

ইভান দীবাকে নিয়ে যুক্তি দেখাতেই কৌড়ির নিয়ে এলোমেলো ভাবনা মস্তিষ্কে চলতেই থাকলো নিভানের।কৌড়িকে নিয়ে নিভানের এতোদিনের কঠিন মন,এমন দূর্বল হয়ে পড়েছে।মেয়েটা তার হবেনা ভাবলেই, হৃদপিণ্ড সেকেন্ডে সেকেন্ডে ছটফটিয়ে উঠছে তার।বিচলিত হলো সে।আপতত মেয়েটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।তন্ময়ীর সাথে কথা বলে বাহিরে বের হয়ে কৌড়িকে কোথাও দেখতে পেলোনা সে।আশেপাশে খুঁজলো তবুও পেলোনা।বাধ্য হয়ে ফোন দিলো।একবার নয় কয়েকবার দিলো।পরপর কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ হলো ওপাশ থেকে।ফোন রিসিভ হতেই এপাশ থেকে বিচলিত গলায় নিভান বললো।

‘এতোবার ফোন দিচ্ছি,ধরছো না কেনো?কোথায় তুমি? আমার তোমার সাথে কথা আছে,প্লিজ দুমিনিট হলেও আমার সাথে কথা বলে যাও,কৌড়ি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here