#ফুলকৌড়ি
(১৯)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
শরতের কালবৈশাখীর ন্যায় বৈরী-হাওয়াটা প্রকৃতিতে আর তান্ডব চালালো কোথায়!তার থেকে দ্বিগুণ বৈরী হাওয়া শুরু হলো নিভানের মনে।বাহিরের ঝড়ো হওয়ার থেকেও দ্বিগুন তন্ডব লীলা চলতে থাকালো বুকের ভিতরের যন্ত্রণটায়।ছটফটিয়ে উঠলো মন।মা এসব বলছেটা কি?বাহিরের এই বৈরী ঘোর আমাবস্যার ন্যায় অন্ধকারচ্ছন্ন অবস্থা,ঝুম বৃষ্টি!তারমধ্যে মেয়েটা এখনো বাড়িতে ফেরে-নি।আর সেই কথাটা মা এখন তাকে বলছে!আশ্চর্য!ওপাশ থেকে অনবরত অপরাধী গলায় এটাওটা বলতেই থাকলেন নীহারিকা বেগম।সেসব যেনো কানের ভিতরে গেলেও,মন স্পর্শ করলোনা।ফোন কেটে দিলো নিভান।সেকেন্ড দেরী করলোনা।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষ থেকে বের হলো সে।আশেপাশে কোথায় কে আছে,খেয়াল করলো-না।বড়বড় পা ফেলে কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে ব্যতিব্যস্ত পায়ে সামনে এগোলো।পথিমধ্যে দেখা হলো মৃদুলের সাথে।মিটিং রুমে ক্লায়েন্টের বসিয়ে সে আসছিলো নিভানের সাথে দেখা করতে।আজ একটা বিশেষ কনফারেন্স আছে।বড়ো একটা ডিল-ও সাবমিট করতে হবে।সেসব সব তদারকি করে,স্যারকে জানাতে আসছিলো।পথিমধ্যে নিভানকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বের হতে দেখে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লো।নিভানের গম্ভীর মুখাবয়বের প্রকাশভঙ্গি অদ্ভুত ঠেকলেও,দু’জনে সামনাসামনি হতেই মৃদুল বললো।
‘স্যার,কনফারেন্স রুমে আপতত সব কমপ্লিট।ক্লায়েন্টরা-ও এসে গেছে। আপনি গেলেই কনফারেন্স শুরু হবে।
তবুও থামলো না নিভান।আজ ডিলটা বিদেশি ব্যবসায়ীদের সাথে।নিজেদের কোম্পানির বিভিন্নরকম প্রডাক্ট শেয়ারে নিয়ে বিদেশিরা তাদের নিজেদের দেশে ব্যবসা করতে চান।জে এইস জে এর বিভিন্ন প্রডাক্ট, দেশে ছাড়া-ও বাহিরের দেশে নামডাক রয়েছে,চলে-ও প্রচুর।যার কারন ভিত্তিক বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত আছে তারা।আজ সেরকমই আর-ও একটা বিদেশি ব্যবসায়ীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা।ডিলটা ইম্পর্ট্যান্ট।এই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে-ও,উনারা হাজির।তবে সেসব এখন আর তার মাথায় ঘুরছেনা।কৌড়ির থেকে সেই ইম্পর্ট্যান্ট ডিলটাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে পারছেনা।মুলত দিতে চাইছেনা না নিভান।তাতে যা হয় হোক।সামনে এগোতে এগোতে সে বললো।
‘আজ ছোটো চাচ্চুকে সামলিয়ে নিতে বলুন।না পারলে আপনি সামলিয়ে নিন।
বিস্মিত হলো কথাকাজে অনড় থাকা স্যারের অদ্ভুত কথাগুলো শুনে।এমন তো কখনোই হয়নি।আজ হঠাৎ কি হলো স্যারের?ভাবনার সাথে সাথে নিভানের পিছু নিলো সে।বললো।
‘আজকের কনফারেন্সটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ,সেটাতো আপনি জানেনই।আর সেখানে আপনার ভুমিকা-ও যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন।থাকাটা খুবই জরুরি।এটা-ও তো আপনার জানা।আপনি ছাড়া যে ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যেতে পারে।সেটাও তো আপনি জানেন!
‘তবে ক্যান্সেল করে দিন।এই ডিলটার থেকে-ও,সে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
নিভানের মুখের কথাগুলো আশ্চর্যের থেকেও আশ্চর্য লাগলো মৃদুলের কাছে।ডিলের থেকে-ও সে ইম্পর্ট্যান্ট।মানেটা কি?কে সে?থমকালো মৃদুল।তবে স্যারের মুখের উপরে জিজ্ঞেস তো করা সাঝে না।তাই বললো।
‘স্যার, এ্যানি প্রবলেম?
‘নো।
এই পর্যায়ে এসে আর কথা বাড়ানো উচিত নয়।নিজের সীমা জানে মৃদুল।তবুও মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।তার দেখা এতোদিনের মানুষটার সাথে আজকের মানুষটার এতো অমিল!মন মানলো না।কৌতুহলী করে তুললো তাকে।নিভানের পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললো।
‘বাহিরের এই খারাপ পরিস্থিতি।এই পরিস্থিতিতে বাহিরে বের হওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না,স্যার।যতোই ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় হোক না কেনো,আপনার এখন বের হওয়াটা উচিত হবেন….
লিফটের দোরগোড়ায় এসে থামলো নিভান।মৃদুলের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চাইল।এই ছেলে যদি জানতো,তার ভিতরের পরিস্থিতিটা সম্পর্কে।কৌড়ি কোথায় আছে,কিভাবে আছে?সর্বোপরি ঠিক আছে কিনা!এসব ভেবে তার ভিতরে কি অবস্থা হচ্ছে!তবে হয়তো এগুলো বলার সাহস দেখাতো না।এমনিতেই মৃদুলকে এতো কথা বলতে দেখে,নিজেই বিরক্ত হলো।এতো কথা তো বলেনা ছেলেটা।নিজের সীমার মধ্যে থেকে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলে।তবে আজ এতো কথা বলছে কেনো!বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলোনা নিভান।শুধু গম্ভীর গলায় বললো।
‘আমাকে নিয়ে আপতত না ভাবলে-ও চলবে।পারলে
আপনি ওদিকটা দেখুন,কিভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করা যায়,সেদিকে গুরুত্ব দিন।তবে আমার না থাকাটা যদি ডিলটা ক্যান্সেল হয়, সমস্যা নেই।
‘পাগল হলেন আপনি।
মৃদু শব্দে আওড়ানো কথাটাও নিভানের কান এড়ালো না।তবে সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে লিফটে ঢুকে গ্রান্ডফ্লোর বাটুন প্রেস করে চোখ বুঁজে নিলো।সঙ্গে সঙ্গে কৌড়ির মায়াময় সুন্দর মুখখানা ভেসে উঠলো বদ্ধ নজরে।তখন মৃদলের কথার প্রতিত্তোর সরূপ মৃদুস্বরে আওড়ালো।
‘পাগল হতে আর বাকি রেখেছে কোথায়,ওই মেয়েটা!পাগল তো বানিয়েছে সাথে স্বস্তির যে নিঃশ্বাসটা তার চলছিলো সেটা-ও যেনো মৃতু্প্রায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
ভারী শ্বাস ফেললো নিভান।চোখ খুলে ফের বুঁজে ফেললো।মন অতিমাত্রায় ছটফট করছে তার।মনেহচ্ছে চোখের পলকে,মেয়েটার সামনে হাজির হতে পারলে মন শান্তি পেতো।তাকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেলে,সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতো।নিজের নজর,মন,মস্তিষ্ক, পরাণ সব সুখ সুখ অনুভূত হতো।মনেমনে আবারও বিড়বিড়িয়ে বললো।
‘প্লিজ কৌড়ি,আমি তোমার কাছে আসা পর্যন্ত নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে যেভাবেই হোক আগলিয়ে রেখো।প্লিজ প্লিজ কৌড়ি।
ফের ঘনোঘনো শ্বাস ফেলে মনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানালো–ও প্রভু,সবদিক দিয়ে ঠিক রেখো ও-কে।
★
বাহিরের বৈরী হাওয়াটা কিছুটা কম হলে-ও,ঝুম বৃষ্টিতে চারপাশটা কুয়াশাচ্ছন্নের মতো ঢেকে আছে।শুনশান রাস্তা।বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।অনেক সময় পরপর দুই একটা করে সিএনজি আসছে যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো যানবাহনের চিহ্নটুকো নেই।যদি-ও এই রাস্তায় ছোটো-খাটো যানবাহন ছাড়া, বড়োসড় কোনো যানবাহন চলেনা।রাস্তার ধারের বিভিন্ন দোকানপাটগুলো হয়তো বৈরী এই আবহাওয়ার কারনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অসময়ে বন্ধ দোকানের কপাটগুলো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছোটো খাটো শপিংমলগুলোও নিস্তব্ধ।মানুষের আনাগোনো নেই বললেই চলে।অথচ এই সময়টাতে প্রচুর লোকজনদের ভিড় থাকে সেখানে। পিচঢালা রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ যতোদূর নজর যাচ্ছে,শুনশান রাস্তা আর ঝুম বৃষ্টির বড়োবড়ো ফোঁটাগুলা ছাড়া সেভাবে কিছুই নজরে পড়ছে না।তবে মেয়েটা গেলো কোথায়?
কৌড়ির কলেজের সামনে এসে গাড়িটা থামিয়েছে প্রায় পনেরো মিনিটের মতো হবে।এখন বাজতে চলেছে প্রায় তিনটে।দুপুরে তিনটে হলেও,রাত তিনটের মতো দেখাচ্ছে চারপাশটা।ভয়ে ধ্বকধ্বক করে উঠলো বুকের ভিতরটা।মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো বিভিন্ন আজেবাজে চিম্তায়।ইতিমধ্যে,কৌড়ির কলেজে খোঁজ নিয়ে জেনেছে নিভান।সেখানে আপাতত কোনো স্টুডেন্ট অবশিষ্ট নেই।আবহাওয়া খারাপের দিকে যাওয়ার মতিগতি দেখতেই স্কুল এন্ড কলেজের সব স্টুডেন্টের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।বৈরী হাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে দারোয়ান দুজন-ও আজ গেটের পাহারাদারে নেই।কি করবে নিভান এখন?কোথায় খুঁজবে মেয়েটাকে!কি পরিস্থিতিতে আর কোথায় আছে মেয়েটা!উফ, নিঃশ্বাস নিতেই যেনো অসহ্য লাগছে তার!অনর্গল বইতে থাকা ঝুপঝাপ বৃষ্টির মধ্যে-ও আকাশের দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে ওই সাত আসমানের উপরে বসাবসরত মালিকের কাছে হাজারও সাহায্য প্রার্থনা করলো।
‘ও মাবুদ, তাকে একবার শুধু পাইয়ে দাও।শুধু একবার।
শুনশান রাস্তার একপাশে গাড়িটা রেখে আশেপাশে দৃষ্টি বোলাতে ব্যস্ত নজর।বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা! সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো-না নিভান।তার শুধু একটাই ভাবনা,খেয়াল।কৌড়িকে সুস্থ সমেত পাওয়া।আর নিজের রয়েসয়ে ধীমেধীমে চলা নিঃশ্বাসটাকে একটু স্বস্তি দেওয়া,শান্তি দেওয়া।বৃষ্টির এই উগ্র তোপের মধ্যে-ও ব্যস্ত পায়ে প্রায় আশপাশের বিভিন্ন গলিপথ, দোকাপাটের আনাচকানাচ,বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিলো নিভান।তবে নিরাস হতে হলো তাকে।খুজতে খুঁজতে প্রায় মেইন সড়ক ছাড়িয়ে,কৌড়িদের কলেজের রাস্তার পিছনের সড়কে চলে এলো।যদি-ও এদিকের রাস্তায় আসার সম্ভবনা নেই মেয়েটার।কেননা এটা তাদের বাড়ির রাস্তাতো নয়,বরং আবাসিক লোকালয়ও নয়।দূর পাল্লার রাস্তা।যেখানের রাস্তার দু’পাশে শুধুই সারিবদ্ধ গাছ।কিছুদূর পরপর ঝোপঝাড় আছে।আর বিশাল চওড়া কালো পিচঢালা রাস্তাটায় ক্ষনে ক্ষনে ছয়চাকা আটচাকার বড়োবড়ো যানবাহনগুলো চোখের পলকে শোঁ-শোঁ করে ছুটে চলেছে।বৈরী অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে,আজ সেসব যানবাহনের চলাচলও কম দেখাচ্ছে।শুধু নজর-ভর দেখাচ্ছে পিচঢালা ফাঁকা রাস্তা আর কুয়াশাচ্ছন্ন টুপটুপ বৃষ্টি।আশপাশে খেয়ালি নজর দিলো নিভান।কিছুই পড়লো না নজরে।তবে মেয়েটা কোথায়?কোথায় আর কি অবস্থায় আছে সে।ছটফটানি চঞ্চলা মন এবার উতলা,উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো।সবসময়ের শান্ত নজরোজড়ো হয়ে উঠলো বিচলিত।ফাঁকা রাস্তায় দিশাহীন হয়ে বেশ কিছুসময় এদিকওদিক খুঁজলো,দেখলো, তবে দূর্ভাগ্যবশত কিছুই নজরে পড়ল না।আবেগি মন মনেমনে গেয় উঠলো,যদি আচমকা একটা ম্যাজিক হয়ে যেতো আর মূহুর্তেই কৌড়িকে সে পেয়ে যেতো।কতো সুখকর হতো তারজন্য বিষয়টা।সেটা শুধু সেই অনুভব করতে পারছে।
আশাহত নিভান,কলেজের পিছনের রাস্তাটা পার করে পুনরায় কলেজে মেইন সড়কে আসার জন্য উদ্বেগী হতেই,হঠাৎই পা থামকালো নিভানের।সিনেমাটিকভাবে থেমেথেমে কোনোমতে চলা হৃদস্পন্দনটা দ্বিগুনহারে বেড়ে গেলো তার।যেমনটা কৌড়ি আশে-পাশে থাকলে হয়।তাঁকে দেখলে অনুভব করে মন।ক্লান্ত হৃদয় তাকে দেখলে প্রশান্ত হয়।খারাপ মন,তাকে অনুভব করলে ম্যাজিকের মতো মন খারাপের মেঘগুলো কেটে যায়।
তবে কি মেয়েটা আশেপাশে কোথায় আছে?তড়িৎ গতিতে আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর ফেললো নিভান,নজরে কিছুই না পড়লেও মূহুর্তেই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলো সে।কৌড়ির গলার স্বর।ওই মেয়েটা আর তারমধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।যেটুকু নিজের মন থেকে তৈরী হয়েছে সেই সম্পর্কের দূরত্বও অনেক!একই বাড়িতে থেকেও মাইল কি মালই সেই দূরত্বের গভীরতা!তবে ওই মেয়েটাকে অজানা কারনে নিভানের খুবচেনা।মেয়েটার নিজের মধ্যে থাকা চুপিচুপি চাওয়া পাওয়াগুলো চেনা।তাকে দেখে মেয়েটার লুকোচুরি খেলা দূরের স্পর্শগুলো চেনা।মেয়েটার নিঃশব্দে পায়ের চলাচল গুলো চেনা।মেয়েটার নীরবে হোক বা ফুপিয়ে কান্নার শব্দগুলোও তার চেনা।হঠাৎ কি কারনে,দূরে থেকেও মেয়েটা নিজের এতো কাছের চেনা মানুষ হয়ে উঠলো কিকরে?নিভানের জানা নেই।হয়তো নিজেই চেয়েছিলো,মেয়েটাকে চিনতে জানতে।সেকারনেই।তবে
এতো সময় তো আশেপাশে ছিলো সে,কৈ কোনো কান্নার শব্দ তো সে পায় নি।তবে কি কৌড়ি তাঁকে দেখেছে, আর দেখেই পাগল মেয়েটা কান্না শুরু করে দিয়েছে।
ক্ষীন হাসলো নিভান।দুহাটুতে দুহাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে এতোসময়ের বাধোবাধো হয়ে চলা নিঃশ্বাসটা স্বস্তিতে ত্যাগ করলো নিভান।পাথর ভর করে থাকা বুকের ভিতরটা হালকা হতে থাকলো।নিজের জানপাখিটা বুঝি জানের জায়গায় ধীরেধীরে অবস্থান করতে থাকলো।মাথার চুল বেয়ে চুইয়েচুইয়ে পড়তে থাকলো বৃষ্টির ঝমঝমে পানিগুলো,এমনকি সমস্ত শরীর বৃষ্টির পানিতে একাকার।ফুপিয়ে কান্নার রেশটা বেড়েছে।ওই অবস্থায় কিছুটা জোর গলায় কৌড়িকে ডাক দিলো নিভান।
‘কৌড়ি।
রাস্তার পাশের একটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা দোকানের আড়ালে হাঁটু মুড়ে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।এতোসময় নীরবে কাদলেও,এই ফাঁকা রাস্তায় পানির ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ কাওকে হাঁটতে দেখে পিছে ভয়ার্ত নজরে পিছে ফিরেছিলো সে। ক্ষনিকের জন্য মনে হয়েছিলো, ওই বুঝি সেই হায়েনারা আবার পিছু নিলো তার।খাবলেখুবলে খেতে এলো তাকে।কিন্তু না, পরিচিত মুখটাকে দেখে,ভরসা পেয়ে জোরেসোরে কেঁদে ফেলল সে।ফের নিভানের নরম কন্ঠের ডাকটা কর্ণগোচর হতেই আর-ও জোরে কেঁদে দিলো।সেই কান্না অনুসরণ করে পা বাড়ালো নিভান।বড়বড় কদম ফেলে ভিজে জুবুথুবু হয়ে হাটুমুড়ে বসে থাকা কৌড়ির সামনে গিয়ে নিজেও হাঁটু মুড়ে বসলো।বার কয়েকে জোরেজোরে ঘনোঘনো শ্বাস ছেড়ে,এলোমেলো হাসলো।কৌড়িকে এই অবস্থায় এখানে বসে থাকতে দেখে চতুর দৃষ্টি বুঝে নিলো অনেককিছু।তবে মেয়েটাকে পেয়েছে,এটাই শান্তি দিলো তাকে।শ্বাস ফেলে কোমল কন্ঠে সামনে বসা মেয়েটাকে শুধালো।
‘খুব ভয় পেয়েছো তাই-না?
ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেও যেনো কৌড়ির ডগরডগর চোখের টলমলে নোনাজলগুলো দৃশ্যমান।সেদিকে শান্ত আর অটল নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।এভাবে কেউ কাঁদে!তাহলে কি নিজেকে স্থির রাখা যায়! আর না ওই ক্রন্দরত মায়ময় চোখজোড়া দিয়ে ওভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজেকে সামলিয়ে রাখা যায়!বর্ষায় ভিজে জুবুথুবু ওই ছোট্টো দেহটা যে খুব করে নিজের দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে শক্তকরে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।সাথে ওই কেঁদেকেটে লাল বানিয়ে ফেলা মুখশ্রীর আনাচে-কানাচেতে ভালোবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছে।প্রবৃত্তি-গুলো মনে জাগতেই অদৃশ্যভঙ্গিতে মাথা ঝাড়া দিলো নিভান।নিজের আবেগ কন্ট্রোল করলো।অপেক্ষা করলো কৌড়ির উত্তরের।প্রশ্নবিদ্ধ হতেই আজ যেনো কৌড়ি কোনো দ্বিধা সংকোচ করলো না,তবে কান্নার তোপে কথাও বলতে পারলো-না।শুধু মাথা ঘনো-ঘনো উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জনালো।তার মাথা নাড়ানোর ঘনত্ব দেখে,নিভান বুঝে নিলো।একটু নয় মেয়েটা অনেকটাই ভয় পেয়েছে।কৌড়ির উত্তর পেতেই মোলায়েম কন্ঠে
‘আমি এসে গেছি-তো তোমার কাছে।আর ভয় কিসের!উঠে এসো।চলো।
নিঃসংকোচে কৌড়ির বরফঠান্ডা হাতটা ধরলো নিভান।কেঁপে উঠলো কৌড়ি,সেটাও অনুভব করলো।কতক্ষণ ধরে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা ভিজে চলেছে কে জানে!হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বাঁধা পেলো নিভান।মেয়েটা কঠিন পাথরের মতো অটল বসে আছে।মনের মধ্যে যে ধারণাগুলো একটু আগে ধরা দিলো,তা মূহুর্তেই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো নিভানের।চোখ বুঁজে ফেললো সে।ফের কৌড়ির বলা শব্দগুলো কর্ণগোচর হতেই,বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা পানির মধ্যেও কানমাথা গরম হয়ে এলো তার।ক্রোধিত হয়ে পড়লো মন মস্তিক।
‘আমার গায়ে ওড়না নেই।ওরা আমার মাথার হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।সাথে ওড়ানাটা-ও কেঁড়ে নিয়েছে।
কম্পনরত ফুঁপানো গলায় বাধোবাধো স্বরে কথাগুলো বললো কৌড়ি।রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো নিভানের।মুঠোর তোপে পড়ে,ফুলেফেঁপে উঠলো হাতের শিরা-উপশিরাগুলো।টনটন হয়ে উঠলো শরীরের সমস্ত পেশী।সে কৌড়িকে এরকম একটা পরিত্যক্ত জায়গায় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে দেখে আগেই বুঝে নিয়েছিলো,কিছু একটা তো হয়েছে!আর কি হয়েছে সেটাও কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলো।আর সেটাই শুনতে হলো!আবারও জোরেজোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিভান।এখন মেয়েটাকে সামলানো দরকার।তারপর সে দেখছে?কার-ও আত্মা ধরে টানাটানি করার ফলটা ঠিক কিরূপ হয়!আর এসব শোনার পরে তাদের আত্মাগুলো কিভাবে টেনে শরীর থেকে বের করতে হয় জানা আছে নিভানের।
কৌড়ির হাত ছেড়ে দিলো নিভান।গায়ে ভিজে চুপসে যাওয়া ব্লেজারটা খুলে ফের কৌড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।যে অবস্থায় মেয়েটা কলেজ আসে,সেই অবস্থায় নেই।সাদা ইউনিফর্ম হিজাব বোরকাটার,শুধু বোরকাটা পরা থাকলেও হিজাব নেই গায়ে মাথায়।কৌড়িকে বরাবরই দেখেছে,মাথায় ওড়না বা স্কাফ হিজাবের সাথেও আলাদা করে ওড়না পরতে।হয়তো সেই ওড়নাটার কথা বলছে।কৌড়ির হাত ধরে টেনে ব্লেজারটা গায়ে পরিয়ে দিলো নিভান।কৌড়ি সংকোচিত হলেও কিছু বললোনা,শুধু সামনে থাকা মাবুষটার থমথমে মুখের দিলে চেয়ে রইলো।বৃষ্টির তোপে চেয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তবু্ও চেয়ে থাকার চেষ্টা করলো সে।তার মনে হচ্ছে,একটু আগের স্বাভাবিক চোখমুখের মানুষটার সাথে এখনকার চোখমুখের মানুষটার মিল নেই।হঠাৎ শ্যামবর্ণ মুখটা থমথমে ভাব, চোয়ালদ্বয় লৌহকঠিন মূর্তি।একটু আগের শান্ত বাদামি বর্ন চোখজোড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিম আভা!
‘এখনো ভয় করছে?
খুব আদূরে গলায় জিজ্ঞেস করলো নিভান।প্রতিত্তোরে
কথা বললো-না কৌড়ি।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।
সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।কৌড়ির কোমল ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফের বললো।
‘তবে কোনো কারনে আমাকে ভয় পাচ্ছো না তুমি?
ফের মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না সম্মতি জানালো কৌড়ি।অশান্ত মনে শান্ত চোখে সেটা দেখলো নিভান।মেয়েটাকে তারদিকে অটল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনেহলো,মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো!কোনোকারনে আবার তাকে ভয় পাচ্ছে না তো!বিধায় কথাটা জিজ্ঞেস করলো নিভান।উঠে দাঁড়ালো সে।কৌড়িকে বললো।
‘উঠো।চলো।
দাঁড়িয়ে পড়লো কৌড়ি।ঠান্ডায় পা হাত পা সব অচল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।উঠতে গিয়ে শরীরটা কেমন অচল অনুভব হলো।হেলে পড়ে যেতে নিলেই,নিভান তাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।ফের নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো কৌড়ি।পাশে ফেলে থাকা ব্যাগটা নিতে গেলেই বাঁধা দিলো নিভান।অন্য হাতে সেটা তুলে নিল।আবারও কৌড়ির ডান হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে বড়বড় পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।মেয়েটার শরীর কম্পনরত।হয়তো অতিরিক্ত ভেজার ফলে আর মনের শঙ্কায় এই অবস্থা।ভিজে অবস্থায় দুজনে গাড়িতে গিয়ে বসলো।গাড়িটা বাড়ির পথ ধরতেই স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো।
‘তুমি,ছেলেগুলোকে এ-র আগে কখনো তোমাদের কলেজের আশেপাশে দেখেছো?
অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে ভেজার কারনে ফর্সা মুখটা এমনিতেই ফ্যাকাসে বর্ন ধারণ করেছে।নিভানের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনতেই মুখটা আর-ও ফ্যাকাসে বর্ন হয়ে গেলো।মনে পড়ে গেলো সেই বিভৎস সময়ের কথা।আবহাওয়া খারাপের কারণে যখন কলেজ টাইম পার করার আগেই ছুটি ঘোষনা করা হলো,তখন সে কিছু নোটস নিজের খাতায় কালেক্ট করতে ব্যস্ত ছিলো।তারা কিছু মেয়েরা বাদে অধিকাংশ মেয়েরা তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলো।অল্প সময়ের মধ্যে সংক্ষেপে নোটসগুলো কোনোমতে কালেক্ট করে, কলেজের বাহিরে বের হতেই ঝড়ের আনাগোনা শুরু।কৌড়ি মনে করেছিলো, সিএনজি পেলে আর তো কোনো সমস্যা নেই।তবে খালি সি এনজি পাওয়ায় মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো।পরিচিত দু-একজন বান্ধবী যারা তারসাথে দাঁড়িয়ে ছিলো,তাদের বাড়ি উল্টো পথে আর আশেপাশে হওয়ায়।তারা দ্রুত হেঁটে চলে গিয়েছিলো।ঝড়ের সাথেসাথে বৃষ্টির আনাগোনা যখন শুরু হলো, বিপদের শঙ্কায় কৌড়ি-ও কলেজের সড়ক রেখে,সামনের সড়কের দিকে হাঁটা দিল।যদি ওখান থেকে দ্রুত খালি সিএনজি বা রিকশা পায়।তবে সে পর্যন্ত যাওয়ার আগেই আকাশ ভেঙে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামতে দেখেই একটা টঙ দোকানের ভিতরে আশ্রয় নিতে হলো তাকে।অতিমাত্রায় বৃষ্টির তোপে দোকনদারও তখন দোকানের ঝাঁপি লাগিয়ে দিয়েছে।তখনও ছাওনির নিচে একা দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছিলো কৌড়ি।কিছুসময় বাদে হঠাৎ দেখলো,তিনটে ছেলে তারপাশে ছাওনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।গায়ে মাথায় বৃষ্টির পানি লাগায় সেগুলো ঝাড়ছে মুছছে।ছেলেগুলোকে এরআগে দেখেছে কৌড়ি।কলেজ থেকে মেয়েরা বের হলেই উল্টো পাল্টা গান ধরা,অভদ্রের মতো শিষ বাজানো।কলেজের এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে আড্ডাবাজি করা।প্রতিনিয়ত এসবই কাজ এদের।তাদের চেহারায় প্রকাশ পায়,এরা অভদ্র বখাটে আর নেশাখোর!
রাস্তা তখন শুনশান।বাতাসের প্রকোপ আর ঝুম বৃষ্টির আনাগোনা। ভয়ে শঙ্কায় কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!ইতিমধ্যে ছেলেগুলোও তাকে ইঙ্গিত করে উল্টো প্লাটা বাক্য ছোঁড়া শুরু করে দিয়েছে।সাথে সিগারেটের বাজে দুর্গন্ধ তো আছেই।দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো, প্রান যায়যায় অবস্থা কৌড়ির!নিজের সাথে যখন তখন বাজে কিছু ঘটতে পারে ভেবেই সেই ঘনো বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।আর তখনই ঘটলো বিপত্তি।একটা ছেলে তার গায়ের ওড়নাটা পিছন থেকে টেনে ধরলো।বোরকার সাথে ওড়নাটা পিনআপ না করে থাকায়,মূহুর্তেই সেটা ওদের হাতের মুঠোয় চলে গেলো।ভয়ে শঙ্কায় থরথরিয়ে কেঁপে চলছিলো কৌড়ি।কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।রাস্তা শুশশান, আশে পাশের দোকানপাট গুলো বন্ধ।চিৎকারে চেচামেচি আর ছেলেগুলোর অসভ্যতামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও তো কোনো লাভ হবেনা।বিধায় ভয় শঙ্কা নিয়ে আবারও সামনে এগোতে গেলে,তার মাথায় মুড়ানো হিজাবটাতে টান অনুভব করলো।ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলো কৌড়ি।তবে ভয়ের সাথে সাথে এবার রাগ ক্ষোভও হয়েছিলো প্রচুর।পরিস্থিতিতে বুঝেও রাগ ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে পিছনে ফিরে জোর গলায় প্রতিবাদও করেছিলো।
‘আপনারা কেনো আমার সাথে অসভ্যতামো করছেন? রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করার আগে ঘরে মা বোনদের কথা মনে পড়েনা?
এমনিতেই কৌড়ি ভিতু টাইপের।তার উপর শঙ্কিত গলায় কথাগুলো বলতেই ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসতে শুরু করলো।ফের লালসিত গলায় বললো–মনে পড়ে তো মা বোনদের কথা।কিন্তু রাস্তার সব মেয়েকে যদি মা আর বোন ভাবি।তবে বউ পাবো কোথায়,সন্দুরী? আর তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে থোড়াই না মা বোন ভাবা যায়।তোমার মতো মেয়েকে নজরে পড়লে শুধু বউ বউ রকমের আসে।
আরও শত বিশ্রীরকমের কথা বলতে লাগলো একের পর এক।বাহিরে চোখমুখ শক্ত রাখলেও, ভিতরে ভিতরে ভয়ে শঙ্কায় নুইয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।এই অসভ্য জানোয়ার গুলোর সাথে কথা বাড়ানো মানেই বিপদ!বুঝেই দ্রুত সামনে এগোতে গিয়েই আবারও বাঁধা পেলো। তবে দাঁড়ানোর মনোভাব দেখালোই না।হিজাবে টান পড়া সত্ত্বেও সামনের দিকে হাঁটা দিল সে।তবুও ছাড়িনি ওই অমানুষ গুলো।বরং আরও জোরে হিজাবের কোনাটা টেনে ধরতেই,চুল ছিড়েখুঁড়ে হিজাবটা নিয়ে নিলো তাদের হাতের মুঠোয়।সঙ্গে সঙ্গে চিতকার করে কেঁদে দিয়ে সামনের দিকে দৌড় দিয়েছিলো কৌড়ি।রাস্তায় তখন একটা মানুষ-ও নেই।
ঝড় আর বৃষ্টির প্রকোপ দ্বিগুণ তখন।চারপাশটা কেমন অন্ধকার!পিছন থেকে ছেলেগুলোও ছুটে আসছে দেখেই,দিশাহারার মতো যেদিকে নজর গেছে সেদিকে ছুটে গিয়েছে কৌড়ি।বেশ কিছুক্ষণ দিশাহীন ছুটে চলার পর হঠাৎই মনে হলো ছেলেগুলো তার পিছনে নেই।কারনটা কি জানা নেই কৌড়ির।কেনো ছেলেগুলো তার পিছু নেওয়া ছেড়েছিলো।তবে নিজের নিরাপদ রাখতে, ওই পরিত্যক্ত জায়গায়টার পিছনে গিয়ে লুকেছিলো সে।ঘন্টা পেরেয়ি যাওয়ার পর-ও সাহসে কুলায়নি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার।তবে মনেমনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছিলো।
‘কৌড়ি।
হুঁশে ফিরলো কৌড়ি।ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটার দিকে উদভ্রান্তের ন্যায় ফিরলো সে।মানুষটার দৃঢ় নজর তখনও সামনের দিকে।তবে মনোযোগ তার দিকে এটা বেশ অনুভব করতে পারলো কৌড়ি।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে,মুখে মৃদুশব্দে বললো।
‘মুখ চেনা।ওদেরকে প্রতিনিয়ত কলেজের আশেপাশেই দেখা যায়।
আর কথা বাড়ালোনা নিভান।বাড়ির কাছাকাছি গাড়িটা পৌঁছানোর আগেই,কাওকে ফোন দিলো সে।ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো।
‘মান্য..একটা ওড়না নিয়ে বাড়ির বাহিরে আয়।
ওপাশ থেকে মুখে হাত চেপে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মান্যতা।কৌড়ি বাড়িতে না আসাতে সে-ও ছটফট করছে।বাড়ির অধিকাংশ লোকই এখনো জানে না, কৌড়ি বাড়িতে ফেরেনি।বিশেষভাবে মা আর সে ছাড়া।একটু আগে মায়ের কাছ থেকে জেনেছে,কৌড়ি বাড়িতে না আসায় দাদাভাইকে জানিয়েছেন তিনি।একটু নিশ্চিত হলেও টেনশন কমেনি।এখন দাদাভাই ওড়না নিয়ে বাহিরের যাওয়ার কথা বলছে কেনো? মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি তো!ও আল্লাহ।দ্রুত
ওয়ারড্রব থেকে একটা ওড়না বের করে নিয়ে দৌড় দিলো মান্যতা।বাড়িটা আপতত শুনশান।বৃষ্টির ঠান্ডার প্রকোপে যে যার রুমে অবস্থার করছে।হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে।কোনোরকম মেইন দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যেও লন এরিয়ায় পা রাখতে গিয়েও দেখলো,দাদাভাইয়ের গাড়িটা এদিকে আসছে।দাঁড়িয়ে পড়লো মান্যতা। গাড়ি এসে থামতেই দ্রুতবেগে গাড়ীর জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো সে।ততক্ষণে জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছে নিভান।বিধ্বস্ত কৌড়িকে দেখেই,পরাণ কেঁপে উঠলো তার।তারমধ্যে মান্যতাকে দেখেই কেঁদে ফেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই গাড়ির দরজা খুলে, নিচু হয়ে কৌড়িকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো মান্যতা।ভিজে গেলো নিজে, তবুও সরলোনা।কৌড়ির মাথায় বরাংবার হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু দিয়ে বললো
‘তুই ঠিক আছিসতো পাখি?আর কখনো তোকে এভাবে একা ছাড়বোনা।কাঁদিস না পাখি, চুপ কর।
অনর্গল এটাওটা বলে গেলো মান্যতা।মান্যতা আদূরে কথাগুলোয় কান্না যেনো বাড়লো কৌড়ির।সেটা বুঝে মান্যতা ফের বললো।–কিচ্ছু হয়নি।একদম কিচ্ছু হয় নি।
ছেড়ে দিলো কৌড়িকে।ভাইয়ের ব্লেজারটা কৌড়ির গায়ে দেখতেই আঁতকে উঠলো বুকের ভিতর।তবে মুখে তা প্রকাশ করলোনা।নিয়ে আসা ওড়না মেলে তারউপর গায়ে দিয়ে বললো।–তাড়াতাড়ি বাহিরে আয়।কতক্ষণ থেকে ভিজছিস তার ঠিক নেই।সর্দি-জ্বর বাঁধলো বলে!
কৌড়িকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো মান্যতা।বাড়ির দিকে পা রাখবে এমন সময় মান্যতাকে ডাকলো নিভান।ফের বললো—ওকে এই অবস্থায় যেনো বাড়ির কেউ না দেখে!বিশেষ করে ফুপিমণি!আর ও ভয় পেয়েছে প্রচন্ড,ওকে আপতত একা ছাড়িস-না।খাবার শেষে জ্বরের একটা ঔষধ খাইয়ে দিস।
গাড়ি স্টার্ট দিলো নিভান।হঠাৎ কৌড়ির মন ছটফটিয়ে উঠলো।মানুষটাও তো তারমতো কাকভেজা।তবে জামাকাপড় চেন্জ না করে আবার-ও যাচ্ছে কোথায়? কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু শা-শা বেগে গাড়ীর চলে যাওয়াটা দেখলো।মনেমনে আওড়ালো।
‘আজ কেনো ওই মানুষটার দিকে মনটা টানছে তার।ওই মানুষটার শক্তচোয়াল আর রক্তিম চক্ষুোদ্বয় তাকে যে ইঙ্গিত দিলো,তবে কি এই কাকভেজা অবস্থায় সেদিকে ছুটলো মানুষটা!কিন্তু কেনো?তারজন্য!এসব কি ভাবছে সে!নিজের সীমা-তো যানে কৌড়ি।সেই সীমা কখনো অতিক্রম করতে চায়-না সে।উচিত-ও নয় অতিক্রম করা।আর সেই অনুচিত কাজের ভাবানাটা-ও সীমার মধ্যে পড়ে।তাই সেটা নিয়ে ভাবনাও অনুচিত।
চলবে….