প্রমত্ত_অঙ্গনা #লেখিকা_আরোহী_নুর ১৬,১৭

0
154

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
১৬,১৭

আঁখি কোনোরূপ গেটের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে,দূর্ভাগ্যবশত আজকে তার গাড়িটা ড্রাইবার গেটের বাইরেই পার্ক করেছে,আঁখির গার্ড দু’দিক থেকে তাকে আগলে রিপোর্টারদের ভিরের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে,এদিকে রিপোর্টারেরা তো সবাই নাছোড়বান্দা,তারা ঘেরাও করে রেখেছে তাকে,বেরুতেই দিচ্ছে না।এক এক জন এক এক কথা বলছে।

ডা.আঁখি আপনি কি আদ্রিশ রাহমানকে স্বইচ্ছায় ডিভোর্স দিয়েছেন?

ডা.আঁখি রিদিকা নামের মেয়ের সাথে কি আদ্রিশ রাহমানের বিয়ের আগ থেকেই অবৈধ সম্পর্ক ছিলো?

ডা.আঁখি, কিছু তো বলেন,আপনি এভাবে জবাব না দিয়ে গেলে কিন্তু সত্যতা চাপা পরে থাকবে না,আমাদের আসল সত্যটা বলুন।

আরে এ কী বলবে!হয়তোবা নিজেরই কোনো সমস্যা ছিল, আরে স্বামী কি আর স্বাদে বউ ছেড়ে অন্যত্র যায়,হয়তবা নিজের কোনো অক্ষমতা আছে নয়ত অন্য কোনো পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক, তাই তো মুখ ঢেকে পালাচ্ছে।

কথাটা কানে যেতেই পা থামিয়ে নিলো আঁখি,পাক ফিরিয়ে উল্টো হাতে একটা থাপ্পড় বসালো সে রিপোর্টারের গালে,টাল সামলাতে না পেতে সে লোকটা দাঁড়ানো থেকে পরে গেল।সবাই হতবাক হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।এবার আঁখির সবার উদ্দেশ্য গর্জে উঠে বলল।

আর কে কি জানতে চাও সামনে এসে বলো?সামনে এসো বলছি,ছিঃ এ দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে আমার লজ্জা করছে,আপনারা এতজন শিক্ষিত লোক আমার কাছে এসেছেন আমার স্বামীকে আমি কেন ছেড়েছি তা জানতে,যেখানে আদ্রিশের কাছে আপনাদের মধ্যে একজনও হয়ত এখনও যায় নি–আমি তাকে কেন ছেড়েছি বিষয়টা জানতে।কারণ আপনাদের একজন নারীকে হেনস্তা করতে ভালো লাগে,তারভুল ত্রুটি খোঁজে বার করাই তো আপনাদের অন্যতম শখের একটা অংশ,সংসার ভেঙেছে নিশ্চয়ই এতে নারীর কোনো ভুল ছিল,ধর্ষণ হয়েছে নিশ্চয়ই এখানেও তারই কোনো দোষ ছিল,এমনিই কেন একটা ছেলে তাকে ধর্ষণ করবে!আপনাদের তো শুধু মশলাদার খবর চাই,পীড়িত মেয়েদের পক্ষে কতো কথা লিখে পত্রিকায় ছাপাবেন,টিভিতে দেখাবেন,অতঃপর ৬-৭ দিন পর তার আর কোন খোঁজ নিবেন না,সেই অপরাধীকে আদোও কি ধরা হয়েছে বা তার শাস্তি হয়েছে তার খোঁজ আর নেওয়া হয়ে উঠে না আপনাদের,নারীদের নিয়ে খবর দিলে খবর বেশি ভাইরাল হবে,আপনাদের লাভ হবে,নাম হবে বেশি তাই তাদেরই হেডলাইনে রাখতে চান সবসময় কিন্তু তাদের সম্মান করতে চান না একচুলও,অশিক্ষিতদের তো ছাড় দেওয়াই যায় কিন্তু আপনাদের মতো শিক্ষিতদের এসব কর্মকাণ্ড বেশি খারাপ লাগে।ছিঃ…জানতে চান না আমার স্বামীকে আমি কেন ছেড়েছি,কারণ ও আপনাদের দলেরই একজন ছিলো,নারীদের প্রতি বৈষম্য রোধ করার চিন্তা মাথায় রাখলেও নিজের প্রথম স্ত্রীকে হাতের মুঠোয় দমিয়ে রাখতে চেয়েছে সে।এমন স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া তে খুব কম জিনিস প্রাণে মে*রে ফেললেও কষ্ট দূর হবে না আমার মনের।

সবাই হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঁখির এমন কার্যকলাপ আর জবাবে,কেউ যেন আর কোনো কিছু বলার সাহস জোটাতে পারল না,আঁখি গাড়িতে উঠে চলে গেল।

আদৃত ডা.আশরাফ খানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে,আগামীকাল থেকেই সে উনার হাসপাতালে জয়েন হবে।বিছানায় বসে ল্যাপ্টপে কিছু কাজ করছিল তখন ফোন বেজে ওঠল তার হঠাৎ, রিংকি নাম টা দেখে বেশ বিরক্ত হলো আদৃত,একবার ফোন কাটলে আবারও কল আসলো,এভাবে ১০ তম বার ফোন উঠাল আদৃত, রিংকি আহ্লাদী করে বলল।

″কি আদৃত ডিয়ার ফোন কেন ওঠাচ্ছিলে না?কোথায় আছো তুমি?বাংলাদেশে গিয়ে তো ভুলেই গেছো আমায়।″

″আমেরিকায় থাকতেই কখন মনে করতাম তোমায়। ″
বিড়বিড় করে কথাটা বলল আদৃত।

″কি বললে তুমি?″

″কেনো ফোন করেছ আগে সেটা বলো?″

″তোমাকে খুব মিস করছিলাম তাই ফোন করলাম,কবে ফিরছ বলো?″

″আমি আর আসব না,দেশেই থাকব।ভালো থেকো।″

কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল আদৃত রিংকিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।

এদিকে আদৃতের মা তার কক্ষেই আসছিলেন তখন দরজার বাইরে থেকে কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পান উনি,যাতে খুশিতে আত্নহারা অবস্থা হয় উনার মুহুর্তেই।

আঁখি আজ অনেক বিরক্ত,ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে,যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ, গ্লানি,কোনো দুঃশ্চিন্তা, কোনো পিছুটান।জীবনটা এমন কেন হলো আঁখির!কতো সুন্দর ছিল সেই শৈশব যেখানে ছিল না কোনো হতাশা,কোনো দুঃশ্চিন্তা,চোখ বন্ধ করলেই যে প্রশান্তির ঘুম ছেঁয়ে যেত চোখ জুরে,আর এখন রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কাটাতে হয় আঁখিকে।খুব করে ইচ্ছে করছে আঁখির আবারও সেই শৈশবে চলে যেতে,বাবা মায়ের কোলে আহ্লাদী করে শুয়ে থাকতে।যা চাইলেও এখন করতে পারবে না আঁখি।
মন বড় অস্থির, মা বাবার সন্নিকটে থাকতে চায় এবার আঁখির মন,আশরাফ খানের প্রস্তাবে সাথে সাথে সম্মতির খবর পাঠিয়ে দিয়েছে উনার কাছে।তাকে আশরাফ খান দু’দিন পর জয়েন হবার জন্য বলেছেন,কিন্তু আঁখি বাবার পাশে যাওয়ার ব্যাকুলতা আর সয়ে উঠতে পারছিল না,তাই আগামীকাল থেকেই জয়েন করার আর্জি রাখল,যাতে মানা করলেন না আশরাফ খান,মেয়েকে দেখার অধীর এক আগ্রহ যে উনার মনেও সুপ্ত আছে।

আদ্রিশ ক্ষিপ্ত মেজাজে বাড়ি ফিরল,উভয় গালেই আঁখির দেওয়া থাপ্পড়ের দাগ,বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখল রিদিকা তার মায়ের পা ধরে কান্না করছে আর তার মা রিদিকাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।রিদিকা কেঁদে কেঁদে বলছে।

আমাকে আর মারবেন না মা দয়া করে,আমি কখনও আর এমনটা করব না,আপনার পায়ের ধুলা হয়ে পরে থাকব,আমাকে প্লিজ ঘর থেকে বের করবেন না।

আদৃত ছোটে গিয়ে রিদিকাকে উঠাল,তার বাম হাতের উপরের বেশ জায়গা পো*ড়ে গেছে,গালেও আঙুলের ছাঁপ,আদ্রিশ বেশ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল।

″কি হয়েছে রিদিকা?″

″কই কিছু না তো,তুমি কখন আসলে?তুমি রুমে যাও আমি আসছি।″

″কি হয়েছে রিদিকা বলবে তো?″

″বলছি তো কিছু হয় নি।″

″কি হয়েছে রিদিকা বলো আমায়?″

আদ্রিশ এবার বেশ রেগে গর্জে ওঠে জিজ্ঞেস করলে রিদিকা বেশ কেঁপে উঠে বলল।

″আমি আজকে রান্না করে তরকারির পাত্র সরিয়ে আনছিলাম কিন্তু হাত থেকে পিছলে পাত্রটা নিচে পরে যায়,তখন পাশে শুভ্রতা ভাবি দাঁড়িয়ে ছিলেন যার ফলস্বরূপ উনার পায়ের ওপর কিছু গরম তরকারি পরে আর উনার পা অনেকটা জ্বলে যায়, মা এর জন্য আমাকে দোষী ভেবে আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসেন, হাতে গরম তরকারির বাকি অংশ ঢেলে দেন।প্লিজ তুমি এসব নিয়ে কোনো কথা বলো না,তুমি রুমে যাও,এসব আমরা শাশুড়ি বউয়ের বিষয় তুমি মাঝখানে এসো না।″

″বাবা আমি কিছুই করি নি,ও মিথ্যে বলছে।তুই জানিস আমি কেমন মানুষ।″

″এজন্যই তো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এসব তুমি করেছ,ছিঃ মা, আমি সবসময় তোমাকে মা রুপে আদর্শ মানতাম,কারণ তুমি কখনও আমার আর ভাইয়ার মধ্যে যেমন ভেদাভেদ করো নি তেমনটা আঁখি আর ভাবিকেও একই দৃষ্টিতে দেখেছ,নিজের মেয়েদের মতো আদর করেছ,তবে তুমি রিদিকার সাথে এমনটা কি করে করতে পারলে!″

″আদ্রিশ,কথা শুনো,রিদিকা মিথ্যে বলছে,মা এমন কিছু করেন নি,ও ইচ্ছে করে ওসব করেছে।″

″এনাফ ভাবি,ও কি পা*গ*ল যে নিজেকে এভাবে নিজে আঘাত করবে!গতকাল যখন রিদিকা বলেছিল তুমি ওর হাতে খামছি দিয়েছ আমি বিশ্বাস করতে পারি নি।ছিঃ তোমরা এতটা জগণ্য,আঁখি সক্ষম ও সবল ছিল বলে ওর সাথে কিছু করতে পারো নি তোমরা,আর রিদিকাকে অসহায় ভেবে এমনটা করছ তোমরা তাই না?কিন্তু এ ভুল দ্বিতীয় বার করো না বলে দিলাম,আঁখির মতো রিদিকা ও আমার স্ত্রী, ওর সাথে আবারও যদি কোনো খারাপ ব্যবহার করতে দেখি তোমাদের তবে আমি ভুলে যাব তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।″

অতঃপর রিদিকাকে ধরে নিয়ে কক্ষের দিকে হাঁটা ধরল আদ্রিশ।

শুভ্রতা আর আদ্রিশের মা জাহানারা রাহমান তাকিয়ে রইলেন শুধু তাদের যাওয়ার পানে।

″আমার ছেলে আর আমেরিকা যাবে না।আল্লাহ রহম করলেন অবশেষে, ওর সাথে বিয়ের কথা বলি না যদি আবার আমেরিকা চলে যায়,যাক এবার নিশ্চিত হলাম,এখন একটা লক্ষি মেয়ের খোঁজ পেলেই হলো।″

″মা,তুমিও না,সারাদিন কি ভাইয়ার বিয়েই ঘুরে তোমার মাথায়?তোমার এই বিয়ের চাপের ভয়েই ভাইয়া হয়ত ছয় বছর দেশে আসেন নি।এখন আবার এসব শুরু করলে আবার চলে যাওয়ার জন্য না উঠেপরে লাগেন।″

″তবে কি করব বল?ওর বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। ″

″মা তুমি চিন্তা করো না তো,ভাইয়া এডাল্ট,জোর করে তো তুমি উনাকে বিয়ে করাতে পারবে না,নিজের জীবন ভাইয়াকে সামলে নিতে দাও দেখবে ভাইয়া ঠিকই একদিন এগিয়ে যাবে।″

″আর কতো রে মা?আঁখি চলে যাওয়ার পর থেকে আমার ছেলেটাকেই হারিয়ে গেলাম আমি।আর কবে ফিরে পাব ওকে আমি।″

″মা নিরাশ হয়ো না, তুমি দেখে নিও আল্লাহ ভাইয়ার দিকে ঠিকই মুখ তুলে তাকাবেন।উনার জীবনে খুব জলদি সুখ চলে আসবে।″

আজ আদৃতের খুশি হাজারগুণ বেড়ে গেছে।আশরাফ খানের কাছে নিজের সাথে নতুন কোনো ডাক্তার উনার মেডিকেল কলেজে নিয়োগ হবেন কি না তা জানতে চাইলে উনি আদৃতকে তার লিস্ট দেখালেন।যেখানে আঁখির নাম দেখে যেন পাহাড় সমান প্রাপ্তি নিমিষেই পাওয়া হয়ে গেল আদৃতের,আঁখি আজ থেকেই জয়েন হবে বিষয়টা তার খুশিতে অতিরিক্ত আমেজ জুরে দিলো।খুশিতে মন আজ যে নাচতে ইচ্ছে করছে আদৃতের, সাত সকালে ঘুম ভেঙেছে,সময় যেন কাটছেই না তার,কবে হাসপাতালে যাওয়ার সময় হবে আর কবে সে তার আঁখিকে দেখতে পাবে।মনের উথালপাতাল ভাব আজ হয়ত আঁখিকে দেখার আগ অব্দি কমবেই না।মেরুন রঙের একটা শার্ট পরেছে।শার্টটা আঁখির দেওয়া,সেদিন হঠাৎ এই শার্ট টা নিয়ে হাজির হয়েছিল আঁখি আদৃতের সামনে।

″আজকে আপনি এই শার্টটা পরবেন।″

″কেন?আমি তোমার দেওয়া শার্ট পরব কেন?তাছাড়া আমার রঙিন জিনিস পছন্দ না।″

″কোন শোকে জীবন সাদা কালো করে রেখেছেন আপনি শুনি?হ্যাঁ এটা জানি আপনাকে কালো রঙেই বেশি মানায়,কিন্তু অন্যান্য রঙেও মাশাআল্লাহ খারাপ লাগবে না।এই মেরুন রঙ আপনার উপর যা লাগবে।″

″আমি পরব না এটা।″

″আপনাকে পরতেই হবে।আর না পরলে আপনি ভালো করে চেনেন আমায়,ভরা সমাজে আমার হাতে গায়ের শার্ট না ছেড়াতে চাইলে এটা ভালো ভালোয় পরে বাইরে আসেন,এখন আমি রুম থেকে যাই আপনি শার্ট পরুন কেমন।″

কথাটা মনে পরতেই আদৃতের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটল।হাসিটাতেও লুকিয়ে আছে আঁখির স্মৃতি, আঁখি বলত।

ডা.আদৃত সবসময় হাসেন না কেনো আপনি?আপনাকে হাসলে যা লাগে।

অবশেষে আঁখির পাশে থাকার, তাকে ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ আদৃত পেয়ে গেল।হাতছাড়া করবে না এ সুযোগ প্রাণ থাকতে আর সে প্রেমিক পুরুষ মনে পুষে নিয়েছে তীব্র এক আকাঙ্খা।

আঁখির পছন্দ অনুযায়ী আজকে তৈরি হলো আদৃত, তাকে চোখ ভরে দেখার অধিকার যে শুধুই তার সুখপাখির।

আঁখির মন আজকে বেশ ভালো।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ফুরালো তার।লম্বা একটা কুর্তি পরে চোখে কাজল টানল আঁখি,চুলগুলো আজ ছেড়ে দিলো,হাতে ঘড়ি পরল,কানে হালকা দুল ও পায়ে পায়েল দিলো,তারপর এপ্রোণ পরে বেড়িয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

চলবে……..

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(১৭)

আদৃত রেডি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে,শায়েলা মির্জা তাকে নাস্তার জন্য ডাকতে যাবেন তার আগেই আদৃতকে বেড়িয়ে আসতে দেখলেন।

″আরে বাবা তুই কোথায় যাচ্ছিস?নাস্তাটা করে যা।″

″না মা তাড়া আছে,আজকে হাসপাতালে প্রথম দিন,স্পেশাল কেউ আসছে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। চলি।কথাটা বলেই আদৃত বেড়িয়ে গেল।″

ছেলের উৎফুল্ল মনোভাব বুঝে ওঠতে পারলেন মা,স্পেশাল কেউ কথাটা মনে উনারও খুশির জোয়ার তুলল।অবশেষে উনার ছেলে কি জীবনে এগুতে চলেছে!মনে আশাটা প্রস্ফুটিত হলো উনার।

সময়ের আগেই চলে এসেছে আদৃত,নতুনদের আগমণের জন্য মেডিকেল কলেজে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে।একে একে সবাই সে সমারোহে যোগদান করছেন।নতুন ছয় জন ডাক্তার নেওয়া হয়েছে, সবাই ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়ে গেলেও আঁখির খোঁজ নেই,যদিও অনুষ্ঠান শুরুর অনেক সময় বাকি এখনও তবুও আদৃতের মনে নেই একটুও প্রশান্তি, গেটের দিকে চোখ রেখে বসে আছে কবে তার সুখপাখিকে একপলক দেখতে পাবে।অবশেষে আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে না পেরে গেটের দিকে যেতে নিলে আঁখির গাড়ি গেটের ভিতরে প্রবেশ করল,গাড়ি থামলে ভিতর থেকে নামল আঁখি,অপলকে তাকিয়ে আছে আদৃত তার প্রিয়সীর দিকে,সেই কাজল টানা চোখের প্রেমে যে আজ আবার নতুন করে পরল সে।ঘন লম্বা সেই চুল,সেই মায়াবী চেহারা সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও যে মন ভরবে না আদৃতের,এর চেহারায় মায়ায় কাটিয়ে দিতে সারাজীবনও কম পরে যাবে তার, গাড়ি থেকে নামতেই আঁখির চোখ গেল আদৃতের ওপর,মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে আছে সে।এই মুগ্ধতা তো আঁখি এর আগেও অনেক বার আদৃতের চোখে নিজের জন্য দেখেছিল কিন্তু তার এক অংশও তো সত্য ছিল না তবে আজকের অংশকে কিভাবে সত্য মানা যাবে!না এ মুগ্ধতা আঁখির জন্য হতে পারে না।এবার আঁখির খেয়াল গেল আদৃতের পরণের শার্টের ওপর,শার্টটা কেমন জানি পরিচিত লাগল আঁখির,চোখ পরল আঁখির শার্টের কলারের ওপর যেখানে ছোট্ট করে আঁখি লিখা,যেটা আঁখি নিজে আদৃতের শার্টে লিখিয়ে দিয়েছিল,শার্টটা কি করে ভুলতে পারে আঁখি,তারমানে এটা আঁখির দেওয়া আদৃতকে প্রথম শার্ট।আঁখির মনে এবার গভীর প্রশ্ন ঘোরপাক খেতে শুরু হলো।

ডা.আদৃত তো কখনও আমায় ভালোবাসেন নি তবে আমার দেওয়া শার্ট এখনও কেনে সামলে রেখেছেন?এর কি মানে হতে পারে।যদি ভালোই না বেসে থাকেন তবে ৭ বছর আগের শার্ট কেন সামলে রাখবেন?

গুড মর্নিং আঁখি।

″মুগ্ধতা কাটিয়ে আদৃত স্বাভাবিক অবস্থায় আসার চেষ্টা করে সকালের শুভেচ্ছা জানালে আঁখির ধ্যান ভাঙল, হাসিমুখেই জবাব দিল।″

″গুড মর্নিং ডা.আদৃত।কেমন আছেন?″

″এইতো আলহামদুলিল্লাহ।তুমি?″

″আল্লাহ যেমনটা রেখেছেন।″

″হুম,তা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে ভিতরে চলো।″

″হুম চলুন।″

অতঃপর দু’জনই সমারোহে অংশগ্রহণ করল।

আদ্রিশের মন ভালো নেই বুঝতে পারছে রিদিকা, রাতেও শুধু রিদিকার ক্ষততে ওষুধ লাগিয়ে ওকে ঘুম পারিয়ে ওর কক্ষ থেকে চলে এসেছিল সে।আদ্রিশের গালের কালচে দাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকে কিছুই জানাল না আদ্রিশ,বর্তমানে রেডি হয়ে বেড়িয়ে যাবে তখনই রিদিকা সামনে এলো।

″কোথায় যাচ্ছো আদ্রিশ ব্রেকফাস্ট করবে না?″

″না রিদিকা,ইচ্ছে নেই।তোমার হাত এখন কেমন আছে?″

″এখন ঠিক আছে,আগে বলো কোথায় যাচ্ছো?তোমার গালের দাগ সম্পর্কে ও কিছু বললে না,আমি জানি তোমার মন খারাপ,আমি তো তোমার স্ত্রী আমার সাথে তো সব শেয়ার করতেই পারো,বলো না কি হয়েছে?″

″এখন ভালো লাগছে না রিদিকা,পরে বলব,কাজ আছে যাই,তুমি তোমার খেয়াল রেখো,ভাবি আর মা তারা কিছু যদি বলে তোমায় তবে আমাকে ফোন করো কেমন।কিছু লুকোতে যেও না আবার,এখন চলি আমি।″

″রাতে কবে ফিরবে?″

″রিয়াদের সাথে যাব একটু,তাই ফিরতে দেরি হবে।″

″রিয়াদ,রোজ কি ওর সাথে সময় কাটানো জরুরি?″

″একটাই বেস্ট ফ্রেন্ড আমার,দিনশেষে ওর সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে।আঁখির ওকে নিয়ে কখনও কোনো সমস্যা হয় নি,আশা করি তোমারও হবে না।″

কথাটা বলে চলে গেল আদ্রিশ।

সমারোহে নতুন আসা সকল ডাক্তার একে একে নিজেদের কিছু মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করলেন,ঠিক সেভাবে আদৃতও করল,এবার আঁখির পালা,আদৃত মনোযোগ সহকারে আঁখির বলা প্রতিটা লাইন শ্রবণ করছে।আঁখির বক্তব্যে বেশিরভাগ নারীদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তোলার অনুপ্রেরণা রয়েছে,অতঃপর বক্তব্যের শেষের দিকে বলল আঁখি।

সব শেষে এটাই বলব,আমাদের সবাইকে মা বাবার সম্মান করা উচিৎ, কখনও তাদের অবাধ্য যাওয়া উচিত না,একটা সন্তান গড়ে তুলতে মা বাবা যে ত্যাগ স্বীকার করেন তা হয়ত আমরা কেউ কখনও পারব না মা বাবার জন্য,তাই বেশি কিছু না হলেও তাদের কথার মান তো আমরা দিতেই পারি। জানিনা অন্যেরা কি ভাবে কিন্তু আমার মতে যতই শিক্ষিত হয়ে যাওয়া যায় না কেন মা বাবার দোয়া ব্যতীত জীবনে সফলতা কখনও আসে না,কমতি টা একদিকে হলেও থেকেই যায়।ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মা বাবা এটাই কামনা।আবারও আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।

মেয়ের শেষের বক্তব্য হৃদয় নাড়াল আশরাফ খানের,মেয়ের অনুতপ্ততা অনুভব করতে পারলেন উনি তার বক্তব্যের শেষে বলা প্রতিটা অক্ষরে।

আজকে প্রথম দিন তাই নতুন কাউকেই কোনো কাজ দেওয়া হয় নি,সবাই যার যার মতো সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে, ঘুরে হাসপাতাল টা দেখে নিচ্ছে।আঁখিও দেখছে আবার মন ভরে হাসপাতাল টা,বাবার গড়া হাসপাতাল, নিজে ডাক্তার হলেও বাবার এই কলেজে পড়ে নি সে।বাবা কখনও চান নি কেউ বলুক নিজের মেয়ে বলে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে ডাক্তারি পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে,কেউ তার মেয়ের যোগ্যতায় কলঙ্ক মাখুক তার সুযোগ উনি কখনও কাউকে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না,তাই অন্য বড় মেডিকেল কলেজে পড়িয়েছেন উনি মেয়েকে,তবে হাসপাতাল টায় আঁখি অনেক বার এসেছে,এখানে জমে আছে আঁখির আদৃতের সাথে কাটানো কতো স্মৃতি, আঁখি এখানে আসতই আদৃতকে পেরেশান করতে।কথাটা ভাবনায় ধরা দিতেই মুচকি হাসল আঁখি।কতো না বিরক্ত করত সে আদৃতকে,এভাবে কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে উত্তপ্ত করে বলে মনে হয় না যেমনটা আঁখি আদৃতকে করত।ভালোবাসতো যে তাকে বড্ড,স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে,তাদের বিয়ে হয়ে,দু’টো গলুমলু বাচ্চা হবে,একটা ছেলে একটা মেয়ে,দু’জন মিলে দু’জনকে মানুষ করবে,কতো শত খুনসুটি বাঁধাবে একে ওপরের সাথে তবে দিনশেষে ভালোবাসায় ভুলিয়ে দিবে মনের সকল মনেমালিন্যতা।কিন্তু কি তে কি হয়ে গেল।সবকিছুই যদি সত্যিই স্বপ্নের মতো সহজে সাজানো যেত তবে জীবনটা নিশ্চয়ই বিষাদময় হতো।কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন,তা মানিয়ে নেওয়া দুর্বোধ্য হলেও এটাই সত্য।

কলেজের পিছনে একটা মাঠ,মাঠের এককোণে একটা বড় আকারের বট গাছ,তার নিচে বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বানিয়ে দেওয়া আছে,আঁখি সেখানে বসেই ভাবনার জগতে বিচরণ করছিল,তখন হটাৎ এসে আদৃত তার পাশে বসল।

অল্পক্ষণ দু’জনেই নিরবতা বজায় রাখল,অতঃপর আঁখি বলল।

″তা এতোদিন কোন হাসপাতালে ছিলেন?″

″আমেরিকাতে একটা হাসপাতালে ছিলাম।″

″আমেরিকাতে!কিন্তু কেন আপনি তো কখনও দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করতে চান নি,তবে হঠাৎ এমন চিন্তা মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠার কারণ জানতে পারি?″

″কাউকে সুখী করতে গিয়ে নিজের অনিচ্ছার পথটাই বেঁছে নিতে হলো।″

″আপনি একটুও বদলান নি,ঘুরিয়ে কথা বলার অভ্যেস কবে যাবে আপনার বুড়ো দাদু হয়ে গেলে?″

″তুমিও তো একটুও বদলাও নি,খবরদারি করার অভ্যেস যায় নি।″

কথাটা শুনে আঁখি বেশ খক করে হেঁসে তাকালো আদৃতের দিকে,টোল পরা গালের সে মোহনীয় হাসি এতবছর পর আবারও চোখ ভরে দেখতে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হলো আদৃতের।আঁখি হাসিমুখেই বলল।

″হাসেন না কেন?যতো যা হয়ে যাক না হাসার পণ টা এখনও ভাঙেনি আপনার তাই না?″

″হাসানোর নির্দিষ্ট জন জীবনে না থাকলে কিভাবে হাসিখুশি বাঁচা যায় বলো?″

আঁখি আদৃতের বলা কথাটা শুনে তাকানো স্থির রাখল তার দিকে, গভীর দৃষ্টিতে তার মনোভাব যেন পড়ে নিতে চাইল তার চোখের মাধ্যমে,ঠিক তখন একজন নার্স এসে ডাক দিল তাদের।

স্যার, ম্যাম, ডা.আশরাফ রায়হান আপনাদের ডেকেছেন।

নার্সের কথায় দু’জনেরই ধ্যান ভঙ্গ হলো,ওঠে চলে গেল দু’জন একসাথে আর কোনো কথা বলল না।

রাত প্রায় ১১ টা,রিপোর্টার লিজান তার বাসস্থানে ফিরছে,বাড়ির সরু রাস্তা দিয়ে নিজের বাইকে চড়ে যাচ্ছে সে,মাথায় আটছে হরেক কুবুদ্ধি, আঁখির থাপ্পড়ের জবাব সে দিয়েই ছাড়বে,এতবড় অপনাম সে সহজে মেনে নিবে না,আঁখিকেও সমপরিমাণ ফিরিয়ে দিবে।তাকে নিয়ে কি এমন খবর ছাঁপলে আঁখি কোথাও মুখ লুকানোর আশ্রয় পাবে না ভাবনাটা পেরেশান করে তুলেছে তাকে,তার ভাবনাকে বিরক্তিতে পরিণত করল হঠাৎ তার বাইকের চাকায় সমস্যা হয়ে যাওয়া।সহসা বাইকটার চাকায় কিছু লাগলে তা চলার গতি হারিয়ে ফেলে,লিজান পরে যেতে নিলে কোনোরূপ ভারসাম্য ধরে রাখে ,বাইক থামিয়ে রাস্তায় কীল পরে থাকতে দেখে, রাস্তায় এতো কিল পরে থাকতে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় লিজান,এটা কারো কোনো বিছানো জাল নয় তো ওর বিরুদ্ধে, রাস্তাটাও বেশ জনশূণ্য,এতো রাতে এখান দিয়ে লোক সমাগম কম,মনে ভয় নাড়া দিয়ে গেল লিজানের,বাইকটাকে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে দ্রুগতিতে যাওয়ার চেষ্টায় এগিয়ে যাবে তার আগেই পিছন থেকে লিজানের মাথায় পরল ভারি কিছুর আঘাত।মাথায় হাত দিকে পাক ফিরতেই হুডিওয়ালা কেউ তার বুক বরাবর একটা ধারালো ছু*রি পুরোটা ঢুকিয়ে দেয়,লিজান চিৎকার করে মাটিতে পরে কাতরানো শুরু করেছে,হুডিওয়ালা সে ব্যক্তি এবার হাঁটুগেড়ে তার সামনে বসে তার বুক থেকে এক টান দিয়ে ছু*রি টা বার করল,নিশ্বাস ধরে আসা কন্ঠে,কাপন্ত ঠোঁটে খুব কষ্টসহকারে তাকে প্রশ্ন করল লিজান।

″কে তুমি?আমাকে কেন মারছ?প্লিজ আমাকে মেরো না।″

″আমি তোর মৃত্যু, প্রমত্ত অঙ্গনা,তোকে যে আজ মরতেই হবে।″

অতঃপর সাথে সাথে ছু*রিটা লিজানের কপাল বরাবর ঢুকিয়ে দিলে লিজান সাথে সাথেই মৃ*ত্যু বরণ করল।

তার পাশে রক্তে ভিজে যাওয়া মাটিতে সে অঙ্গাত ব্যক্তিত্ব বড় বড় অক্ষরে লিখে দিল প্রমত্ত অঙ্গনা নামটি।

রাত প্রায় ১ টায় ফিরল আদ্রিশ বাড়িতে,কাজের মেয়ে রহিমা দরজা খুলে দিলো আজ,এখন তো রোজ রিদিকা দরজা খুলে দেয় তার জন্য,আজ কোথায় সে?উত্তরের আশা আদ্রিশ জিজ্ঞেস করল তাকে।

″রিদিকা কোথায়?″

″জানিনা স্যার,অনেক্ষণ ধরে দেখি নি।″

″হুম, আমি দেখছি।″

আদ্রিশ রিদিকার খোঁজে তার কক্ষের দিকে গেল।কিন্তু কক্ষের কোনো প্রান্তে রিদিকাকে খোঁজে পেল না সে,কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যাবে তখনি রিদিকা হুটহাট প্রবেশ করল সেখানে।আদ্রিশকে দেখে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকলেও স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করার চেষ্টা করল।

″আদ্রিশ কখন এলে তুমি?″

″এই তো এলাম,তুমি কোথায় ছিলে।″

″ছাঁদে ছিলাম।″

″এতো রাতে ছাঁদে কি করছিলে?″

″ওই তো,তোমার অপেক্ষা করছিলাম,সময় পার হচ্ছিল না তাই ভাবলাম ছাঁদে গিয়ে চাঁদ দেখা যাক।″

″হুম।″

চলবে…….

গল্পটার থিম আমি চার ধরনের বিষয়ের উপর সাজিয়েছি,স্যাড,রোমান্টিক, সাইকো আর থ্রিলার।স্যাড আর রোমান্টিকতা ইতিমধ্যে হয়ত ফোটাতে সক্ষম হয়েছি আমি,আলহামদুলিল্লাহ। তবে সাইকো আর থ্রিলার রূপটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় আছি।আশা করি আপনারা এই গল্পটাতে কিছু নতুনত্ব খোঁজে পাবেন।তবুও কারো যদি গল্পটা ভালো না লাগে তবে তার জন্য আমি দুঃখীত।আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here