করে চাই তোকে পর্বঃ ৭ (শেষ পর্ব) লেখিকাঃ লিজা

0
353

গল্পঃ খুব করে চাই তোকে
পর্বঃ ৭ (শেষ পর্ব)
লেখিকাঃ লিজা

আবির চৌধুরীর কন্ঠ কানে আসতে সায়ান আমার হাতটা ছেড়ে দিলো।আমি ছুটে হৃদের কাছে আসলাম।হৃদকে অনেক ডাকলাম কিন্তু হৃদ উঠলো না।হৃদের মাথাটা উঠিয়ে আমার কোলের উপরে রেখে মেঘ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—“কিসের ইনজেকশন দিয়েছেন আমার হৃদকে আপনি?”

মেঘ স্যার নিশ্চুপ হয়ে রইলো।কোনো উত্তর দিলো না।আবির চৌধুরী মেঘ স্যারের সামনে গিয়ে দাড়ালো।মেঘ স্যার কিছু বলতে যাবে এমন সময় আবির চৌধুরীর স্যারের গালে মারলো এক চড়।মেঘ স্যার গালে হাত রেখে মাথাটা নিচু করে আছে।পাশ থেকে প্রিয়া বলে উঠলো,

—“ভাইয়াকে কেন মারলে বাবা? ভাইয়া তো শুধু হৃদের স্মৃতি যেন ফিরে না আসে তার চেস্টা করছে।”

প্রিয়ার কথা শেষ না হতেই প্রিয়ার গালেও আবির চৌধুরীর হাতের চড় পরলো।প্রিয়া চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে।আবির চৌধুরী রাগি দৃস্টিতে তাকিয়ে বলল,

—“তোমাদের দুই ভাই বোনকে আমি ডাক্তারি পড়িয়েছি পেশেন্টদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার জন্য। ভুল চিকিৎসা করে পেশেন্টদের ক্ষতি করার জন্য না।ভেবেছিলাম অনেক হয়েছে।তোমাদের ভুলগুলো তোমরা বুঝতে পারবে।কিন্তু না।তোমরা এখনও একই রকম রয়ে গেছো।আমি তোমাদের আরাম আয়েশ দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছি।আমার আগেই তোমাদের শাষণ করা উচিৎ ছিলো।তুমি বিয়ে করেছো নিজের ইচ্ছায়।হ্যাঁ আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না তোমাদের বিয়েতে।কিন্তু যখন তোমার বিয়ের আসল কারণটা আমি জানলাম তখন আমি চলে আসলাম বাড়িতে।ছিঃ মেঘ ছিঃ।নূরকে শুধুমাত্র বিয়ে করেছো তুমি ব্যাকমেইল করার জন্য? প্রিয়ার জীবনে হৃদকে এনে দেওয়ার জন্য?”

মেঘ স্যার আবির চৌধুরীর মুখের দিকে তাকালো।চোখে চোখ রেখে বলল,

—“এসব কথা তোমাকে কে বলেছে বাবা?”

পেছনের থেকে নূর আপু বলে উঠলো,

—“আমি বলেছি।”

মেঘ স্যার রাগি দৃষ্টিতে নূর আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।আপু বলতে শুরু করল,

—“তোমাকে আমি ভালো বেসেছিলাম মেঘ।তোমার অর্থ সম্পদকে কখনোই ভালোবাসিনি আমি।যখন জানলাম তোমার জীবনে অন্য কোনো মেয়ে আছে তখন আমি খুব ভেঙে পরেছিলাম। হৃদ শত অপমান সহ্য করেও আমাকে তোমার জীবনে আনার চেষ্টা করেছে।কারণ হৃদ তখন আমাকে ভালোবাসতো।আর তুমি সেই সুযোগটা নিয়েছো।নিজের বোনের আবদার পূরণ করতে হৃদের দূর্বলতা হিসেবে আমাকে ব্যাবহার করেছো।কিন্তু তুমি কখনোই মন থেকে আমাকে ভালোবাসো নি।বিয়ের প্রথম রাতে তুমি আমাকে অনেক অপমান অপদস্ত করেছো।আমাকে বলেছো এতোদিন শুধু ভালোবাসার নাটক করেছো আমার সাথে। আর তোমার বাবা আমাদের বিয়েটা মেনে না নিয়ে চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে।তার জন্য দায়ী শুধু আমি।সেদিনই তুমি যদি আমাকে তোমার আসল উদ্দেশ্যের কথাটা বলতে আমি কিছুতেই ফুল আর হৃদের বিয়ে হতে দিতাম না।কিন্তু ওদের বিয়ের পরে তুমি আমাকে বললে প্রিয়ার জীবনে হৃদকে এনে দিতে বিয়ে করেছো আমায়।তখন আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে হৃদকে বোঝায় ফুলের জীবন থেকে দূরে সরে যেতে।কিন্তু আমি জানতাম না ফুলও হৃদকে ভালোবাসা।যদি জানতাম কখনো ওদের আলাদা করার কথা ভাবতাম না।আমি খুব ভালোবাসি আমার বোনকে।তোমার বোনের জন্য যদি তুমি আমাকে ব্যাবহার করতে পারো।তাহলে আমি আমার বোনের সুখের জন্য তোমাকে কেন ছাড়তে পারবো না? তুমি সেদিন আমাকে বলেছিলে না আমার সাথে সংসার করার কথা ভাববে? আজ আমি বলছি তুমি চাইলেও আর তোমার সাথে থাকবো না আমি।তুমি আমার বোনের সন্তানকে নষ্ট করতে যাচ্ছিলে? এতোটা নিচ তুমি? একটা কথা শুনে রাখো মেঘ।আমিও প্রেগনেন্ট।মন পরে সেই দিনটার কথা? যেদিন প্রিয়ার বিয়ের প্রস্তাব হৃদের জন্য নিয়ে গিয়েছিলে।আর প্রিয়ার বিয়ের জন্য খুশি হয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে কাছে টেনে ছিলে? তোমার ওই ভালোবাসাটা একদিনের জন্যই ছিলো।যখন জানলে হৃদ প্রিয়াকে বিয়ে করতে চাই না তখন আবার তুমি বদলে গেলে।তোমার মতো এতোটা কস্ট আমাকে কেউ কক্ষনো দেয় নি মেঘ।কেমন মানুষ তুমি? শুধু মাত্র বোনের একটা আবদার পূরণ করতে এতোটা খারাপ হতে পারলে? চলে যাচ্ছি আমি ফুল আর হৃদকে নিয়ে।তোমার বাবাকে সত্যিটা বলার দরকার মনে করেছিলাম তাই বলেছি।”

কথাগুলো বলে আপু হৃদ আর আমার কাছে আসলো।আপুর সাথে আমি হৃদকে ধরে উঠিয়ে চলে আসতে লাগলাম।আবির চৌধুরী পেছনের থেকে আপুকে ডেকে উঠলো।বলল দাড়াতে,,

আমরা দাড়িয়ে পরলে আবির চৌধুরী এগিয়ে এসে আপুর মাথায় হাত রেখে বলল,

—“আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও বৌ মা।আমি ভেবেছিলাম তুমি একটা লোভী মেয়ে। মেঘ প্রায় রাতে মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরতো।যেই মেয়েটাকে ভালোবেসে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমি ভেবেছিলাম ওই মেয়েটা তুমি।যখন মেঘ বলল ওর ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করবে।আমি রেগে বলেছিলাম বিয়েটা হলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।মেঘ শুনলো না।বিয়ে করলো তোমাকে অনেক ধুম ধাম করে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য চলে গিয়েছিলাম আমি।কিন্তু আজ না।আমি যখন এসে গিয়েছি তখন আর কোনো অন্যায় করতে দেবো না ওদের।আমি ঠিক করেছি আমিও তোমাদের সাথে যাবো।আমি ভুলে যাবো আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছিলো।এই বাড়িটা ওদের মায়ের নামে করেছিলাম।তাই ওদের বলতে পারবো না এখান থেকে চলে যেতে।কিন্তু আমার হসপিটালটা ওটা এখনো আমার নামেই আমি।আমি নূরেকে লিখে দিবো হসপিটালটা।নূর না চাইলে আমার হসপিটালের মধ্যে মেঘ আর প্রিয়া পা রাখবে না।”

প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,

—“একটা বাইরের মেয়েকে তুমি হসপিটালটা দিয়ে দিবে বাবা? ওর অনুমতি নিয়ে হসপিটালে ঢুকতে হবে আমাদের?”

আবির চৌধুরী রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—“হ্যাঁ, ওর অনুমতি নিতে হবে। থাকার জন্য যে আশ্রয়টুকু পাচ্ছো এটাই তোমাদের জন্য অনেক বেশি।”

মেঘ স্যার চুপ হয়ে আছে।কি ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না এখন।আপু বলে উঠলো,

—“কোনো কিছুর প্রতি লোভ আমার নেই।আর না আমি কারও থেকে তার বাবাকে কেড়ে নিতে চাই।আপনি ভাববেন না বাবা আমার সন্তানটা জন্ম নিলে আমি ঠিক আপনার কাছে দিয়ে যাবো।কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার এই কথাটা আর রাখতে পারবো না।”

আপু আবির চৌধুরীর কথা না রেখে চলে আসলো আমার আর হৃদের সাথে।আবির চৌধুরী অনেক অনুরোধ করলো শুনলো না।

বাড়িতে এসে হৃদকে এনে রুমে শুইয়ে দিয়ে আপু ওর চেকাব করলো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল আমায়,

—“ভয় নেই ফুল মেঘ হয়তো ইনজেকশন দিয়ে হৃদকে স্মৃতি ভুলিয়ে রাখতো।তিন চার ঘন্টার মধ্যে হৃদের জ্ঞান ফিরলে সব মনে পরে যাবে।আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো আনিয়ে নিস মাকে দিয়ে।হৃদের যত্ন নিস।আর নিজেরও খেয়াল রাখিস।”

কথা শেষ করে আপু আমাকে হৃদের রুমেই থাকতে বলে বেড়িয়ে গেলো। আমার রুমে গিয়ে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমি হৃদকে রেখে একটু এগিয়ে এসে জানালা সামনে দাড়িয়ে দেখতে পেলাম আপু কাঁদছে। মাও এগিয়ে এসে দেখতে পেলো ব্যাপারটা।মা আপুকে ডাকতে চাইলো।আমি মায়ের মুখটা টিপে সেখান থেকে সরিয়ে আনলাম। মাকে বললাম আপুকে কাঁদতে দিতে।মেঘ স্যার যেটা করেছে।তারপরও মেঘ স্যারকে ভোলা আপুর জন্য সহজ হবে না।তাই আপুর কেঁদে মনটা হালকা করা প্রয়োজন।

সন্ধ্যার দিকে হৃদের জ্ঞান ফিরেছে।ওর সব মনে পরেছে।কাকিমণির কথা ভাবতেই অনেক ভেঙে পরেছে হৃদ।কাকিমণি আর নেই এটা যেন ও বিশ্বাসই করতে পারছে না।কত স্বপ্ন ছিলো কাকিমণির আমাদের বিয়েটা নিয়ে।অথচ কি হয়ে গেলো।মা আর নূর আপু হৃদকে সামলাচ্ছে।আমার শরীরে শক্তি কোথায়? তিনদিন তো হসপিটালে পরেছিলাম।কিছু খাইনি। নিজের যত্ন নিই নি।এখন দূর্বলতায় ঘিরে ধরেছে আমাকে। আপু পেগনেন্ট। মনের অবস্থাও ভালো নেই। এর মধ্যে সবকিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছে।আপুর বেবিটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব।প্রিয়া যেমন জেদি মেয়ে এতো সহজে মেঘ স্যারকে আপুর কাছে আসতে দিতে চাইবে না।কিছু করে না বসে প্রিয়া।আবার ভাবছি এতো ভয় পেলে চলবে না।আবির চৌধুরী তো আছেন।উনাকে বলে যদি মেঘ স্যারকে তার ভুল বুঝাতে পারি।তাহলে আমার আপু একটু সুখি হবে। নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পাবে।

হৃদের পাশের বালিশে শুয়ে আছি আমি।নূর আপু আর মা রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে হৃদ ঘুরে এসে আমার পেটে নিজের মুখটা গুজে দিলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো হৃদ।আমি বুঝতে পারছি ওর কাকিমণির কথা খুব মনে পরছে।কিন্তু ওকে কি বলে বোঝাবো সেটা ভেবে পাচ্ছি না।হৃদের চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে মাথাটা আঁকড়ে ধরে উঠিয়ে বললাম,

—“দেখও হৃদ তুমি যদি এভাবে কাঁদো তাহলে কিন্তু আমিও কাঁদবো।আমি কাঁদলে তোমার পুচকুও কাঁদবে।”

হৃদ আমার মুখটা টিপে ধরলো।এক হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে অন্য হাতটা আমার পেটের উপরে রেখে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে উঠলো,

—“আমার মনে হচ্ছে আমার মা আমাদের খুব কাছে আছে।তোর আর আমার সন্তান।এইখানে।”

কথাটা বলে হৃদ আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে। মাথাটা এনে আমার বুকে রাখলো।আমি হৃদের পিঠে একটা হাত রেখে অন্য হাতটা হৃদের মাথায় রাখলাম।হৃদ আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—“আমার সন্তানের খুব যত্ন নিতে হবে কিন্তু।তুই খাওয়া দাওয়া তেমন একটা করিস না।এই সময়টাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি তোকে প্রচুর খেতে হবে।সিঁড়িতে চড়া যাবে না।রাত জাগা যাবে না।আর আমাকে ভালোবাসতে হবে।পারবি?”

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,

—“হুমম।পারবো।এখন একটু ঘুমাও তো তুমি।কাল হসপিটাল যাবা তো।কাজের মধ্যে থাকলে তোমার মনটাও ভালো থাকবে।”

হৃদ কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরলো।আমারও ঘুম আসলো।ঘুম থেকে উঠেছি সময়টা খেয়াল নেই।চোখ মেলে দেখি আপু আলমারি থেকে কাপড় বের করে হৃদকে দিচ্ছে। আর হাসি মুখে বলছে। ওটা পরলে হৃদকে ভালো লাগবে।আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আপু বললো,

—“আজ কি কলেজ যাবি নাকি বাড়িতেই রেস্ট নিবি?”

আমি বললাম,

—“হৃদতো যাচ্ছে ওর সাথে গেলে আমারও মনটা ভালো থাকবে।সারাদিন বাড়িতে থাকার চেয়ে কিন্তু তুমি যাবে না আপু?”

আপু মুখে হাসি টেনে নিয়ে বলল,

—“কোথায় যাবো? আমি ভেবেছি মেঘকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।আর এই সন্তানটাও রাখবো না।পৃথিবীতে আসলেই আবির চৌধুরীকে দিয়ে আসবো।মানুষটা সারা জীবন একা থেকেছে।আপন ছেলে মেয়েও তাকে কখনো ভালোবাসা দেয় নি।শুধু সম্পত্তির লোভে যতটুকু সম্মাণ দিয়েছে।বাচ্চাটাকে পেলে হয়তো জীবনে একটু সুখি হবে।ওই হসপিটালে আমি আর যাবো না।আমি আবির চৌধুরীর সাথে কথা বলেছি।আমার সব দায়িত্ব হৃদকে বুঝিয়ে দিতে।পুরো হসপিটালে হৃদের মতো আদর্শবান ডাক্তার আর ক’জন আছে? হৃদ ঠিক পারবে পুরো হসপিটালটা সামলাতে।”

কথাগুলো বলে আপু রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।হৃদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হৃদ নিশ্চুপ হয়ে আছে।আমি হৃদকে বললাম,

—“আপুকে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন ছিলো হৃদ।তোমরা ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ফ্রেন্ড।বেবিটার জন্য অন্তত মেঘ স্যারের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত আপুর।তুমি তো আপুকে বলে বোঝাতে পারো।”

হৃদ আমাকে বলল,

—“আমি কখনোই নূরকে বলতে পারবো না মেঘের মতো একটা খারাপ মানুষের সাথে সংসার করতে।মেঘের কাছে ফিরে যেতে।মেঘের বেবিটা যদি মরেও যায় তবুও না।ভালো হয়েছে নূর নিজের থেকে ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।মেঘের কোনো যোগ্যতা নেয় নূরের ভালোবাসা পাওয়ার।”

—“তোমার আছে যোগ্যতা?”

আমার প্রশ্ন শুনে হৃদ আমার মুখের দিকে তাকালো।আমি উঠে গিয়ে হৃদের সামনে এসে দাড়িয়ে বললাম,

—“দেখও হৃদ। আপুকে তো তুমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতে।হয়তো এখনো ভুলতে পারো নি।আমি বুঝতে পারছি তোমার মনে এখনো আপু আছে।নিজের সন্তানের কথা কত ভাবো অথচ মেঘ স্যারের সন্তান? তুমি কিভাবে বলো বেবিটার মরে যাবার কথা।তোমার মুখে কি আটকায় না? আমি সবসময় চাই আপু নিজের ভালোবাসার কাছে সুখে থাকুক আর তুমি চাও আপু এভাবে মেঘ স্যারের থেকে দূরে থেকে কস্ট পাক?”

হৃদ আমার কথা শুনে খুব রেগে গেলো।নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,

—“ফুল আমাকে রাগিয়ে কখনো কথা বলিস না।আমার নূরের জন্য চিন্তা হয় বলে কথাগুলো বলেছি।আমি নূরের পরিবারের একজন সদস্য।ওর ভালো চাই আমি।এটাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু বলিস না যা তোর আর আমার সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।”

আমি হৃদকে টেনে ধরে বললাম,

—“আচ্ছা ছরি।ভুল হয়েছে আমার।তোমাকে আর কিচ্ছু বলবো না।”

হৃদ আমার মুখের দিকে তাকালো।আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

—“এতো বোকা কেন রে তুই? তুই জানিস তোকে আমি কতটা ভালোবাসি।নূর ছিলো আমার অতীত।তোর মুখে যেন আর কখনো আমি এমন কথা না শুনি।”

আমি মাথা নাড়িয়ে বলবো না বুঝিয়ে হৃদকে সরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।হৃদ যতোই বলুক।আমি তো ওকে ভালোবাসি।চিন্তা হয় খুব।হৃদ শুধুই আমার।ওর মনে আপুকে আর আসতে দেবো না।আপুকে মেঘ স্যারের জীবনে ফিরে যেতেই হবে।

পুরো হসপিটালটা আজ অন্যরকম লাগছে।হৃদ আমাকে মাটিতে পা রাখতে পর্যন্ত দিচ্ছে না।সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে।চলছি আমি কিন্তু পা দুটো ওর।সকলে কি ভাবছে জানি না।তবে ওর আমার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে প্রিয়া নিশ্চয় বুঝে গেছে হৃদ কখনো আমাকে ছেড়ে ওর কাছে যাবে না।

মেঘ স্যারকে দেখতে পেলাম।আমি ডাকলাম হয়তো শুনলো না।অন্য মনুষ্ক হয়ে আপুর চেম্বারের দিকে গেলো।হৃদ ওয়াশরুমে যেতেই চুপিচুপি ওর চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসলাম আমি।আপুর চোম্বারের দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখলাম স্যার কাঁদছে।তাও আপুর জন্য।আপুর নাম ধরে চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে বলছে,

—“করেছি আমি ভুল মানছি তো।কিন্তু এখন পারছি না তোমাকে ছাড়া থাকতে।কিভাবে বোঝাবো তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।আর একটাবার ফিরে এসো না নূর।আমি আর কোনো ভুল করবো না।তোমাকে আর কস্ট দেবো না।কারও সাথে কোনো অন্যায় করবো না।তুমি তো জানো আমি কেমন জেদি।কাউকে ছরি বলতে পারি না আমি।তুমি কেন বুঝছো না।নিজের থেকে একবার এসো না আমার কাছে।আমাদের সন্তানের জন্য অন্তত।”

বাইরে থেকে স্যারের কথা শুনছিলাম এমন সময় আমার কাঁধে কারও হাত পরতেই কেঁপে উঠলাম আমি।ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম হৃদ দাড়িয়ে আছে।আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

—“এখানে কি করছিস? তোকে বলেছি না আমি? যেখানে যাবি আমাকে বলবি আমি তোকে নিয়ে যাবো! প্রিয়া বা মেঘ যদি তোর আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি করে দেয়।”

আমি হৃদকে ঘুরিয়ে ওর কাঁধে হাত বাঁধিয়ে সামনের দিকে ঠেলে চলতে চলতে বললাম,

—“তুমিও না হৃদ।কোথায় এতোদিন পর আসলাম সকলের সাথে আড্ডা দেবো তা’না সারাক্ষণ তোমার এই এক কথা।”

হৃদ আমাকে টেনে সামনে এনে বলল,

—“এতোদিন যতো যা করেছিস কিছুই বলিনি।কিন্তু এখন না।আমার সন্তানের কিছু হলে তোকে আমি ছাড়বো না।”

আমি হৃদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভ্রু কুচকে বললাম,

—“শুধু তোমার সন্তানের জন্য। তুমি আমায় ভালোবাসো না?”

হৃদ মুচকি হেসে আমার পেটে হাত রেখে বলল,

—“বাসিতো।কিন্তু এখন বেবিটাকে বাসবো।ওর যত্ন নিলে তুইও ভালো থাকবি।”

পাশ থেকে আবির চৌধুরী এসে বলে উঠলেন,

—“নূর আসে নি হসপিটালে?”

আমরা দু’জন উনার দিকে তাকালাম। হৃদ মাথা নাড়িয়ে না উত্তর দিলে উনি বললেন,

—“মেঘ কিন্তু অতোটা খারাপ ছিলো না আগে।ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি ছিলো মেঘ।হঠাৎ একটা মেয়ে ওর জীবনে আসলো।মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই এমন পাগলের মতো আচারণ করছে।আমি তো আমার সেই ছেলেকে এখন আর খুঁজেই পাই না।মেঘ তো ওর বোনটাকে খুব ভালোবাসে।তারজন্য হয়তো বোনের সুখের কথা ভেবে হৃদকে বোনের জীবনে এনে দিতে চেয়েছিলো।তোমরা একটু বোঝাবে নূরকে? ভুল কার না হয়।আমি কাল থেকে যেন অন্য একটা মেঘকে দেখতে পাচ্ছি।কারও সাথে কথাও বলছে না।কিচ্ছু খাচ্ছেও না।এখন হসপিটালের কোথায় আছে কে জানে?”

হৃদ কিছু বলতে যাবে আমি ওর হাতটা ধরে থামিয়ে দিলাম। আবির চৌধুরীকে বললাম,

—“মেঘ স্যার আপুর চেম্বারে।আপুর চেয়ারটার সাথে কথা বলছে।আপুকে ছরি বলছে।”

হৃদ আমাকে টেনে ধরে বলল,

—“কি বলছিস তুই?”

আমি বললাম,

—“ঠিকই বলছি।তোমার ভয়ে তো ভেতরে যেতে পারলাম না।নইতো স্যারকে বোঝাতাম কথাগুলো আপুর সামনে গিয়ে বলতে।”

আবির চৌধুরী আর দাড়িয়ে না থেকে আপুর চেম্বারের দিকে ছুটলো।আমি হৃদকে বোঝাচ্ছি মেঘ স্যার কতটা চেঞ্জ হয়ে গেছে।এরই মধ্যে আবির চৌধুরীর চিৎকারের আওয়াজ পেলাম। হৃদ আর আমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কি হলো? তারপর ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম। মেঘ স্যার আপুর চেয়ারটার দিকে মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে।স্যারের মুখ থেকে রক্ত পরছে।খুব জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে।আবির চৌধুরী স্যারকে ডাকছে কিন্তু সেই দিকে স্যার পাত্তা দিচ্ছে না।আমরা এগিয়ে এসে দাড়াতেই স্যারের মাথাটা নিচে ঢলে পরলো।হৃদ টেবিলের কোণায় রাখা বিষের শিশিটা উঠালো।আর চিৎকার দিয়ে হসপিটালের যতো ডাক্তার নার্স আছে।সবাইকে ডাকলো।সকলের সাথে প্রিয়াও এসে ভীর ঠেলে এমন একটা অবস্থা স্যারের দেখতে পেয়ে খানিকটা দূরে সরে গেলো।একদম থমকে হয়ে আছে প্রিয়া।

স্যারকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে।আপুকে ফোনে বলার সাথে এক মুহূর্ত দেরি না করে হসপিটালে ছুটে এসেছে।অপারেশন থিয়েটারের সামনের বেঞ্চটাতে বসে আছি আমি, প্রিয়া আর আবির চৌধুরী। পাশে দাড়িয়ে আছে মিনি, নিশি।আপু এসেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবে প্রিয়াকে দেখে থেমে গেলো।এগিয়ে এসে প্রিয়াকে ধরে দাড় করিয়ে ওর দু’গালে অনেকগুলো চড় বষিয়ে দিলো।প্রিয়ার মুখের উপর আঙুল উঁচিয়ে বলল,

—“তোমার জেদের জন্য, আবদারের জন্য আজ মেঘের এই অবস্থা। মেঘ আমার থেকে দূরে থাকলেও অতটা কস্ট হতো না যতোটা কস্ট ওর এই অবস্থার কথা শুনে হচ্ছে।মেঘের কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।”

প্রিয়া নিচে বসে পরলো।দু’হাত জোর করে সকলের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চাইলো।নূর আপুকে বলল,

—“হ্যাঁ আমার জন্য ভাইয়ার এই অবস্থা হয়েছে।তুমি তো ডাক্তার ভাবি। আমার ভাইয়াকে বাঁচাও।আমি আর কখনো কারও কাছে কিছু চাইবো না।কোনো আবদার করবো না।”

আপু আর কোনো কথা না বলে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে গেলো।প্রিয়াকে উঠিয়ে বেঞ্চে বসালাম আমি।মিনি, নিশি এগিয়ে আসলে ওদের কাছে আজ পর্যন্ত যতো খারাপ ব্যাবহার করেছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইলো।চার ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে আসলো হৃদ।আমরা সকলে এগিয়ে আসলে হৃদ বলল,

—“টেনশনের কোনো কারণ নেই মেঘ এখন বিপদ মুক্ত। কিন্তু কিছুদিন কথা বলতে কস্ট হতে পারে। নূর এখন কথা বলছে মেঘের সাথে। ওর কথা বলা শেষ হলে কেবিনে শিফট করে দেবো তখন তোমরা দেখা করে নিও।”

আমি একটু এগিয়ে এসে দেখলাম মেঘ স্যার আপুর হাতটা টেনে ধরে আছে আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে,

—“আমি চলে যাবো ছাড়ো তোমার সাথে থাকবো না।একটা ভীতু, কাপুরুষের মতো বউকে ভালোবাসি বলতে পারে না আবার বিষ খাই।ইগো দেখাই।কিভাবে খেলে তুমি বিষ? একবারের জন্যও আমার কথা ভাবলে না।আমাদের সন্তানের কথা ভাবলে না? তোমার বাবা, বোন যাদের তুমি এতো ভালোবাসো।যেই বোনের সুখের জন্য এতো অপরাধ করলে।একবারও ভাবলে না কতো কস্ট পাবে সবাই?”

মেঘ স্যারের কথা বলতে কস্ট হচ্ছে তাই চুপ করে শুধু শুনছে।কিন্তু আপুকে ছাড়ছে না।এটা দেখে আনন্দে আমার গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি বেড়িয়ে আসলো।হৃদ পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

—“ভালোবাসাটা এমনই কেউ বলতে পারি এতো চাই তোকে আবার কেউ বলতে পারে না।অথচ দেখ মেঘও নূরকে ভালোবাসে এটা আমরা কেউ জানতাম না।মেঘ যদি এই কান্ডটা না করতো তাহলে হয়তো ওর ভালোবাসাটা আমরা বুঝতাম না।আবার ইগোর বষে মেঘ কখনো স্বীকার করতো না। ওর জীবনও চলে যেতে পারতো।

হৃদের কথাটা বুঝলাম। আমার কাঁধ থেকে ওর হাত নামিয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—“তুমি খুব ভালো হৃদ।আমি কোনো ভুল করলে অবশ্যই বলবা।আমায় শাস্তি দিবা।এমন কাজ কখনো করবা না।তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।মেঘ স্যার বোকা তাই এমন করেছে।যখন তোমার আমাকে বলতে ইচ্ছে করবে তখনই বলবা ভালোবাসি।”

হৃদ আমার পিঠে হাত রেখে বলল,

—“তাতো বলিই আমি।আমার মতো এতোটা ভালো কেউ বাসতে পারবে তোকে? আমি এতো চাই তোকে যতটা কেউ কাউকে চাইতে পারবে না।”

হৃদের কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে।ওর কথা শুনে আরও ভালোবাসতে মন চাইছে আমার।আই ইউস হৃদ আমাকে সারাটা জীবন এতোটাই ভালোবাসুক।আপু আর মেঘ স্যারও এইভাবে সবসময় সাথে থাকুক।প্রিয়া এবার নিজেকে শুধরে নিক।আবির চৌধুরী নিজের বাড়িতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সুখে থাকুক।আর মা আপু আর আমার টেনশন বাদ দিয়ে নাতি নাতনিদের কথা ভাবুক।কিছুদিন পরই তো ওরা আসবে।না জানি কার মতো হয়।তবে আমাদের বেবিটা যেন আমার মতোই হয়।হৃদ যা তেড়া।ও ঠিক পারবে শাষণ দিয়ে আদর দিয়ে পেলে নেলে বড় করতে।আর আপুর বেবিটা মেঘ স্যারের মতোন হোক।আপুর অনেক অভিজ্ঞতা আছে মেঘ স্যারকে সামলানোর।নইলে কিনা মেঘ স্যারের মতো একটা মানুষ আপুকে এতোটা ভালোবাসে?

।।।।সমাপ্ত।।।।

গল্পটা কেমন লাগলো কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দেন ।
এরকম ভালো সুন্দর সুন্দর গল্প পেতে পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।

পেইজ- নিবেদিতা ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here