বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প #পর্ব-৪৪ #লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

0
897

#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৪৪
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )

( ৩২৬৩ শব্দ সংখ্যা। সবাই কে মেইন ফেসবুক থেকে পড়ার পরামর্শ দেয়া হলো।আর রাতের মধ্যে ৫০০ রিয়েক্ট এর কাছাকাছি হলে এক্সট্রা এক পর্ব দেয়ার পরিকল্পনা করব।)

প্রেগন্যান্সি চলাকালীন যাতায়াত করা খুবই টাফ্ হয়ে যায়।আর শরীর দুর্বল থাকলে তো কথাই নেই।শীত কাল শেষ হয়ে একটু একটু করে গরমের তেজ দেখা মিলছে।গরম অতটা না পড়লেও আজকাল হুর একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘেমে যায়। আগের তুলনায় পেট একটু উঁচু হয়েছে।পাঁচ মাস চলল বলে কথা।হুর শুনেছিল প্রেগন্যান্সির সময় নাকি অতিরিক্ত বমি হয়, জ্ঞান হারায়। কিন্তু তার সাথে এমন কিছুই হয় না। সে নরমাল ই আছে। মাঝে মাঝে একটু দুর্বল হয়ে যায়। তা অবশ্য যাতায়াত করার জন্য মনে হয়।রুদ্ধ তার সাথে আগের মত কথা বলে না। হয়তো তার কথা মান্য করা হয়নি দেখে তাই। এতে আফসোস নেই হুরের। সে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য সব করতে রাজি।যখন থেকে জেনেছে তার গর্ভে ছোট্ট একটি প্রান আছে, তখন থেকে হুরের মাঝে নতুন এক অনুভূতি যুক্ত হয়েছে।মাতৃত্বের অনুভূতি।অনুভূতিটার স্বাদ ঠিক কি রকম বুঝতে পারল না হুর।যেহুতু এই অনুভূতি তাকে সুখ দিচ্ছে তাই “মিষ্টি অনুভূতি”নামে তাকে নির্ধারিত করল।

বিকেলের সময়!কিছুক্ষণ আগে দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল হুর।ইদানিং খুব বেশি ঘুম পায়। যখন তখন চোখ লেগে আসে।তাই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে চোখে ঘুম ভর করল।আস্তে আস্তে চোখের পাতা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।কিছুক্ষণ পর হাতে একটি প্লেট নিয়ে রুমের মধ্যে আসে রুদ্ধ। হুর কে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে লম্বা এক নিঃশ্বাস ছাড়ে। হুরের এত ঘুম তার কাছে ভালো ঠেকছে না।তার ঘুম নিয়ে সে দুশ্চিন্তায় ভুগছে। হাতে ফলের প্লেট টেবিলের ওপর রাখল।প্রথমে ভাবলো হুরকে ডাকবে। পরেক্ষণে মনে করলো কাচা ঘুম ভেঙে গেলে উল্টো মাথা ব্যথা করবে। তাই আর ডাক দিলো না। কথা ছিল ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকআপ করে আসবে। তাই অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করে চলে আসলো হুরের কাছে। এখন না হয় আর একটু অপেক্ষা করা যাক। বউটার তো ভালো মতন ঘুম দিতে পারবে এই অনেক।ফ্রেশ হতে চলে গেল রুদ্ধ। হুরের বাম পাশে বসে কিছুক্ষণ ফোন দেখলো ডাক্তার কে ফোন করে ভিজিটের সময় পরিবর্তন করল।

মিসেস সোনালী খানের কেবিনে বসে আছে হুর আর রুদ্ধ।মিসেস সোনালী প্রথমে হুরের ব্লাড প্রেসার চেক করে নিল।ঠিকই মনে হল।এখন আল্ট্রা করাবে।আল্ট্রা করানোর জন্য মিসেস সোনালীর অ্যাসিস্ট্যান্ট রুদ্ধকে বাহিরে যেতে বললে মিসেস সোনালী তাকে আটকে দেন। যেহেতু রুদ্ধ তার স্বামী সে ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। বিছানায় শুইয়ে পেটের ওপর থেকে কাপড় সরানো হলো। পেটের ওপর সাদা আঠার মত কি যেন লাগানো হলো। তারপর একটা যন্ত্রের সাহায্যে পেটের ওপর রাউন্ড রাউন্ড ঘুরাতে লাগলেন মিসেস সোনালী।।হুর বা রুদ্ধ কোন কিছুই বুঝতে পারছে না।ডাক্তার যন্ত্রটি হুরের পেটের ওপর ঘুরছে আর পাশে থাকা মেশিন টির দিকে মনোযোগী হয়ে লক্ষ্য করছে।ডাক্তার চেক করে রুদ্ধ আর হুরের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি। রুদ্ধ আর হুর কিছুই বুঝতে পারছেনা ।আহাম্মক দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে চেয়ে আছে। তা দেখে ডাক্তার মেশিনের দিকে ইশারা করে বলে।

” আপনাদের বাচ্চা।

দুজনেই মেশিনের দিকে তাকালো।সাদা কালো সবকিছু দেখা যাচ্ছে।কিছু একটা নড়াচড়া করতেই দুজনের নজর থেমে গেল।ভ্রু কুঁচকে রুদ্ধ সেটা বোঝার চেষ্টা করল।কিছু সময়ের মধ্যে ভ্রু শিথিল হয়ে আসলো।বোধ হল এটাই তার সন্তান।পরমহুর্তে আবার মস্তিষ্ক জানান দিল বাম পাশে কিছু নড়ে উঠলো।বিচলিত হলো রুদ্ধর মন।ডাক্তারকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল,

“ওটা কি? নড়ছে কেন এভাবে?

এবার শব্দ করে হেসে দেন ডাক্তার।হাসতে হাসতে এই উত্তর দেন,

“আপনার দ্বিতীয় সন্তান।

বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে গেল রুদ্ধ আর হুরের মুখ।ইতিমধ্যে হুর তো মুখ হাঁ করে ফেলেছে ।হা হয়ে যাওয়া মুখের ওপর হাত রাখতে ভুলেনি।পলকহীন দৃষ্টিতে নিজ দুই সন্তানকে দেখতে পাচ্ছে রুদ্ধ ।যদিও তা অস্পষ্ট। তবে তাই অনেক। ডাক্তার ফের বলেন,

“বেবিদের হার্টবিট শুনতে চান?

প্রশ্ন করলেও উত্তর কেউর কাছ থেকেই পেলেন না ডাক্তার। তাই নিজেই বুদ্ধি বের করে হার্টবিটের সাউন্ড এর মাত্রা বাড়িয়ে দেন। ধ্বকধ্বক করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দুই বাচ্চার হার্টবিট।মাঝে মাঝে শব্দ তুলে চলছে মাঝে মাঝে একটু স্লো হচ্ছে।রুদ্ধ আর হুর যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।আদৌ কি এই ঘোর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব কিনা জানেনা।
বাড়িতে আরেক দফা মিষ্টি খাওয়া হচ্ছে। কারণ এতদিন জানতো না যে হুরের টুইন বেবি হবে।তাই টুইন বেবি হওয়ার খুশিতে আরেক দফা, মিষ্টি মুখ করছে সবাই। এটা অবশ্য ফায়াজের ই আইডিয়া ছিল। কারণ সে চায় না তার ভাতিজি বা ভাতিজার সাথে কোন অন্যায় হোক। দুজনকে এক চোখে দেখা উচিত। তাই দ্বিতীয় বার খুশির সংবাদ শুনে নিজেদের মধ্যেই মিষ্টিমুখ করা হলো।খুশিতে আত্মহারা বাড়ির সদস্যরা।

একসাথে দুইটা নতুন অতিথি আসতে চলেছে। খুশি কেউ ধরে রাখতে পারছে না। এখন আরো কেয়ার ফুল হতে হবে হুরের জন্য।থমথমে মুখ নিয়ে রুদ্ধ সোফায় বসে আছে। সবার আনন্দ বিলাস করা দেখছে।হুর আসার পর থেকেই দাঁত বের করে হেসে চলেছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা অনেক খুশি। কিন্তু রুদ্ধর ঠোঁটে হাসি নেই। মুখ চকচকে নেই। ডাক্তারের কাছ থেকে টুইন বেবির কথা শোনার পর থেকে থমকে গিয়েছে সে। বাকশক্তি হারিয়েছে। হাসপাতালে শুধু ডাক্তারের কথা শুনে গিয়েছে। বিপরীতে কোন কিছুই বলেনি। সে তখন থেকে এই পর্যন্ত বো/বা পদবী লাগিয়ে ঘুরছে।রুদ্ধের দিকে আপাতত কেউর খেয়াল নেই। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হুরকে নিয়ে। রুদ্ধ বাবা হলেও বেবি ক্যারি করছে হুর। তাই হুরের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। রুদ্ধ গোল্লায় যাক তাতে কি!হাটুর উপর দুই কনাই রেখে মাথার চুল খামচে ধরল রুদ্ধ।ডাবল বেবি মানে ডাবল টেনশন।হুর মিলিয়ে হলো ত্রিপল টেনশন।

যেখানে সে একটা বেবিকে মানতে নারাজ সেখানে দুই দুইটা এসে হাজির হবে। মাথা ব্যথায় মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। এত টেনশন নিতে পারছে না। বেশ ভালই তো ছিল একা জীবনে। কে বলেছিল হুরকে তার জীবনে আসতে? আসলো তো আসলো টেনশন বাড়িয়ে দিল। যাক এটা না হয় বাদ ই দেওয়া হল। মেয়েটা তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে বাচ্চাও নিয়ে নিল। খুব সতর্ক থাকতে হবে তাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই খোকনের চ্যাপ্টার বন্ধ করে দিতে হবে। না, হলে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারবে না। যাই হয়ে যাক না কেন বউকে তার চাই।তাই যেভাবেই হোক দুশমনদের বউ এবং তার অপছন্দনীয় বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।সোফায় রুদ্ধকে ভাবুক হয়ে থাকতে দেখে হুর জিজ্ঞেস করে,

“কি হলো আপনার?চিন্তিত মনে হচ্ছে!

ক্ষ্যাপা বাঘ হয়ে হুরের দিকে তাকালো রুদ্ধ। ভড়কে গেল হুর। পূর্বে কিছু করেছে কি না মনে করতে লাগল। মনে পড়ল না। আমতা আমতা করল। তার আগেই রুদ্ধ গর্জে উঠে,

” কি দরকার ছিল ডাবল টেনশন বাড়ানোর?

আহাম্মক হয়ে গেল হুর। ডাবল টেনশন! কিসের ডাবল টেনশন? সে তো কিছু করেনি। তাহলে টেনশন করছে কেন রুদ্ধ?সোফার রুমে ফায়াজ আর সোহেল শেখ ও আসলেন।হুর আর রুদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন তাদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব হচ্ছে। তাই তাদেরকে স্পেস দিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে সরে গেলেন। সোহেল শেখ চলে গেলও ফায়াজগেল না। সোফায় বসে থেকে ভাই আর ভাবীর দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনেই চুপ করে আছে। মনে মনে ভাবতে লাগলো,

“আরে ভাই ঝগড়া করার থাকলে জলদি কর। এত সাসপেন্স এর মধ্যে কেন রাখছিস? কতদিন ধরে বউ জামাইয়ের ঝগড়া দেখিনা। এখন যা একটু সুযোগ পেলাম তাও দুজন চুপ করে আছিস। উম..এ ঝগড়া কে মৌন ঝগড়া বলা যায়।

আর বেশিক্ষণ ফায়াজ কে অপেক্ষা করতে হলো না।

“আমি তো কিছুই করিনি। তাহলে ডাবল টেনশনের কথা কোত্থেকে আসলো?

বসা থেকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো রুদ্ধ। হকচকিয়ে কয়েক কদম পিছে চলে গেল হুর।টি টেবিলের সাথে বারি লাগবে তার আগেই রুদ্ধ তাকে ধরে নিল।কন্ঠ খাদে নামিয়ে চোখ গরম করে বলল,

“যেখানে আমি একটা বেবিকে মানতে পারছি না সেখানে তুমি দুই দুইটা বেবি ক্যারি করছ।

মাথা নত করে নেয় হুর।রাগে তার শরীর রি রি করছে।সে কি ইচ্ছে করে দুইটা বাচ্চা নিয়েছে নাকি?আর একটা হোক বা দুইটা, তাতে কি?ডাবল বাচ্চা মানে ডাবল খুশি। কিন্তু না।এই লোকটার তো খুশি ভুলে টেনশন নিয়ে পড়ে আছে।আর এমন ভাবে বলছে যেন সে নাদান।স্বার্থপর স্বামী যদি তাকে এত এত আ/দর না করতো তাহলে কি বাচ্চারা পেটে আসত?ভাব এমন যে, সে কিছুই করে নি।সব দোষ পড়েছে এখন তার ঘাড়ে।হুরের মনের কথা ফায়াজ বলে দিল।

” আরে ভাইয়া এভাবে ভাবীকে বকছো কেন?ডাবল বেবি মানে ডাবল খুশি।তুমি এক সাথে দুই বাচ্চার বাবা হচ্ছো তাতে কি তুমি সুখী না?

রুদ্ধ শক্ত কন্ঠে বলে,

“না,আমি সুখী না।বউ আমার। তবে বাচ্চা আমার না।

ফ্যালফ্যাল করে ফায়াজ তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে সন্দেহের জটলা বাধলো।রুদ্ধ প্রথম থেকেই এক কথা বলছে “বউ আমার কিন্তু বাচ্চা আমার না”তার মানে হুরের পেটে অন্য কেউর বাচ্চা। রহস্য উন্মোচন করে যেমন খুশি হল। তেমন দুঃখী ও হল।তবে ব্যাপার না। বাচ্চার বাবা যেই হোক না কেন তাতে কি?বাচ্চা হবে তাতেই অনেক। এবং রুদ্ধর নামে পরিচয় পাবে তাই ঢের।আকাশকুসুম অনেক কিছু ভেবে চেহারায় দুখী ভাব নিয়ে ফায়াজ রুদ্ধকে বলে।

“ভাই তুমি কষ্ট পেও না।বেবিরা হওয়ার পর তোমার কাছে থাকবে না। তুমি তাদের এখন জন্ম হওয়ার আগ থেকেই দেখতে পাচ্ছো না।আর যখন তারা হবে তাদের তো আছাড় দিতেও ভুলবে না।আমি তাদের যত্ন করব।আমি সবসময় তাদের আমার কাছে রাখব। খেয়াল রাখব তারা যেন তোমায় ডিস্টার্ব না করে। তুমি একটা কাজ করো বেবিদের বাবার কাছ থেকে কাস্টাডি নিয়ে নাও।তাহলে আর কখনও কোনো ঝামেলা হবে না।

ফায়াজের কথা শুনে রুদ্ধর কানে সুন করে এক শব্দ হতে লাগলো।কিছু পল্লব বেআক্কেল এর মত তাকিয়ে রইল।ফায়াযের ইঙ্গিত বুঝে তৎক্ষণাৎ শিরা-উপশিরায় রাগের আভাস পেল।মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মুঠো হয়ে আসলো শক্ত দুটি হাত। ফায়াজের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে দাঁত কিরমির করে জিজ্ঞেস করল।

“কার কাছ থেকে কাস্টাডি নিব?

ফায়াজের সহজ সরল উত্তর,
“বেবিদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে।

একই ভঙ্গিতে আবার রুদ্ধ বলে।
“বেবিদের বাবা-মা আমরা দুজনই।

সমীকরণে নড়চড় হল।সন্দেহর জটলা একটু খুলে গেল, পুরোপুরি ভাবে খুললো না। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো মস্তিষ্ক তার কাজ করছে না। বো/কা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল।

” মানে?

“মানে বেবিদের বাবা আমি আর মা হচ্ছে হুর।

চমকে উঠল ফায়াজ।রুদ্ধর ভেতর দুইটা রূপ আছে। এই পজেটিভ তো এই নেগেটিভ। ভুলভাল কথা বলে দেয়ার অভ্যাসও আছে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বলল বউ তার বাচ্চা তার না। এখন আবার বলছে সে নাকি বাচ্চার বাবা। কোন দিকে যাবে ফায়াজ?আচ্ছা, রুদ্ধ তাকে ইচ্ছে করে গোলক ধাঁধায় ফেলছে না তো?হয়তো তাই।

“বেবিরা যদি তোমার হয় তাহলে তুমি বারবার কেন বলো বউ তোমার কিন্তু বেবিরা তোমার না?বেবিরা যদি তোমার না হয় তাহলে কেউ না কেউ তো হবে।

“ওই কেউটাই হচ্ছি আমি।আর তোমার সাহস তো কম না আমার বাচ্চাদের তুমি অন্যের বাচ্চা বানিয়ে দিলে?এখন কি নিজের বাচ্চার জন্য কাস্টাডি লড়তে হবে নাকি?

“কিন্তু….

থামিয়ে দেয় রুদ্ধ।বলে,

“এই বলদটার সাথে থাকতে থাকতে দিন দিন তুমিও বলদ হয়ে যাচ্ছ।আমার বউয়ের পেটে অন্যের বাচ্চা থাকবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব এমনটা মনে হয় আমাকে?জা’ন বের করে দিব সবার। প্রয়োজন হলে বউকেও খতম করে দিব।তারপর বাড়ির পিছে কবরে দাফন করে সংসার করবো।তবুও বউকে অন্যের হতে দিব না।

————————————
পরদিন।গার্ড নিয়ে কলেজে চলে আসলো হুর।ঢিলে ঢালা কাপড় পড়ে আসতে হয় তাকে।এক্সট্রা ক্লাস থাকায় আজ একটু লেট হয়েছে ছুটি হতে।কলেজ থেকে বের হয়ে সোজা ঢুকে পড়লো গাড়িতে।গাড়ি চলতে থাকল তার নিজস্ব গতিতে।গার্ডরা পিছনের গাড়িতে আসছে। সবই ঠিকঠাক চলছিল। গাড়িতে বসে হুর ফোন স্ক্রল করছিল। ফোন স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ কাঁচের জানালা ভেদ করে রাস্তার দিকে। সাথে সাথে চোখ কুঁচকে নেয়। মনে করার চেষ্টা করে এই রাস্তাটা কি আদৌ সে চেনে নাকি!চিনতে না পেরে ড্রাইভার এর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“আঙ্কেল এটা তো আমাদের বাড়ির রাস্তা না। কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

ড্রাইভার এর কাছ থেকে কোন উত্তর আসলো না। চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগলো।হুর একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠল,

“কি হলো বলছেন না কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

ড্রাইভার এবার মাথা উঁচু করে ফ্রন্ট মিরর দিয়ে হুরের দিকে তাকায়। ফ্রন্ট মিররের দিকে তাকাতেই হুর চমকে উঠে।এটা তো তাদের ড্রাইভার আঙ্কেল না।অচেনা এক লোক। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসলো হুরের। ঘাবড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কে আপনি? এখানে কি করছেন? আর ড্রাইভার আংকেল কই? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

হুরের কথা শুনে লোকটি হো হো করে হাসতে লাগলো। যেন হুর খুব সুন্দর একটি জোকস শুনিয়েছে।

“আপনার ড্রাইভার আংকেল তার আসল জায়গাতে আছেন। তাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আপনি এখন শুধু নিজের জন্য চিন্তা করুন। আর একদম ভয় পাবেন না। আপনাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে কষ্ট হবেনা আপনার। আর বেশি উত্তেজিত হবেন না। না, হলে এতে আপনার বাচ্চার ক্ষতি হবে।

ভয়ে ঢোক গিললো হুর।মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে জায়গাটা দেখতে লাগলো। রাস্তা পুরো ফাঁকা।গাড়ির নাম নিশানা পর্যন্ত নেই। হঠাৎ গার্ডদের কথা মস্তিষ্কে আসলো। দ্রুত গতিতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তাদের গাড়ি নেই। আরো ঘাবড়ে গেল হুর। গার্ডরাও উধাও হয়ে গেছে। এখন কি করবে হুর? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকে? কিভাবে বাঁচাবে তার বাচ্চাকে? বড্ড অসহায় মনে হল। নিমিষেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পেটের মধ্যে হাত রেখে কিছুক্ষণ বুলানো। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। কিছুতো একটা করতে হবে।সে বলে,

“প্লিজ আমার বাসায় যেতে দিন। আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি।তাহলে আপনি আমায় কেন নিয়ে যাচ্ছেন? প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন। আপনার দুটো পা পরি। ছেড়ে দিন আমায়।

কঠিন তেজে লোকটি বলল,

“আপনাকে তুলে আনার জন্য অর্ডার পেয়েছি। ছেড়ে দেয়ার জন্য না। তাই চুপচাপ বসে থাকুন। কোন প্রকার চিল্লা চেঁচামেচি করবেন তো আপনার জা’ন নিতে ২ মিনিটও সময় লাগবে না আপনার।

বলেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে হুরকে দেখালো। অশ্রুসিক্ত নয়ন মুহূর্তে এই বড় বড় হয়ে আসলো। ওড়না চেপে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলো।

প্রায় ৪৫ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে একটি বাংলোর সামনে গাড়ি থামল। লোকটি গাড়ি থেকে নেমে হুরের পাশের দরজা খুলে দিল। গাড়ি থেকে বের হতে চাইলো না হুর। ভীষণ শুনশান বাংলোটি। আশেপাশে কোন ঘর নেই। বাংলোটি দেখে অনেক পুরাতন মনে হচ্ছে। রং করা হয় না কত বছর ধরে! সাদা রঙের উপর কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। বাংলোর চারিপাশে গাছগাছালি। দেখতে খুবই ভয়ঙ্কর পরিবেশ। অচেনা মানুষের সাথে অচেনা এক ভুতুড়ে জায়গায় এসে ভয়ের মাত্রা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। হুরকে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে লোকটি বলল,

“বেরিয়ে আসুন।ভেতরে বস অপেক্ষা করছে।

অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে ভেজা গলায় হুর বলে,

“আমি যাব না। কোথাও যাবো না আমি।আমায় প্লিজ ছেড়ে দিন। যেতে দিন আমায়।

“আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কোথায় যাবেন? আপনি কি আদৌ জানেন আমরা কোথায় এসেছি?আপনার শরীরে হাত দেয়া বারণ। তাই শরীরে হাত দিয়ে কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। এখন যদি আপনি আমার কথা না শুনেন তাহলে আপনার শরীরে হাত দিতে বাধ্য হব।

চমকে উঠে হুর। কিছুক্ষণ ভেবে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে।হুরকে সামনে রেখে পিছন পিছন লোকটি আসছে। লোকটি যেভাবে বলছে সেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে হুর।কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলে এসেছে। অতিরিক্ত টেনশন আর কান্নায় শরীর দুর্বল হয়ে এসেছে।আবার দুপুরের খাবার ও খায়নি।বাংলার ভেতরে প্রবেশ করে বিদঘুটে এক গন্ধ নাকে আসলো। সাথে সাথে নাক চেপে ধরল হুর।বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। গড়গড় করে বমি করে দিল।বমি করে দুর্বল মুখ নিয়ে মাথা উঁচু করতেই সামনে থেকে কাউকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। লোকটি হুরের কাছে এসে হুরকে ধরতে চাইল। সাথে সাথে পিছিয়ে গেল হুর।লোকটি হুরকে ধরতে চেয়েও ধরল না। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো হুরের পানে।

“জা’ন জা’ন তুমি ঠিক আছো?কষ্ট হচ্ছে তোমার?বকুল! এই বকুল জলদি পানি নিয়ে আয়।

দৌড়ে বকুল পানি নিয়ে আসলো।লোকটির হাতে দিতেই বোতলের ঢাকনা খুলে হুরের দিকে এগিয়ে দিল।হুর তাকিয়ে থাকলেও বোতল হাতে নিল না। তা দেখে লোকটি বলল,

” প্লিজ জা’ন পানিটুকু খাও।ভালো ফিল হবে।

হুর নিজেও বুঝলো তার এখন পানি খাওয়া খুব জরুরী।দ্বিধা নিয়ে লোকটির হাত থেকে পানি মুখে নিল।কুলি করতে হবে। কিন্তু মুখের পানি কোথায় ফেলবে! চোখ বুলিয়ে পানি ফেলার মত আশেপাশে জায়গা খোজার চেষ্টা করল।পেল না। হুরের মতিগতি বুঝে লোকটি বলল,

“জা’ন তুমি এখানেই পানি ফেলো।

লোকটির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে হুর। চেনা চেনা মনে হচ্ছে। তাও যেন অচেনা।মাথায় একটু প্রেসার দেয়ার পর মনে পড়ল এটা সেই লোক যিনি নারী পাচারকারীর কাজের সাথে লিপ্ত আছে।রুদ্ধকে যেদিন গ্রেফতার করা হলো সেদিন এই লোকটিকে নজরে পড়েছিল। তাই হয়তো চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। রুদ্ধ এই লোকটির নাম বলেছিল। কিন্তু মনে পড়ছে না তার। তার সাথে আর একটা কথাও বোধগম্য হচ্ছে না। লোকটি তাকে বারবার জা’ন বলে সম্মোধন করছে। এত চাপ নিলোনা। কুলি করে পানি সেখানেই ফেলে দিল। মেইন দরজার কয়েক ধাপ এগিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে। কুলি করে পানি খেয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে এখানে আনার উদ্দেশ্য ঠাহর করতে পারছে না।তবে ভালো কিছু যে হবে না তা ঠিকই আন্দাজ করতে পারল। লোকটি হুরের দিকে তাকিয়ে অদূরে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“ভালো লাগছে এখন?

মাথা উঁচু করে লোকটির দিকে দৃষ্টি রাখল।ভরা চোখ নিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল,

“আমায় যেতে দিন।

অন্ধকারের মাঝেই হুর বুঝতে পারলো লোকটির চেহারার ভাব পরিবর্তন হলো। শীতল দৃষ্টি আচানক রাগে পরিণত হলো। রাগ নিয়ে উত্তর দিল,

“ভুলেও আর এই কথা বলবে না জা’ন।বহু কষ্টে তোমায় আমি এখানে আনতে পেরেছি।এখন আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না। প্রয়োজন পড়লে খাঁচায় বেঁধে রাখবো তোমায়। তারপরও তোমায় ছাড়বো না। আর হ্যাঁ এসব বা ছাড়াছাড়ির কথা বলে আমার মাথা নষ্ট করবে না। তোমার সাথে আমি রাগারাগি করতে চাই না।

“আমার ভীষণ ভয় করছে প্লিজ আমাকে যেতে দিন।জায়গাটি ভীষণ ভুতুড়ে।

রাগান্বিত চেহারায় কেউ যেন এক চিলতে মায়া ঢেলে দিল।বকুল কে আবার আদেশ দেয়।

“বকুল পুরো বাড়ির বাতি জ্বালিয়ে দে। কোথাও যেন একটুকুও অন্ধকার না থাকে।জ্বলজ্বল করা চাই পুরো বাড়ি।

আদেশ পেয়ে দৌড় লাগালো বকুল।মিনিটের মধ্যে বাড়ির সকল বাতি জ্বলে উঠলো।হঠাৎ ড্রয়িং রুমের এত বাতি একসাথে জ্বলার দরুন হুরের চোখে এসে লাগলো। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল। পুনরায় আস্তে আস্তে চোখ খুলে নজর বুলালো পুরো বাড়ির দিকে।বাড়ি পরিষ্কার থাকলেও জিনিসপত্র পুরাতন আমলের।হুরকে ভয়ে সিটে থাকতে দেখে আশ্বাস দিয়ে বলে,

” জা’ন ভয় পেও না।কেউ কিছু করবে না তোমার। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

অভয় দিলেও ভয় কমে না হুরের।ভীত হয়ে আশপাশ দেখতে থাকে।হুরের দুর্বল মুখ দেখে লোকটি বলে,

“তোমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে তাই না?তুমি বসো। কিছুক্ষনের মধ্যে খাবার আসছে।

“আমায় এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?আমি বাসায় যাব প্লিজ আমার বাসায় দিয়ে আসেন।

“এখন থেকে তোমার এটাই বাসা।চিরজীবনের জন্য তুমি এখানে থাকবে।

উত্তেজিত হয়ে যায় হুর। গলার স্বর বাড়িয়ে বলে,

“কি সব বলছেন আপনি? আমি কেন এখানে সারা জীবনের জন্য থাকব? আমি আমার বাড়িতে যাব। আমি রুদ্ধর কাছে যাব।

বলেই পিছন ফিরে দৌড় দিতে লাগলো ।তার আগেই লোকটি হুরের বাহু টেনে ধরল। টেনে নিয়ে যেতে লাগলো ভেতরে। হুংকার ছেড়ে সব গার্ডদের ডাকল। গার্ডরা আসতেই কঠিন স্বরে আদেশ দিল,

“ও যেন কোন মতেই বাড়ি থেকে বের না হতে পারে।লক্ষ্য রাখবে সবাই।

হুরকে টেনে দ্বিতীয় তলার একটি রুমের মধ্যে নিয়ে গেল।বিছানায় বসিয়ে অতি শান্ত স্বরে বলল।

“এ বাড়ি থেকে এক কদম বাহিরে পড়লে তোমার সাথে কি হবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।নিজেকে এবং নিজের বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে আমি যা বলছি তাই কর। চুপচাপ বসে থাকো।

নিজের রাগ দমাতে পারল না হুর।বসা থেকে উঠে চিল্লিয়ে বলে উঠলো।

“কি করবেন কি আপনি আমার সাথে?কেন নিয়ে এসেছেন আমায়?কি করেছি আমি?আমায় যেতে দিন। নাহলে আমার স্বামী আপনায় আস্ত রাখবে না।খু/ন করে ফেলবে।আপনি কার বউকে তুলে এনেছেন তা কি ভুলে গেছেন?

” ভুলবো কেন?আমার স্বরনে আছে তুমি কার বউ!এবং একটু পর অন্য কারো বউ হয়ে যাবে।আর তুমি কি মনে করেছো আমি ভয় পেয়ে যাব রুদ্ধর কথা বললে?ভেরি ফানি!রুদ্ধ কিছুই করতে পারবে না আমার।

হুরের কানে গুজলে লাগল “একটু পর অন্য কারো বউ হয়ে যাবে”।আনমনে জিজ্ঞেস করলো,

“একটু পর অন্য কারো বউ হয়ে যাব মানে?

” আমার বউ হবে তুমি। আমি হব তোমার স্বামী।আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে পরিচয় পাবে।

“কখনও না।আমার জীবন থাকা অবস্থায় আমি কখনও দ্বিতীয় বিয়ে করব না। আমি আমার স্বামী নিয়ে খুব সুখী আছি।আর আপনি ভাবলেন কিভাবে আপনাকে আমি বিয়ে করব?

“আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য তুমি।

“সময় থাকতে সতর্ক করে দিচ্ছি। ছেড়ে দিন আমায়।না,হলে…

” না,হলে কোনো কিছুই না।তুমি বিয়ে না করতে চাইলে তোমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হব আমি।

আঁতকে উঠল হুর।হাত চলে গেল পেটে।রাগে,ক্ষোভে,কষ্টে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে যাচ্ছে।

“আপনার কি মনে হয় বাচ্চাকে মেরে ফেললে আমাকে পেয়ে যাবেন?কখনও না।আমার উপর একমাত্র অধিকার আমার স্বামীর।আর আমি থাকতে আমার বাচ্চার ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।

” আচ্ছা যাও মারব না তোমার বাচ্চাকে।তোমার বাচ্চাসহ আমি তোমায় গ্রহণ করব।নিজের সন্তান এর মতো তাকে স্নেহ করব।তুমি কোনো রূপ ঝামেলা না করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। অন্যথায় অন্য পথ আমায় বেছে নিতে হবে।যা তোমার ভালো লাগবে না।হারাতে হবে অনাগত বাচ্চাকে।অনেক ভালোবাসি জা’ন। প্লিজ ঝামেলা না করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। অনেক অপেক্ষা করেছি।অনেক রাত জেগেছি। অনেক স্বপ্ন বুনেছি তোমায় নিয়ে।প্রতিদিন তোমায় না পাওয়ার বেদনা আমায় পীড়া দেয়। ছারখার হয়ে যায় হৃদয়।জানো কত দিন পর তোমার এত সামনে থেকে দেখছি?প্রায় ৪ টা মাস পর দেখে হৃদয় শান্ত হচ্ছে আমার।

……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here