অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-২

0
273

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

“একলা, একলা কই যাও সুন্দরী? আমাদের সঙ্গে নিলেও তো পারো। তোমার রুপের সুধা পান করতে দিলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না জান।”

ছোট বাচ্চাদের একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায় ঝুমুর। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা পায়। বাবা’র টাকা থাকা স্বত্তেও নিজের জন্যই এই কাজটা আনন্দ নিয়ে করে সে। কিন্তু ওকে উক্তক্ত্য করতে বখাটেগুলো এখান অবধি এসে পড়বে তা ভাবেনি। কোচিং শেষে বের হতেই এ কথাগুলো শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠলো ওর। সামনের রাস্তাটা ফাঁকা। ও দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু ওর ভয়টা আরও বেড়ে গেলো যখন দেখলো ছেলেগুলো ওর পিছু নিয়েছে। ও ঘাবড়ে গিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লো। ভয়ে রীতিমতো ঘাম ছুটে গেছে ওর। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বাবাকে কল করলো, কিন্তু ধরলো না শামসুল হক। ভাইকে ফোন দিতে গিয়ে মনে পড়লো ইয়াসিফ আজ সকালেই সিলেট চলে গেছে। তার ভার্সিটিতে এক্সাম আছে। ঝুমুরের মাথা কাজ করলো না। এই বিপদের সময় একমাত্র তাখলিফের চেহারাটাই মানসপটে ভেসে ওঠলো। ঝুমুর চায় না ওকে বিরক্ত করতে। কিন্তু আসন্ন বিপদ দেখেই বাধ্য হয়ে কল করলো ওকে। এবং বরাবরের মতোই ফোনটা রিসিভ করলো না তাখলিফ। ঝুমুরের অভিমান হয় ভীষণ! সাহায্য নিবে না ভেবেও ম্যাসেজবক্সে গিয়ে টাইপ করে,
“আপনি কি অফিসে? একটু কি আমাকে নিতে আসবেন? আমার খুব ভয় করছে।”

ম্যাসেজটা সিন হলো সাথে সাথেই। যেন ফোন হাতে নিয়েই বসেছিলো তাখলিফ। আর অপেক্ষা করছিলো ঝুমুর কখন ম্যাসেজ করবে। ঝুমুরের বড্ড হাসি পেলো। এই লোকটা এত অদ্ভুত! সবসময় এড়িয়ে চলতে চায়, দূরত্ব বজায় রাখতে চায় ওর থেকে। কিন্তু দিনশেষে প্রকৃতি তা হতে দেয় না। ঝুমুর আবারও ম্যাসেজ লিখে, “আসবেন?”

উত্তর আসে অনেকক্ষণ পর।
“কোথায় তুই? গর্ত থেকে বেরিয়ে আয়।”

ঝুমুর বেরিয়ে আসে। এদিকসেদিক তাকাতেই দেখে ফোন হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাখলিফ। আশেপাশে বখাটেগুলোর অস্তিত্ব নেই। ঝুমুর স্বস্তি পায়৷ এই তাখলিফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে এমন সাহস কোনো বখাটের নেই৷ ওকে দেখে হনহনিয়ে হেঁটে আসে তাখলিফ। ধমক দিয়ে বলে, “কই? এখানে ইঁদুর-বিড়াল কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। তুই ভয় পেলি কি দেখে?”

ঝুমুর বলল, “ইঁদুর-বিড়ালকে তো আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে দেখবেন কি করে?”

তাখলিফ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে চাকরি করে। ওকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে সোজা অফিস থেকে এখানে এসেছে। নয়টা-ছয়টা অফিস করে চেহারায় মিশে আছে ক্লান্তি! ঘর্মাক্ত কপাল মুছছিলো রুমাল দিয়ে, ঝুমুরের কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে ছোট ছোট চোখ করে তাকায়। এরপর শক্ত গলায় বলে,
“চল।”

ঝুমুর আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
“আপনার অফিস ছুটি?”

তাখলিফ পকেটে রুমাল রাখতে রাখতে বিরক্ত গলায় বলে, “তোর এত জানার কি? আসতে বলেছিস এসেছি। বসতে দিলে শুতে চাস এই মেয়েমানুষের জাত তোরা!”

ঝুমুরের মুখ কালো হয়ে গেলো। এই লোকটা জীবনেও ওর কোনো ভালো কথার জবাব দিবে না। ও বিষন্ন গলায় বলে, “আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি, আসলে আব্বু ফোন ধরছিলো না তাই আপনাকে বলেছি। আপনি কি রাগ করেছেন?”

তাখলিফ বিরক্ত হয়ে বলে, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ন্যাকামি আর ঘ্যানঘ্যান করতে থাক। আমি গেলাম।”

বলে সোজা হাঁটা ধরে। ঝুমুরও ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। তাখলিফ একবার দেখে ওকে, কিছু বলে না। গলি পেরিয়ে তারা মেইনরোডে এসে পড়ে। সন্ধ্যা নামছে। আকাশ অদ্ভুত রঙিন। হালকা বাতাস বইছে। পিচঢালা রাস্তায় চলছে ব্যস্ত মানুষ, রিকশা, কার, বাস। শহুরে পরিবেশটা আচমকাই হয়ে ওঠে অনিন্দ্য! সামনে হাঁটতে থাকা লম্বা দীর্ঘদেহী মানুষটিকে অনুসরণ করতে থাকে ঝুমুর। এই অসময়ে, তাকে রক্ষা করতে আসা এই মানুষটির প্রতি আচমকাই বাঁধভাঙা ঢেউয়ের ন্যায় ঝুমুরের মনে প্রেম জাগে। বড় বড় পা ফেলে তাখলিফের সাথে সমানতালে হাঁটতে গেলেই তাখলিফ ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ওকে। এরপর হঠাৎই একটা রিকশা ডেকে তাতে ওঠে পড়ে সে। ঝুমুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখের কোণে জমে জল। ও পাশাপাশি হেঁটেছে বলেই কি এই আচরণ? হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তা মুছে সামনে পা বাড়াতেই তাখলিফ মুখ শক্ত করে বলে “ওঠে পড়। গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

ঝুমুরের পছন্দ হয় না ওর বলার ধরণটা। এভাবে না বলে একটু ভালো করে বললে কি হয়? সবসময় এমন করে লোকটা! ও মুখ কালো করে প্রশ্ন করে, “আমার সাথে এক রিকশায় বসবেন আপনি? পরে না ধাক্কা মেরে ফেলে দেন৷ তাহলেই তো আপনার জীবনের বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”

তাখলিফ রেগে যায়, “একটা থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে
দেবো বেয়াদব। ইদানীং বেশি ফটরফটর করছিস। গেলে যাবি না গেলে ভাগ!”

বাধ্য হয়ে ঝুমুর রিকশায় ওঠে বসে। তাখলিফ খানিকটা সরে বসে। দু’ইঞ্চির সামান্য দূরত্ব বজায় রাখে। ঝুমুর তা দেখে বলে,”আপনি পুরোদস্তুর
একটা যাচ্ছেতাই।”

তাখলিফ বিরক্ত হয়ে ধমক দেয়, “বেশি সাহস বেড়েছে?
মুখ সেলাই করে দেব।”

ঝুমুর প্রসঙ্গ পাল্টে নরম সুরে জিজ্ঞেস করে,
“খেয়েছেন দুপুরে?”

অধিকারসূচক জিজ্ঞাসা। তাখলিফ শান্ত হলেও
উত্তর দেয় না। ঝুমুর ব্যাগ থেকে একটা অরেঞ্জ ফ্লেভারের কেকের প্যাকেট বের করে ওর সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, “খাবেন?”

অরেঞ্জ ফ্লেভারের কেক দারুণ পছন্দের তাখলিফের। ঝুমুর সেটা জানে। কিন্তু তাখলিফ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে “না” বলে দেয়। ঝুমুরের চোখ ছলছল করে ওঠে। ওড়নার কোণ দিয়ে সেটা মুছে নেয় সাথে সাথেই। এই পাষাণ লোকটাকে সে চোখের পানি দেখাতে চায় না একদমই। ব্যাগে ফোন বেজে ওঠে। বাবার ফোন দেখে রিসিভ করে ঝুমুর। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে আসে, “ফোন দিয়েছিলি? আমি তো কাজে ছিলাম। ফোন ড্রয়ারে ছিলো দেখিনি। কোথায় তুই?”

“বাড়ি ফিরছি। টেনশন করো না। ভেবেছিলাম
তুমি নিতে আসবে নাকি!”

“এখন আসবো?”

“নাহ। প্রায় এসেই গেছি।”

“সাবধানে আসিস। রাখি তবে।”

“হুম।”

ঝুমুর ফোন রেখে দেয়। পাশে বসা তাখলিফ ভাবলেশহীন। দৃষ্টি ওর বাইরে, রাস্তায়। যেন ওর পাশে বসা এই রমনীটির ভালো-মন্দ, হাসি-কান্নায় ওর কিছু আসে যায় না। অথচ ওর সবকিছুর সাথে জড়িয়ে আছে এই রমনীটির ভালো থাকা! বোঝে কি এই পাষাণ মানবটা? ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে।

___________

ইয়াসিফ চলে গেছে বলে মন ভালো নেই পাখি বেগমের। খানিকক্ষণ পরপর ফোন করে ছেলেকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছেন আর হু হু করে কাঁদছেন৷ একটা মাত্র ছেলে তার। কত আদরের! সেই ছেলে হলের বাসি-পচা খাবার খাবে আর তিনি বাড়িতে আরাম করে খাবে তা হয় না। প্রমিলা বড় জা’য়ের মন খারাপের কারণ বুঝতে পেরেই আর ঘাঁটালেন না তাকে। প্রতিবার ইয়াসিফের চলে যাওয়ার দিনটা পাখি বেগম এমনই বিষন্নভাবে থাকেন। পরদিন আবার স্ন ঠিকঠাক। প্রমিলা তাই রাতের রান্নার যোগাড়
নিজেই করলেন। ঝুমুর এসে তাকে জোর করে সাহায্য করতে চাইলে প্রমিলা হেসে বললেন,
“বাপের বাড়িতে আছিস আবার রান্নার দায়িত্ব
নিচ্ছিস কেন? শ্বশুরবাড়ি গেলে তখন এসব করিস। আজকালকার শ্বাশুড়িরা খাটিয়েই মেরে ফেলবে।
যা এখান থেকে।”

ঝুমুর আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
“আমার শ্বাশুড়ি নেই, তাই এসব চিন্তাও নেই।”

“কিহ?”

প্রমিলার বিস্মিত কন্ঠস্বর শুনে ঝুমুর ভড়কে গেলো। বেফাঁসে এটা কি বলে ফেললো সে! এখন কি বলে পরিস্থিতি সামলাবে? প্রমিলার সন্দেহী দৃষ্টি দেখে ঝুমুর হাসার চেষ্টা করে বলল, “মানে শ্বাশুড়ি নেই এমন পরিবার দেখে বিয়ে করবো চাচী।”

“সেটাই ভালো হবে। দেখলি না সেদিন তোর আব্বা কি একটা সম্বন্ধ আনলো, ছেলে মায়ের ভক্ত। এসব ছেলেপেলের সাথে আর যাইহোক সংসার করা অসম্ভব!”

ঝুমুর কথা বলে না। প্রমিলাও রান্নায় মনোযোগ দেয়। ঝুমুর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কি যে হয়েছে ওর! সাজেদা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই প্রমিলা জিজ্ঞেস করে, “কিছু লাগবে আম্মা?”

সাজেদা খ্যাকখ্যাক করে বলেন,
“মাথাটা ঘুরে। তেল দিতাম। নিশি-তিথির পরীক্ষা। ওরা পড়ে। হাতে তেল লাগলে তো লিখতে অসুবিধা হইবো। এই ঝুমু তুই দিয়ে দিবি, নাকি
তোরও পরীক্ষা?”

ঝুমুর উত্তরে বলে, “যাও যাও, আমিই দিয়ে দেবো। তবে আমাকে জোর করা যাবে না। তোমার মতলব তো জানি, নিজেও দেবে সাথে আমাকেও ভুলিয়ে ভালিয়ে দিয়ে দেবে। তেল দিতে আমার ভালো লাগে না। এছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।”

সাজেদা আদুরে স্বরে ধমক দিয়ে বলেন, “এই তেল দিয়া দিতাম দেইখাই চুলগুলান লম্বা হইছে। নয়তো ঝাড়ু হইয়া থাকতো।”

“হলে হবে।”

প্রমিলা দাদী-নাতনির খুনসুটি দেখে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে, “আমাদের ঝুমু পুরোদস্তুর গৃহিনী হয়ে গেছে, তাই না আম্মা?”

সাজেদাও পুত্রবধূর সাথে তাল মিলিয়ে গর্ব করে বলেন, “দেখতে হইবো না নাতনি কার। একটা রাজপুত্র দেইখা বিয়া দিমু ওরে। যে আমার নাতনিরে কোনো কাজই করতে দিবো না। দিনরাত ভর ভালোবাসবো, আদর করবো।”

ঝুমুরের মুখশ্রী বদলে গেলো। চেহারায় মেঘ জমলো। দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন করে ধীর স্বরে বলল,
“তোমরা এত বিয়ে বিয়ে করো কেন? আমার
অসহ্য লাগে। দয়া করে এই প্রসঙ্গ আর তুলো না। আমি আর বিয়েই করবো না।”

“বাব্বাহ! এমনভাবে বলছিস যেন তুই আগে অনেক বিয়ে করে রাখছিস!”

দাদীর ঠাট্টা শুনে ঝুমুর হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।
মাথা কাজ করছে না কেন আজ? বারবার ভুলভাল কথা বলছে। কেন বলছে নিজেও জানে না। অথচ যার জন্য ওর এই অবস্থা সেই লোকটা দিব্যি আছে! এদিকে তার জন্য ভেবে ভেবে ঝুমুরের মাথা খারাপ হওয়ার দশা!

_____________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মাত্র শুরু, আস্তে আস্তে বুঝে যাবেন।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here