এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ৪২

0
142

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪২

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারিশ আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। তার যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্রিতা এখন আর এই মুহূর্তেই কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে। ফারিশের এই আচমকা ঘুম ভাঙিয়ে বিয়ের করার ব্যাপারটা টোটালই হজম হচ্ছে না। ফারিশ কিছু সময় চুপ থেকে বললো,“আপনার মাথা কি ঠিক আছে ডাক্তার ম্যাডাম নাকি বন্ধুর বৌভাত খেয়ে এসে মাথাটা পুরোই গেছে।”

আদ্রিতা বিরক্ত হলো দারুণ। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“আমি সিরিয়াস ফারিশ। দ্রুত উঠুন বিয়ে করবো।”

ফারিশ উঠলো না। চুপ করে বসে রইলো। ‘এমন হুট করে বিয়ে করবো বললেই কি তাকে বিয়ে করতে হবে নাকি’। আদ্রিতা তাড়া দিয়ে বললো,“কি হলো ফারিশ উঠছেন না কেন?”

ফারিশ তার চুলগুলো খানিকটা ঠিক করে বললো,“মুড নেই আমার।”

আদ্রিতা অবাক হয়ে বলে,“মুড নেই মানে। আপনি তো বললেন আজ বিকেলে বিয়ে করবেন।”

ফারিশ এতক্ষণ পর যেন সবটা বুঝলো। তার সকালের মজার ছলের কথাটা আদ্রিতা সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। ফারিশ মৃদু হাসলো। বললো,“আমি আপনায় বিশ্বাস করি আদ্রিতা তাই এখন বিয়ে করার প্রয়োজন নেই।”

আদ্রিতা আচমকাই ফারিশের শার্টের কলার টেনে নিজের দিকে টানলো। ফারিশ হতভম্ব হয়ে চেয়ে। আজকের আদ্রিতার আচরণ বড়ই উদ্ভট। আদ্রিতা ফারিশের চোখে দিকে চোখ রেখে গম্ভীর এক স্বরে বললো,“আমার দারুণ প্রেম প্রেম পেয়েছে তাই আমরা বিয়ে করবো।”

ফারিশের চক্ষু বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বলে,“এসব আপনি কি বলছেন?”

বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হচ্ছে আদ্রিতা। জোরে নিশ্বাস ফেলে বিরক্ত নিয়েই বলে,“আপনি কি উঠবেন ফারিশ নাকি আমি চলে যাবো।”

ফারিশ আদ্রিতার হাত দুটো নিজের কলাট থেকে ছাড়ালো। শান্ত গলায় বললো,“এভাবে কি বিয়ে হয় ডাক্তার ম্যাডাম? আমার না হয় আদিব ছাড়া কেউ নেই কিন্তু আপনার তো আছে। আপনার বাবা মা তাদের পারমিশন তো নেয়ার প্রয়োজন।”

আদ্রিতা মৃদু হেসে বলে,“তারাও রাজি। আমি সকালেই তাদের কাছে আপনার কথা বলে দিয়েছি। আপনার ছবি দেখিয়েছি মা পছন্দ করেছে। বাবা প্রথমে একটু নাকচ করেছিল কিন্তু যখন শুনেছে আপনি একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক তখন থেকে আর কিছু বলে নি। আর বাবা আপনায় চেনে কাছ থেকে না হলেও দূর থেকে চেনে। তাই আর সমস্যা নেই। এখন চলুন।”

ফারিশের পুরো ব্যাপারটা যেন মাথা উপর দিয়ে গেল। এমন সময় তাদের কক্ষে এক প্রকার দৌড়ে ঢুকলো মৃদুল। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,“দুলাভাই কই আপনে?”

বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরলো মৃদুল। মৃদুলের আকস্মিক এমন কান্ডে ফারিশ চমকে উঠলো। মুনমুন এগিয়ে এসে বললো,“দুলাভাই দুলাভাই চলুন না কাজী অফিস যাই, বান্ধবীর মনে খালি আপনারে চায় আপনারে চায়।”

ফারিশ একে পর এক অদ্ভুত কান্ডে কি করবে বুঝছে না। এই পাগলের দল কোথা থেকে উদয় হলো। রনি ব্যাঙের মতো নাচতে নাচতে বললো,“আরেহ দুলাভাই আপনি এহনো রেডি হোন না কেন? কাজী অফিস যাবেন না।”

ফারিশ করুণ চোখে তাকালো রনির দিকে। এরই মাঝে চাঁদনী আসলো দৌড়ে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,“ওরে দুলাভাইইইইই…

চাঁদনীর দৌড়ানো ছিল খুব ভয়ানক। যে ছুটে এসে ধাক্কা খেল রনির সাথে রনি ছিটকে পড়লো তার সামনে থাকা মুনমুনের সাথে। মুনমুন ছিঁটকে গেল মৃদুলের গায়ে। মৃদুল পড়বে তার আগে তাকে আটকালো ফারিশ। ঘটনা চক্রে সবাই হতভম্ব। আর ফারিশের মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল তখন, “এই পাগলের দল সব আদ্রিতার বন্ধু।”

মৃদুল নিজেকে উঠিয়ে শুঁকনো হেঁসে বললো,“ধন্যবাদ দুলাভাই।”

সেই মুহূর্তে দরজা মুখে হাজির হলো মৃদুলের বউ, নীলিমা তার সাথে আশরাফ আর নয়নতারাও। সেও এসেছে এদের সাথে। সবাই উৎফুল্লের সাথে বলতে লাগলো,“দুলাভাই উঠেন বিয়ে করবেন না?”

এক নিমিষেই ফারিশের ঝিমিয়ে থাকা পুরো বাড়ি নেচে উঠলো। হাসি তামাশায় মক্ত হলো চারপাশ। আদিব দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার চোখে হঠাৎই পানি আসছে। তাদের এত বছরের জীবনে এমন উৎফুল্লকর ঘটনা কখনো ঘটে নি। ফারিশ নিজের কান চেপে ধরলো চারপাশের সবাই একটা কথাই বলে চলছিল তাকেত,“দুলাভাই বিয়ে করবেন না?”

অতঃপর ফারিশ মেনে নিলো। হাল্কা চেঁচিয়েই বললো,“তোমরা সবাই থামো আমি বিয়ে করবো।”

সবাই থেমে গেল হঠাৎ। খুশিতে গদগদ হলো মৃদুল,রনি,চাঁদনী, মুনমুন, আশরাফ,নীলিমা আর নয়নতারা। আদ্রিতা হাসলো এবার। উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“সত্যিই বিয়ে করবেন ফারিশ?”

ফারিশও নিরুপায় ভঙ্গিতে বললো,“হুম।”
একে একে সবাই বের হলো রুম থেকে। আদ্রিতাও গেল তাদের সাথে। সঙ্গে ফারিশকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হতে’। ফারিশও বিনিময়ে জবাব দিলো, ‘ঠিক আছে’। যাওয়ার পথে দরজার মুখে চাঁদনী আদিবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো শুধু। চোখের ইশারায় বুঝালো,“এরপর তার পালা।”

আদিব বুঝলো বিনিময়ে কিছুই বললো না। শুধু লাজুক হাসলো। সবাই বের হতেই আদিব ভিতরে ঢুকলো। স্বল্প আওয়াজে বললো,“দুলাভাই,,

ফারিশ হতাশ মুখে তাকালো আদিবের দিকে। বললো,“তুমিও শুরু করলে আদিব।”

আদিব উৎফুল্লতা নিয়ে কঠিন সুন্দর এক হাসি দিলো। হাসি হাসি মুখে বললো,
“ভাই আজ আমি খুব খুশি।”

ফারিশ ভাবলো না। উল্টো বললো,
“বিষয়টা তোমার কাছে খুব দ্রুত দ্রুত লাগছে না।”
“আমি জানি ভাই একটা মানুষের থেকে ধোঁকা খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার তাকে বিশ্বাস করতে আমাদের সময় লাগে, তার সব কাজেই দ্বিধা কাজ করে। কিন্তু এবার আপনি ঠকবেন না দেইখেন। ডাক্তার ভাবি আপনায় সত্যি ভালোবাসে। আপনি ফ্রেশ হন আমি আপনার জন্য একটা সুন্দর পাঞ্জাবি বের করছি।”

ফারিশ নাকচ করলো সঙ্গে সঙ্গে। বললো,“না পাঞ্জাবি লাগবে না। তুমি কালো রঙের শার্ট বের করো।”

আদিব অবাক হয়ে বললো,“কালো কেন?”
ফারিশ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,“এমনি।”
—-
বেলা তখন চারটার কাটা ছাড়িয়ে সাড়ে পাঁচটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। ফারিশদের ড্রয়িং রুমে বসে ফারিশের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। ছেলেটা এত দেরি করছে। আদ্রিতা তার ভাড়ি লেহেঙ্গা ধরে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“তোরা বস আমি দেখে আসি ওর কতদূর হলো।”

আদ্রিতার কথা শুনে সবাই ‘ও হ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আদ্রিতা বিমূঢ় চেয়ে। মুনমুন বললো,“আরেহ বাস এখনো বিয়েই হয় নি তার আগেই ‘ওর’। বিয়ে হলে কি ডাকবি রে আদু জানু, বাবু,সোনা।”

আদ্রিতা হেঁসে বললো,“হুস এর চেয়েও ইউনিক কিছু।”

চাঁদনী অবাক হয়ে বললো,“সেটা কি?”
আদ্রিতা জবাব দিলো না। মিষ্টি হেঁসে ছুটলো ফারিশের কামরার দিকে।”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ফারিশ। গায়ে জড়িয়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, শার্টটা ইন করে পড়া,শার্টে হাতাও কনুই পর্যন্ত বোল্ড করা। চুলগুলো খানিকটা অগোছালোই রাখলো আজ। আদিব তার দিকে চেয়ে। ফারিশ তার পায়ে কালো শু জুতো জোড়া পড়তে নিলেই আদিব বসলো নিচে। ফারিশ অবাক হয়ে বললো,“এসব কি করছো আদিব?”

আদিব ফারিশের হাত থেকে জুতো জোড়া নিয়ে আদুরে গলায় বললো,“আমি পড়িয়ে দেই ভাই?”

আদিব এমন ভাবে কথাটা বললো যে ফারিশ চেয়েও আর না করতে পারলো না। ফারিশ পায়ে মুজা জড়ালো আগে। বললো,“কিছু কি বলবে আদিব?”

আদিব যেন চমকে উঠলো। কি করে বুঝলো তার ভাই সে কিছু বলতে চায়। ফারিশ আদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“তুমি আমার ছোট ভাই আদিব আমি তোমায় বুঝবো না।”

আদিব হাসে। নিজ হাতে ফারিশের ডান পায়ে আগে জুতাটা পড়াতে পড়াতে বলে,“আমার জন্যই আপনার জীবনটা এমন এলেমেলো তাই না ভাই।”

ফারিশ অবাক হয়ে বললো,
“তোমার জন্য মানে?”
“আমার জন্যই তো আপনি মাফিয়া ভাই। ওইদিন যদি আমার জন্য খুন না করতেন। তবে তো আজ আমরা এমন থাকতাম না।”
“না মারলে আমরা কি বেঁচে থাকতাম আদিব?”
“তা হয়তো থাকতাম না কিন্তু এমন পাপ কাজ করেও তো বেঁচে থাকা লাগতো না। আমরা মরার পর কি জবাব দিবো ভাই?”
“তোমার জবাব দেয়া লাগবে না তুমি পাপী নাকি। পাপি তো আমি। তুমি ভালোই থাকবে।”

আদিব ছলছল নয়নে ফারিশের দিকে তাকালো। তার চোখ ভেসে উঠেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই ফারিশ আদিবের যত্ন করে। ফারিশের কাছাকাছি সবসময় থাকলেও আদিব কখনো তার কাজে নিযুক্ত হতে পারে নি। সে সব জানে কখন ফারিশ কি করে? টুকটাক খবরাখবর দেয় কিন্তু আদিবকে কখনো সেই নেশালো দ্রব্য হাত দিয়ে ছোঁয়ার অধিকার দেয় নি ফারিশ। যা করার ফারিশই করতো আদিব শুধু দেখতো। তার বয়স যখন বিশ তখনও আদিব এই বেআইনি কারবার সম্পর্কে অবগত ছিল না। এরপর হুট করেই সে সবটা জানে। ফারিশও আর লুকিয়ে রাখে নি। লুকিয়ে আর কতকাল রাখবে যে সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আদিব ফারিশের হাত ধরে বললো,“কাজটা কি ছাড়া যায় না ভাই?”

ফারিশ অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে বলে,“কিভাবে ছাড়ি? তুমি তো জানো সবটা।”

আদিব আর কিছুই বললো না। ফারিশ কেমন একটু করে যেন বললো,“আমি কি বিয়ে করে ভুল করছি আদিব?”

আদিব বলে,“না ভাই। ডাক্তার ভাবি তো সব জানে।”
ফারিশ কিছু বলে না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আদ্রিতার ভিতরের সব কথাই শোনে। বলে না আর কিছুই নীরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।’

ঢাকার মানুষ তখন মাগরিবের নামাজ সেরেছে অনেকক্ষণ। সময় তখন প্রায় রাত আটটা। কবুল বলার মাধ্যমে কাজী অফিসেই বিয়ে হয়ে গেল ফারিশ আর আদ্রিতার। আদ্রিতার মা বাবা আর ছোট ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিল। বিয়ের শেষে গলায় মালা পড়ালো দুজন দুজনকে। আদ্রিতার মুখ হাসি হাসি। ফারিশ মলিন মুখে তার পানে চেয়ে। করুণ গলায় আওড়ায়,
“আপনি হাসছেন। অথচ আমার হৃদয়টা ভিতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি মরছি,অন্তরটা ঝলসে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে পুড়ছে আর যেন কইছে,ফারিশ কি ভুল করেছে?”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here