ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো (৩)

0
700

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৩)
ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে যাওয়ার বকুলতলায় একদল স্টুডেন্টের ভিড় দেখা যায়। তাদের মধ্যে দুজনের হাতে গিটার। সম্ভবত গানের আসর বসবে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলে স্টুডেন্টস দের আড্ডা। চত্বরে গোল হয়ে তাদের বসা দেখে তানভীর দুতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। নজর আটকায় সবার মধ্যমনি হয়ে বসা লাবিবায়। হলুদ গাউন হিজাবে শীতের সকালে ফোঁটা গুচ্ছ গাঁদার মতো সৌন্দর্য যেনো ধরা পরেছে। মেয়েটাকে সবার মাঝে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। মিডিয়াম হেলদী। গুলুমুলু চেহারায় আঙুল ছোঁয়াতে ইচ্ছা করে। নামটাও কেমন যেনো! ভীষণ আদুরে,লাবি…বা! এই মেয়েটাই না সেদিন ভয় পেয়েছিলো? আজ কেমন গুন্ডি গিরি করছে! তানভীর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই লাবিবা পাশের ছেলেটার পিঠের উপর ধুপ ধাপ কিল ছুঁড়ে সোজা হয়ে বসে। ছেলেটার নাম নাকিব। তুখোড় ছাত্র। ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট। লাবিবার বন্ধু। তার অপরাধ তাকে বলা হয়েছে গিটারে এক সুর তুলতে,সে তুলেছে আরেক সুর। কিল খেয়ে পিঠ বাঁকিয়ে কুকিয়ে উঠে, ” ও মা! ” এইটুকুনি আওয়াজেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে লাবিবা। আঙুল তুলে শাষায়।
” একদম ঢং করবি না। এই তোকে কি খাওয়ায় না? এতো হাড্ডি কেন শরীরে? রড়ের মতো শক্ত। শরীরে একটু গোশতো বানাতে পারিস না?”

উর্মিলা দাঁত বের করে হাসে। নাকিবের পিঠে আদর করে বলে ,
” ব্যাথা পেয়েছিস?”

” একদম না। ”

অথচ নাকিব ব্যথায় হাতের উপর আরেক হাতে চেপে ঘষছে । চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে।মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তবুও স্বীকার করতে নারাজ। বন্ধু মহলে নিজেকে শক্ত দেখাতে আগ্ৰহী সে। নাকিব সোজা হয়ে বসে। ভেংচি কাটে।
” আরেকবার মারতে আসিস। পিঠ আরো শক্ত করে রাখবো। ব্যথা পেয়ে ভ্যা ভ্যা করবি।”

” আগেরটা বাদ অন্য কোন গানের সুর তোল।”

” কোনটা বল।”

” তাহসানের দ্যা ফেভারিট সং অফ আওয়ার ফ্রেন্ডস।ইয়েএএএ…”

গিটারে সুর তুললো। সুরের তালে তালে সবাই একসাথে গাইতে লাগলো,

” তুমি আর তো কারো নও , শুধু আমার
মত দূরে সরে যাও, রবে আমার
স্তব্দ সময়টাকে ধরে রেখে
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার
কেনো আজ এতো একা আমি, আলো হয়ে দূরে তুমি
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না।
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবেনা।”

গাইতে গাইতেই লাবিবার চোখ পরে দুতলার বারান্দায়। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের হেড খবিরুল ইসলাম স্যার, দুজন প্রফেসর সহ তানভীরকে দাঁড়িয়ে থেকে গান শুনতে দেখে। খবিরুল ইসলাম স্যারের সাথে তানভীর খানের কনভারসেশন চোখে পড়ার মতো। বিনয় যেনো ঝড়ে পরে কথায়। চারজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কি নিয়ে যেনো আলোচনা করছে আবার তাঁদের দিকে তাকিয়ে গানও শুনছে। একে একে সবাই মাথা উঁচিয়ে তাকালে তানভীর পকেট থেকে একটা হাত বের করে থামবস্ শো করে। নিঃশব্দে হাসি বিনিময় করে সবাই তার সাথে। তানভীর মুচকি হেসে স্যারদের সাথে প্রস্থান করে।

আড্ডা শেষ হতেই একে একে যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যায়। বসে থাকে লাবিবা। উর্মিলা তাড়া দেয় লাবিবাকে।
” চল যাওয়া যাক। উঠ এবার।” লাবিবার সাড়া না পেয়ে দৃষ্টি অনুসরণ করে দুতলার খালি বারান্দার দিকে তাকায়। উদাস ভঙিতে একধ্যানে তাকিয়ে আছে লাবিবা। উর্মিলা কাঁধে হাত রাখে। ঝাকি দিয়ে ধ্যান ভাঙায়।

” কি দেখিস এভাবে?বারান্দা তো খালি। ”

লাবিবা চটপট উর্মিলার দিকে ঘুরে তাকায়। চোখ পিট পিট করে উর্মিলার দিকে ঝুঁকে বসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
” চার অক্ষরের নাম গুলো এতো সুন্দর হয় কেন? যেমন: তানভীর, আনভীর, রাফসান,সাদমান, আদনান! দুই অক্ষরে জিহ্বা থেমে যায় চার অক্ষরে পূর্ণতা পায়।‌ কি কিউট না? নামেই যার বিশালতা প্রকাশ!দীগন্ত জুড়ে পাই তারই আভাষ!”

লাবিবা চোখ দুটো বন্ধ করেই লম্বা শ্বাস টানে। স্পঞ্জের ন্যায় গাল দুটোয় মুহূর্তেই লালচে আভা ছড়িয়ে পরে। চেহারার দ্যুতি কি খানিকটা বেড়ে গেলো?
উর্মিলা জহুরীর চোখে পরখ করতে চাইলো। লাবিবার দিকে এগিয়ে গেলো। চশমাটা চোখে ঠিক করে নিলো। মুখের সামনে মুখ রাখলো। হটাৎ ই সে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়লো। চিন্তার কারণে কপালে একটি দুটি ভাজ পড়লো। এই চিন্তার কোন সমাধান পাওয়া গেলো না । প্রশ্নটা করেই ফেললো।
” কে সেই ভাগ্যবান?”

রিপ্লাই পাওয়া মাত্রই উর্মিলার গায়ে কাঁটা উঠলো। দ্বিতীয়বার লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া গভীর থেকে ফিসফিসিয়ে অথচ দৃঢ় সেই আওয়াজ পেলো,
” ভীর..রররর !”

” তানভীর?”

“খান।”

“স্যার?”

লাবিবার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো। নিঃশব্দ অথচ লাজুক হাসি! ব্যাগটা কাঁধে তুলেই পিচ ঢালা রাস্তায় পা চালালো। উর্মি যেনো বোকা বনে গেলো। মনে মনে আওড়ালো ,
“স্যারর!”

মাথায় নাড়া দিতেই বলে উঠলো,
” মানে কি? কার মুখে কি নাম! লাব্বু! তাও আবার লাজুক গাল! নাম বললো তানভীর খান!”

লাবিবার যাওয়ার দিকে তাকালো। সেও পিছু পিছু দৌড় দিলো। লাবিবা ততোক্ষনে কলেজের লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উর্মিলা একদম লেগে দাড়াঁতেই‌ লাবিবা ধাক্কা খেলো। সরে দাঁড়িয়ে কপট রাগ দেখালো।
” গায়ের উপরে উঠছিস কেন? আমার দুলার হক মারার প্ল্যান আছে নাকি?”

” রাখ তোর দুলা। আগে ক্লিয়ার কর বিষয়টা কি? ”

” দাঁড়া বইটা আগে নিয়ে নিই। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলি।”

লাবিবা খুঁজে খুঁজে অনেক গুলো বই বাছাই করলো। বাছাইকৃত বইগুলোর মধ্যে আবারও বাছাই করলো। কাঙ্খিত বই না পেয়ে ইসলামিক বইগুলো খুলে দেখতে লাগলো। উর্মিলাও মুখ এগিয়ে দেখলো। একটা অধ্যায় পেলো- ” সপ্নের ব্যাখা।” লাবিবা বইটা কিনে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
” তোকে বলেছিলাম না? হুট করেই ভোরের সপ্নে একজন এসে বীণা টিকিটে এন্ট্রি করে। আই ফিল হিম রিয়েল। সুপুরুষ সে। আমি তাকে ছুঁয়ে দেই। তার চওড়া কাঁধ লোমশ বুকের উষ্ণতায় ঢুবে যাই। বিস্তৃত এক ভ্যালিতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি সপ্ন সাজাই।”

” হ্যা কিন্তু তুই তো চেহারা বলতে পারিস না।”

” আজ সকালের সপ্নে কি দেখেছি জানিস? আমার বিয়ে হচ্ছে। ধূমধাম করে বিয়ে সেই সুপুরুষের সাথে। টুপি মাথায় ব্লাক শেরোয়ানি পরে জায়নামাজ হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আঁধার কাটিয়ে যতোই সে আলোতে ধরা দেয় আমার দৃষ্টিতে সেই সুপুরুষের মুখ ততো উজ্জ্বল হতে থাকে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে আমার হাতের উল্টোপিঠে চুমু খায়। তারপর”

” তারপর?” উর্মিলা জিজ্ঞেস করে।

” আম্মুর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলে আমি আর কথা বলার শক্তি পাই না। আমার গা মরঘাম দেয়। বিছানা সহ ভিজে যায়। আর আমি হা করে হাপড় টানছিলাম একটু পর পর। আম্মু আমাকে পানি খাইয়ে দিয়ে আব্বুকে ডেকে আনে। গোছল করিয়ে দেয়। ব্রেকফাস্ট করার পর আমি সুস্থ হই। ডক্টর জানায় টাইফয়েড থেকে উঠার পর আমার শরীর দূর্বল জন্য এসব দুঃসপ্ন দেখি। কিন্তু আমি জানি আজ দূর্বলতার কারণে নয় আমার কিশোরী বয়স থেকেই এই সুপুরুষ আমার সপ্নে আসে। তবে আমি সপ্নে একটুও ভয় পাইনি। বরং অনেক খুশি ছিলাম। কিন্তু কেন যে আমি অসুস্থ হয়ে পরলাম বুঝতে পারিনি। তবে সন্দেহ হচ্ছে। আম্মু বার বার জিজ্ঞেস করছিলো আমাকে, তানভীর খান কে? আমি নাকি তানভীর খানের নাম নিয়েছি। কিন্তু আমার সত্যিই খেয়াল নেই কে ছিলো সেই সুপুরুষ? বরাবরের মতো আজও ভুলে গেছি। কিন্তু তার নাম যে তানভীর খান এটা বুঝতে পেরেছি। নামটা মাথায় বার বার রিমেম্বার হচ্ছিলো। ক্যাম্পাসে পোস্টারে নামটা চোখে পরতেই খেয়াল হলো আমাদের প্রিন্সিপাল মি.তানভীর খান। এই নামে একমাত্র তাকেই আমি চিনি। আর কাউকে নয়। ”

” তুই কি এখন প্রিন্সিপালের পেছনে পড়বি?” উর্মিলা চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে।

” পেছনে কিরে? আমি তার সামনেও নাই পেছনেও নাই। কার সাথে কি তুলনা করিস? ডলফিনের মতো বড় মানুষটাকে দেখলেই আমার বাচ্চা খরগোশ মনটা খোদা খোদা করে। রেগে গেলে হুংকার যে ছাড়ে! সিংহের বাচ্চা! কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ব্যাটা বুড়ো নিশ্চিত দুই তিনটা বাচ্চার বাপ । ”

” এই যে মিস! আস্তে। কাকে বুড়ো বলছিস?”

” কেন? প্রিন্সিপালকে। বুড়ো না হলেও মাঝ বয়সী তো। কখনো দেখেছিস কোন ইয়াং পার্সন কোনো ভার্সিটির প্রিন্সিপাল হয়? ডায়েট প্ল্যান করে জিম করে ঐরকম ইয়াং লুক বড়লোকেরা এখন প্রায় সবাই ধরে রাখে। বয়সই বুঝা যায়না।”

” প্রিন্সিপাল স্যার নাউ থার্টি টু।”

” পাগল তুই।”

” তুই পাগল। গুনে গুনে তোর থেকে দশ বছরের বড়।”

“রিয়েলি? কিভাবে পসিবল?”

” এই কলেজের সাবেক প্রিন্সিপালের নাতনী প্রেজেন্ট প্রিন্সিপাল। আলহাজ্ব মাজহারুল ইসলাম স্যারের মৃত্যুর পর তার পরিবারের যোগ্য তানভীর খান স্যার তার দায়িত্ব গ্ৰহন করেন। বলতে পারিস এই কলেজ তাদের নিজেদেরই কলেজ। সেজন্যই এতো অল্প বয়সে তানভীর স্যার এখানকার প্রিন্সিপাল।”

” তুই কিভাবে জানলি?”

” আমার কাজিন আমাদের ব্যাচের দুই ব্যাচ সিনিয়র। সে এই কলেজে যখন ছিল তখন মাজহারুল স্যার মৃত্যু বরণ করেন আর তানভীর স্যার জয়েন করেন। তানভীর স্যারের এখানে আসা নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। কলেজের পরটে পরটে চলেছে রাজনীতি। আর এখন সব কিছুই স্যারের মুঠোয়। দক্ষ হাতে সবটাই আয়ত্ত্ব করে নিয়েছেন।”

“নিজেদের কলেজ বলেই বুঝি এতো পাওয়ার?”

” পাওয়ার আসে ভেতর থেকে এবং যোগ্যতা থেকে। সাবেক প্রিন্সিপালের নাতনী তকমা নিয়ে অনেক বাজে সিচিয়ুশনে পড়েছেন। এজন্য নিজের যোগ্যতা সর্বত্র বিচরণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এমনিতেও প্রোফাশনাল লাইফে তাদের পার্সোনাল লাইফকে মনে হয়না তাদের ফেমেলির কেউ টেনে আনে। তানভীর স্যারের ফ্যামিলি সম্পর্কেও আমরা কিছুই জানি না। প্রিন্সিপাল আলহাজ্ব মাজহারুল ইসলাম মারা যাবার পর ভাইস প্রিন্সিপাল যদি ঝামেলা না করতো তাহলে মনে হয়না তানভীর স্যারের এই পরিচয়টাও কেউ জানতে পারতো। এখান খেয়াল করলে দেখতে পারবি ভাইস প্রিন্সিপাল কেমন সবসময় প্রিন্সিপালের নেওটা হয়ে থাকে।”

” তুই তো অনেক কিছুই জানিস। আমি তো এর কিছুই জানিনা।”

” তোর মতো বাপ থাকলে দুনিয়ায় বইয়ের ভাষা ছাড়া বিশ্বাস কর আমিও কিছুই জানতাম না। ক্যাম্পাসে থাকিস কতক্ষন ক্লাস ছাড়া? ”

” আব্বুকে কেন টানছিস? এই শোননা। এখন বাসায় ফিরতে হবে। বইটা তোর কাছে রাখ। আমি কালকে এসে পড়বো। এই বই বাসায় কেউ দেখলেই হলো!”

“এটা দিয়ে কি হবে? ”

” আম্মু বলেছে নিজের বিয়ে সপ্নে দেখলে আশেপাশে মানুষ মরে।কথাটা কতটুকু সত্যি বইয়ে খুঁজে দেখতে হবে।”

“ধ্যাত এসব কিছুনা। মানুষ এমনিই বলে। আচ্ছা দোস্ত তুই যে এতো বিয়ে নিয়ে ভাবছিস কিন্তু তুই তো বিয়ে করবি না। তাহলে ঐ সুপুরুষ কে ভাগিয়ে দিতে পারিস না?”

”সপ্নে কি আর মানুষের হাত থাকে?”

“না।”

তাদের পাশ কেটে শা শা করে একটা কার চলে যায়। গল্প করতে করতে খালি রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছিল তারা। গাড়ির হর্ণ পেয়ে দ্রুত সরে যায়। উর্মিলা ভয়ে বুক চেপে ধরে। চিৎকার করে।
“দোস্ত আরেকটু হলেই তো ইন্তেকাল ফরমাইতাম।”

লাবিবা সাথে সাথে ঘুরে তাকায়। দেখতে পায় পেছনে প্রিন্সিপালের কালো গ্লাসের চকচকে সাদা নোহা কারটা। ফুল স্পিডে ধেয়ে যাচ্ছে। যতদূর দেখা যায় ততদূর পলকহীন তাকিয়ে রয় লাবিবা। অন্যমনস্ক অসাবধানতায় হাতের বইটা পড়ে যাচ্ছিল। হুড়মুড়িয়ে কোনভাবে আটকায়। বুকের সাথে চেপে ধরে। ফের পেছনে তাকায়। গাড়িটা আর দেখা যাচ্ছে না। ভর দুপুরে খা খা করছে জনমানবহীন রাস্তা।

চলবে __

®লাবিবা তানহা এলিজা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here