#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৩১)
“তোমার হাজব্যান্ড! বাহ! অন্য মেয়েদের সাথে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আর তোমার হাজব্যান্ড ক্লাবের ভেতরে দাঁড়িয়ে তাও আবার অন্য মেয়ের সাথে!”
লাবিবা কটমট করে তাকায়। ফ্লোরা গলায় আফসোস তুলে বলে,
” আহারে! রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কি বানিয়ে বলছি? নিশ্চয় কাছের কেউ টেউ হবে। ছেলেদের একটু স্পেস দেওয়া উচিত বুঝলে? নয়তো বেঁকে বসে। তুমি নিশ্চয় আমাকে কিছু বলবেনা। ”
লাবিবা নজর ফিরিয়ে তানভীরের দিকে তাক করে। বর্তমানে সে শহরের মেইন পয়েন্টে এক বিলাসবহুল নাইট ক্লাবে অবস্থান করছে। দিন দুপুরেও এই ক্লাবের সামনের রাস্তায় সাধারণ কেউ হাটতে আসেনা। বড় লোক ছেলে মেয়েদের মাতলামো পনা চলতেই থাকে। যাদের টাকা রাখার জায়গা নেই তাঁরা এখানে আড্ডা দিতে আসে। তানভীরের জন্য আজ লাবিবাকে এখান অব্দি পৌঁছতে হয়েছে। সাত তলায় লিফটে উঠতে না পেরে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়িতে দৌড়ে উঠেছে। ক্লাবের দরজায় এসে হাঁটুতে ভর করে হাপাচ্ছে আর জলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। ব্লাক কালার স্যুট পরা মেয়েটা এসে প্রথমেই তানভীরকে হাগ দিয়েছে। তারপর ইয়েলো কালার স্যুট পড়া মেয়েটা। এই মেয়েগুলোকে লাবিবা চেনেনা। তবে ছেলেগুলোর মধ্যে একজনকে চিনে। যে বড় চাচার ছেলে। লাবিবার অতি প্রিয় ভাই কবির। একজন এস আই। সেও মেয়েদুটোর সাথে ফ্রাংকলি হাগ দিচ্ছে। এসব দেখে রাগে যখন লাবিবার চোখ দুটো পানিতে টইটুম্বুর তখন দেখা যায় ভিড়ের মাঝে ফ্লোরাকে। ফ্লোরার হাতে হুইস্কি গ্লাস। লাবিবাকে সে নোটিশ করেছে। তার দিকেই এগিয়ে আসে। নজরে তাক করে তানভীর কে দেখে ফ্লোরার কন্ঠ ভীষণ দরদী হয়ে উঠে। অভিনয়ের সহিত বলে,”তোমার হাজব্যান্ড! বাহ! অন্য মেয়েদের সাথে।”
ফ্লোরা লাবিবাকে ইশারায় তার সাথে আসতে বলে। একটা ফাঁকা টেবিলে গিয়ে দুজনে বসে। লাবিবার সামনেই বরফ মিশিয়ে একটু একটু করে সিপ নেয়। এগিয়ে দেয় হাতের গ্লাস, ” খাবে?”
” না। তুমি হুইস্কিও খাও? ”
লাবিবার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। ফ্লোরা হালকা হাসে।
” কে বললো এটা হুইস্কি? আমার কাছে এটা ফ্রুট জুস। দেখো একদমই নেশা হয়না।”
আশ্চর্য ভাবে একদমই ফ্লোরার নেশা হল না। স্বাভাবিক রইল। লাবিবার দৃষ্টি তানভীরেই আবদ্ধ দেখে ফ্লোরা ওকে জানাল,
” তানভীর এখানকার মেম্বার। আমিও মেম্বার। এতে অবাক হবার কিছু নেই। এখানে শুধু মানুষ মদ গিলতেই আসেনা। বরং চিল করতে আসে। তানভীরের সাথে মেয়ে দুটোকে দেখছো ওরা ফ্রেন্ড। তোমার ভাই কবির ও তানভীরের ফ্রেন্ড। আমি তাদের চিনি। অনেক আগে থেকেই।”
” চিল করার অনেক জায়গা আছে। এখানে কেন?”
“যার যেটা পছন্দ! তানভীর বহু বছর দেশের বাইরে ছিল। লাইফস্টাইল এর ব্যাপার স্যাপারও আছে। বুঝতে হবে।”
ফ্লোরা যা বোঝাতে চেয়েছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে লাবিবা। উত্তর না করে এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে। ফ্রেন্ডস এন্ড কাপল। কাপলের সংখ্যায় বেশী। তারা যে বেশ বড়লোক তাঁদের ড্রেসাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।এই ক্লাব সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছে। ভালো কিছু আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। তবে আজ এখানে এসে সর্বোপরি এটা বুঝলো যতটা খারাপ মানুষ বানিয়ে বলে তার অর্ধেকও না। ভেতরের পরিবেশটা কেমন যেন। ভালোও লাগে আবার গায়েও কাটা দেয়। পাশের অন্য সেক্টরে ডিসকো চলছে। মদ খেয়ে মাতলামো! এটাতো যার যার চয়েজ।
” আমরা এখানে প্রায়ই আসতাম। বিশেষ বিশেষ রাতে। তোমার ভাসুর অবশ্য তেমন পছন্দ করতো না। আমার জোরেই আসা হতো। এন্ড উই ক্রিয়েট এ লট অফ রোমান্টিক এটমসফিয়ার এ্যারাউন্ড আস।”
” তুমি আগে থেকেই হুইস্কি খেতে? ”
” তুমিও চাইলে খেতে পারো। নেশা হলে রোমান্স ভাল জমে। ”
” চাইনা। ঐদিকে কি? ডিসকো? ”
” হুম। যাবে? চলো।”
লাবিবা তানভীরের দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে নেয়। এখনও আড্ডায় মশগুল হয়ে আছে। লাবিবা যে এখানে আছে সেকি বুঝতে পারছে না? সে তো এক মাইল দূরে থাকলেও লাবিবা তাকে ফিল করে। লাবিবা কাছাকাছি থাকলে সে কেন বুঝতে পারে না? মনের টান থাকলে তো বুঝবে। কিছুই তো নেই। বিয়ে হয়েছে অর্ধেক বছর চলে গেছে। এখনো দুজন দুজনের মতো দুই ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একডালে বাসা বাঁধা আর হবে বলেও মনে হয় না। লাবিবার ই কেনো তবে এত দোটানা?
ডিসকোতে উপচে পড়া ভীড়। একজনের গায়ে সাথে আরেকজনের গা চাইলেই ঘেস খাচ্ছে। ফ্লোরার কোনো অস্বস্তি নেই। সে এসবে অভ্যস্ত। তার কোনো কিছুর পরোয়া নেই। কিন্তু লাবিবার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিছু সময় পর লাবিবা ফিল করে তার আশেপাশের সবাই তার থেকে ডিস্টেন্স মেইনটেইন করছে। কোন এক অদৃশ্য আবরণে লাবিবা আবৃত আছে। সেই আবরণের নাম তানভীর খান লাবিবা জানে। তানভীর যতই আড়ালে থাকুক তার উপস্থিতি লাবিবা ঠিকই বুঝতে পারে। সিউর হয় তানভীরের গলা শুনে।
একজন ফ্রেন্ডস জিজ্ঞেস করে,
” তানভীর মেয়েটাকে চিনিস? তোর পরিচিত?”
” হুম।”
” কে হয়?”
তানভীর কিছুক্ষণ নিবর চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
” আমার আত্মীয়।”
লাবিবা বাঁকা চোখে তাকায়। অতি শান্ত সে-ই চোখ। কোথাও যেনো অভিমান উঁকি দিচ্ছে। তানভীর রিয়েক্ট না করলেও কবির মুচকি হেঁসে বলে,
” আমার বোন।”
” কিরে আমরা তো জানতাম তুই হচ্ছিস তানভীরের ফ্রেন্ড। রিলেটিভস কবে থেকে হলি তবে?”
” ঐতো হয়ে গেলাম এভাবেই।”
বাসায় ফেরার সময় কবির বলে,
” আমার বোনকে হার্ট করেছিস তুই আজকে । ”
” কিভাবে?”
” তুই জানিস না ও তোর থেকে কি ডিজার্ভ করে? বউকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিচ্ছিস আর জিজ্ঞেস করিস কিভাবে?”
” মিথ্যে বলেছি? আত্তার সাথে যার সম্পর্ক তাকে তো আত্মীয়ই বলবো। বউ যদি অবুঝ হয় তাহলে আমার কি করার? তোর বোনের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক।”
পেছন পেছন আসছে লাবিবা। তানভীরের কথা শুনে ফিসফিসায়, “কচুর সম্পর্ক। ”
অর্ধ রাস্তায় গিয়ে তানভীর দাঁড়ায়। কবিরকে বলে,
” তোর বোনকে সামনে হাঁটতে বল। পেছন পেছন হাঁটা করা আমি পছন্দ করি না। ”
কবির জানতো না লাবিবা তাদের সাথে আছে। সে পেছন ফিরতেই লাবিবাকে দেখতে পায়। লাবিবা এগিয়ে আসলে কবির লাবিবার হাত মুঠোয় নেয়। গম্ভীর মুখে বলে,
” পেছনে আছিস আওয়াজ দিতে হয়। আর ফ্লোরার সাথে ক্লাব অব্দি চলে গেছিস এসব কাকা জানে? এতো যে উড়ছিস কাকা জানলে আস্ত থাকবিনা। ”
“আমার বিয়ে হয়ে গেছে ভাইয়া। তোমার কাকা আর আমার উপর এতো অধিকার ফলাতে পারবে না।”
তানভীর আড়চোখে তাকায়। শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে অধিকার ফলাতে বলছো?”
ওদের কথপোকথন এ কবির হাত ছেড়ে এগিয়ে যায়।
” না। আমার উপর আপনার কোনো অধিকার নেই।”
” তোমার বিয়েটা আমার সাথেই হয়েছে। ”
” বেশিদিন আর এ সম্পর্ক থাকবে না। ”
” মানে? থাকবেনা মানে কি? পাগল হয়ে গেছো তুমি।”
” আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে স্যার। আপনাকে আর বেশীদিন এই আত্মীয়ের পরিচয় বহন করতে হবেনা।”
” কার সিদ্ধান্ত?”
” আমার সিদ্ধান্ত। আপনাকে মুক্তি দিতে চাই। আপনি আমাকে যেটার জন্য সাহায্য করেছিলেন সেটা হয়ে গেছে। ডিভোর্সী মেয়েকে কেউ বিয়ে করবেনা। ”
তানভীরের পা পেছন দিক ঘুরে যায়। লাবিবার সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা কত স্বাভাবিক। অথচ তার নিষ্ঠুর আচরণ। তানভীর কাতর স্বরে প্রশ্ন করে,
” এতোটা সাহস কে তোমাকে দিল লাবিবা? বিয়েটা আমি তোমাকে স্বেচ্ছায় করেছি। একবারও ছাড়াছাড়ির কথা মাথায় আনি নি। তোমার মাথায় এসব কে ঢুকাচ্ছে? ফ্লোরা?”
” আমি কি এতোটা বোকা?”
” তাহলে কেন চাইছো এমন?”
” ভালোবাসা ছাড়া কখনও সংসার হয় না। একটু হলেও মায়া থাকতে হয়। দিন শেষে আমিও চাই আমাকে কেউ ভালোবাসুক। আমার সঙ্গী হোক। সেখানে আপনার মনে আমার জন্য কোন জায়গা নেই। বাসাটা বাধঁবো
কোথায়?”
” ভালোবাসলেই বলতে হবে? না বললে ভালোবাসা হয়না? ”
” আমি কিছুই জানিনা।”
তানভীর আরো এগিয়ে এসে তানভীরকে ছুঁতে চায়। লাবিবা দু পা পিছিয়ে যায়। তেজী কন্ঠে প্রতিবাদ জানায়,
” এখনও আপনার গা থেকে মেয়েদের পারফিউমের স্মেল আসছে। প্লিজ আমাকে ছুঁবেন না।”
” তুমি ভীষণ হিংসুটে লাবিবা। ওরা শুধুই আমার ফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড না।”
” তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ”
” তুমি আর ফ্লোরার সাথে মিশবে না। ”
” ভাবী বলুন। ফ্লোরা না। এতো প্রেম মিশিয়ে আড়ালে ডাকবেন আমার সামনে না।”
” ফ্লোরার সাথে আমার কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই লাবিবা। এভাবে দিনের পর দিন ভুল বুঝে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখো না। ”
” আমি জানি সেটা। ফ্লোরা আপু তামিম ভাইকে ভালোবাসে। আপনাকে না। ”
” তাহলে পাত্তা দিচ্ছো কেন তাকে?”
” কারণ সে আমার ভালো চায়। ”
” সে যদি তোমার ভালো চাইতো তাহলে আমাদের মাঝে ডিস্টেন্স তৈরী করার চেষ্টা করতো না। ”
” আপনার ভুল ধারণা। উনি তেমন কিছুই চেষ্টা করেনি। আপনি আমাকে আমার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পারিনি। তাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
” তুমি উল্টো বুঝছো লাবিবা।”
” তাহলে সিধেটা কি? আপনি আপনার মতো আমি আমার মতো। এটাই তো? বাঁধন ছিঁড়ে দিন।”
” কি চাও তুমি?”
” এক সমুদ্র জল স্বচ্ছ ভালোবাসার অধিকারিণী হতে চাই। কোটি কোটি টন আবর্জনা মিশ্র হলেও যার স্বচ্ছতার অভাব হবে না।”
সময় সল্পতায় ছোট লেখা। এখন থেকে প্রতিদিন গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ ♥️।
চলবে__