#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১১]
_________
আম্মা রাত নয়টা বেজে গেল তিনি কি তবে আসবেন না?আমার চাওয়া পাওয়ার দাম যে তার কাছে নেই আগেই জানতাম আমি।
ইতিকার কথায় নাসরিন স্মিথ হাসলেন।হুঠ করে তার চোখ দুটো অশ্রু কণায় ভরে গেছে।ইতিকার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস সুরে বলে,
– আরেকটু দৈর্য্য ধর মা।আসলেও তো আসতে পারে।
নাসরিনের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসলেন ইনানের বাবা ইব্রাহিম।
– জন্মদিনে মেয়েটা আবদার করেছিল আজকে অন্তত এই বাড়িতে আসতে কিন্তু সে আসেনি।কোন কুলাঙ্গার জন্ম দিলাম আমরা!ইতিকা মা তুই কেক কাঁ/ট সে আসবে না আর।রাত দশটা পার হয়ে যাচ্ছে।
তাদের তিনজনের আফসোস দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় অলীদ এবং সুফিয়া।ইতিকার আবদারেই তারা আজ এখানে এসেছিল কিন্তু ইনান আসেনি।
– আব্বা আমি কেক কাটবো না। আপনারা কেটে খেয়ে নিন আমি ঘুমাতে গেলাম।
ইতিকা উঠে দাঁড়ায় দরজার দিকে আরেক পলক তাকিয়ে অভিমান করে নিজের রুমে চলে যায়।
ইনান আসে বেশ কিছুক্ষণ পরেই।তাকে দেখে বাড়ির সকলেই স্থির মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে থাকে।এক পা দু পা এগিয়ে এসে ইব্রাহিমের পা ছুঁয়ে সালাম করে ইনান।কতদিন পর বাবার মুখোমুখি হয়েছে একদম সব রাগ, অভিমান ঝেরে।
– কেমন আছো বাবা?
ইফতিহার ইব্রাহিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু জল বিসর্জন দিতে থাকেন।বেশ কিছুক্ষণ বাবা, ছেলের কান্না শেষে ইনান সুফিয়াকে ইশারায় বলে ইতিকার কথা।
– ইতিবউ কোথায় সুফু?
– তোর বউ অভিমান করে উপরে চলে গেছে।
– যা নিয়ে আয়।
বেশ কিছুক্ষণ পর সুফিয়া ইতিকাকে নিয়ে নিচে নামে।ইনানকে দেখে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে।ইনানো তার সাথে ভাব দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলেনি।পুরো অনুষ্ঠানটাই শেষ হয় দুজনের বাক্যহীন ভাবে।
.
রাতের গভীরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ইনান বারান্দায় বসে সিগারেটের ধৌঁয়া উড়াতে ব্যস্ত।কত মাস পর সে ফিরে এসেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।ইতিকা গুটিগুটি পায়ে এসে ইনানের পেছনে দাঁড়ায়।তার অবস্থা বুঝতে পেরে স্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইনান।
– কিছু বলবেন ইতিবউ?
– ন…না।
– যান ঘুমান।অনেক রাত হয়ে গেছে।
– আপনি ঘুমাবেন না?
– আপনার কোলে যদি আমার মাথা রাখার ঠাই হয় তবেই ঘুমাবো।হবে কি?
ইনানের নিঃসংকোচ আবেদনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইতিকা।’হা’ নাকি ‘না’ কি বলবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।মন তো চাইছিল একবার বলি আসুন আমার কোলে মাথা রেখে চিন্তাহীন,তন্দ্রায় আচ্ছন্ন থাকুন।কিন্তু কোথায় যেন বাঁধা দিল মন।
নিজের সাথে নিজেই যুক্তিতর্কতে পেরে না উঠে ইতিকা রুমে চলে যায়।অপরদিকে তার এমন সংকোচ অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে ইনান।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান রুমে ডুকে।ইতিকা তখনো বসে বসে টেলিভিশন দেখছে মন দিয়ে।ইনান একবার টেলিভিশনের দিকে তাকায় আরেকবার ইতিকার দিকে।টম এন্ড জেরি কার্টুন এত মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে বুঝলো না সে।
ইনান ঝটপট ইতিকার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে শুয়ে যায়।
– আপনি…
– এত রাতে জেগে আছেন কেন?আর এই কার্টুন মমনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে?
– আপনার ঘুম পেয়েছে?বিছানায় ঘুমান।
– কেন আপনার কোলে ঘুমালে কি জাত চলে যাবে?
ইতিকা উত্তর দিলো না।আবারো মন বসালো কার্টুনের দিকে।ইনান বিরক্ত হয়ে রিমোট’টা নিয়ে টিভি অফ করে দিলো।
– ইতিবউ যখন আমি আপনার পাশে থাকবো ধ্যান- ধারণা,মনোনিবেশ সব আমাকে ঘিরে হবে।শুধু আমাকে।বুঝতে পারছেন?
– কেন এটা কি আপনার সাথে সংসার করার রুলস?
– যদি বলি তাই।আর এই রুলস সারাজীবনের জন্য মানতে হবে আপনাকে।
ইতিকা জবাব দিল না।চুপচাপ ইনানের চুলে হাত বুলাতে থাকে।
– একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?
-কী প্রশ্ন ইতিবউ?
– আমাকে সবসময় ‘আপনি’ ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন কেন?শুধুমাত্র গতকাল রাগের মাথায় ‘তুমি’ বলেছিলেন।
ইতিকার প্রশ্নে লীন হাসে ইনান।
– তুমি আমায় যেভাবে শাসন করো,ধমক দাও,আদেশ ছুড়ে দাও তাতে মনে হয় তুমি আমার বড়।মনে আছে বিয়ের দিন জলন্ত উত্তপ্ত আগুনের মতো রাগ নিয়ে জানতে চেয়েছিলে মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজকে বিয়ে করছেন সাক্ষী হিসেবে আমার মা-বাবা কোথায়। সেদিনি আমি বুঝে নিয়েছি তুমি তো আমাকে এক ইশারায় সোজা করার ক্ষমতা রাখো।প্রথম প্রথম রাগ দেখিয়ে আপনি বলেছি কিন্তু এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
– তাই নাকি?আমার কোন কথা আপনি কী শুনেন?
– যদি তোমার কথা না শুনতাম তবে আজ এই বাড়ির চৌকাঠে কখনোই পা মাড়াতাম না।
– আম্মা ঠিকি বলে বেপরোয়া ছেলেদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত।বউয়ের মায়ায় পড়ে ঠিকি ঘর সংসারে মনোনিবেশ করবে।
– তাই নাকি তোমার আম্মা আর কি কি বলেছে?
– বলেছে বলেছে অনেক কথা বলেছে এবার বালিশে মাথা রাখুন আমি ঘুমাবো।
– পরে ঘুমাবে আগে আমার কপালে তোমার ওই নরম ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দাও।
ইনানের বেখাপ্পা কথায় লজ্জায় নুইয়ে যায় ইতিকা।ইনানের নিঃসংকোচ আবেদন সে মান্য করতে নারাজ।
_
বাহরুল ইসলাম আজ বেজায় চটে আছেন।এতটাই রেগে আছেন যে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে ব্যস্ত সে।তার স্ত্রী রোশনী হন্তদন্ত হয়ে রুমে ডুকেন।
– আরে পাগল হয়ে গেছো তুমি?মাথায় এমন মগ ভর্তি পানি ঢালছো কেন?
– আমার সব জল্পনা-কল্পনা ধীরে ধীরে মাটি হয়ে যাচ্ছে রোশনী স্থির থাকবো আমি কি করে?
– কি হচ্ছে, না হচ্ছে তা পরের কথা।নিচে চলো সাহাব ভাইজান এসেছে।
– হোয়াট?শক্রু আমার ঘরে চলে এসেছে।সাহাব কেন এসেছে কিছু বলেছে তোমায়?
– না।তোমায় শীঘ্রই নিচে যেতে বলেছে।
.
বাহরুল ইসলাম মাথা মুছে নিচে চলে যায়।সাহাব উদ্দিন তাকে দেখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
– কেমন আছো বন্ধু?
– হঠাৎ শক্রু আজ ঘরে?
– একটা সময় তো বন্ধু ছিলাম।যাই হোক বলেছিলাম গ্রামের মেয়েটাকে মেরে দিতে।না হয় পাচার চক্রের কাছে বেঁচে দিতে।তুই তো জানিস পুলিশ আমার উপর আলাদা নজরদারি রেখেছে চাইলেও কিছু করতে পারবো না।তোর সাহায্য চেয়েছিলাম আর তুই মেয়েটাকে ইনানের বউ করে আনলি।অদ্ভুত!
– আমার ইচ্ছা ছিল না মেয়েটাকে ইনানের বউ করার।কিন্তু ইনানের জোরাজুরিতে আমিও রাজি হতে বাধ্য হই।মেয়েটা যেমন তোর বিপদ ছিল এখন আমারো বিপদ হয়ে দাড়িয়েছে।এক কথায় আমি খাল কেটে কুমির ঘরে ডুকালাম।
– বাহরুল ‘ওয়াসিম’ জেনে গেছে ইতিকার বিয়ে হয়ে গেছে।তাও আবার ইনানের সঙ্গে।সে বলেছে খুব শীঘ্রই ঢাকায় ব্যাক করবে।তুই তো জানিস এই ছেলে কতটা জেদি।মেয়েটাকে মেরে দিলে আজ না আমার বিপদ হতো না তোর বিপদ হতো।
বাহরুল ইসলাম প্রত্যুত্তর করলো না।তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন।কিছুক্ষণ পর সাহাবের দিকে তাকিয়ে সিগারেট মুখে পুরে বলেন,
– তুই কি কিছু ভেবেছিস?
– না।
– আর ভাবতে হবে না তোকে।আমরা খুব শীঘ্রই এই সম্পর্কে গোপন মিটিং এ বসবো।সেখানে ইনান থাকবে না।
– অবশ্যই।আজ তবে আমি আসি।ভালো থাকিস।
_
ক্যানভাসে রংতুলিতে রাঙিয়ে তুলছে সাদা কাগজটি একটি মেয়ে।যার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।ক্লিপ দিয়ে চুলগুলোকে আটকে রংতুলিটা মুখে পুরে কিছু একটা ভাবতে থাকে ক্যানভাসে দিকে তাকিয়ে।
– কি রে মা আসবো?
বাহরুল ইসলামের কন্ঠে ঘুরে তাকায় রুমু।
বাহরুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে রুমু।যার বৈশিষ্ট্য সবসময় চুপচাপ থাকা।নিজেকে ব্যস্ত রাখে রংতুলির মাঝে।ঝগড়া বিবাদে কখনো জড়িয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।
– তোমার এই রংতুলির যুদ্ধ কি কখনো থামবেনা রুমু মা?
– না বাবা, তুমি জানো আমি কতটা ভালোবাসি এই রংতুলি।কিছু বলবে তুমি?
– তোমায় আগেই বলেছি ইনানকে বাড়ির জামাই করতে চাই।কিন্তু তুমি তো কোন পাত্তাই দিচ্ছো না।
– আগেই বলেছি বাবা ইনানকে আমার সাথে যায় না।আমার প্রয়োজন শান্তশিষ্ট, আমাকে বুঝতে পারবে এমন ছেলে।আর প্রতিষ্ঠিত একটি ছেলে।কিন্তু ইনান ভাই সব কিছুর বিপরীত।
– কিন্তু আমাদের তো তাকে পছন্দ মা।
– বাবা এই সম্পর্কে পরে কথা হবে।এখন আমায় ডিস্টার্ব করো না।
– ঠিক আছে পরে কথা হবে তবে।
বাহরুল মুখভার করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মেয়েটা তার সহজ সরল।তবে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে এক পা ও ফেলবে না।নিজের ইচ্ছাতেই অনড় সে।
_
স্কুলের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ইতিকা এবং ইনান।গাড়ি থেকে নেমে ইনানকে বিদায় দিতেই ইতিকার চোখে পড়ে হাস্যজ্বল চেহারার রাতুলকে।ছেলেটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে।ইতিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়।তখনি কারো বুকের সাথে ধাক্কা লাগে তার।পেছনে ঘুরে ইনানকে দেখে ইতিকার ভেতরটায় আরো ভয়ের সঞ্চার হয়।কিন্তু ইতিকার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমান করে ইনান রাতুলের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
– হেই রাতুল কি অবস্থা?
– ভালো ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন?
– হুম ভালো। আমি যাচ্ছি ইতিকাকে ক্লাসে পৌছে দাও।
– চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমি আছি তো।
ইতিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনান এবং রাতুলের দিকে।দুইদিন আগেও যারা সাপ নেউলের মতো ঝগড়ায় মত্ত থাকতো তারা আজ কি করে এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ।
– আসছি ইতিবউ।
ইনান ইতিকাকে বিদায় দিয়ে হাটতে শুরু করে।ইতিকা তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় এক ছুটে দাঁড়ায় ইনানের সামনে।
– কি হলো ফিরে আসলে যে?
– রাতুলের সাথে হঠাৎ এত মেলামেশা বুঝলাম না।
– তোমার বুঝতে হবে না ইতিবউ।আমার বৈশিষ্ট্য বেইমান বন্ধুদের সাথে শত্রুতা করা আর শক্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা।
#চলবে…
সবগুলো পর্ব একসাথে – https://polyanan.com/tag/aguntuker-asokti/
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ❌
[ আজ নাকি প্রমিস ডে🤨।প্রমিস করো আজ সবাই গঠন মূলক মন্তব্য করবে🥺]