তপ্ত ভালোবাসা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া #পর্বঃ_৬৬

0
672

#তপ্ত ভালোবাসা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া
#পর্বঃ_৬৬

.
🍁
-” আমি সবটা জানতে চাই আর আপনি আমাকে সেই সবটা বলবেন নিরদ্বিধায় এখন। কি হয়েছে ছিল সেই রাতে ওদের সাথে?

.
আমার এমন কথায় মূহুর্তে থমকে যায় আসিফ। আমার মুখে এমন কিছু শুনার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না। আমি চমককের ধাপটা ছিল দ্বিগুণ। আমার দিকে ভিতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে। আমার কোনো কথায় কোনো রকম প্রতিক্রয়া না জানিয়ে চুপ করে যেতে নেই সেখান থেকে। কিন্তু আমার ইচ্ছাটা ছিল প্রবল তাই আবারও আটকা পড়তে হয় আমার হাতে আসিফকে। আমি আসিফকে জায়গায় থেকে নড়তে না দিয়ে খানিকটা নরম সুরে কাতর হয়ে বলে উঠে…..

.
—” আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইছি ভাইয়া। প্লিজ আমাকে বোন হিসাবে এতটা সাহায্য করুন। আমাকে যদি আজ ফিরিয়ে দেন তো আমার সাথে সাথে তিন তিনটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। যেটা আমি বা আপনি কেউ চাই না। আমি খুব অসহায় হয়ে ওঠেছি প্লিজ আমার অসহায়ত্বটা বুঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ আমাকে বলুন সেদিন কি হয়েছিল ওদের সাথে? আমার জানাটা খুব বেশি প্রয়োজন।

.
আমার এমন কথায় আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো রকম বনিতা ছাড়ায় বলে উঠে….
.

–” আপনাকে বলার মতো কিছুই নেই ভাবি। আজ আপনি অসহায় হয়ে পড়েছেন কিন্তু রিদ খান বিগত দুই বছর ধরে আপনার জন্য অসহায় হয়ে আছেন। আপনার অসহায়ত্বটা দুইদিনের কিন্তু রিদ খান যবে থেকে আপনার সাথে দেখা হয়েছে তখন থেকে তার অসহায়ত্বটা শুরু হয়েছে। আপনার অসহায়ত্বটা সীমিত কিন্তু রিদ খানের অসহায়ত্ব অসীম করে তুলেছেন আপনি দিন বা দিন। তার কি জবাব দিবেন আপনি?

.
আসিফের ক্ষেপ্ত সুরের কথায় মূহুর্তে কপাল কুঁচকে এলো আমার। আমি রিদ খানের অসহায়ত্ব হলাম কবে থেকে! আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে রিদ খানের সাথে আমার পরিচয়টা আসিফ ভাইয়া বিয়ের সময়। তাহলে আসিফ কেন বলছে রিদ খানের সাথে আমার পরিচয়টা দুই বছরের? তাহলে এখানে আরও কিছু কিন্তু আছে? রিদ খানের সাথে কি আমার আরও কোনো সম্পর্ক আছে? কথা গুলো চিন্তা ভাবনা করেই অস্থির হয়ে ওঠি আমি। নিজের অস্থিরতা নিয়ে আসিফকে বলে উঠি……

.
—” মানেহহহ?

.
আমার এমন কথায় হতাশ হয় আসিফ যা তার ফেঁসে স্পষ্ট ভেষে উঠে। নিজের এমন হতাশ পূণ্যতা নিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবারও আমাকে বলতে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে……

.
—” আপনি মানেটাই তো বুঝতে চাননি কখনো ভাবি! না কখনো দেখতে চেয়েছেন পাশের মানুষ গুলোকে। আপনার চারপাশে সবসময় ছায়ার মতো কাউকে না কাউকে দিয়ে রাখতো রিদ ভাই আপনার সেইফটির জন্য যাতে আপনার কিছু না হয়। আপনাকে নিয়ে ভাইয়ের মনে একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে সেটা আজ থেকে নয় সেটা আরও তিন বছর আগে থেকেই। হুমম আপনকে ভাই তিন বছর ধরে আগলে রেখেছে। আর আপনি যাদের অতীত সম্পর্কে জানতে এতটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন আমার কাছে সেই অতীতটা আর অন্য কারও নয় সেটা আপনার নিজেরই অতীত।

.
আসিফের মনস্তাপ কথায় মূহুর্তে থমকে যায় আমি। থমকে যাওয়া গলায় আবারও প্রশ্ন করে বলে উঠি…..

.
—” আমার অতীত?

.
—” হুমমম আপনার অতীত! সেদিন রাতে বর্ষা, কেয়া, সাথে পৃপ্তী নামের মেয়েটি ছিলেন আপনি। ভাইয়ার সাথে আশ্রমের সেই পৃপ্তী নামের মেয়েটি মানে আপনার সাথে সম্পর্ক ছিল গভীর ভাবে। যেটা আজ আপনি ভুলে গেছেন কিন্তু সেই ভালোবাসার ঘানি টানতে হচ্ছে আজও রিদ খানকে। সেদিন রাতের ভয়ানক আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই চলেও আপনি সেদিন বেঁচে গেছিলেন। সেদিন রাতে আমি আর রিদ ভাই নারী পাচারকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে ব্যস্ত ছিলাম। তাই আপনাদের কাছে আসতে অনেকটা ধরী হয়। আমরা যখন বাংলোতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফিরে আসি তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। আমরা আসতে আসতে ততক্ষণে চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পরেছিল আর এতটাই ছিল যে আমাদের হাতে কিছু করার ছিল না। সেদিন আমি প্রথম রিদ খানকে পাগলামো করতে দেখেছিলাম কোনো মেয়ে জন্য। রিদ খানকে আমরা সবাই মিলেও আটকে রাখতে পারছিলাম না ভাই এই আগুনে মধ্যে ঝাপিয়ে পড়তে চাইছিল আপনাদের বাঁচানোর জন্য। আর শুরু বুক ফাটা চিৎকার করছিল আমার রিত, আমার রিত বলে। আমরা বেশ কিছু বডিগার্ড মিলে ভাইকে আটকিয়ে রাখি সেদিন রাতে। আর ফায়ারসার্ভিসের লোকেরা দ্রুত আগুন নিভাতে দৌড়াদৌড়ি করছিল। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ একজন সংবাদ দেয় যে বাংলো পিছনের বাগানের মধ্যে একটা মেয়ে বডি পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। সেটি শুনার সাথে সাথে জানে জান ফিরে এসেছি রিদ ভাইয়ের দৌড়ে মেয়েদিকে উদ্ধার করে দেখলো মেয়েটি আপনি ছিলেন সেখানে পড়ে। তার পাশেই পড়ে ছিল আপনার হাতে লেখা একটি ডাইরি। সেদিন রাতে আপনি জালানা দিয়ে পরে যাওয়ায় আপনি খুব বাজে ভাবে ঘায়েল হলেও আপনি সেই যাত্রায় বেচে যান। আপনার দুই বান্ধবী কেয়া, আর বর্ষা দুইজনেই সেরাতে মারা যায় আগুনে পুড়ে। সেরাতের আগুনে থেকে কেয়া, বর্ষা ও মাদারের লাশ উদ্ধার করে ফায়ারসার্ভিসের লোকেরা। আপনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় রিদ খান হসপিটালের নিয়ে যায়। টানা ছয় মাস কোমায় ছিলেন আপনি। বাহির থেকে স্পেশাল ডক্টর আনিয়ে ট্রিটমেন্ট দেওয়ার হতো আপনাকে। আপনার মাথায় প্রচন্ড রকমের আঘাত পাওয়ার ফলে আপনাকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে টানা ছয় মাস। আর এই ছয় মাস রিদ ভাই জীবন্ত লাস হয়ে বেঁচে ছিল। নিজের কাজ কর্মের পাশা পাশি রাতে আপনার কাছে চলে আসতো। সারারাত আপনার পাশে থাকতো সকাল হলে আবারও নিজের কাজে যেতো। ছয়মাস মাস ছিল রিদ খানের কাছে একটা পরীক্ষা মতো নিজের ভালোবাসাটাকে বাঁচিয়ে রাখার সবোচ্চ অসাধ্যকে সাধ্য করেছেন।

.
কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আসিফ। আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে পরি পাথর মূতিই মতো নিজেকে বাক রুদ্ধ মনে হচ্ছে। কিছু বলার ভাষা নেই এই মূহুর্তে আমার। শুধু বোক ফাটা চিৎকার আচ্ছে। আমি নিজের দু’হাতে কাপড়ে দুই দিক শক্ত করে মুষ্টি বদ্ধ করে ঠোঁট কামড়িয়ে নিজের কান্নাটা আটকিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম আসিফের সামনে। আসিফ আমাকে নিচের দিকে তাকিয়ে নিরব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে…..
.

—“আপনার মাথায় আগের থেকে নাকি সমস্যা ছিল। আপনি নাকি কোনো একটা এক্সিডেন্টে কারণে ঘায়েল হয়েছিলেন আগেও একবার। আমার জানা মতে বয়স যখন বারো বছর তখন নাকি আপনার পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন কোথায় আর সেখান থেকে পরিবার নিয়ে ফেরার সময় আপনাদের গাড়িটির এক্সিডেন হয়। আর সেই এক্সিডেন্টে আপনি আপনার পরিবার থেকে দূরে চলে যান এবং সিতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আপনাকে রিশান নামক একটা ভদ্রলোক সরকারি হসপিটালের রেখে চিকিৎসার দিয়ে সুস্থ করে মিস নিথ্রিস এর আশ্রমে রেখে যায় মানে মাদার আশ্রমে আরকি। আর সেখানে আপনি পৃপ্তী নামে পরিচিত হয়ে সবার সাথে থাকেন। পরিচিত হন কেয়া আর বর্ষা সাথে। কেয়া, বর্ষা ছোট থেকেই ঐ আশ্রমে ছিল। আপনি দীর্ঘ চার বছর ঐ আশ্রমে ছিলেন এর মতোই ভাইয়ের (রিদ) সাথে পরিচয় তারপর ভালোবাসাটা হয়। ভাই আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পরই কিছু মাস পর আপনার আসল পরিচয় খুঁজে বেড় করে কিন্তু আপনার সিতিশক্তি না থাকায় আপনাকে আপনার পরিবারের কাছে পাঠাতে পারিনি। কারণ ডক্টররা বলেছেন আপনি নিজের থেকে যদি কোনো কিছু মনে না করতে পারেন তো আপনাকে জোর করে কিছু না মনে করিয়ে দিতে। যদি তা করে তো আপনি অতিরিক্ত চাপে কোমায় চলে যেতে পারেন। কারণ আপনাকে সরকারি হসপিটালের রেখে চিকিৎসা দেওয়া ফলে আপনার মাথায় জমাট বেঁধে থাকা রক্ত গুলো রয়ে গিয়েছিল। আর তার জন্যই চাইলেও রিদ খান আপনাকে আপনার পরিবারের কথা মনে করিয়ে দিতে পারতো না। আবার চাইলে সেটা অপারেশন করতে পারতো না ডক্টর বলেছেন যদি তখন অপারেশন করতে যায় তো আপনাকে হারানোর চান্সটা থাকবে ৯৫%। ভালো হওয়ার থেকে খারাপটাই বেশি হবে। সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে রিদ খানকে চুপ থাকতে হয়। এখান অবধি সবিই ঠিক ছিল রিদ খানের লাইফে কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয় তখন যখন আপনি ছয়টি মাস কোমায় থাকার পর চোখ খুলে তাকান। আপনার মাথার অপারেশনের পর ছয় মাস আপনি কোমায় ছিলেন এই ছয়টি মাস আপনাকে অবজারভেশনে রাখা হয় কিন্তু যখন আপনার হুস ফিরে আসে তখন আপনি কাউকে চিন্তে পারছিলেন না এমনকি রিদ খানকে না। আপনার আগের সিতিশক্তি ফিরে আসে এবং পরিবারের কাছে যেতে পাগল হয়ে ওঠেন। আপনাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে এক সাপ্তাহ শুধু ঘুম পারিয়ে রেখেছেন ডক্টরা কারণ তখন আপনার ব্রেইন শুধু রেস্ট দরকার ছিল পরিপূর্ণ ভাবে। আপনি যখনই হুস এ আসতে তখনই পাগলামো করতে পরিবারের কাছে যেতে এতটাই পাগলামো করতেন যে আপনার আশেপাশে কে ছিল সেটা দেখার প্রয়োজনও মনে করতেন না। আপনি একটা বার যদি পাশে তাকাতেন তাহলে দেখতে পারতেন রিদ খানের নিঃস্বতা, অসহায়ত্বা, কষ্টটা, আপনার পাগলামো দেখে শুধু নিরব দর্শকের নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো পাশে। আর ডক্টরা আর নাসরা আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করতো। অবশেষে আপনাকে থামাতে না পেরে রিদ খান আমার মাধ্যমে লোক দিয়ে আপনাকে আপনার বাসায় পাঠানো হয়। যারা আপনার নকল মা বাবা সেজে আপনার আসল বাবা মা কাছে নিয়ে যায় তারা আপনার অতীত সম্পর্কে সবটা বলে আপনার পরিবারকে। শুধু এতটা মিথ্যা বলে যে আপনাকে তারা বাচিয়েছে রিদ খানের নামটা তাদের নিতে না করা হয়েছিল সেদিন। আর সেদিনের পর থেকে আপনি দিব্যি নিজের মতো করে বাচতে শুরু করেন আর কেউ একজন আপনার জন্য রোজ ধোকে ধোকে মরছিল আর সেটা অন্য কেউ নয় রিদ খানই ছিল।

.
আসিফের সম্পূর্ণ কথা গুলো শুনে ঠাস করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পুরি আমি। নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে রিদ খানের অপরাধী। আমার চারপাশে এতো কিছু হয়ে গেল আমি কিছু বুঝতে পারিনি। আমাকে মাটিতে বসতে দেখে আবারও আস্তে করে বলে উঠে……..
.

—” আপনি কখনো কিছু লক্ষ করে দেখার প্রয়োজন বোধ মনে করেননি। যদি আপনি ভালো করে চারপাশটা সবকিছু লক্ষ করতেন তো আপনার চোখে সবিই ধরা পরতো। আপনি নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর পেতেন আজ আমাকে এখানে দাঁড়াতে হতো না।

.

.

.
চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here