প্রণয়ের_বন্ধন #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৮

0
353

#প্রণয়ের_বন্ধন
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তাহসিনের কেবিন থেকে বেরিয়েই নিজের ক্লাসে চলে গেল মেঘা। নিঃশব্দে বসলো তনুর পাশে। ক্লাসে শিক্ষক ছিল না কোনো। তনু ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে। মেয়েটার সাথে পরিচয় আজ প্রায় এক মাসের বেশি হয়েছে কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখেনি কখনও। তনু কনুই দিয়ে খোঁচা দিল মেঘাকে, বলল – কি হয়েছে? এভাবে মুখ লটকিয়ে আছিস কেন?

ওদের সোজাসুজি পাশের বেঞ্চেই বসে ছিল গৌরব। সে স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে তনুর কথা। গৌরব মুখ বাঁকিয়ে বলল – জামাই মরেছে ওর।

মেঘা কোনো প্রতিবাদ করলো না। এমনি সময় হলে এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে ফোঁস করে উঠতো মেঘা। গৌরব বুঝলো অবস্থা ভালো না। সে উঠে এলো মেঘার কাছে, কোমল কন্ঠে শুধালো – মন খারাপ?

মেঘা হ্যা না উত্তর দিল না। গৌরব বুঝলো এই চটপটে চঞ্চল মেয়েটার মন খারাপ কোনো কারনে। সে আবার বলল – ফুচকা খাবি?

চট করে লাফিয়ে উঠলো মেঘা। এই এক কথাতেই তার সব মন খারাপ যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। মেঘা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল – হ্যা হ্যা ফুচকা খাব আমি। তুই খাওয়াবি কিন্তু।

ঠোঁট বাঁকালো গৌরব, বলল – স্বামী মরলে তোর মরেছে আমি খাওয়াবো কেন?

– তাহলে বললি কেন? এখন ফুচকা তো খাওয়াতে হবেই। এই তনু চল চল।

তনুও লাফিয়ে উঠলো, বলল – চল চল।

দুপুরের তপ্ত রৌদ্র। সূর্যটা মাথার উপর তার তেজ নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। গৌরবকে টেনে টুনে বাইরা নিয়ে গেল মেঘা আর তনু। কলেজের বাইরে আসতেই মেঘার চোখ পড়লো তাহসিনের দিকে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দেখতেই মনে হচ্ছে অসুস্থ সে। চোখ দুটো টলমল করছে। মায়া হলো মেঘার, কিন্তু একটু আগে তাহসিনের ব্যবহার মনে পড়তেই ঠোঁট বাঁকালো সে। না সে যাবে না ঐ অভদ্র ডাক্তারের কাছে। একটু আগে তাকে কি পরিমান অপমানটাই না করলো। ছাতাটা ফেলে দিল ময়লার ঝুড়িতে। কেন ফেললো? শুধু মাত্র সে ব্যবহার করেছে বলে? মেঘা ধীর পায়ে হাঁটছে গৌরব আর তনুর সাথে। মেঘাকে ভাবুক ভঙ্গিতে দেখে তনু শুধালো – কি ভাবছিস?

ধ্যান ফিরলো মেঘার, বলল – উম কিছু না।

গৌরব আর তনুর সাথে হাঁটতে হাঁটতেই মেঘা পিছু ফিরে তাকালো তাহসিনের দিকে। কিন্তু আর এগোতে পারলো না সে। হাজার হলেও ওর জন্যই অসুস্থ লোকটা। সেদিন ওকে ছাতা দিয়েই তো বৃষ্টিতে ভিজেছিল সে। লোকটা তো অভদ্রই তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাই বেকার। তাই বলে সেও কি অভদ্র পাশান হয়ে যাবে? মোটেই না। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের সুযোগ সুবিধা দেখা তার কর্তব্য। এটা মানবতা। মেঘা গলা উঁচিয়ে গৌরব আর তনুকে বলল – তোরা দাঁড়া আমি আসছি।

– কোথায় যাচ্ছিস?

তনুর কথার পিঠে মেঘা শুধু উত্তর দিল – আসছি আমি।

মেঘা পিছন ঘুরে লম্বা লম্বা পা ফেলে এলো তাহসিনের কাছে, সে এখনও গাড়িতে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা তাহসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল – স্যার আপনি কি অসুস্থ?

দূর্বল চোখ দুটো তুলে তাকালো তাহসিন কিন্তু বলল না কিছুই। মেঘা আবার জিজ্ঞেস করল – স্যার সমস্যা কোনো? আপনাকে দেখে ঠিক লাগছে না।

তাহসিন গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিল – তাহলে কেমন লাগছে আমাকে?

– কেমন অসুস্থ অসুস্থ।

মেঘার কথার পিঠে তাহসিন কোনো উত্তর দিল না। মাথ নিচু করে নিচের দিকে তাকালো শুধু। এই মুহূর্তে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না তার। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী নিয়ে ঘুরছে সে। দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ড্রাইভারটাও এখনও আসছে না। ভুলে তাহসিন তার কেবিনেই নিজের ব্যাগটা ফেলে এসেছিল। সেটাই আনতে গিয়েছিল ড্রাইভার। কিন্তু এখনও আসছে না। তার মধ্যে এসে জুটেছে এই অভদ্র মেয়েটা আর তার বিরক্তিকর বকবকানি। তাহসিন বিরক্ত হচ্ছে বেশ। মেঘা গলা উঁচিয়ে দেখলো চারদিকে অতঃপর বলল – আপনার ড্রাইভার কোথায়?

– আপনাকে বলতে বাধ্য নই।

তাহসিনের কাঠ কাঠ কন্ঠে একটু আগে তাহসিনের উপরে হওয়া রাগ অভিমানটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো মেঘার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – মরবে তবুও ভালো কথা বলতে পারবে না। খবিশ লোক একটা। যাই হোক আমার কি? এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে আমার। এর জন্যই লোকে বলে ভালো মানুষের দাম নেই আজকাল। বেশি ভালো মানুষি করতে এসেছিলাম কিনা।

মেঘা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে সামনের দিকে পা বাড়ালো তখনই পিছন থেকে ধপাস করে একটা আওয়াজ হলো। তড়িৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো মেঘা, তাহসিন পড়ে আছে মাটিতে। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে, আঁতকে উঠলো মেঘা। দৌড়ে গেল তাহসিনের কাছে। বসে পড়লো তার মাথার কাছে। তাহসিনের গায়ে হাত পড়তেই চমকে উঠলো, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। অস্থির হয়ে পড়লো মেঘা। এখন কি করবে? গৌরব আর তনুর কথা মনে আসতেই গলা উঁচিয়ে ডাক দিল তাদের – গৌরব, তনু তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।

মেঘার ডাক শুনেই দৌড়ে এলো ওরা। তাহসিনকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে অস্থির হয়ে পড়লো ওরা দুজনও। তনু ব্যস্ত কন্ঠে শুধালো – কি হয়েছে স্যারের?

– জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে মনে হয়। ধর তোরা হাসপাতালে নিতে হবে এক্ষুনি।

গৌরব, মেঘা আর তনু তিনজন কোনো রকম ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল তাদের। তাহসিনকে দেখেই অন্যরা চিনতে পেরেছে। দ্রুত কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা শুরু করেছে। তাহসিনের এমন খবর পেয়ে আফজাল তালুকদারও ছুটে এসেছে। স্যালাইন লাগানো হয়েছে তাকে। জ্বরে এমনি দূর্বল ছিল তার উপর সকাল থেকে না খেয়ে ছিল তাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। গৌরব, তনু আর মেঘা তিনজন তাহসিনের পাশেই বসা ছিল।

_______________________________________

পড়ন্ত বিকেল। সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। তাহসিনের জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে। পিটপিট করে চোখ খুললো সে। দূর্বল চোখে তাকালো চারদিকে। মেঘা, গৌরব আর তনুর দেখা মিললো। আফজাল তালুকদার রোগী রেখে এসেছিল তাই সে এসে কিছুক্ষণ পরই চলে গিয়েছিল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। উঠে বসতে চাইলো মেঘা দ্রুত এগিয়ে গেল তার কাছে, বলল – একদম উঠবেন না, ডাক্তার আপনাকে উঠতে বারন করেছে।

তাহসিন শীতল দৃষ্টিতে তাকালো মেঘার দিকে, থতমত খেল সে। মিনমিনিয়ে বলল – না মানে আপনার শরীর দূর্বল।

তাহসিন শুনলো মেঘার কথা, উঠলো না বরং শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যা হয়েছে। সূর্য ডুবে গেছে ক্ষানিক আগে। এখনও সম্পূর্ন অন্ধকার হয়নি, আবছা আলো আছে এখনও। মেঘা চিন্তায় পড়ে গেছে রাতে তাহসিনের সাথে থাকবে কে? লোকটা এত অসুস্থ কিন্তু বাড়ির লোক বলতে তো কাউকেই চোখে পড়লো না। শুধু মাঝে ঐ একবার আফজাল তালুকদার এসেছিল এই যা। তাহলে বাড়ির লোকেরা কি এখনও খবর পায়নি? হয়তো পায়নি, বাড়ির লোক চিন্তা করবে বিধায় জানায়নি সম্ভবত। তনু চলে গেছে বাড়িতে। মেঘা আর গৌরব তাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আরও আগে। তাহসিন এখন মোটামুটি সুস্থ। সে কিছুতেই থাকতে চাইছিল না হাসপাতালে কিন্তু তার সিনিয়র ডাক্তাররা একদম আজ বাড়িতে ফিরতে বারন করে দিয়েছে তাকে। তাহসিন আশেপাশে তাকালো অতঃপর গৌরব আর মেঘার দিকে তাকিয়ে বলল – রাত হয়ে আসছে, বাড়ি যাচ্ছেন না কেন?

ইতস্তত করছে মেঘা, কিছু হয়তো বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। তাহসিন বুঝলো মেঘার ইতস্ততবোধ। সে শান্ত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করল – কিছু বলবে?

– আসলে বলছিলাম আপনার বাড়ির কেউ আসবে না?

– না আসবে না।

– কেন?

– এই কেনর কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।

তাহসিন ভাবলেশহীন। মেঘা চিন্তায় পড়ে গেল, চিন্তিত কন্ঠেই বলল – আপনাকে এই অবস্থায় একা ফেলে কিভাবে যাব?

তাহসিন তাকালো মেঘার দিকে। মেয়েটা তার জন্য চিন্তা করছে? হয়তো এই পৃথিবীতে এই প্রথম কেউ তার জন্য চিন্তা করছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তাহসিন, বলল – আমার একা থাকার অভ্যাস আছে।

– হয়তো আছে, কিন্তু আমি আপনাকে এভাবে অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারি না। এতটা নির্দয়ও আমি না।

তাহসিন শীতল দৃষ্টিতে তাকালো মেঘনার দিকে। গৌরব এতক্ষন শুনছিল ওদের কথা। ওদের কথার মাঝেই সে বলল – আমি থাকছি।

মেঘা তাকালো গৌরবের দিকে। গৌরব একটু থেমে মেঘনার দিকে আবার বলল – তুই মেয়ে তোর এখানে থাকাটা ভালো দেখাবে না। তুই চলে যা আমি থাকছি স্যারের কাছে।

মেঘা যেন একটু স্বস্থি পেল। তার চির শত্রু এই অভদ্র ডাক্তারের জন্য আজ হুট করেই ভীষন চিন্তা হচ্ছে, খারাপ লাগছে। হয়তো মনুষ্যত্ববোধের জন্য। এমনিও মেঘার মনটা ভীষণ নরম। অন্যের কষ্ট একদম সহ্য করতে পারে না সে। মেঘা চলে গেল হাসপাতাল থেকে, গৌরবকে অনেক বারন করার পরও থেকে গিয়েছে সে। তাহসিন আজ ভীষণ অবাক
হয়েছে। যেখানে তার কাছের মানুষগুলোর তার কথা মনেই নেই, কখন তাদের পাশে পায়নি সে সেখানে এই কয়েকদিনের পরিচয় হওয়া ছেলে মেয়েগুলো কত কি করছে তার জন্য। সবচেয়ে অবাক হচ্ছে মেঘাকে দেখে। মেয়েটার সাথে তার সাপে নেউলে সম্পর্ক, যখন দেখা হয় তখনই ঝগড়া। দুজন দুজনের চোখের বিষ অথচ আজ সেই মেয়েটাই চিন্তা করছে তার জন্য। সেই মেয়েটাই ব্যথিত তার ব্যথায়।

চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here