#প্রণয়ের_বন্ধন
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আজও সকাল সকালই হাসপাতালে চলে এসেছে মেঘা যদিও আজ তার মাথায় কোনো কুটবুদ্ধি নেই। একদম ফ্রেস মনে এসেছিল যে এসে মন লাগিয়ে কাজ করবে। কিন্তু একি কেবিন খুলে ভিতরে ঢুকেই চোখ তার কপালে। এটা কেবিন নাকি গরুঘর? কেবিনের এই অবস্থা হলো কি করে? সব কিছু ছড়ানো ছিটানো। কেবিনের মেঝেতে মাটি পর্যন্ত লেগে আছে। রাগে দাঁতে দাঁত চাপলো মেঘা। এই কাজ নির্ঘাত ঐ অভদ্র ডাক্তারের। তাকে খাঁটানোর জন্য এইসব ইচ্ছে করে করেছে। কিন্তু কি আর করার তাকে তো করতেই হবে। মেঘা রাগে গজগজ করতে করতে কাজে লেগে পড়লো। যে মেঘা কিনা বাসায় এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না উঠতে বসতে মায়ের বকুনি খায় সেই মেঘা কিনা আজ গাধার মতো খাটছে। এর প্রতিশোধ তো মেঘা নিবে। যে করেই হোক নিবে। রাগে গজগজ করতে করতে কেবিনটা সম্পূর্ণ গুছিয়ে ফেললো মেঘা। সব গুছিয়ে উঠে একটু বসতে পারলো না এর মধ্যেই এসে জুটলো তাহসিন। এসেই তাড়া দিয়ে বলল – চলুন রোগী চেকিং এ যাব।
– কিন্তু স্যার।
– কোনো কিন্তু নয়। এর পর আবার আপনার ক্লাস আছে তো।
অগত্যা মেনে নিতে হলো তাসকিনের কথা। আর বসা হলো না তার, কাঁধ ব্যাগটা ঝুলিয়ে ছুটলো তাহসিনের পিছু পিছু। রোগী চেকিং করতে করতে সময় গড়িয়েছে অনেকটা। মেঘাকে তাহসিন ছাড়লো ক্লাস শুরুর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে। এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে মেঘার। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার আর সময় নেই তার । ওদিকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আর ইতি উতি না ভেবে দৌড় লাগালো ক্লাসে।
____________________________________
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। সূর্যটার তেজও প্রখর। গ্রীষ্মকালের কাঠফাঁটা রোদ। সারা সকাল দৌড়াদৌড়ি করে ক্লাস করে মেঘার হাল বেহাল। শরীরটা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাসরুম থেকে তাহসিনের কেবিনে যাওয়ার শক্তিই পাচ্ছে না সে। তবুও অনেক কষ্টে ধীর পায়ে হেঁটে গেল তাহসিনের কেবিনে। তাহসিন নেই কেবিনে, মেঘা দরজা খুলে বসলো চেয়ারে। মাথাটাও প্রচন্ড ধরেছে। অবশ্য এইটুকু কাজ তাকে এভাবে কাবু করতে পারতো না। সে খেয়ে আসেনি সকালে ভেবেছিল কলেজের ক্যান্টিনে খেয়ে নিবে। কিন্তু সেই সময়টাই যেন পায়নি সে। এখন অবধি পানি ছাড়া পেটে পড়েনি আর কিছুই। শরীরটাও বেশ দুর্বল লাগছে। মেঘা ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করলো। একটুখানি খেয়ে টেবিলের উপর রাখলো। তখনই কেবিনে প্রবেশ করলো তাহসিন , এক হাতে হাতে তার খাবারের একটা প্লেট, আর অন্য হাতে ছোট একটা বাটি । মেঘা একবার তাকালো তার দিকে অতঃপর চোখ ঘুরিয়ে আবার পানির বোতলটা হাতে নিল। তাহসিন প্লেটটা নিয়ে রাখলো মেঘার সামনে, বলল – খেয়ে নিন।
মেঘা অবাক হলো। অবাক সুরেই বলল – আমি?
তাহসিন চোখ ঘুরিয়ে দেখলো চারদিকে অতঃপর বলল – আর তো কাউকে দেখছি না।
মেঘা এবার ভালোভাবে তাকালো প্লেটের দিকে সেখানে ভাত, এক টুকরো মাছ, করলা ভাজি আর একটা ছোট বাটিতে পাতলা ডাল। সব মেঘার অপছন্দের খাবার। করলা ভাজি তো সে জীবনেও খায়নি এর জন্য মায়ের হাতে কত মাইর যে তাকে খেতে হয়েছে তার হিসাব নেই। মাছ মোটামোটি খায় কিন্তু কাঁটা বাছতে সমস্যা। আর ডাল তো সে সহজে ছোঁয় না। মোট কথা তার ভাত খেতেই অনীহা। সব খাবারগুলো একে একে পর্যবেক্ষণ করলো মেঘা, মেকি হাসলো। খাবারের প্লেটটা হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলল – বাসায় গিয়ে খাব আমি, খিদে নেই।
ধমক দিলো তাহসিন, বলল – খিদে নেই মানে কি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না সকাল থেকে পেটে পড়েছে কিছু। এখন না খেয়ে মরে গিয়ে কি আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন নাকি?
– একদম বাজে কথা বলবেন না।
– খেয়ে নিন তাহলে আর বাজে কথা বলবো না।
যদিও খাবার দেখে পছন্দ হয়নি মেঘার কিন্তু খিদে পেয়েছে ভীষণ। তাই আর অনীহা করলো না সে। টেনে প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিল। মাছের টুকরোটা এক পাশে রেখে খাওয়া শুরু করলো। তাহসিন কি ভাবলো কে জানে, সে একটা ছোট্ট প্রীচ এনে মাছের টুকরোটা তাতে নিয়ে নিল। একটু একটু করে মাছ বেছে আবার মেঘার প্লেটে তুলে দিতে শুরু করলো। মেঘা কেবল প্রথম লোকমা ভাত মুখে পুড়েছিল। হঠাৎ তাহসিনকে মাছ বেছে দিতে দেখে গাল ভর্তি ভাত নিয়েই গোল গোল চোখে তাকালো তার দিকে। তাহসিন বুঝলো এ তাকানোর মানে। সে শান্ত কন্ঠেই বলল – ওভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই । সাহায্য করছি জাস্ট মানবতার খাতিরে।
মেঘা কিছু বলল না আর, চোখ নামিয়ে ভাতের দিকে মনোযোগী হলো। অল্প গেল সে এরপর প্লেটটা তাহসিনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল – আর খাব না।
– তো কি মাইর খাবেন? সম্পূর্ণটা শেষ করুন।
– পেট ভরে গেছে আমার।
– আমি কি জানতে চেয়েছি নাকি আপনার পেট ভরেছে নাকি খালি আছে? দ্রুত খাবার শেষ করুন।
মেঘা গাল ফুলালো, বলল – না খাব না আমি। এমনিই আমি এইসব তরকারি খাই না তারপরও যতটুকু খেয়েছি এই বেশি।
– বাহ গর্ব করে কথাটা বলছেন দেখছি। কিন্তু এসব না খেলেও এখন থেকে আপনাকে এসবই খেতে হবে। বাইরের অখাদ্য কুখাদ্য খেতে খেতে তো পেটের মধ্যে গ্যাস্টিকের পাহাড় গড়েছেন।
– দেখুন!
তাহসিন চোখ গরম করে তাকালো মেঘার দিকে, বলল – তাড়াতাড়ি শেষ করুন। এ বিষয়ে আপনার সাথে আমার কোনো খাতির চলবে না।
মেঘা অসহায় দৃষ্টিতে ভাতের দিকে একবার তাকালো আর একবার তাহসিনের দিকে। এতগুলো ভাত একসাথে তো সে কখনও খায়নি তার উপর আবার তার অপছন্দের তারকারি। মনে মনে তাহসিনের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে আবার ভাতে হাত দিল মেঘা। তাহসিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘনার দিকে। মেঘা খাচ্ছে আর একটু পর পর দাঁত কিড়মিড় করে তাহসিনের দিকে তাকাচ্ছে। হাসি পাচ্ছে তাহসিনের, কিন্তু নিজেকে সংযত করে রেখেছে সে। এই মুহূর্তে হাসা মানেই বিপদ। তবে এই চোখ! এই চোখ দেখেছে তাহসিন, তার স্বপ্নে তার হৃদয়ে এই চোখের, এই দৃষ্টির আনাগোনা। যদিও এখনও সে শিওর হতে পারছে না মেঘাই কি সেই মেয়ে? অনেক সময় দেখা যায় মাস্ক পড়লে কিছু কিছু মানুষের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অর্থাৎ মাস্ক পড়লে চোখ সুন্দর দেখায় কিন্তু মাস্ক খুললে চেহারাও আশানুরূপ হয় না আর তখন চেহারার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে চোখগুলোও সুন্দর লাগে না।
তাহসিন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। জীবনের ২৯ টা বসন্ত পার করেছে সে। এখনও অবধি প্রেম এলো না তার জীবনে। আসবে কিভাবে সে কখনও আসতে দেয়নি, নিজের একাকিত্বকে বরন করে নিয়েছিল সানন্দে। কলেজে পড়ার সময় যখন ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা একে অন্যের সাথে হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত থাকতো তখন সে মুখ গুজে থাকতো বইয়ে। কখনও তার জীবনে বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে এলেও ভদ্রভাবে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাহসিন। সে কখনও চায়নি তার এককিত্ব জীবনে কাউকে সঙ্গী হিসেবে নিতে। তার মনের কোনের বিষন্নতাকে ভাঙতে পারেনি কেউ। তার স্বপ্নে জায়গা করে নিতে পারেনি কেউ। কিন্তু এই মেয়ের শুধু মাত্র চোখ দুটোই তার হৃদয়ে তোলপাড় করে দিয়েছে। জীবনের সকল চিন্তা ভাবনা ব্রতকে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু কে সেই মেয়ে জানা নেই তার। এভাবে সন্দেহ করেও যেকাউকে সে ধরে নিতে চায় না সেই মেয়ে হিসেবে। দরকার হয় সম্পূর্নভাবে তার সামনে আসার অপেক্ষা করবে সে। অপেক্ষার ফল অবশ্যই সুমিষ্টি হয়।
তাহসিনের ভাবনার মধ্যেই খাওয়া শেষ করলো মেঘা। চেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে বলল – নিন খাওয়া শেষ।
তাহসিন প্লেটের দিকে তাকালো। প্লেটে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুটি কয়েক ভাত। ধমক দিল তাহসিন , বলল – মুরগির বাচ্চার মতো প্লেটে ভাত ছড়িয়ে রেখেছেন কেন? প্লেট পরিষ্কার করে খান।
মেঘা বিরক্তি নিয়ে তাকালো তাহসিনের দিকে, হাত বাড়িয়ে ভাতগুলো নিয়ে মুখে পুরো, বলল – হয়েছে এবার?
– এই তো গুড গার্ল। একটু বিশ্রাম করুন। আজ আর কাজ হবে না একটু পর বাড়ি চলে যাবেন।
মেঘা অবাক হলো । সারা সকাল এত এত খাটিয়ে এখন দরদ দেখাচ্ছে। মুখ বাঁকালো মেঘা। বিরবিরিয়ে বলল – ঢং
_____________________________________
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে হয়তো নীড়ে ফেরার তাড়া তাদের। মেঘা মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। শরীরটা এখন আগের থেকে বেশ ভালো। চারতলা বাড়িটা মেঘাদের, নিজস্ব বাড়ি। এই বাড়িরই তলায় থাকে তারা বাকি সব ভাড়া দেওয়া। মামুন সাহেব একটা গার্মেন্টসের উপরক্ত কর্মকর্তা, তাছাড়া মাস শেষে বাড়ি ভাড়া আসে। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় তাদের। মেঘা লাগাতার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কিন্তু খুলছে না কেউ। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার তার বেশ বিরক্ত লাগছে। এবার বেশ রেগেমেগেই কলিং বেল বাজালো মেঘা। সাথে সাথেই দরজাটা খুলে গেল। বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই চমকে গেল মেঘা। মুহুর্তেই হাসি ফুটে উঠল তার। হাস্যজ্জ্বৌল মুখে বলল – মুহিত ভাই!
ঠোঁট বাঁকালো মুহিত, বলল – এই তোর আসার সময় হলো? কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলাম তোর।
মেঘা ঘরের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিল – কাজ ছিল ভাই। কখন এসেছো? ফুপি এসেছে?
– সেই দুপুরে এসেছি। না মা আসেনি। আমি একাই এসেছি।
– যাক অবশেষে আসলে তাহলে। তোমাকে কতদিন বলেছি আসতে তুমি আসোই না শুধু তারিখ দেও।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ