#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_45
#ইয়াসমিন_খন্দকার
সমুদ্র রেগে গিয়ে নিজের ঘরে এসে বসে থাকে। কোনভাবেই প্রণালীকে শায়েস্তা করতে না পেরে ভীষণ রেগে আছে সে। সমুদ্র নিজের কপাল চাপড়ে বলে,”মেয়েটার মধ্যে কি আছে? ওর কোন ফিলিংস হয় কি না? এত কিছুর পরেও কেউ কিভাবে এত স্বাভাবিক থাকতে পারে? ওকে জব্দ করতে গিয়ে আমি তো নিজেই জব্দ হয়ে বসে আছি।”
সমুদ্রের এমন ভাবনার মাঝে কেউ তার দরজায় নক করে। সমুদ্র বলে,”কে?”
তখনই রায়ান সাহেব বলে ওঠেন,”আমি, সমুদ্র। তোমার রায়ান আঙ্কেল। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
“ওহ, আঙ্কেল আপনি ভেতরে আসুন।”
রায়ান সাহেব ভেতরে এসে সমুদ্রকে বলল,”কি ব্যাপার? তুমি হঠাৎ করে সবার মাঝ থেকে চলে এল?”
“না, মানে…”
“দেখো সমুদ্র, এখন তোমার সাথে আমার মেয়ের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। তাই আমি তো তোমাকে অবহেলা করতে পারি না। আমি জানি, হয়তো প্রণালীকে নিয়ে তোমায় অনেক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। কারণ প্রণালী এখন অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আজ ওকে দেখে আমি নিজেই এটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি।”
সমুদ্র কিছুই বলে না। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলার মতো কিছুই খুঁজে পায়না। এরমধ্যে রায়ান সাহেব বলেন,”আমার মেয়েটা এমন ছিল না। হঠাৎ করেই ওর জীবেন আসা কিছু ধাক্কা ওকে এভাবে বদলে দিয়েছে বাবা। তুমি একটু ওর সাথে মানিয়ে নিও।”
সমুদ্রর কৌতুহল বাড়ে। সে তো আগে থেকেই প্রণালীর এমন ব্যবহারের কারণ জানার চেষ্টা করছিল। আর এখন রায়ান সাহেবের কথা শুনে তার এই আগ্রহ বাড়লো আরো বেশি। তাই সে বলে উঠল,”কি হয়েছে প্রণালীর সাথে যে ও এমন ব্যবহার করছে?”
রায়ান সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আমি তোমার থেকে কিছুই লুকাতে চাই না বাবা। আমি তোমাকে সব খুলে বলছি।”
এই বলে তিনি সমুদ্রকে শান্তর ব্যাপারে, শান্ত প্রণালীর সাথে কি কি করেছে এবং কি পরিস্থিতিতে প্রণালী বিয়েতে রাজি হয়েছে সব বলেন। সব শুনে সমুদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে প্রণালীর উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে তাই সে এমন শক্ত হয়ে গেছে।
সমুদ্র যখন নিজের ভাবনায় মশগুল ছিল তখনই রায়ান সাহেব তার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে বাবা। আমি জানি ওর সাথে মানিয়ে নিতে এখন তোমার অনেক অসুবিধা হবে। আমি বাবা হিসেবে এইজন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, আমার মেয়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। ও কিন্তু মোটেই খারাপ মেয়ে নয়। এখন যেমন চুপচাপ আর নির্লিপ্ত দেখছ ও কিন্তু ঠিক এর বিপরীত স্বভাবের।”
সমুদ্র চৌধুরী বলে,”আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার মেয়ের খেয়াল রাখব।”
মুখে এই কথা বললেও মনে মনে সে বলে,”প্রণালীকে স্বাভাবিক করতে হবেই। আমার প্রতিশোধ নেওয়া যে এখনো বাকি।”
তবে প্রতিশোধের কথা বললেও সমুদ্রের মন যে প্রণালীর প্রতি একটু বলেও দূর্বল হয়ে গেছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। তবে এই দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে চায় না সমুদ্র। সে ভাবছিল সবই হয়তো ইমোশন। হঠাৎ করে প্রণালীর দুঃখের কথা শুনে হয়তো তার প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে। যেমনটা স্বাভাবিক। বাড়ির একটা কুকুর বেড়ালের প্রতিও এমন মায়া হয়। এই ভাবনা থেকেই সমুদ্র ভাবল এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আসলেই কি তাই? তার উত্তর তো সামনে পরিস্কার হবে।
~~~~~
প্রণালী সবাইকে নিজের হাতে খাবার খেতে দিচ্ছিল। এটাই নাকি চৌধুরী বাড়ির নিয়ম। যদিও রান্না বাইরের লোকই করেছে। অতিথিরা সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে বিদায় নেয়। রায়ান সাহেবও প্রত্যুষকে নিয়ে চলে যান। আর এরপরই পুষ্পা চৌধুরী সুযোগ পেয়ে যান নিজের আসল রূপ দেখানোর। এইজন্যই তো তিনি সমুদ্রকে বলেন,”বাবাই তুমি খাওয়া দাওয়া শেষ করে টায়রাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরতে যাও। মেয়েটা কতদিন পর দেশে ফিরল। দেশটা একটু ঘুরে দেখুক।”
সজল চৌধুরী বলেন,”এসব তুমি কি বলছ? তোমার ছেলের সবে সবে বিয়ে হয়েছে। আর ও কিনা নিজের বউকে ফেলে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাবে! এটা কোন আঙ্কেলে বলছ তুমি? তোমার কি কোন সেন্স নেই?”
“তোমার কোন কথা আমি শুনতে চাইনি৷ তুমি নিজের মতো খাও। আমার বা আমার ছেলের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।”
সায়মা চৌধুরী বলে ওঠেন,”ভাবি! তুমি কিন্তু এটা ঠিক করছ না। সবার সামনে ভাইয়াকে এভাবে বলার অধিকারও কিন্তু তোমার নেই।”
“তুমি নিজের সীমার মধ্যেই থাকো। অনুষ্ঠান তো মিটে গেছে। তাহলে তুমি এখানে পড়ে আছ কেন? যাও নিজের বাসায় যাও।”
সায়মা চৌধুরী অপমানিত বোধ করেন। তবুও বলেন,”এটা আমার বাবার বাড়ি। এখানে আমি যতদিন ইচ্ছা থাকব।”
পুষ্পা চৌধুরী বাকা হেসে বলেন,”কিন্তু এই বাড়িটা তো আমার নামে। তাই এখানে থাকতে চাইলে তোমার আমার কথা শুনে চলতে হবে।”
সায়মা চৌধুরী একদম চুপ হয়ে যান। খাওয়া শেষ করে সমুদ্র টায়রাকে বলে,”চলো আমরা ঘুরতে যাই।”
টায়রাও বিনাবাক্যে রাজি হয়। প্রণালীর পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। সমুদ্র প্রণালীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”দেখি, তুমি কতদিন এমন সহ্য করে চলতে পারো। একদিন না একদিন তোমায় রিয়্যাক্ট করতেই হবে।”
~~~~~~
রাতে বাসায় ফিরে সমুদ্র প্রথমে নিজের রুমে ঢো মারে। সে দেখে প্রণালী তার রুমেই শুয়ে আছে। সমুদ্র রুমে প্রবেশ করে প্রণালীকে বলে,”তুমি এই রুমে কি করছ? এটা আমার রুম। বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”
প্রণালী কোন কথা না বলে উঠে বসে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। প্রণালী রুম থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় সমুদ্র তাকে আটকে দিয়ে বলে,”এমন কেন তুমি? তোমাকে আমি বললাম আর তুমি বেড়িয়ে যাচ্ছ। একটু প্রতিবাদ তো করতে পারো। নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা তো করতে হবে।”
প্রণালী স্বাভাবিক থেকেই উত্তর দেয়,”যা আমার নয়, তার উপর আমি অধিকার দেখাই না।”
প্রণালীর এই কথা ভীষণ হার্ট করে সমুদ্রকে। সে প্রণালীর হাত ছেড়ে না দিয়ে প্রণালীকে নিজের আরো কাছে নেয়। প্রণালী প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। এক ঝটকা দিয়ে সমুদ্রকে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর একদম স্বাভাবিক ভাবে রুম থেকে চলে যাবার চেষ্টা করে যেন কিছু হয় নি। কিন্তু এতে করে সমুদ্র আরো রেগে গিয়ে আবার প্রণালীকে নিজের কাছে টেনে নেয়। প্রণালী থমথমে গলায় বলে,”ছাড়ুন আমায়।”
সমুদ্র বলে,”না, ছাড়বো না। আজ তোমায় আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এমন পাথরের মতো হয়ে আছ কেন তুমি? কেন কিছুতেই আমি তোমায় জব্দ করতে পারি না? তোমার মধ্যে কি কোন ফিলিংস নেই।”
“না, নেই।”
প্রণালীর স্পষ্ট উত্তর।
” আমাকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখলে তোমার কষ্ট হয় না?”
“না, হয়না।”
“নিজেকে তুমি আমার স্ত্রী বলে মানো না?”
“না, মানি না।”
প্রণালীর সব কথা যেন সমুদ্রর গালে এক একটা থাপ্পড়ের মতো লাগে। সমুদ্র চৌধুরী, যে নিজের সৌন্দর্য আর বংশ পরিচয়, ধন-সম্পদ নিয়ে সবসময় অহংকার করেছে। যার সাথে কথা বলার জন্য সব মেয়েরা উৎসুক থাকে তাকে কিনা এই মেয়েটা ঘোল খাওয়াচ্ছে। তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছে না। এটা তার হজম হয় না। সমুদ্র প্রণালীর আরো কাছে যেতে চাইছিল এমন সময় পুষ্পা চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হন। এসেই দুজনকে এত কাছাকাছি দেখে রেগে যান। চিৎকার করে বলেন,”বাবাই! কি করছ তুমি? এই মেয়ের থেকে দূরে সরে আসো।”
হঠাৎ মায়ের গলা শুনে সমুদ্র ছিটকে সরে আসে। প্রণালী পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রের কাছে এসে বলেন,”বাবাই, তুমি এই মেয়েটার এত কাছে ছিলে কেন? যাও আমার রুমে যাও।”
সমুদ্র মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো তার কথায় চলে যায়। সে যাওয়ার পর পুষ্পা চৌধুরী প্রণালীকে বলেন,”একদম আমার বাবাইয়ের কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তোমার উদ্দ্যেশ্য আমি বুঝি না ভেবেছ, নিজের রূপ দিয়ে ছলাকলা করে আমার বাবাইকে ভোলাতে চাইছ। এভাবে তুমি আমার বাবাইকে পাবে না। আমার বাবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি না বলা পর্যন্ত ও তোমায় ছুয়েও দেখবে না। তুমি আমার থেকে আমার বাবাইকে কেড়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করো না। তুমি কিছুতেই বাবাইকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
to be continue…