ইরার হাত চেপে ধরে,ইরার হাতে সযত্নে গরম কপি ঢেলে দিলো মাহির। ছোট্ট ইরার হাতে ফোসকা পরে গেলো, মুহুর্তেই। বারো বছর বয়সী বালিকা ইরা শব্দ করে কান্না করতে চাইলে,আট বছর বয়সী বালক মাহির তার মুখ চেপে ধরে বলে, ‘ খবরদার ইরাবতী,আপনি একদম শব্দ করবেন না, নাহলে এর থেকেও ভয়ংকর এবং কঠোর শাস্তি আপনাকে দেয়া হবে।’
ইরা শব্দ করলো না, সে ফুপিয়ে কান্না করলো। সে কাঁদতে কাঁদতেই প্রশ্ন করলো, ‘ আমার দোষটা কী? বলবি তো মাহির?’
মাহির চোখ গরম করে জবাব দিলো, ‘ আপনি আমার বন্ধুদের সাথে আজকে লুকোচুরি খেলেছেন, তাও আমার অনুমুতি ছাড়া। কাজটা আপনি মোটেও ঠিক করেন নি। ‘
‘ কেন? আমি অন্য কারো সাথে খেলা করলে, তোর কিসের সমস্যা? সবসময় কি তোর অনুমুতি লাগবে? ‘
মাহিরের ইরার প্রশ্ন সহ্য হচ্ছে না। এদিকে ইরার হাতে ফোসকা পরে অবস্হা নাজেহাল! ইরা শব্দ করেই কান্না করতে লাগলো। ইরার কান্না শুনে, মাহির তাকে থামাতে চাইলো কিন্তু ইরা থামলো না। সে উচ্চশব্দে মা গো, বাবা গো বলে চেচিয়ে কান্না করলো। ইরার কান্না শুনে উপর থেকে সিড়ি বেয়ে ইরার বাবা আফজাল হোসেন এবং মা কবিতা নেমে আসে। মাহিরের বড় বোন স্নেহা ও দৌড়ে ছুটে আসে। ইরার হাতের অবস্হা দেখে তাদের বুঝতে বাকি রইলো না,কাজটা মাহিরের। আফজাল হোসেন মেয়ের ফোসকা পরা হাতে দ্রুত বরফ ঢলে দিতে লাগলেন। কবিতা মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন। স্নেহা ভাইয়ের দিকে ক্রোধান্বিত আখিজোড়া মেলে তাকালো, তাতে কোনপ্রকারু ভ্রুক্ষেপ নেই মাহিরের। সে দাঁতে দাঁত চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা তার ভাইয়ের কাঁধ চেপে ধরে প্রশ্ন করে, ‘ তুমি ইরার হাতে গরম কফি ঢেলেছো কেন, হ্যা? বড্ড বেয়াদপ হয়েছো তুমি!’
‘ আমি যা করেছি, একদম বেশ করেছি। উনি আমার বন্ধুদের সাথে খেলবেন কেন? ‘
ছোট্ট ভাইয়ের এমন ভ্রুক্ষেপহীন কথা শুনে, স্নেহা হাত উচিয়ে থাপ্পড় মারতে চাইলে, আফজাল হোসেন দ্রুত ভাগ্নির হাত ধরে রুখে দিয়ে বললেন, ‘ কি করছিস স্নেহা? ওর গাঁয়ে এইভাবে হাত তুলিস না।’
‘হ্যা, স্নেহা, আমাদের তো মাহিরকে বুঝাতে হবে, এমনভাবে মারধর করলে তো মাহির আরো বিগড়ে যাবে।’
কবিতার কথা শুনে, স্নেহা কনুই দিয়ে ললাটে ঘাম মুছে, তীব্র ক্ষোভে জবাব দিলো, ‘ মামা, মামি, তোমাদের আস্কারা পেয়ে পেয়ে, মাহির এতোটা একরোখা এবং জেদি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। ‘
মাহিরের কঠিন দৃষ্টি তখনো ইরার উপর। ইরা ভয়ে ভয়ে মাহিরের দিকে তাকাচ্ছে। স্নেহা হাটু গেড়ে বসে, কারণ মাহির তার কোমড়ের কাছাকাছিও নেই। স্নেহা নিজের রাগটুকু নিয়ন্ত্রন করে, প্রশ্ন করে, ‘ সমস্যা কি তোমার মাহির? ইরা তোমার কাজিন বড় আপু হয়, সেখানে তুমি ইরাকে সহ্য করতে পারছো না কেন? অনেকদিন ধরে কিন্তু আমি বিষয়টা লক্ষ্য করছি।’
মাহির গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, ‘ কিসের আপু? কিসের বোন? উনি তো আমার আপন বোন না। আমার নিজের বড় বোন আছে যা শুধুমাত্র তুমি। উনি কেন আমার বোন হতে যাবেন? ‘
‘ আচ্ছা ইরা তোমার আপন বোন না কিন্তু ইরা তো তোমার বন্ধু ও হয়। বন্ধুকে কেউ বুঝি এইভাবে কষ্ট দেয়? আঘাত দেয়? ‘
‘ না, উনি আমার বন্ধুও নয়। উনি শুধু অন্যদের সাথে খেলতে পছন্দ করেন, আমার সাথে মোটেও খেলেন না। ইরাবতী প্রচুর বাজে। উনি আমার কিচ্ছু হয়না। আমিও উনার কিচ্ছু হয়না। ‘
মাহির ছুটে বেড়িয়ে যায় বাসা থেকে। ইরা ফ্যালফ্যালে নয়নে তাকিয়ে থাকে। স্নেহা বেশ চিন্তায় পরে যায়! এইটুকু ছেলের কথার কি ধরণ! গাড়ি এক্সিডেন্টে বাবা- মা মারা যাওয়ার পরে, তার মামা- মামি তাদের দুই ভাই-বোনকে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসে। নিজেদের সবটুকু দিয়ে তারা স্নেহাকে পড়াশোনা করিয়ে, একজন ডাক্তার বানিয়েছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই স্নেহার। স্নেহা চেষ্টা করছে নিজের সবটুকু দিয়ে মামা- মামির মুখ উজ্বল করবে, সেখানে তার ছোট ভাই দিনের পর দিন একরোখা এবং জেদি হয়ে যাচ্ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পরছে ইরার উপর!
_______
আহরারের ডাকে, অতীত থেকে বেড়িয়ে আসে ইরা এবং তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে, গরম কফির কাফে চুমুক দিয়ে, ছোট্ট করে, ‘আহ ‘ শব্দ উচ্চারিত করে ফেলে। আহরার ব্যাতিব্যস্ত হয়ে, ইরার পাশে বসে বলে, ‘ ইরা কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো তো?এইভাবে কেউ গরম কফিতে চুমুক দেয়?’
ইরার মা কবিতা রান্নাঘর থেকে বেডিয়ে এসে বললেন, এতো বড় মেয়ে হয়েছে,তবুও এই মেয়ের কোন আক্কেল হলো না। এই মেয়েকে নিয়ে আমি সত্যিই পারি না। ‘
‘ একদম ঠিক বলেছেন আন্টি! ইরা শুধু হাতে- পায়েই বড় হয়েছে। মাথায় কিচ্ছুটি নেই।’
আহরারের কথা শুনে, ইরা কঠিন দৃষ্টিতে, আহরারের দিকে তাঁকায়। আহরার কবিতার আগোচরে, ইরাকে চোখ মেরে, ধীর গলায় শুধায়,
‘আমার বেয়াক্কেল হবু বউ!’ ইরা মুখ বেকিয়ে বলে,
‘ আসলে মা, কফির কাপ টা দেখে, হঠাৎ মাহিরের কথা মনে পড়লো। ‘
‘ ওহ হ্যা! তোর মনে আছে? ছোটবেলায় একবার মাহির তোর হাতে গরম কফি ঢেলে দিয়েছিলো। বাবা! তোর সে কি কান্না!’
‘ মাহির? আই মিং ইরা তোমার সেই কাজিন ভাই মাহির? যে লন্ডনে থাকে। ‘
ইরা শুকনো মুখে বলে, ‘ হু!’
ইরার মা কবিতা সোফায় বসে বললেন, ‘ স্নেহার বিয়ের পর, স্নেহার হাজবেন্ড স্নেহা এবং মাহিরকে একসাথে লন্ডনে নিয়ে যায়। সেখানেই ওরা এতোবছর ধরে আছে। ‘
‘ আমি তো উনাদের এতোবছরে দেখিনি, উনারা কি আর বাংলাদেশে আসেনি?’
‘ না, স্নেহা এবং স্নেহার হাজবেন্ড খুবই ব্যাস্ত থাকে। দুজনেই ডাক্তার, তাছাড়া মাহির ও সারাদিন নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত। মাত্র নয় বছর বয়সেই, মাহির লন্ডনে চলে যায়, তারপর সেখানকার পরিবেশে বড় হতে থাকে। ছেলে টা বাবা- মা মারা যাওয়ার পর থেকেই জেদি হয়ে গিয়েছিলো, সেখানে গিয়ে শুনেছি শান্ত হয়েছে তবে আমাদের সাথে তেমন যোগাযোগ করেনি। হয়তো আমাদের কথা তার তেমনি মনে নেই। যোগাযোগ যা হয় সবই স্নেহার সাথে। তবে তারা আসবে শুনেছি। ‘
‘ কবে আসবে আন্টি?’
‘ কেন? সামনে তোমার এবং ইরার বিয়েতে। স্নেহার সাথে আমার কথা হয়েছে। মাহিরকে জোড় করে হলে ও সে এবার বাংলাদেশে নিয়ে আসবে। ‘
আহরার কফির কাপে চুমুক বসিয়ে বলে,
‘ তা হলো তো আর বেশি দেরী নেই,খুব শীঘ্রই তাদের দেখা পাচ্ছি কারণ ইরার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম টা শেষ হলেই তো বিয়ে!’
‘ হ্যা, তা ঠিক!’
আহরার অনেক্ষন যাবৎ লক্ষ্য করছে ইরা চুপচাপ হয়ে আছে। ইরা যেনো গভীরভাবে কিছু ভাবছে। আহরার ইরার কাধে হাত রেখে বলে, ‘ কি হলো ইরা? তুমি কি ভাবছো?’
ইরা তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘ কিচ্ছু না। আচ্ছা আহরার তুমি কি আমাকে একটু নীলক্ষেতের সামনে ড্রপ করে দিবে? আমার কিছু বই কেনার দরকার ছিলো।’
আহরার উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়, ‘ আচ্ছা, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে, অফিসে চলে যাবো। ‘
তাদের কথোপকথনের মাঝে, ইরার ছোট বোন কথা সিড়ি বেয়ে নেমে ছুটে এসে বলে, ‘ আহরার ভাইয়া আমাকে ড্রপ করে দিতে হবে কিন্তু কারণ আমাকেও কিছু বই নিতে হবে। ‘
কথা বর্তমানে একাদশ শ্রেনীতে মানবিক শাখাতে অধ্যায়ন করছে। বইয়ের প্রতি তার আলাদা ভালোবাসা কাজ করে সবসময়। মাহির হালকা হেসে বলে, ‘ সমস্যা নেই, হবু বউ এবং শালি দুজনকেই আমি ড্রপ করে দিবো। ‘
______________
নীনক্ষেতের একপাশে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে ইরা এবং কথা। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা। মেঘলা আকাশ বিরাজমান! কিছুক্ষনের মাঝেই গুড়গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। কথা কোমড়ে হাত রেখে বলে, ‘ আপা, মনে হচ্ছে না আজকে রিক্সা পাবো। বষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে, কিছুক্ষন পর আবার মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে।’
‘ আমারোও তাই মনে হচ্ছে কিন্তু কী করা যায় বল তো?’
‘ আহরার ভাইয়াকে একটা ফোন করবে? ‘
‘ দাঁড়া করছি। ‘
ইরা ফেন বের করার পূর্বেই, হাত থেকে পিছলে ফোনটা রাস্তায় পড়ে যায়। সে হাত বাডিয়ে, অসাবধানতা বসত ফোনটি তুলতে চাইলে, তড়িৎ গতিতে একটা গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে দেয়। ইরা ছিটকে রাস্তার পাশে পড়ে যায়, কথা ‘আপা ‘ বলে চেচিয়ে উঠে। ইরা মাথায় হাত দিয়ে ঝাপসা নয়নে সামনের দিকে একপলক তাকায়। একজন কালো ব্লেজার পরা লম্বা চওড়া যুবক তার দিকে ছুটে আসছে, ইরার মনে হচ্ছে যুবকটি তার বড্ড চেনা, বড্ড কাছের! কিন্তু কে সেই আগন্তক? জানেনা ইরা। ইরা মাথায় হাত দিয়ে, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলো।
চলবে…
#প্রিয়_ইরাবতী
#পর্ব-১
#Jannatul_ferdosi_rimi
প্রথমেই বলি রাখি কিছুটা আনকমন থিমের গল্প। নায়িকা,নায়কের থেকে প্রায় ৪বছরের বড়। কিছুটা সিনিয়র-জুনিয়ার টাইপ প্রেমের গল্প। প্রায় তিন মাস পর ফেসবুকের লেখালিখি জগতে ফিরে আসলাম। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন।