অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫১।

0
62

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫১।

পুলিশ রিসোর্টে এসে অনেক খোঁজ নিয়েও কাউকে ধরতে পারেনি। তার উপর রিসোর্টের সিসি টিভি ক্যামেরাও কাজ করছে না ঠিক মতো। নীহাল আর ফারজাদ এই নিয়ে ম্যানেজারের সাথে ভীষণ রাগ দেখাল। রিসোর্টে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ ঐদিকের কোনো সিসি টিভি ফুটেজ’ই নেই। পুলিশ জানিয়েছে, রিসোর্টটা আপাতত কয়দিন তাদের নজরদারিতে থাকবে। যদিও ম্যানেজারে অনুশোচনায় অনেকবার ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, আর এমন হবে না।

বাড়ি ফিরছে সবাই। চারদিক চকচকে অন্ধকার। বাতাস বইছে সাঁ সাঁ করে। রাস্তার সোডিয়ামের আলোটা এখন বেশ বিদঘুটে লাগছে প্রিয়তার নিকট। মনে হচ্ছে, এটাও বুজে গেলে ভালো হতো বেশ। খোঁপা করা চুলের বাঁধন সে আলগা করে দিল। চুলগুলো ছাড়া পেয়ে যেন পাগলপ্রায়, তারা নৃত্য জুড়েছে বাতাসের তালে তালে। প্রিয়তা চোখ বুজল, জোরে শ্বাস টানল, নাসিকা পথে এক তীব্র ঘ্রাণ প্রবেশ করল ততক্ষণাৎ। এই কয়দিনে এই ঘ্রাণটা তার বড্ড পরিচিত হয়ে উঠেছে। সে চোখ মেলে তাকাল আবার। ফারজাদের পিঠের উপর দৃষ্টি তার। কিঞ্চিৎ হাসল। মুখটা খানিকটা এগিয়ে নিয়ে ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘আমি বাংলাদেশে চলে গেলে আমায় মিস করবেন?’

হঠাৎ এই প্রশ্নে ঘাড়টা ঈষৎ কাত করে তাকাল ফারজাদ। পরক্ষণেই আবার সামনে চেয়ে বলল,

‘যদি বলি মিস করব, তবে কি থেকে যাবেন?’

প্রিয়তা হেসে বলল,

‘ভয় নেই, আর থাকব না। অনেক জ্বালিয়েছি, তাই না?’

‘ভীষণ।’

প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি। সামনে চাইল সে। বলল,

‘তবে আমি অবশ্যই মিস করব। আন্টিকে, মৌমিকে, এই পাকিস্তানকে (একটু থেমে) আর আপনাকেও।’

ফারজাদ জবাব দিল না আর। ঠিক বাড়ির গেইটের সামনে এসে থামল সে। নীহালদের গাড়িও এসে থামল তার পরপরই। সবাই নামল একে একে।

____________

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরেই এসেছে সবাই। কাল’ই প্রিয়তাদের বাংলাদেশে ফেরার ফ্লাইট। মৌমির চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, মেয়েটা কেঁদেছে তা আর বোঝার বাকি নেই। প্রিয়তা তার গোছানো ব্যাগটা সাইডে রাখল। মৌমির পাশে বসল গিয়ে। বলল,

‘কাঁদছ কেন?’

মৌমি ঠোঁট চেপে নিজের কান্না চাপার চেষ্টা করে বলল,

‘আমার খুব খারাপ লাগছে।’

‘কেন?’

‘কেন আবার, তুমি চলে যাচ্ছো বলে।’

প্রিয়তা তার গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,

‘আবার আসব।’

‘জানি, মিথ্যে কথা।’

‘উঁহু, একদম সত্যি। অবশ্যই আবার আসব। তোমাকে নেওয়ার জন্য হলেও তো আসতে হবে, তাই না?’

মৌমি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমাকে কোথায় নিবে?’

‘বাংলাদেশে, আমাদের বাড়িতে। এমনি এমনি না, আমার ভাইয়ের বউ করে।’

মৌমি চমকে উঠে বলে,

‘পাগল হয়েছ তুমি?’

‘কেন, নীহাল ভাইকে কি এত অপছন্দ তোমার?’

‘না, তা না, কিন্তু এটা তো সম্ভব না।’

‘সম্ভব, আমি সম্ভব করব।’

মৌমি মাথায় হাত দিয়ে বসল। এটা আবার কেমন হলো, একদিকে সে প্রিয়তাকে নিজের ভাইয়ের বউ করার কথা ভাবছে, অন্যদিকে প্রিয়তা আবার তাকে তার ভাইয়ের বউ করার কথা ভাবছে! কেমন ক্রস কানেকশন হয়ে গেল! প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, ভাইয়াকে তোমার পছন্দ না?’

মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘উনি ঝগড়ুটে খুব।’

প্রিয়তা মুখ চেপে হাসি আটকে বলল,

‘সেটা তুমিও তো কম না।’

মৌমি কপাল কুঁচকাল। বলল,

‘যাও, হবো না তোমার ভাইয়ের বউ।’

প্রিয়তা হেসে বলল,

‘একদম তুলে নিয়ে যাব, মেয়ে।’

মৌমি ভেংচি কেটে বলল,

‘আচ্ছা দেখা যাবে।’

দুজনেই হাসছে। মৌমি এর মাঝেই প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,

‘তোমার মতো মেয়ে আমি দেখিনি, আপু। তুমি অসাধারণ। শেষ দিনটাও আমার জন্য খারাপ গিয়েছে তোমার, আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত, পারলে ক্ষমা করে দিও।’

প্রিয়তা তাকে আগলে নিয়ে বলল,

‘বোকা মেয়ে, বার বার একই কথা কেন বলছো? বললাম তো এতে কারোর কোনো হাত নেই। যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এখন এসব রেখে হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও।’

মৌমি তাও কেঁদে ফেলে। বলে,

‘বিদায় কখনো হাসি মুখে দেওয়া যায়?’

প্রিয়তারও মন খারাপ হচ্ছে ভীষণ। সে বলল,

‘এমন করো না, আমারও যে ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি চাই, তোমরা ভালো থাকো। এমনিতেই আমার জন্য তোমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, আর কোনো কষ্ট করতে না হোক। শোনো, মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে, আন্টির কথা শুনবে সব, মা আর ভাইয়ের প্রতি খেয়াল রাখবে। আর যখনই আমার কথা মনে পড়বে তখনই কল দিবে আমায়, আমি তোমার জন্য সব সময় ফ্রি।’

মৌমি নাক টেনে বলল,

‘বাংলাদেশে গিয়ে আমাদের ভুলে যেও না কিন্তু।’

‘কখনোই না।’

রাত তখন একটা। কারোর চোখে ঘুম নেই। অদ্ভুত ভাবে দুজন অপরিচিত মানুষের বিদায়ের জন্য বাড়ির সকলের মন খারাপ। ব্যাপারটা অদ্ভুত খুব। কিছুদিন আগেও যে মানুষগুলোকে তারা চিনতও না, আজ তাদেরই বিদায়ের বেলাতে একেক জনের বুক ফেটে যাচ্ছে। দিলরুবা বেগম আঁচলে চোখ মুছে একটা ব্যাগ প্রিয়তাকে দিয়ে বললেন,

‘এটা তোমার ব্যাগে রেখে দাও, মা।’

‘এটাতে কী, আন্টি?’

‘আছে কিছু টুকিটাকি জিনিস। রেখে দাও, আমাদের স্মৃতি হিসেবে না হয় দেশে নিয়ে গেলে।’

প্রিয়তা মন খারাপ করে বলল,

‘আপনারা আমার মনে গেঁথে গিয়েছেন, আন্টি। আপনাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমার কিছু লাগবে না।’

‘তাও, রাখলে আমি খুশি হব, মা।’

দিলরুবা বেগমের মন রাখতে প্রিয়তা সেই ব্যাগটা নিজের ব্যাগে ভরে নিল। মৌমি এখনো এক কোণে বসে কেঁদে যাচ্ছে। নীহাল সেই সময় রুমে এসে বলল,

‘তোর সব গোছানো হয়েছে, প্রিয়?’

‘হ্যাঁ ভাইয়া, শেষ।’

‘আচ্ছা শুয়ে পড় তবে, সকাল সকাল বেরুতে হবে আমাদের।’

‘আচ্ছা।’

নীহাল ফিরে যেতে নিয়েও আবার ঘুরে তাকায়। মৌমির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এই ঝগড়ুটের কী হয়েছে আবার? কেঁদে কেটে নাক মুখ তো টমেটো করে ফেলেছেন একেবারে।’

প্রিয়তা ম্লান হেসে বলে,

‘আমরা চলে যাব বলে কাঁদছে।’

নীহাল ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

‘বলিস কী! এত মায়া!’

‘হ্যাঁ, আপনার মতো পাষাণ না আমি।’

মৌমি নাক টানতে টানতে বলল। নীহাল হাসল তার কথা শুনে। বলল,

‘আমি পাষাণ?’

‘তা নয়তো কী? পাষাণ বলেই তো আমার এত কান্না উপেক্ষা করে বোনকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন।’

‘ওহ, এই ব্যাপার! তবে প্রিয়তাকে রেখে দিন না আজীবনের জন্য, আমি তো না করছি না।’

মৌমি ঠোঁট উল্টে আফসোসের সুরে বলল,

‘ফারজাদ ভাইয়া রাজি হলেই রেখে দিতাম।’

বলেই সঙ্গে সঙ্গেই টনক নড়ল তার। পরে মাথা চুলকে আমতা আমতা শুরু করল। প্রিয়তা মলিন হেসে বলে,

‘উনি যে আমাকে এই কয়দিন সহ্য করেছেন সেটাই অনেক।’

মৌমি বুঝতে পারছে, প্রিয়তা ভুলটা বুঝেছে। সে কিছু বলতে নিয়েও নীহালের ইশারায় আর কিছু বলে না। নীহাল তার পকেট হাতড়ে বলে,

‘বাচ্চাদের কান্না থামানোর জন্য তো চকলেট লাগে। তা ঝগড়ুটে মেয়ে, আপনার কান্না চকলেটে থামবে তো?’

নীহালের কথা শুনে প্রিয়তা আর দিলরুবা বেগম হাসেন। নীহাল এগিয়ে যায় মৌমির দিকে। মৌমির কোলের উপর অনেকগুলো চকলেট রেখে বলে,

‘এগুলো আপনার। এবার কান্না থামান। নয়তো পরে সবজিওয়ালা টমেটো ভেবে ভুল করে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবেন।’

চকলেট পেয়ে খুশি হলো মৌমি। মাথা নুইয়ে বলল,

‘ধন্যবাদ।’

নীহাল হেসে বলল,

‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’

আর কথা না বাড়িয়ে নীহাল নিজের রুমে ফিরে যায়। দিলরুবা বেগমও চলে আসেন নিজের ঘরে। প্রিয়তা আর মৌমিও শুয়ে পড়েছে। প্রিয়তাকে ঝাপ্টে ধরে শুয়ে আছে সে। মেয়েটার এত এত ভালোবাসায় প্রিয়তা যেন আপ্লুত। ভাবে, ওদের মতো মানুষেরা বেঁচে আছে বলেই হয়তো পৃথিবী এখনো এত সুন্দর, নয়তো কবেই তলিয়ে যেত কুৎসিত, কদাচিৎ নর্দমায়।

_______

এপিঠ ওপিঠ হাঁসফাঁস করেও ঘুমের দেখা পাচ্ছে না মানুষটা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। কীসের এক শূণ্যতা অনুভব করছে কে জানে। রুমের ভেতর হালকা সোনালী বর্ণের এক আলো। আলোটা আসছে তার দেয়ালের ফেইরি লাইটগুলো থেকে। সে সেগুলোর দিকেই চেয়ে আছে। মা আর বোন ব্যতিত অন্য নারীকে নিয়ে চিন্তা না করা মানুষটার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে আজ এক অন্য নারী বিচরণ চালাচ্ছে। কী বিদঘুটে এক ব্যাপার। এই প্রিয়তা মেয়েটা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না একদম। বারবার তার বলা কথাগুলো কানে বাজছে যেন। “আমি বাংলাদেশে চলে গেলে আমায় মিস করবেন?” হ্যাঁ, মিস করবে সে, ভীষণ রকম মিস করবে। অথচ এটা সে কখনোই স্বীকার করবে না।

চলবে….

(প্রিয়তা আর ফারজাদের প্রণয়ের অপেক্ষায় আছেন কে কে? শীঘ্রই আসছে কিছু কাঙ্খিত পর্ব।)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here