অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫৮।

0
56

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৮।

সোমবারের সকাল। বাড়ি জুড়ে তোড়জোড় চলছে বেশ। সকাল থেকেই বেশ আয়োজন করে রান্না করছেন লুৎফা বেগম। প্রিয়তা ঘর গোছাতে ব্যস্ত। অলিউল জামান আর নীহাল গিয়েছে টুকিটাকি বাজার সারতে। কিছুক্ষণ আগেই খবর এসেছে ফারজাদরা ফ্লাইটে উঠে পড়েছে। রাতের ভেতরেই পৌঁছে যাবে তারা।

লুৎফা বেগম আজ মারাত্মক খুশি। বান্ধবীর জন্য তাঁর সব প্রিয় খাবার রাঁধছেন তিনি। প্রিয়তা ফুরফুরে মন নিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। নিজের হাতে যত্ন করে গুছাচ্ছে সব। এরই ফাঁকে একবার রান্নাঘরের কাছে যায়। মা’কে গিয়ে বলে,

‘মা, এক্সট্রা তো কেবল একটা রুম। ঐ রুমে কে থাকবে?’

‘ঐ রুমে ফারজাদকে দিয়ে দিস। তুই আর মৌমি এক রুমে। আর আমি আর রুবা এক রুমে।’

‘আর বাবা?’

‘তোর বাবা নাহয় এই কয়টা দিন তোর ভাইয়ের রুমে থাকবেন।’

প্রিয়তা অবাক হয়ে বলে,

‘কী বলো, বাবা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন?’

লুৎফা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রিয়তা ইতস্তত ভঙিতে হেসে বলে,

‘না মানে, তোমরা কখনো আলাদা রুমে থাকোনি তো তাই।’

‘পারবেন। এই কয়টা দিন আমি আমার বান্ধবীর সাথেই থাকব, ঠিক আগের মতো।’

বান্ধবীর প্রতি মায়ের এত ভালোবাসা দেখে খুশি হলো প্রিয়তা। এত দিন যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও বন্ধুত্ব তাঁদের কমেনি এইটুকুও।

সে চলে আসে। ফারজাদের জন্য ঠিক করা রুমটা একটু বেশিই যত্ন করে গোছাচ্ছে সে। ফারজাদের পছন্দ অপছন্দ এই কয়টা দিনে সে কিছুটা হলেও ঠাহর করতে পেরেছে। তাই সেই অনুযায়ী’ই রুমটাকে সাজিয়ে নেয়।

____________

সব কাজ শেষ করে এখন গোসলে যাবে প্রিয়তা। আলমারি খুলে দাঁড়িয়েছে কাপড় বের করতে। পুরো আলমারি জুড়ে তার’ই কাপড়। সে তার একপাশের কাপড়গুলো সরিয়ে নিল, যেন মৌমি এসে তার কাপড়গুলো রাখতে পারে। সরিয়ে নেওয়া কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখার সময় আলমারির এক কোণে রাখা একটা শাড়ি চোখে পড়ল তার। নীল রঙের শাড়িটা। সে বের করল সেটা। খুলে ধরল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। ঢোক গিলল। চোখ ছলছল করে উঠল তার। মুহুর্তেই বিষাদে ভরে গেল মনটা। বারান্দায় নিয়ে গিয়ে শাড়ি মেঝেতে রাখল। তারপর রান্নাঘর থেকে গিয়ে আনল দিয়াশলাইয়ের একটা বক্স। একটা কাঠি বের করে আগুন জ্বালাল। জ্বলজ্বল কাঠিটা শাড়িটার উপর ফেলতেই ততক্ষণাৎ আগুন ধরে গেল সেটাতে। দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। ভেতরটা জ্বলছে তার। চোখের সামনে পুড়ছে তার প্রিয় মানুষের দেওয়া প্রথম উপহার। কেবল শাড়িটা একা পুড়ছে না, পুড়ছে তার অন্তঃস্থলও। পুড়তে পুড়তে এক পর্যায়ে শাড়িটা একেবারে ছাই হয়ে গেল। প্রিয়তা সেই ছাই পরিষ্কার করে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যদি একইভাবে সে সেই মানুষটার স্মৃতিগুলোকেও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে পারত, তাহলে আজ হয়তো এতটা যন্ত্রণা পেতে হতো না তার।

_________

রাত এখন। সব নাস্তা গুছিয়ে বসে আছেন দিলরুবা বেগম আর প্রিয়তা। অলিউল জামান আর নীহাল গিয়েছে এয়ারপোর্টে, ফারজাদদের আনতে। প্রিয়তা আর তার মায়ের অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছেই না। কবে আসবে মানুষগুলো, সেই আশায় অধৈর্য হয়ে উঠেছে তারা।

অবশেষে অনেকটা সময় অপেক্ষার পর, বাইরে থেকে শোনা যায় গাড়ির শব্দ। লুৎফা বেগম তখন ছিলেন ওয়াশরুমে। প্রিয়তা দৌড়ে গিয়ে বলে,

‘মা, উনারা বোধ হয় চলে এসেছেন। গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, জলদি বের হও।’

বলেই সে নিজে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। বারবার সিঁড়ির দিকে উঁকি দেয়, কাউকে দেখা যাচ্ছে কি-না। কিছু সময় বাদেই সিঁড়ি বেয়ে বাবাকে উঠতে দেখে। এবার অস্থিরতা আরো বাড়ে তার। ততক্ষণে লুৎফা বেগমও দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অলিউল সাহেবের পেছনেই নীহাল আর তার পাশেই ফারজাদ। গল্প করতে করতে আগাচ্ছে দুজন। প্রিয়তার ফারজাদের দিকে চোখ যায়। ফারজাদ কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় তাকে খেয়াল করেনি এখনো। অলিউল সাহেব দরজার সামনে এসে থামতেই ফারজাদ সম্মুখে তাকায়। প্রিয়তার সাথে চোখে চোখ পড়ে। এই তো সেই মুখ, যেই মুখটা এই কয়টা দিন তার মন মস্তিষ্ক সব দখল করে নিয়েছিল। সে হাসল কিঞ্চিৎ। পাশেই লুৎফা বেগমের দিকে চেয়ে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।’

লুৎফা বেগম হেসে জবাব দিলেন। নীহাল বলল,

‘মা, উনিই ফারজাদ। দিলরুবা আন্টির ছেলে।’

লুৎফা বেগম উৎফুল্ল সুরে বললেন,

‘ভেতরে এসো, বাবা।’

নীহাল ভেতরে ঢুকল তাকে নিয়ে। ভেতরে ঢুকার মুহুর্তে প্রিয়তার দিকে চেয়ে ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,

‘ভালো আছেন?’

প্রিয়তা ছোট্ট করে বলল,

‘জি।’

তারা দু কদম এগোতেই কানে এল বড়ো সড়ো কান্নার শব্দ। হকচকিয়ে সামনে তাকাল সবাই। দেখে দুই বান্ধবী গলা জড়িয়ে কাঁদছে। প্রিয়তা মৌমিকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। মৌমি তো প্রচন্ড খুশি নিয়ে প্রিয়তার হাত জড়িয়ে ধরে মায়ের কান্না দেখছে। অনেকক্ষণ দুই বান্ধবী এভাবেই কেঁদে যায়। বাড়ির সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে চুপচাপ। কান্না থামিয়ে লুৎফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেমন আছিস, রুবা।’

দিলরুবা বেগম চোখ মুছে বললেন,

‘আল্লাহ রেখেছে ভালো।’

‘আয় আয়, ভেতরে আয়।’

ভেতর দিকে ঘুরতেই দেখে বাড়ির বাকি মানুষ সব কৌতুহল নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই অস্বস্তিতে পড়ে বেশ। দিলরুবা বেগম কোনোরকমে হেসে বললেন,

‘প্রিয়তা মা, ভালো আছো?’

প্রিয়তা উঠে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। অভিমানের সুরে বলে,

‘বান্ধবীকে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেলেন, আন্টি।’

‘কী যে বলো না, মা; তোমাকে ভোলা সম্ভব?’

প্রিয়তা হেসে চেয়ে বলল,

‘কেমন আছেন?’

‘তোমাদের সবাইকে দেখে আমি এখন ভীষণ ভালো আছি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে। এবার গিয়ে বস একটু।’

লুৎফা বেগম বললেন। প্রিয়তা দিলরুবা বেগমকে সোফায় বসাল। তারপর মায়ের সাথে গেল টেবিলের কাছে , নাস্তা আনতে।

সোফার সামনে টি টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা সাজানো। সবকিছু গুছিয়ে রেখে প্রিয়তা এক পাশে বসে। লুৎফা বেগম সবার হাতে হাতে শরবত তুলে দেয়। মৌমি শরবত নিতে গিয়ে বলে উঠে,

‘আন্টি, দেখেছেন, কেউ আপনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে না। আমার যেন কোনো দাম’ই নেই।’

মৌমির কথা শুনে হেসে ফেলে সবাই। প্রিয়তা কিছু বলার আগেই নীহাল বলে উঠে,

‘মা, উনাকে চেনোনি? উনি সেই বাঁদর মেয়েটা, যে সবসময় যেচে পড়ে আমার সাথে ঝগড়া করে।’

মৌমি গর্জে উঠে ততক্ষণাৎ। বলে,

‘একদম বাজে কথা বলবেন না। কে যেচে পড়ে ঝগড়া করে সেটা সবাই জানে। প্রিয়তা আপু, তুমি বলো তো, কে যেচে পড়ে ঝগড়া করে?’

‘ও কী বলবে? সবাই জানে, আপনি যে ঝগড়ুটে।’

‘প্রিয়তা আপু, তোমার ভাই কিন্তু আমাকে বাসায় এনে অপমান করছেন। আমি কিন্তু চলে যাব।’

নীহাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘আজ রাতে আর কোনো ফ্লাইট নেই। যেতে হলে কাল সকালে যেতে পারবেন।’

মৌমি নাক মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘আমার আসাই উচিত হয়নি। আমি কাল সকালেই চলে যাব।’

আরেকদফা হাসল সবাই। তাতে মৌমি আরো ক্ষিপ্ত হলো যেন। বলল,

‘ওহ, তোমরা সবাই আমাকে নিয়ে মজা করছো? প্রিয়তা আপু, তুমিও?’

প্রিয়তা হাসি থামাল খুব কষ্টে। লুৎফা বেগম বললেন,

‘না মা, তোমাকে নিয়ে কেউ মজা করছে না। আমার ছেলেটা খুব পাঁজি না, দাঁড়াও ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিব।’

‘এক্ষুনি দিন, আন্টি।’

নীহাল বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে বলে,

‘মিস মিমি ওপস স্যরি মৌমি, আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, এটা যে আমার বাড়ি।’

মৌমি নাক মুখ কুঁচকে তাকাল। দাঁতে দাঁত পিষছে মনে মনে। লোকটা যে তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে বেশ এটা সে ঠিকই ঠাহর করতে পারছে। আপাতত বড়োরা সবাই বসে আছে বলে সে আর কথা বাড়াল না। শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, পরে এর প্রতিশোধ তুলবে।

চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here