#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪৯
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
তারপর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ায় তাদের আর বেশিক্ষণ কথা বলা হয়নি।
খুব সুন্দর ভাবে মেহেদী সন্ধ্যা কেটে গেল। সুজানার দুহাত রাঙানো হলো মেহেদীর লাল রঙে। “এ এফ” লেটারদুটোর জায়গা পেল তার দু’হাতের মেহেদীর ফাঁকে ফাঁকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুকনো মেহেদীর উপর হাত ছোঁয়াতেই সুজানার কেমন যেন অনুভূতি হলো। মাস্টারমশাইয়ের নাম তার হাতে। সে তা ছুঁতে পারছে। এক অন্যরকম সুখানুভূতি হলো তার।
নবকুঠিরে গতরাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে প্রায় ফজরের কিছু আগে। অভিককে দু’হাতের মেহেদী শুকানোর আগ অব্ধি কেউ ঘুমাতে দিতে রাজী ছিল না। কখনো এভাবে রাত জাগেনি বলে তার চোখ দুটোর অবস্থা দেখার মতো হয়েছিল। তারপর যেই সুযোগ পেল হাত মুখ ধুঁয়ে সোজা ঘুমাতে চলে গেল। ঘুমাতে পারলো কই? তিন ঘন্টার ঘুম পুরোপুরি না হতেই মায়ের ডাকাডাকি। বাচ্চাদের হৈহৈ ছোটাছুটি। মেহমানদের হাঁক-ডাক। আর বিচ্ছু কাজিনগুলো তো আছেই। মাথা নষ্ট অবস্থা।
পরেই দু হাতের মেহেদীতে সুজানা নামটা দেখে ক্লান্তি আর বিরক্তিগুলো দূরে সরে পড়লো । মনে পড়লো অন্য দশটা দিনের মতো নয় আজকের দিনটি। এটা তার জীবনের অন্যরকম একটা পূর্ণতার দিন। জীবনের এতগুলো বছরে সে কি পেয়েছে কি পায়নি তার হিসেব রাখেনি তবে আজকের এই পাওয়াটা তার চিরদিন মনে থাকার মতো। একটা নিজের মনের মতো মানুষ পাওয়ার দিনটা স্মরণীয় করে না রাখাটাই তো বড় ভুল।
ইংরেজি লেটারে সুজানার নামটার উপর সে আঙুল ছোঁয়ালো আরও একবার । এই নামটা আর সেই মেয়েটা তার জীবনে এক অন্যরকম প্রশান্তির। ভাবলেই কেমন যেন মনটা শান্ত হয়।
অতঃপর নির্ঘুম রাতটা সুজানার নামেই বিসর্জন দিয়ে দিল সে। এ আর এমন কি। এমন অনেক রাত সুজানার সহজ সরল চাহনিটা তাকে ঘুমাতে দেয়নি। ভালো করে খেতে দেয়নি। স্টুডেন্টদের পড়ায় মনোযোগ দিতে দেয়নি। বাবার কাজের ফাইলে ভুলচুকের একমাত্র সাক্ষী। এসব কোনো ব্যাপারই না।
______
ঘুমঘুম চোখে ব্রাশ হাতে নিয়ে সে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য এগিয়ে গেল। পুরো বাড়িতে গাঁদাফুল, রজনীগন্ধা আর গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। বাচ্চারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যা অবস্থা করেছে।
অভিক কিচেনে উঁকি দিতেই দেখলো সেখানে অনেক মুরুব্বি আছেন। গল্পগুজব করছে সালমা বেগম আর আনজুমা বেগমের সাথে। অভিক দাদুকেও দেখতে পেল।
তিনি সর্বপ্রথম নাতিকে দেখে বললেন
ঘুম ভেঙেছে আমার ভাইয়ের? আহারে চোখদুটো বসে গেছে কেমন।
সবাই ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো। অভিক বলল
সবাই ঘুমাতে দিল কই? মা ঘরটা ওইরকমই থাকবে? অতগুলো জিনিস! কেমন দেখাচ্ছে।
শোনো ছেলের কথা। তোর বউ ঘরে ঢুকার আগেই সব গোছানো হয়ে যাবে। অতগুলো গিফটবক্স আমি রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই ওখানে রেখেছি। এখনি সরিয়ে ফেলব।
আনিকা বলে উঠলো
ইশশশ কি চিন্তা তার! তোর বউকে ওই গুদামঘরেই রাখবো। হুম।
অভিক ভুরু কুঁচকে চাইলো। সবাই হাসলো। আনজুমা বেগম বললেন
আহা মজা করছে অভি। আমরা ক্লাবে যাওয়ার আগে সব ঠিকঠাক করেই যাব।
অভিক মাথা দুলিয়ে বলল
তাহলে ঠিক আছে।
_______
ক্লাবে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের দায়িত্বে গতকাল থেকে সুজানার বড় মামা, ছোট মামা আর চাচা আছেন। সাথে খালু আর ফুপারাও দেখাশোনা করছেন। এসব নিয়ে সাজিয়া বেগমের তেমন মাথা ঘামাতে হয়নি। তিনি অনেকগুলো বছর পর শ্বশুর বাড়ির মানুষদের এত কাছাকাছি আছেন। শ্বাশুড়ি যিনি একসময় সেই স্কুল পড়ুয়া সাজিয়া বেগমকে নিজের বড় ছেলের জন্য পছন্দ করে বাড়ির বউ করে তুলেছিলেন সেই শ্বাশুড়ির সাথেও দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল কিছু ভুল বুঝাবুঝি আর মান অভিমানের কারণে। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় মা বাবা আর ভাইদের সাথে সাথে শ্বাশুড়িও যে উনাকে আবারও বিয়ের কথা বলবেন সেটা তিনি কুক্ষণেও ভাবেননি। মা ভাই নাহয় তার কথা ভেবেছিল। কিন্তু শ্বাশুড়ি? ছেলের রেখে যাওয়া দুটো সোনামানিকের মুখের দিকে চেয়ে কি করে অমন কথা তিনি মুখে আনতে পারলেন?
কথা-কাটাকাটি, নিজের সন্তানদের প্রতি অবহেলিত আচরণে সবার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দিলেন একা । বহুকষ্টে তিলে তিলে দু সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে গিয়ে পিতৃহীন হওয়ায় বহুবার পিছিয়ে পড়েছেন, শত বাঁধাবিপত্তি এসেছে। তবুও হার মানেননি। নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছেন। উনি উনার মাস্টারমশাইয়ের রেখে যাওয়া আমানতগুলোকে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন। মানুষটা না-ই বা থাকুক, সেই সহজ সরল প্রাণখোলা হাসির মানুষটার চেহারা চোখে ভাসলেই আজও উনি শক্তি পান, ভরসা পান।
ভালোবাসা যে মরেনা কভু। মরণ তো ঘটেছিল একসাথে পথচলার সেই স্বপ্নগুলোর।
___
পার্লারে যাওয়ার আগে সুজানাকে ঘুম থেকে তুলে আজ নিজের হাতে খাওয়ালেন সাজিয়া বেগম। পরম যত্নে। সেই ছোট্ট সুজানাকে যেভাবে খাওয়াতেন।
খেতে খেতে সুজানার চোখজোড়া যে কতবার ভিজলো নোনাজলে!
মায়ের হাতে মাখা ভাতের ঝালে নয় মায়ের পরম মমতায় আপ্লূত হয়ে। মায়েরা এত ত্যাগ করতে কিভাবে পারে?
খাওয়ার পর আজ মুখটা মায়ের শাড়ির আঁচলেই মুছা হলো। তারপরের দশ মিনিটের বেশি সময় মেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল। মায়ের কথা “নবকুঠির আর কতদূর!
আর মেয়ের কথা “ততটাই দূর আম্মা যতটা দূর থেকে চাওয়ামাত্রই তোমার কাছে ছুটে এসে কোলে মাথা রাখা যাবেনা। মায়ের কাছে মেয়েদের থেকে যাওয়ার মতো অনিয়ম গুলো একবারের জন্য হলেও নিয়ম হোক।
মা আদরে আদরে বললেন
এ হয় না। হয় না।
________
ব্লুমিংপার্ক ক্লাবে বিয়ের যাবতীয় আয়োজন। ক্লাবটা সুজানার খালু পছন্দ করেছেন। বেশ দারুণ দেখতে সেটি। খরচও নেহাত কম নয়। সব খরচ উনি বহন করেছেন বিধায় সাজিয়া বেগম আর কোনো উল্টো প্রশ্ন করেননি। তাছাড়া একটা ভালো ক্লাব দরকারই ছিল।
সুজানার গাড়ি এসে থামলো বেলা তিনটের দিকে। তার সাথে তার বান্ধবীরা আছে। আহির, নিখিল আর জায়িনরা তাদের ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। আজ স্যারের কাছ থেকে ফিতা কাটার দরুন মোটা টাকার উসুলের ধান্ধায় আছে তারা। সুজানার সাথে পার্লার থেকে ফিরলো শান্তা, মেহুল আর নিহাত। নিহাত ক্লাবে না এসে পার্লারেই চলে গিয়েছিল। সুজানা তাকে দেখে খুব খুশি। তাদের বন্ধুমহলে মেয়েটাকে কেন ভাবওয়ালী বলা হয় সেটার উত্তর সুজানা আজও পায়নি। মেয়েটা কথা বলতে শুরু করলে থামেই না। সুজানার তো তাকে দারুণ লাগে।
তারা ক্লাবে পৌঁছার পরপরেই বরপক্ষের অনেকে তার দেখা করার জন্য ছুটলো। বরের পরিবার থেকে যদিও তখনও কেউ আসেনি।
সুজানার ফটোশেসন চললো অনেক। বন্ধুদের ফাইজলামির সাথে পেরে না উঠে সে বড়ই ক্লান্ত। তাদের বন্ধুমহলের ছবি তুলতে তুলতে বরপক্ষের ক্যামেরাম্যান হাঁপিয়ে উঠেছে। এমন বিচ্ছু বন্ধুও মানুষের থাকে?
বরের গাড়ির সাথে পরপর অনেকগুলো গাড়ি এসে থামলো তারও ঘন্টাখানেক পরে। সবার হৈচৈ বেড়ে গেল। মিষ্টি আর ফুল নিয়ে বড়রা ছুটলো নতুন বেয়াই বেয়াইন অভ্যর্থনা জানাতে। আর যুবক যুবতীরা বর সাদর সম্ভাষণের মাধ্যমে ক্লাবে প্রবেশাধিকার দিতে।
মজার কথা এটাই, বর তাদের বেশিরভাগেরই স্যার হওয়ায় সবাই তথাকথিত বর আর বরের বন্ধুদের সাথে তর্কে যেতে লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। মেহুল তো সামনেই গেল না। নিহাত আর শান্তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল। নিহাত খুব সুন্দর করে ব্যাপারগুলো মিটিয়ে নিল।
অভিক সব বন্ধুদের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তার তো এসবে হেলদোল নেই। ভেতরে যাওয়ার তার ভীষণ তাড়া।
অতঃপর ফিতা কাটা আর মিষ্টিমুখ করানো শেষে বরপক্ষের লোকজন ভেতরে গেল।
সালমা বেগম তো একটু মিষ্টিমুখ করেই সোজা সুজানার কাছে গিয়ে স্টেজে পাশাপাশি গিয়ে বসে আছেন। সবাই বউ শ্বাশুড়িকে দেখছে। ক্যামেরা ম্যান এসে ছবি নিতেই উনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন
আহা টাকা দিছে বলে এভাবে উসুল করে নিতে হবে? কাল সারারাত ছবি তুলেও শান্তি হওনি বাপু?
ক্যামেরা ম্যান হেসে জবাব দিল।
বউ শ্বাশুড়ির এমন ছবি না নিলে আমি আর কিসের ক্যামেরা ম্যান হলাম আন্টি!
সুজানা মৃদু হাসলো।
আনিকা আর জিনিয়া, তরী, খড়ি আরও অনেকে অন্য গাড়িতে করে এল। অনা আবিদ তো সুজানাকে বধূবেশে দেখে তার পাশ ছাড়লো না। বারবার সুজানার দিকে তাকালো। আর জানতে চাইলো
সুজান বউ? লাল বউ?
——
বর এসেছে শুনে সাজিয়া বেগম দোতলায় নেমে গেলেন। ওখানে বরের অনেক বন্ধু আর বাবা, জেঠু আর উনাদের গণ্যমান্য বন্ধুবান্ধব থাকায় উনি সেদিকে আর এগোলেন না। তবে একপলক দেখলেন মেয়ে জামাইকে।
আজকে “উনি” থাকলে দুটো মাস্টারমশাইয়ের কেমিস্ট্রি পুরো জমে যেত। কত খুশি হতো সুজানার আব্বা!
হঠাৎ অভিকের চোখ উনার দিকে পড়ায় উনি বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলেন। অভিক কপালে পাঁচ আঙুল স্পর্শ করে সালাম জানাতেই উনি দূরে দাঁড়িয়ে হাসলেন। ইশারায় বুঝালেন ” আদর “।
___________
বিয়ের শুরুর দিকে আয়না দেখা পর্ব শুরু হলো। অভিকের দিকে আয়না ঘুরাতেই অভিক আয়নায় চোখ রাখলো।
সুশোভিত, সজ্জিত প্রিয় মুখশ্রীটি দেখে
তার এতক্ষণের ধৈর্যের অবসান ঘটলো । আনিকা জানতে চাইলো
অভি কি দেখছিস?
সময় চলে যেতেই যখন উত্তর এল না। পাশ থেকে এমন আরও প্রশ্ন এল।
অভিক ধীরেসুস্থে ছোট্ট একটা উত্তর দিল।
সুন্দর।
সবাই হো হো করে আওয়াজ করে উঠলো। সুজানার কান দিয়ে গরম গরম ধোঁয়াটে বের হলো। ইশশ কি লজ্জা!
তারপর আয়নাটা তার দিকে দিয়ে জানতে চাওয়া হলো
সুজানা আয়নায় কাকে দেখছ?
সুজানা কৌতূহল বশত চোখ রাখলো। যদিও বুকের ভেতর অসম্ভব রকম তোলপাড় হচ্ছে। আয়নায় চোখ দিতেই সেখানের মানুষটা ভুরু নাচালো। সুজানা চোখ বন্ধ করে নিতেই আবারও প্রশ্ন ভেসে এল।
কাকে দেখতে পাচ্ছ সুজানা?
সুজানা ছোট্ট করে উত্তর দিল…
মাস্টারমশাই।
সবাই করজোড়ে তালি দিয়ে উঠলো একসাথে। তাদের দুজনের সাথে হাসিঠাট্টা শেষে সাজিয়া বেগম এসে মেয়েজামাইকে মিষ্টিমুখ করালেন। বললেন
পাঞ্জাবিতে করিমকে দারুণ মানায়। আর শেরওয়ানিতে একদম রাজার মতো দেখাচ্ছে। আমার জামাই রাজা।
অভিক হাসলো। বলল
দিজ ইজ দ্যা বেস্ট কমপ্লিমেন্ট এভার । করিমের আন্টি আর মাস্টারের শ্বাশুড়ি মা খুবই জিনিয়াস।
সাজিয়া বেগম চুলে হাত বুলিয়ে বললেন…..
আর এটা মানিক রতন।
_____
তারপর সবশেষে,
কাজী আসার পরেই আকদ পড়া শেষে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। এক আকাশ চিন্তা, ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে হাজারটা ভয়, মা ভাইয়ের ভবিষ্যৎ, পুরোপুরি অন্য একটা মানুষের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার সেই কাঙ্খিত সময়ে সেই বৃষ্টি ভেজা ভরদুপুরে প্রথম দেখা অভিক ফারদিনকে সুজানার কবুল করে নেয়ার সাক্ষী হলো তার চোখ থেকে খসে পড়া বিরতিহীন অশ্রুজল, আর অনেকগুলো মানুষ।
আর অভিক ফারদিন। সে তো কবেই কবুল করে নিয়েছে সুজানা আফরিদাকে। আজ জনসম্মুখে কবুল করে নিল সম্পূর্ণ পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে। এই বন্ধন উপরওয়ালা না চাইলে কভু ছিঁড়বে না।
চলবে………
এত অপেক্ষায় রাখার পরেও যারা গল্পটার প্রতি আসক্ত তাদের প্রতি মন থেকে ভালোবাসা ❤️
আর আমার অপারগতার জন্য দুঃখীত🙏