সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️ #আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️ #পর্বসংখ্যা-(০৪)

0
75

#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️ #আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(০৪)
_______________________________

১১.
রাতে ডিনার করতে বসলেন আয়েশা মির্জা এবং আরমান। খাবার মুখে তুলে বললেন,”আজ তোমার জন্য নতুন একটা মেয়ে দেখলাম।”

চোখ তুলে তাকালো আরমান।

“শশীপ্রভার বিয়ে হয়ে গেছে দাদুভাই।”

সবে মুখে খাবার তুলছিলো আরমান। হাত থেমে গেলো তার।

“বিয়ে হয়ে গেছে মানে!?”

“হ্যাঁ। আজ সকালে।”

ধক করে উঠলো আরমানের বুকটা। মুখে খাবার উঠলো না। নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বুকের বাঁ-পাশটা চিনচিন করলো। মেয়েটার বিয়ে হলে তার কি এসে যায়?মেয়েটা তার কে?

“তোমার জন্য নতুন মেয়ে দেখেছি। সামনের সপ্তাহে বিয়ে ফাইনাল করে ফেলেছি।”

আরমানের কেমন যেন বুকটা কাঁপছে। শশীপ্রভা একটু ন্যাকা টাইপের। তবে খারাপ না। আর ন্যাকা টাইপের মেয়েদের ন্যাকামির মধ্যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে যেটা অনেক পুরুষই জানে না। মেয়েটাকে দেখতে তার খুব ভালোই লেগেছে। এই কয়দিনে খুব আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে। যেটা আর কোন মেয়ের জন্য হয়নি। আরমানের কেন যেন ন্যাকা টাইপের মেয়ে ভালো লাগে। এই যেমন শশীপ্রভাকে। আরমান বিশ্বাস করতে পারছে না শশীপ্রভার বিয়ে হয়ে গেছে। দাদীমা কিছু জিজ্ঞেস করতে নিয়েও থেমে গেলো। মলিন হেঁসে বলল,”আপনার যা ইচ্ছে। আমার কোনো প্রবলেম নেই।”

“মেয়েটার পিকচার দেখবে না দাদুভাই?”

“প্রয়োজন নেই। তবে ধার্মিক মেয়ে হলেই হলো।”

“তোমাকে ধার্মিক বানিয়ে নিতে হবে দাদুভাই।”

“বেশ আমার কিছু শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো একটি পেপারে উল্লেখ থাকবে। আপনার পছন্দের পাত্রীকে বলবেন মনোযোগ দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে। আর শর্ত পালন করতে পারলে এই বিয়ে হবে। না পারলে ক্যান্সেল। আর শর্ত মেনে যদি রাজী হয় তাহলে আমিও রাজী। তবে ভবিষ্যতে সে আমার কোন শর্ত ভঙ্গ করতে পারবে না। যদি করে তবে তাকে আমার কঠোরতা সম্পর্কে অবগত করবেন। অবগত করবেন আমার সবকিছু সম্পর্কেও। আমার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও। এর অন্যথা হলে তাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে। যেই-সেই পানিশমেন্ট নয় একদম কঠোর!”

“চিন্তা করো না দাদুভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মানুষ মাত্রই ভুল। দু-একবার ভুল করলে শুধরে নিও।”

“সেটা ভুলের ধরণ দেখে।”

উঠে গেলো আরমান। আয়েশা মির্জা তাকিয়ে রইলেন। শশীপ্রভার বিয়ের কথা শোনায় উনার নাতীটা কেমন যেন রেগে গেলো মনে হলো। আবার শর্তও জুড়ে দিয়েছে। আগে তো দেয়নি! একটা লম্বা শ্বাস ফেললেন। নাতীটাকে মানে মানে বিয়ে দিতে পারলেই হয়। ওইদিকে মারইয়াম ছেলের জন্য বউ ঠিক করে ফেলেছে। মেয়েটাও আবার মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী! ধনে-জনে রূপে-গুণে-স্বাস্থ্যে অনন্য!

১২.
সারাটা রাত আরমান ছটফট করলো। শশীপ্রভাকে দেখার পর থেকেই তার ঘুম হয় না। প্রতিটা রাত নির্ঘুম পার করতে হচ্ছে। আরমানের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। শশীপ্রভার কথা বার-বার মনে পড়ছে। কেন এমনটা হলো তাদের জীবন? অনেক চেষ্টা করলেও ঘুম এলো না। বরং মাথাব্যথা শুরু হলো। আরমান উঠে অযু করলো। নামাযে দাঁড়িয়ে গেলো। মানুষ টেনশনে পড়লে না-কি মদ,সিগারেট,গাঞ্জা ইত্যাদি হাবিজাবি এই-সেই খায়। কিন্তু আরমান এইসব কখনো খায় না। সে নামাজ এবং সিজদাহ্’র মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য খুঁজে প্রশান্তি পায়। নামাজ শেষে রবের নিকট মোনাজাত ধরলো,”ইয়া আল্লাহ! আপনি তো বলেছেন,যারা চরিত্র রক্ষার্থে বিবাহ করতে চায় তাদেরকে আপনি সাহায্য করেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সাহায্য করুন। কারণ আপনি ছাড়া আমার আর কোনো উত্তম সাহায্যকারী নেই। আপনি তো আমার মহা-অভিভাবক এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী।

ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে সর্বোত্তম জীবনসঙ্গী দান করুন। দ্বীনদার,ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণকর রাসূল (সা.) সুন্নাত বিশিষ্ট জীবনসঙ্গী দান করুন আপনার এই বান্দাকে। ইয়া আল্লাহ! আপনার প্রিয় বান্দাদের মধ্য থেকে আমাকে একজন উত্তমসঙ্গী দান করুন। যাকে পেলে সারাটা জীবন আপনার দরবারে সন্তুষ্টিচিত্তে শুকরিয়া আদায় করতে পারি।

ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে চক্ষুশীতলকারী একজন জীবনসঙ্গিনী দান করুন। সৎ কর্মশীল,সৎ চরিত্রবান,দায়িত্ববান,উদারমনস্ক,সুশিক্ষিত,ধৈর্য্যশীলা,রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধহীন,সর্বদিকে মনের মতো,পারফেক্ট,ম্যাচিউর,ধার্মিক,উত্তম চরিত্রের সকল গুণে গুণান্বিত এবং যার কোন বাজে মানুষের সাথে বাজে কোন অতীত নেই। হারাম সম্পর্কে লিপ্ত নেই।

ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে উত্তম জীবনসঙ্গীর পাশাপাশি আমিও যেনো আমার জীবনসঙ্গিনীর জীবনে উত্তমরূপে আসতে পারি এবং একজন দায়িত্ববান স্বামী হতে পারি সেই তৌফিক দান করুন এবং আমার জীবনসঙ্গীকে সকল ফিতনা-ফ্যাসাদ এবং হারাম কাজ,হারাম সম্পর্ক থেকে মুক্ত রাখুন। তাকে হেদায়েত দান করুন।

ইয়া আল্লাহ! এই যুগের সকল ফিতনা-ফ্যাসাদ মুক্ত নবী কারীম রাসূল (সা.) এর সুন্নাত মোতাবেক যেনো বিবাহ সম্পন্ন করতে পারি। ইয়া আল্লাহ! আমাকে এমন একজন দান করুন যে আমাকে আপনার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ইয়া আল্লাহ! আমাকে এমন একজন দান করুন যে জান্নাতে আমার হাত ধরবে। ইয়া আল্লাহ! আমাকে এমন একজন দান করুন যে আমার জীবনকে উন্নীত করবে।

ইয়া আল্লাহ! সারাটি জীবন মোনাজাতে রেখেছি যাকে,আমি বৃদ্ধও হতে চাই তার সাথে! কোনো গোলাপের পাপড়িতে খুঁজিনি তাকে,খুঁজেছি সুরা আল-ফুরকানের ৭৪ নং আয়াতে। অতঃপর আপনি তাকে আমার জন্য উত্তমরুপে প্রেরণ করুন।

وَ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا ﴿۷۴﴾و الذین یقولون ربنا هب لنا من ازواجنا و ذریتنا قرۃ اعین و اجعلنا للمتقین اماما ﴿۷۴﴾.

ইয়া রব! আপনি আমায় হালাল ভালোবাসা দান করুন। আমায় দিন এমন ভালোবাসা,যেই ভালোবাসায় বিচ্ছেদের ব্যথা নেই। ইয়া রব! আমার অন্তরকে এমন ভাবে পরিবর্তন করে দিন যেনো আপনার সকল সিদ্ধান্তে সর্বদা সন্তষ্ট থাকতে পারি। ইয়া রব! আপনি দূরে সরিয়ে দিলে আমার যাওয়ার জায়গা নেই। আপনি কাছে টেনে নিলে চাইবার কিছু নেই। ও আমার রব! সেই হৃদয় গুলোকে আপনি প্রশান্ত করে দিন। যেই হৃদয়গুলোর খবর আপনি ছাড়া আর কেও জানে না। ইয়া আল্লাহ! আপনি যা ভালোবাসেন না অপছন্দ করেন আমার মধ্যে যেনো সে স্বভাব না থাকে। অশ্রুর আড়ালে শব্দের অভাবে যা বলতে পারি না তা আপনি বুঝে নিয়েন ইয়া রব!

ইয়া আল্লাহ! আপনি আমায় উত্তম তৌফিক দান করুন। ইয়া আল্লাহ! আপনি তো কাউকে খালি হাতে ফেরান না। আপনি তো খালি হাতে ফেরাতে লজ্জা পান। আপনি উদার,দয়ালু,সর্ব গুণে গুণান্বিত! আপনি তো দোয়া কবুলকারী! আপনি আমার দোয়া কবুলগুলো করুন ইয়া রব!

ইয়া আল্লাহ! সবারই নিজস্ব প্রয়োজন আছে। আপনার কাছে আমার একটাই চাওয়া,সবাই আমাকে ভুলে গেলেও দয়া করে আপনি আমাকে ভুলবেন না। ইয়া আল্লাহ! যদিও আমি আপনার রহমত পর্যন্ত পৌঁছার যোগ্য না,কিন্তু আপনার রহমত তো আমার পর্যন্ত পৌঁছার যোগ্য! আপনি আপনার রহমত বর্ষণ করুন। ইয়া আল্লাহ! আপনি তো ক্ষমাশীল। আপনি তো ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। ইয়া আল্লাহ! আমার কোনো ভুল হলে ক্ষমা করুন। আমিন। সুম্মা আমিন।”

১৩.
পাঁচদিন পরের কথা। শশীপ্রভা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। খাওয়া-দাওয়া এবং কথা বলা বন্ধ করে দিলো। চোখ-মুখ ফোলা থাকে সবসময়ই। জিজ্ঞেস করলেও কাউকে কিছু বলে না। ফায়াজ অফিসে যায়নি আজ। তার কোমড়ে প্রচণ্ড ব্যথা। বাসায় রেস্ট নিয়েছে এই কয়দিন। আজহার শেখ অফিসে যাওয়ার পূর্বে ফায়াজকে বলে গেছেন মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে। শশীপ্রভাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো ফায়াজ। তার নিজের কোমড়টাও ঠিক নেই। অনেক কষ্টে চলাফেরা করছে। পায়ের ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে গেলো। শশীপ্রভাকে চেক-আপ করে ডক্টর কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করলো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ওরা একটি কফি-শপে ঢুকলো। চেয়ারে বসতেই হঠাৎ চোখ পড়লো হাস্যজ্জ্বল মুখে ফোনে কথা বলা ভীনদেশী মানুষটার উপর। মানুষটাকে দেখামাত্রই কেন জানি বুক ফেটে কান্না এলো শশীপ্রভার। ফায়াজ বিচলিত হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।

“পায়ে ব্যথা হচ্ছে?”

মৌন রইলো শশীপ্রভা। বোনকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসলো। মেন্যুবুক দেখে কিছু অর্ডার করলো। যতবার আরমানের দিকে চোখ পড়ছে ততবারই শশীপ্রভার বুক ফেটে কান্না আসছে। ফায়াজ বুঝতে পারলো না কিছুই। ভাবলো পায়ে ব্যথা করছে। হঠাৎ রিয়াদের চোখ পড়লো শশীপ্রভার উপর। দু’জনকে কাছাকাছি দেখতেই রিয়াদ আরমানকে বলল,”স্যার ওই দেখুন।”

আরমান ফোনে কথা বলায় মনোযোগ দিয়েছিলো। রিয়াদ ইশারা দিতেই সামনের দিকে তাকালো। ওদের দু’জনকে এতোটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতেই আরমানের চোয়াল শক্ত হলো। তবে ফায়াজকে আরমান কি ভাবলো কে জানে! আরমানের কেন যেন সহ্য হচ্ছে না। পরক্ষণেই মনে পড়লো মেয়েটার তো বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েটা তো দিব্যি ভালোই আছে। সে শুধু ছটফট করছে! আকস্মিক সেখানে এলো আরাদ ও তার চ্যালাপ্যালারা এবং কয়েকজন বডিগার্ড। আরাদ শশীপ্রভার পাশের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। একটা ফ্লাওয়ারবুকে জোর করে শশীপ্রভার হাতে তুলে দিয়ে বলল,”অভিনন্দন বউ!”

কথাটা আরমানের কানে পৌঁছাতেই আর বসে থাকতে পারলো না। বুকের মধ্যে জ্বলন টের পেলো। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলো। তারমানে তার দাদীমার কথা সঠিক! ওই ছেলেটাই শশীপ্রভার স্বামী! তাহলে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা ওই ছেলেটা কে? ফ্লাওয়ারবুকেটা দিতেই শশীপ্রভা চমকালো। আরমানকে চলে যেতে দেখে আরাদের গায়ে ছুঁড়ে মা’র’লো। বুক ফেটে কান্না এলো। এতোক্ষণ মনে হয়েছিলো একরাশ সুখ তার সামনে বসে রয়েছিলো। এখন সুখগুলো ফানুসের মতো উড়ে চলে গেলো। আর এই অসৎ মানুষটাকেও এখন আসতে হলো? আরাদকে ফায়াজ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই কোন কথা বলতে না দিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে আরাদ শশীপ্রভাকে থামার জন্য ডাকলো,”শশীপ্রিয়া! শশীপ্রিয়া শুনো!”

কোনো কথাই শুনলো না বেরিয়ে গেলো কফিশপ থেকে। আরমান গাড়িতে উঠে চলে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো শশীপ্রভা।

১৪.
মির্জামহলে বিয়ের ধুম লেগেছে। আজ আরমানের বিয়ে। সপ্তাহখানিক পূর্বে বিয়ের কথা থাকলেও পিছিয়ে আরো দু-সপ্তাহ পরে করা হয়েছে। একদম সাদামাটাভাবে বিয়ের এ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। আরমানের মতে সুন্নতি বিয়ে। মির্জা বাড়ি জমকালো ভাবে সাজলেও কনের বাড়িতে কোন জমকালো আয়োজন করতে দেয়নি আরমান। আর কনের পরিবার ও কেন জানি চুপচাপ সব মেনে নিয়েছে। আর্থিক কোনো প্রবলেম না থাকলেও অন্যকোন প্রবলেম হয়তো ছিলো। আরমান মাথা ঘামালো না। বিয়েটা করে সে বউ নিয়ে চলে যাবে নিজের দেশে। এখানে আর ফিরবে না। দাদীমার জন্যই রয়েছে। আরমানকে মহলের সামনে বাইরে নিয়ে এলো। একটি কারুকার্যময়ী চেয়ারে বসিয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই এলো হলুদ,চন্দন মেহেদী দিতে। আয়েশা মির্জা আরমানকে হলুদ ছুঁইয়ে দিতেই আরমান চেঁচিয়ে উঠলো,”এইসব কি দিদিভাই?”

“আরে আজ তো বিয়ে গায়ে হলুদ করতে হবে না?”

“আমি এইসব পছন্দ করি না দিদিভাই।”

“এটা আমাদের সমাজের নিয়ম। নয়তো অমঙ্গল হয়।”

“ওহ! দিদিভাই কোথায় থেকে পান এইসব কথা?”

“আমাদের সমাজে বিয়ের আগে বর ও কনের গায়ে কাঁচা হলুদ মাখানোর প্রচলন রয়েছে।”

“দেখুন দিদিভাই,গায়ে হলুদ শুধু আমাদের কালচার,তা ঠিক নয়। ইসলামি কালচারের মধ্যে এটা আসেনি। কিন্তু এটা কোনও গুনাহের কাজ নয়। এটা যদি ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করে,তাহলে ভুল হবে। এটা ইবাদতের বিষয় নয়। এটা হচ্ছে এলাকার প্রচলন হিসেবে। সৌন্দর্যের জন্য এটা করা যেতে পারে। এখন ছেলেরা মেয়েদের আবার মেয়েরা ছেলেদের আনুষ্ঠানিকভাবে গায়ে হলুদ দেয়,তা ঠিক নয়। এগুলো পুরোটাই শরিয়াহ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। এই আনুষ্ঠানিকতা ইসলামে কোথাও আসেনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ গায়ে হলুদ মাখে,তাহলে সেটা জায়েজ। অনানুষ্ঠানিক ভাবে যদি কেউ সৌন্দর্যের জন্য মেহেদী দিয়ে কাউকে সাজায়,সেটা জায়েজ আছে। তবে মেহেদী কেবল মেয়েদের বেলায়।(সূত্র:ধর্ম ও জীবন)

সাধারণভাবে গায়ে হলুদ দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে শরীরের রঙ সুন্দর করা ও আনন্দ প্রকাশ করা। ইসলাম কোন সামাজিক প্রচলনকে নিষিদ্ধ করে না যদি না তার মধ্যে ইসলাম বিরোধী কিছু পাওয়া যায়। সুতরাং এ উদ্দেশ্যে বর বা কনের গায়ে হলুদ মাখানো হলে তাতে শরিয়তগতভাবে কোন সমস্যা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে নন মাহরাম ছেলেরা মেয়েদের গায়ে আর নন মাহরাম মেয়েরা ছেলেদের গায়ে হলুদ লাগানো,গান-বাজনা করা,বেগানা নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ,হলুদ মেখে শরীর পবিত্র করার হিন্দুয়ানী বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান করা জায়েজ নাই।

❒ শাইখ আব্দুল হামীদ ফায়যী মাদানী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন,বিবাহের মৌসুমে একটি সতর্কতা:

একদা এক সাহাবির গায়ে হলুদ দেখে নবী করীম (সা.) বুঝেছিলেন যে,তিনি নব-বিবাহিত। (বুখারী,মুসলিম) সেটা হলুদের রঙ নয়। বরং স্ত্রীর দেহের ‘খালুক’ (মহিলাদের ব্যবহার্য্য এক প্রকার সুগন্ধি)-এর হলুদ রঙ যা তাঁর কাপড়ে লেগে গিয়েছিল।(ফাতহুল বারী ৯/১৪৪)

সুতরাং এটাকে পাত্র-পাত্রীর জন্য হলুদ মাখার বৈধতার দলিল মানা যায় না। উল্লেখ্য যে,পাত্র-পাত্রীর গায়ে হলুদ দিয়ে বিবাহ-লগ্ন শুরু করা বিদআত।(আদর্শ বিবাহ ও দাম্পত্য)

তিনি আরও বলেন,“বিয়ে শুভ হবে”-এই নিয়তে গায়ে হলুদ মাখানো হলে তা হবে শিরক,বিয়ের আগে তা করণীয় মনে করলে তা হবে বিদআত,সবার দেখাদেখি করলে তা হবে বিজাতীয় অনুকরণ এবং গায়ের রং উজ্জ্বল করার উদ্দেশ্য হলে তা বৈধ। তবে যার দেহ স্পর্শ করা বৈধ তাকে মাখাতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন,“যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে সেই ব্যক্তি সেই জাতির দলভুক্ত।”(আবু দাউদঃ হা/৪০৩৩,সহিহুল জামেঃ হা/৬১৪৯)(ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত)

অতঃপর দাদীমা হলুদ চন্দন ছুঁইয়ে আচমকা আরমানের হাতে মেহেদী পরিয়ে দিতেই আরমান চেঁচিয়ে উঠলো,”এটা কি করলেন দিদিভাই?”

“হলুদ চন্দনের পর মেহেদী দিতে হয় নয়তো অমঙ্গল হয়।”

“ওহ! দিদিভাই,বিয়েতে হোক বা অন্য সময়ে হোক পুরুষদের জন্য হাতে-পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা হারাম। এটি কবীরা গুনাহের শামিল। কেননা এতে নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। এছাড়াও মেহেদীতে ম্যান্ডেলা ডিজাইন করা যাবে না। বিধর্মীরা যজ্ঞ করার সময় ম্যান্ডেলা ডিজাইন ব্যবহার করে। বিধর্মীদের অনুকরন করে এই ডিজাইন মেহেদীতে বা যেকোনো কিছুতে করা নিষিদ্ধ!(শাইখ সালেহ আল-উসাইমিন,ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ১১/৪১৫-১৬)

পুরুষের চুল-দাড়ি ব্যতীত অন্যস্থানে মেহেদী ব্যবহার হারাম। এটি জায়েয নয়। (ইবনু হাজার,ফৎহুল বারীঃ হা/৫৮৯৯-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন,একদিন এক হিজড়াকে নবী করীম (সা.)-এর নিকট আনা হলো। তার হাত-পা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গানো ছিল। রাসূল (সা.) বললেন,এর এ অবস্থা কেন? বলা হলো,হে আল্লাহর রাসূল! সে নারীর বেশ ধরেছে। রাসূল (সা.) তাকে নাকী নামক স্থানে বহিষ্কারের নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন,হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাকে হ’ত্যা করব না? তিনি বললেন,সালাত আদায়কারীকে হ’ত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।(আবু দাউদঃ হা/৪৯২৮,মিশকাতঃ হা/৪৪৮১,হেদায়াতুর রুওয়াতঃ হা৪৪০৭,সনদ ছহীহ)

তাছাড়া মেহেদী এক ধরনের রঙ। আর পুরুষদের জন্য রঙ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) বলেন,পুরুষদের খুশবু এমন,যাতে সুগন্ধি আছে রং নেই। আর নারীদের খুশবু এমন,যাতে রং আছে সুগন্ধি নেই।(তিরমিযীঃ হা/২৭৮৭,মিশকাতঃ হা/৪৪৪৩)

তিনি রঙ থাকার কারণে পুরুষদের জন্য জাফরানের সুগন্ধী ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারীঃ হা/৫৮৪৬,মুসলিমঃ হা/২১০১,মিশকাতঃ হা/৪৪৩৪)

শায়খ উছায়মীন বলেন,বিয়েতে হোক বা অন্য সময়ে হোক পুরুষদের জন্য হাতে-পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা হারাম। এটি কবীরা গুনাহের শামিল। কেননা এতে নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ-দারবঃ হা/১১/৪১৫-১৬)

তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে যে কোন স্থানে মেহেদী ব্যবহার করা জায়েয। (তিরমিযীঃ হা/২০৫৪,ছহীহাহঃ হা/২০৫৯)

এছাড়া নারী-পুরুষ সবার জন্য মাথার চুল ও দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করা বৈধ। (আবু দাঊদঃ হা/৪২০৫,তিরমিযীঃ হা/১৭৫৩,মিশকাতঃ হা/৪৪৫১,ছহীহাহঃ হা/১৫০৯)

অতঃপর টুকটাক কিছু নিয়মনীতি পালন করে সুন্নতি মোতাবেক আরমানের বিয়ের কার্য সম্পন্ন হলো। বারকয়েক পাত্রীকে দেখতে বললেও আরমান ইচ্ছে পোষণ করেনি। তার দাদীমা নিশ্চয়ই খারাপ মেয়ে চুজ করবে না তার জন্য। তবুও ইসলামের মতে পাত্রীকে একবার দেখে নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আরমান সেটা করেনি মনের মধ্যে একরাশ চাপা কষ্ট রেখেই।

১৫.
বাসরঘরে ইয়া বড় ঘোমটা টেনে মূর্তির মতো বসে রয়েছে শশীপ্রভা। বিয়ে করবে না বলে শেষমেশ করতেই হলো। তবে কার সাথে তার বিয়ে হয়েছে শশীপ্রভা জানে না। ঘোমটার নিচে অঝোরে কাঁদছে। চোখ-মুখ ফুলে ঢোল। হঠাৎ রুমের ভেতর কারো ঢুকার শব্দ হলো। শশীপ্রভা বুঝতে পারলো তার সদ্য হওয়া বর প্রবেশ করেছে। কলিজা ফেটে অশ্রু গড়ালো চোখ বেয়ে। সারা-শরীর কাঁপতে লাগলো ভয়ে। গুটি গুটি পায়ে মানুষটা শশীপ্রভার সামনে এসে দাঁড়ালো। আকস্মিক একটা বুনো সুবাস ছড়িয়ে পড়লো সারা রুমজুড়ে। শ্বাস আঁটকে রইলো শশীপ্রভা। রয়ে-সয়ে বেড থেকে নেমে বরকে কদমবুসি করতে নিতেই আচমকা মানুষটা চেঁচিয়ে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,”এইসব কি হচ্ছে? আপনার মাথায় কি ইসলামিক ইলেম নেই?”

আধভাঙ্গা বাংলায় কথা শুনতেই শশীপ্রভা বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে ঘোমটা সরাতেই দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনের। দু’জনকে দু’জন দেখতেই চমকে উঠে একসাথে বলে উঠলো,”আপনি?”

আরমান বলল,”আপনি এখানে কী করছেন?”

“আমারও তো সেইম প্রশ্ন! আপনি এখানে কেন?এখানে তো অন্যকারো থাকার কথা!”

“সেইম প্রশ্ন আমারও। এটা আমার বাসা। আর আপনার না সপ্তাহ দুয়েক পূর্বে বিয়ে হয়েছে?”

“আমার বিয়ে হবে কেন,শুনলাম আপনি বিয়ে করেছেন?”

“মানে?”

“আমার দিদিমণি তো তাই-ই বললো।”

তার মানে দু’জনকে বোকা বানিয়েছে তাদের পরিবার! বুঝতে বাকি নেই কারো।

“বাই দ্যা ওয়ে আপনি কদমবুসি করছেন কেন? আই ডোন্ট লাইক দিস।”

মিনমিন করে বলল,”এটা আমাদের দেশের নিয়ম।”

“দেশ না ধর্মের।”

“দুটোই।”

“কোথায় পেয়েছেন এমন কথা?”

“বিয়ে হলে নতুন বউকে কদমবুসি করতে হয় স্বামী এবং মুরুব্বিদেরকে।”

“আপনি না এডুকেডেট।”

“জ্বী।”

“তাহলে এই কুসংস্কার আপনার মধ্যে কেন?”

আমতা আমতা করলো শশীপ্রভা।

“কুসংস্কার মানে!? কী বলছেন?”

“ইসলামী শরিয়তে কদমবুসি করা শিরক এবং হারাম। আপনি কি জানেন না?”

কাচুমাচু করলো শশীপ্রভা। সত্যিই সে জানে না। আর এটা তো নিয়ম তাদের দেশের।

“ইসলামে পা ছুঁয়ে সালাম করার কোনো বিধান নেই। এটি একেবারেই ইসলাম পরিপন্থী কাজ। কাফির মুশরিকদের সাদৃশ্যতায় উদ্ভাবিত একটি বিদআত। আর বিদআত এর ব্যপারে হাদীস শরীফে এসেছে,হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত,রাসূল (সা.) বলেছেন,“যে কেউ কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্যতা ধারণ করলো সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”এছাড়াও অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন,“যে ব্যক্তি অন্য কওমের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”(মিশকাত শরীফঃ হা/৪৩৪৭)
________

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here