অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৮

0
115

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

বাঁকা হেসে বলল,

-“ওয়েলকাম টু হেল বেইব।” ( নরকে তোমাকে স্বাগতম বেইব )

ঘন্টা খানেক কেটে গেল। আরুশ বেরিয়ে এলো রং চং উঠে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষ থেকে। ঘেমে নেয়ে একশা অবস্থা ছেলেটার। শার্টের উপরের দুটো বাটন খুলে সে এগিয়ে এলো গাড়ির দিকে। তুর্য গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। আরুশের মধ্যে আবারও কাঁচুমাচু ভাব ফুটে উঠলো। দুনিয়ার কোনো মানবকে আরুশ ভয় না পেলেও এই তুর্য নামক প্রানীর ভয়ে সে সর্বদা আড়ষ্ঠ। আরুশ বেশ ভালোভাবেই জানে তুর্যর ভ’য়ং’ক’র রূপ কতটা হিংস্র। আরুশ আশেপাশে চোখ ঘুরালো। একবার ভাবলো তুর্যকে ডাকবে না। তবে পরক্ষনেই মত পরিবর্তন করলো। এখানে আর সময় অতিবাহিত করাটা ঠিক হবে না, অতি দ্রুত তাদের ঢাকায় যেতে হবে। সেখানেও কাজ আছে অনেক। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলো আরুশ। ধীর কন্ঠে বলল,

-“স্যার!”

তুর্য নড়েচড়ে উঠলো। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে চোখ দুটো খুললো সাথে সাথেই। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,

-“দিলি তো আমার শখের বাসরটা মাঝ পথে আটকে। কেবল বউটাকে চুমু খেতে নিয়েছিলাম। তাও তোর সহ্য হলো না। কাকের মতো কা কা করতে করতে উড়ে এলি। শুধু শুধু কি তোকে আমি মীর জাফরের বংশধর বলি?”

আরুশ আমতা আমতা করলো। বোকা বোকা কন্ঠে বলল,

-“দুঃখিত স্যার। আমি তো আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। আপনার বাসর ভাঙার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না।”

তুর্য সরু দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের পানে। আদেশের সুরে বলল,

-“গাড়িতে উঠে বস। ঢাকা যেতে হবে।”

আরুশ এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের ভিতরে বেশ সাহসের সঞ্চার ঘটালো। অতঃপর বলল,

-“স্যার আপনি আর কতদিন আমার মাথায় নুন রেখে বড়ই খাবেন?”

নাক মুখ কুঁচকালো তুর্য। অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“এই মীর জাফরের বংশধর একদম আমার নামে মিথ্যা বদনাম ছড়াবি না। আমি মোটেই নুন দিয়ে বড়ই খাই না। আমি বাজার থেকে সব সময় মিষ্টি বড়ই কিনি। আর কোনো ভাবে দুই চারটা টক বড়ই পড়লে তোকে খাওয়াই নিজে খাই না।”

আরুশ হতাশ হলো। এই লোকের সাথে কথা বলাই বেকার। এর সাথে কথা বলার থেকে নিজের মাথায় একটা বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে দুই চারটা সেলাই নিয়ে বাড়ি ফেরা ভালো।

১০.
চারদিকে উৎসব লেগেছে। বসন্ত উৎসব সাথে আবার ভালোবাসা দিবস। এই ভালোবাসা দিবসেও ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কি দূরে থাকা সম্ভব? তুর্যের তিন দিন আগে থেকে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। বুক ধরফর করে সারাক্ষণ। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছে সে ক্রমশ। তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে যেন কত ছেলেরা এই ভালোবাসা দিবসে প্রেম নিবেদন করবে। তার উপর তার বউটা তাদের বিয়ের কথাও জানে না। যদি কোনোভাবে তার না দেখা বউ কারো ভালোবাসা গ্রহন করে ফেলে। খুদ কুড়ার লোভ দেখিয়ে যদি কেউ পটিয়ে নেয় মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে। তুর্যর বুক কাঁপছে। অস্থির হয়ে উঠছে সে। তাই তো ঢাকায় যাওয়ার চার দিনের মাথায়ই আবার রাজশাহী ফিরলো ছেলেটা। এই চারদিন পর যে ভালোবাসা দিবস এটা একদমই খেয়ালে ছিল না। খেয়ালে থাকলে ব্যবসা গোল্লায় গেলেও তো কেউ তাকে ঢাকায় নিতে পারতো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তুর্য। আরুশকে সাথে নিয়ে পৃথাদের কলেজে ঢুকলো। বসন্ত উৎসবের রঙে রেঙেছে পুরো কলেজ চত্বর। প্রায় সকল মেয়েরাই শরীরে বাসন্তী রঙা শাড়ি পেঁচিয়ে নানান বাহারে সাজিয়েছে নিজেদের। সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বেশ বড়সড় স্টেজও সাজানো হয়েছে কলেজ মাঠে। আর এই উৎসবের তাগিদে বাহিরের মানুষদেরও আজ ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই সুযোগের মোটেও হাত ছাড়া করেনি তুর্য। যদিও সে এমনিও চাইলে যেকোনো সময় কলেজে ঢুকে আসার ক্ষমতা রাখে তবুও সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশে বউকে দেখার তাগিদেই এই সুযোগটা লুফে নিয়েছে।

তুর্য আজ তার শরীরে এক খানা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী জড়িয়েছে। গলার কাছটায় আবার কিঞ্চিৎ লাল রঙের নকশা। ফর্সা শরীরে পাঞ্জাবীটা মানিয়েছে দারুন। হাতে হাত ঘড়ি আর মাথার চুলগুলো পিছনে ঠেলা। আরুশের সাজটাও প্রায় একই রকম। তুর্য হাত উঠিয়ে নিজের পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করলো। আরুশকে জিজ্ঞেস করলো,

-“আমাকে কেমন লাগছে আরুশ? আমার বউ আমাকে দেখে পাগল হবে তো?”

আরুশ বিস্তর হাসলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

-“শুধু পাগলই হবে না স্যার। একদম গলায় ঝুলে পড়বে। আপনাকে আজ যা লাগছে না।”

তুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরুশের পানে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,

-“তুই আবার আমার দিকে নজর দিস না আরুশ। আমি কিন্তু ছেলেদের প্রতি একদম আগ্রহী নয়। তাছাড়া আমার ছোট খাটো মুরগির বাচ্চার মতো একটা বউ আছে।”

আরুশ চুপসে গেল। সে কি বলল আর এই লোক কোথায় নিয়ে গেল। সে কি গে নাকি যে তুর্যর পানে নজর দিবে। ছিঃ কি সব আজেবাজে কথা। আরুশ মনে মনে তুর্যের এ জঘন্য ভাষ্যের তীব্র নিন্দা জানালেও প্রকাশ্যে চুপ রইলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে শুরু করলো মহিলা কলেজের সুন্দরী রমনীদের।

তুর্যও চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো একবার অতঃপর পিছন ঘুরে অন্য দিকে যেতে উদ্যত হলো। হঠাৎ করেই হাতে টান অনুভব করলো ছেলেটা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো তুর্য অমনি যেন থমকে গেল। এ তো সেদিনের সেই ঝগরুটে মেয়েটা। সেই মেয়েটা এত সুন্দরী কিভাবে হলো? উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা শরীরে বাসন্তী রঙের শাড়ি জড়িয়েছে সে ঝগরুটে নারী, চুলগুলো খোলা, চোখে মোটা কালো কাজলের প্রলেপ, মুখশ্রীতে হালকা মেকআপ। তুর্যের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। দৃষ্টি মুগ্ধ হলো ছেলেটার। কিন্তু পরক্ষনেই সে মনকে ধাতস্থ করলো। নিজের হৃদয়ের এমন পাপ কার্যের তীব্র নিন্দা জানানো। মস্তিষ্ক দ্বারা কঠোরভাবে হৃদয়কে শাসালো তার বউ আছে বলে। বউ থাকতে অন্য নারীর পানে তাকানো পাপ, মহাপাপ। তুর্য ঢোক গিললো। নিজের হৃদয়কে পাপ কার্য থেকে বিরত রাখতে আবারও উদ্যত হলো অন্য দিকে চলে যেতে। তখনই পিছন থেকে চেঁচানোর শব্দ এলো। পৃথা চেঁচিয়ে বলল,

-“আরে আমার শাড়ি, শাড়ি!”

তুর্য থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে পিছনের দিকে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো তার হাত ঘড়ির সাথে মেয়েটার শাড়ির আঁচল বেঁধেছে। তুর্যর কিছু বলার আগেই পৃথা দ্রুত এগিয়ে এলো। আজ আর তেমন ঝগড়া বিবাদে না জড়িয়ে নিঃশব্দে শাড়ি ছাড়ানোর চেষ্টা করলো তুর্যর হাতঘড়ি থেকে। কিন্তু পারলো না। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ পৃথা। বিরক্ত হলো তুর্য। কপাল কুঁচকে বলল,

-“আমি দেখছি সরো।”

পৃথা সরে দাঁড়ালো। তুর্যও কিছুক্ষন সময় নিয়ে টানাটানি করলো মেয়েটার শাড়ির আঁচল নিয়ে। কিন্তু সে ব্যর্থ। আর এদিকে বিরক্তি বেড়েও চড়ম পর্যায়ে যেন। শেষে আর কোনো ইতি উতি না করে এক টানে শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে ফেলেই ক্ষান্ত হলো ছেলেটা। অতঃপর বলল,

-“ব্যস হয়ে গেছে।”

পৃথা চমকালো বেশ। নিজের শাড়ির আঁচলটা দুই হাতে ধরলো চোখের সম্মুখে। কান্না পেয়ে গেল মুহূর্তেই। নতুন শাড়ি তার। মাত্র আজই পড়েছে তার মধ্যে এই ব্রিটিশ লোকটা ছিঁড়ে ফেললো? তেতে উঠলো পৃথা। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“কি করলেন আপনি? আমার শাড়িটা ছিঁড়ে ফেললেন?”

তুর্য নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল,

-“এভাবে নির্লজ্জের মতো অন্যের ঘড়িতে আটকালে তো ছিড়বোই।”

-“সব দোষ আমার শাড়ির তাই না? আপনার ঘড়ির কোনো দোষ নেই? আমার শাড়ি যদি নির্লজ্জ হয় তবে আপনার ঘড়িও নির্লজ্জ।”

-“মোটেই না। আমার ঘড়ি আমার মতোই সভ্য।”

ওষ্ঠ বাঁকালো পৃথা। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

-“আপনি সভ্য তবে অ’স’ভ্য কে?”

তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,

-“তুমি আমার মতো একজন মানুষকে অ’স’ভ্য বলতে চাইছো বেয়াদব মেয়ে?”

পৃথা কিছু বলতে চাইলো তবে তার আগেই তাদের কথাপকথনের মধ্যে ফোড়ং কটালো আরুশ। তুর্যকে ডেকে বলল,

-“স্যার।”

তুর্য গর্জে উঠলো। আরুশকে ধমকে বলল,

-“চুপ আরুশ একদম আমাকে থামাতে আসবি না। আজ এই বেয়াদব মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আমি।”

তুর্যর কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো পৃথা। চড়া গলায় বলল,

-“কি বললেন আপনি? আমি বেয়াদব! আপনি তো ইংরেজদের বংশধর, পাজী, ব’দ’মা’ই’শ পুরুষ মানুষ।”

-“অভদ্র মেয়ে মুখ সামলে কথা বলো।”

-“বলবো না কি করবেন আপনি?”

তুর্য রেগে গেল আরও। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে পৃথার শাড়ির আঁচলটা ধরে আরও কিছুটা অংশ ছিঁড়ে দিল। পৃথা হা হয়ে গেল। ক্রোধে রি রি করে উঠলো তার শরীর খানা। অগ্নি দৃষ্টির তাকালো তুর্যর পানে। তুর্য যদিও খুব একটা পাত্তা দিল না সে দৃষ্টিকে। পৃথা হুট করেই পা উঁচু করে দাঁড়ালো তুর্যের সম্মুখে। ছেলেটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত বাড়িয়ে দুই হাত দিয়ে খামচে ধরলো তুর্যের পাঞ্জাবীর গলার কাছের অংশটা। শক্ত হাতে টেনে ছিঁড়ে দিল মুহুর্তেই। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“শোধ বোধ।”

তুর্য ফুঁসে উঠলো আরও। নিজের গলার দিকে তাকিয়ে ক্রোধ চড়ম পর্যায়ে তার। বুকের কাছটা ছিঁড়ে ফর্সা বক্ষভাগ উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে জনসম্মুখে। তুর্যের মেজাজের পারদ লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠলো। রক্তলাল হলো চক্ষুদ্বয়। কপালের নমনীয় রগগুলোও ফুলে ফেঁপে উঠেছে ইতমধ্যে। স্থান, কাল, পাত্র কোনো দিন না ভেবে সে ঠাস করে একটা থাপ্পর মেরে দিল পৃথার নরম গালে। পৃথা স্বব্ধ হলো। অজান্তেই মেয়েটার গান হাত চলে গেল গালে। ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। বাবা মা ভাই হাজার বকলেও কেউ কখনও মারেনি তাকে। অথচ এই অপরিচিত পুরুষ এভাবে মেরে দিল? পৃথা আশেপাশে তাকালো। তাদের ঝামেলাকে ঘিরে ছোট খাটো একটা জটলা পেকে গেছে ইতমধ্যে। লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে পৃথার। আবার কান্নাও পাচ্ছে। পৃথা আর দাঁড়ালো না এক মুহুর্তও। দৌড়ে ঐ স্থান থেকে প্রস্থান করলো একটু সময়ের মধ্যেই।

আরুশ এতক্ষন হতবম্ব হয়ে দেখছিলো দুইজনের ঝগড়া। পৃথা দৌড়ে চলে যেতেই মুখ খুললো সে। তুর্যর পানে তাকিয়ে বলল,

-“স্যার।”

তুর্য মহা বিরক্তি নিয়ে তাকালো আরুশের পানে। কটমট করে বলল,

-“কি হয়েছে?”

জ্বীহ্বা দ্বারা নিজের দুই ওষ্ঠ ভেজালো আরুশ। আমতা আমতা করে বলল,

-“স্যার এই মেয়েটাই আপনার মুরগির বাচ্চার মতো বউ।”

তুর্য বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে শুধালো,

-“এই দজ্জ্বাল মহিলা আমার বউ?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here