অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_২০

0
98

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২০

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

অসহায় কন্ঠে বলল,

-“আমার কাছে আপাতত কিছুই নেই স্যার।”

তুর্যের মেজাজ বিগড়ালো আরও। দাঁতে দাঁত চেপে সে আরুশকে বলল,

-“তুই আছিস কেন? তুইও নাই হয়ে যা।”

আরুশ ঠোঁট উল্টালো। একটু সময় নিয়ে বলল,

–“আমি নাই হয়ে গেলে কিভাবে হবে স্যার? আমি নাই হলে আপনি কার মাথায় নুন রেখে বড়ই খাবেন? রোজ রোজ মা’রা’মা’রি করে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবেন?”

তুর্য ফুঁসে উঠলো। তেড়ে গেল আরুশের পানে। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,

-“আমি তোর মাথায় নুন রেখে বড়ই খাই? নিজের দোষ তোর ঘাড়ে চাপাই? দাঁড়া তুই আজ তোর ঘাড়সহ মাথাটাই রাখবো না বেয়াদব।”

আরুশ আঁতকে উঠলো। ভয়ে সিটিয়ে গেল মুহুর্তেই। তুর্যের ক্রোধ সম্পর্কে সে জানে বেশ ভালোভাবেই। এবার যদি ছেলেটা সত্যি সত্যি ক্রোধে ভুতের ন্যায় তার ঘাড় মটকে দেয় তখন কি হবে? এই অল্প বয়সে বিয়ের আগেই অক্কা পেতে হবে। আরুশের নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো। কে বলেছিল তাকে এমন বেঁফাস মন্তব্য করতে? অবশ্য দোষটা তার নয়। তার চরিত্রে কোনো কালেই এই বেফাঁস মন্তব্য করার গুনটি ছিল না। এটা এসেছে তুর্যের সহচার্যে থাকতে থাকতে। তুর্যের বাতাস লেগেছে তার শরীরে। আরুশের ভাবনার মধ্যেই সে খেয়াল করলো তুর্য চোখ লাল করে তার নিকটে চলে এসেছে। আর একটু হলেই গলাটা টি’পে দিবে। আরুশ ভয়ে দৌড় দিল তুর্যের সম্মুখ থেকে। এক দৌড়ে গিয়ে থামলো ফ্ল্যাটের বাহিরে। তুর্য চেঁচিয়ে উঠলো। গলা বাড়িয়ে বলল,

-“এখন কোথায় পালাচ্ছিস মীর জাফরের বংশধর। দাঁড়া বেয়াদব।”

আরুশকে আর পায় কে? সে নিজের জান বাঁচাতে পালিয়েছে। তুর্য ছেলেটার পিছু পিছু দৌড় দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাথায় আবার চড়াও হলো পৃথার বিয়ের ব্যাপারটা। তার রা’জা’কা’র শ্বশুর যে এত বড় রা’জা’কা’রী’টা করবে বুঝতে পারলে এতটা সময় সে কখনওই নিতো না। তুর্য ভেবেছিল আগে পৃথার কাছাকাছি যাবে, একটু একটু করে মেয়েটার মনে তার জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করবে তারপর না হয় সবকিছু খুলে বলবে। একবার পৃথার মনে নিজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারলে নিশ্চই মেয়েটা নিজে থেকেই তার কাছে চলে আসতো। তখন কারো সাথে আর যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াতে হতো না তুর্যকে। শ্বশুরের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে তার চোখে অন্তত খারাপ হতে হতো না। সম্পর্কও ভালো থাকতো বউও পেয়ে যেতো। কিন্তু তার শ্বশুরটা সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল দারুনভাবে। এখন আর উপায় নেই যেভাবে হোক বউকে অতিদ্রুত নিজের কাছে নিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে হলেও বউকে নিজের করে নিতে হবে। তুর্যের ভাবনার মধ্যেই ফ্ল্যাটের দরজা গলিয়ে শুধুমাত্র মাথাটা ঢুকিয়ে দিল আরুশ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,

-“স্যার আপনি কি আবার আমাকে তাড়া করবেন নাকি আমি ভিতরে আসবো?”

তুর্য তাকালো আরুশের পানে। আপাতত এই ছেলেটার উপরে যতটুকু ক্রোধ ছিল গিলে নিল। একে তো সে পরে দেখে নিবে। আগে বউয়ের বিয়ে আটকে নিক। তুর্য চড়া গলায় বলল,

-“ভিতরে আসতে হবে না তোকে। গার্ডসদের তৈরি থাকতে বল। আমি বেরুবো।”

আরুশ আর কথা বাড়ালো না। মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে চলে গেল সে।

২৪.
মাগরিবের আজান পড়েছে বেশ অনেক্ষণ। নামাজের পর পরই পৃথাদের ঘরে বেশ কিছু জনমানবের আগমন ঘটেছে। যদিও পৃথা এখনও এই জনমানবের কাউকেই চিনে না বা কেন এসেছে জানে না। তাকেও এ বিষয়ে বলেনি কেউ, সেও জিজ্ঞেস করেনি। যদিও ভিতরে ভিতরে মেয়েটা একটু কৌতুহল অনুভব করেছিল যে এ সময় কারা এসেছে, কেন এসেছে তা ভেবে কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি কাউকে। পরে এরা গেলে না হয় জানা যাবে এদের পরিচয়।

ঘরে একটু বেশি মানুষের প্রাদুর্ভাব উপলব্ধি করে নিজ কক্ষেই বসে ছিল পৃথা। এর মধ্যেই সুফিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন সে কক্ষে। পৃথাকে তাড়া দিয়ে বললেন,

-“সেদিন শপিং এ গিয়ে একটা কালো শাড়ি এনেছিলি না। শাড়িটা সুন্দর ভীষণ, ঐ কালো শাড়িটা পড়ে নে আর সাথে একটু হালকা পাতলা সেজে নে তো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা আকস্মিক মায়ের এমন তোড়জোড়ে অবাক হলো। কোথা থেকে এসে হুট করে বলছে শাড়ি পড়তে। মেয়েটা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“এই রাত বিরতে আমি আবার শাড়ি পড়ে কি করবো মা? আর হুট করে তুমি আমাকে শাড়িই বা পড়তে বলছো কেন?”

সুফিয়া বেগম আমতা আমতা শুরু করলেন। মেয়েকে সে কিভাবে বলবেন যে তার বাবা হুট করেই তার বিয়ের তোরজোর চালাচ্ছেন। মেয়েকে না বলে কয়ে তালাক হীনা মেয়ে দেখানোর জন্য পাত্রপক্ষ বাড়িতে এনে তুলেছেন ইতমধ্যে। সুফিয়া বেগম চুপ রইলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

-“তোর বাবা তোর বিয়ে দিতে চাইছেন। বাইরে পাত্রপক্ষ এসেছে তোকে দেখতে। তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।”

পৃথা এতক্ষনে বুঝলো হঠাৎ ঘরে অপরিচিত জনমানবের আগমনের কারন। সবটা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মেয়েটার। তার বিয়ে! পাত্রপক্ষ বাড়িতে পর্যন্ত চলে এসেছে অথচ সে কিছুই জানলো না? জীবন তার, বিয়ে তার অথচ তারই মতামত নেওয়া হলো না। একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হলো না “তুই কি চাস? কেমন ছেলে পছন্দ তোর?” পৃথার পরিবার তার সাথে এত বড় বেইমানিটা করতে পারলো? তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি বিয়ে কিসের? এখন পর্যন্ত বিয়ের বয়স হয়েছে পৃথার? মাত্র তো সতেরো বছর হলো মেয়েটার। বান্ধবীদেরও বিয়ে হয়নি। পৃথা সমর্থন করতে পারলো না বাবা মায়ের এ সিদ্ধান্তকে। প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,

-“কিসের পাত্রপক্ষ আর কিসের বিয়ে? আমি এখন কোনো বিয়ে টিয়ে করবো না।”

সুফিয়া বেগম ব্যস্ত হলেন। মেয়ের নিকটে গিয়ে বললেন,

-“এমন করে না মা। তোর বাবা তোর ভালোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

পৃথা গলা বাড়ালো। স্থান কাল পাত্র ভুলে বলল,

-“ভালো কিসের ভালো? একটা মেয়েকে না জানিয়ে হুট করে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে এনে বলছো শাড়ি পড়ে নে, এটা কোনো ভালো কার্য?”

থামলো পৃথা। ধরা গলায় বলল,

-“আমার মতামতের কি কোনো দাম নেই মা? তোমরা আমাকে একটা বার জিজ্ঞেস না করে কিভাবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে? আমার বিয়ে অথচ আমিই জানি না!”

পৃথার চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেই কক্ষে এলেন পলাশ শিকদার। মা মেয়ের পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

-“চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছো কেন? বসার কক্ষে মানুষ রয়েছেন। তাদের সম্মুখে আমার মান সম্মান নষ্ট না করলে হচ্ছে না তোমাদের?”

বাবাকে দেখে গলার আওয়াজ একটু নিভে এলো পৃথার। বাবাকে সে ভয় পায় ভীষন। কিন্তু তাই বলে আজ ভয় পেয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। তার বাবা তো এমন ছিলেন না। কখনও তার উপরে জোর জবরদস্তি করে কোনো সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেয়নি। হ্যা শাসন করেছে কিন্তু তাই বলে তার মতামতকে অবহেলা করেনি। তাহলে আজ কেন এমন করছে? পৃথা কিছুটা নরম কন্ঠেই বাবাকে বলল,

-“আমার তো এখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি বাবা, বিয়ের বয়সটাও হয়নি। এর মধ্যে বিয়ে কিসের? আমি কোনো বিয়ে করবো না বাবা।”

পলাশ শিকদার শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের পানে। থমথমে কন্ঠে বললেন,

-“ভরসা রাখো আমার উপর। তোমার খারাপ হবে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত আমি কখনওই নেব না। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি।”

থামলেন পলাশ শিকদার আবার বললেন,

-“ধরে নাও বহুদিন আগে তোমার বাবা বড় কোনো ভুল করেছিলেন সেই ভুল সংশোধনেই আজ নেমেছেন তিনি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো। বসার কক্ষে ওরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

কথাগুলো কোনো মতে শেষ করে ব্যস্ত পায়ে মেয়ের কক্ষ ত্যাগ করলেন পলাশ শিকদার। ডুকরে কেঁদে উঠলো পৃথা। কান্না বিজড়িত কন্ঠে মাকে বলল,

-“আমি কোনো বিয়ে করবো না মা। তুমি বাবাকে বুঝাও একটু। তুমি বুঝালে বাবা নিশ্চই বুঝবেন।”

সুফিয়া বেগম মেয়েকে আগলে নিলেন নিজের সাথে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“কাঁদছিস কেন পাগলি মেয়ে? দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি? আগে পাত্রপক্ষ তোকে দেখবে পছন্দ হবে তারপর তো বিয়ে।”

পৃথার কান্না তবুও থামালো না। সুফিয়া বেগম নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন মেয়েকে। খুঁজে খুঁজে কালো শাড়িটা বের করে দাঁড়ালেন পৃথার সম্মুখে। তাড়া দিয়ে বললেন,

-“এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তো। উনারা যেহেতু বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন মেয়েকে তো দেখাতেই হবে। আমাদের মান সম্মানটা অন্তত রাখ মা। তারপর না হয় আমি তোর বাবাকে বুঝাবো।”

পৃথা কান্না থামালো একটু। মায়ের পানে তাকিয়ে শুধালো,

-“তুমি সত্যিই বাবাকে বুঝাবে তো?”

সুলতানা বেগম অভয় দিয়ে বললেন,

-“হ্যা বুঝাবো।”

মায়ের কথায় একটু ভরসা পেল পৃথা। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কালো শাড়িটা পড়ে তৈরি হয়ে নিল সে। তবে সাজলো না একটুও। সুফিয়া বেগমও আর মেয়েকে জোর করেননি। শাড়িটা পড়াতে পেরেছেন এই তো অনেক।

ক্ষানিক সময় নিয়ে সুফিয়া বেগম পৃথাকে নিয়ে ঢুকলেন বসার কক্ষে। মায়ের শিখানো বুলি আওড়িয়ে পৃথা নত মস্তকে সকলকে সালাম জানালো। অস্বস্তি নিয়ে মায়ের কথায় বসলো সোফায়। তবে হৃদয়টা যে বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে। বারবার তুর্যের কথা মনে পড়ছে। বিয়ের কথাটা জানার পর থেকেই মস্তিষ্কে একটু পর পর তুর্য নামক ব্যক্তিটি হানা দিচ্ছে। তার তো তুর্যের কথা মনে আসার কথা নয়। এই তো কয়টা দিন আগে তাদের দেখা হলো। তারপর শত্রুতা। হ্যা এখন ছেলেটা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে তার প্রতি তো পৃথার কোনো অনুভূতি নেই তাহলে তাকে কেন মনে পড়বে? পৃথা উসখুস করে আড় চোখে তাকালো সম্মুখে বসা অপরিচত মানুষগুলোর পানে।আশ্চর্য হলো বেশ। এখানে তিনজন পৌঢ় নারী এবং দুজন প্রবীন পুরুষ ব্যতীত আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে পাত্র কোথায়? তার বাবা আবার কোনো বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেনি তো? করতেও পারে। যারা এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে তার কথা না ভেবে বিয়ে ঠিক করতে পারে তারা সব পারে।

সময় অতিবাহিত হলো আরও একটু। সম্মুখে উপস্থিত পৌঢ় নারীদের মধ্যে একজন এক গাল হেসে পৃথাকে শুধালো,

-“তোমার নাম কি মা?”

পৃথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। এখানে বসে থাকতেই তো তার মেজাজ গরম হচ্ছে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে মেয়েটা উত্তর দিল,

-“পৃথা ইসলাম।”

পাশের আরেক মহিলা হাসলেন। বললেন,

-“বাহ ভারী মিষ্টি নাম তো একদম তোমার মতোই মিষ্টি।”

মহিলা কথা শেষ করতে না করতেই দরজার দিক থেকে এক গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো। গমগমে কন্ঠে সে বলল,

-“তুর্য চৌধুরীর বউ বলে কথা। মিষ্টি তো ওকে হতেই হতো।”

পরপর একই কন্ঠ শোনা গেল আবারও। বেশ গম্ভীর কন্ঠে এবার পুরুষটি আওড়ালো,

-“শুনলাম আমার বউকে নাকি কারা বিয়ে দিচ্ছে।‌ তাই আমিও চলে এলাম। দেখি কার বুকে কত বড় পাটা আমার বউয়ের বিয়ে দিবে।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here