#তুমিময়_প্রেম🥀♥
#PART_05,06
#FABIYAH_MOMO🍁
05
আমি চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে মোবাইলের হাত কাপতে কাপতে যুদ্ধ শুরু করলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে জমে আসছিলো….
মম লোমহর্ষক ভয়ংকর চাহনিতে তাকিয়ে আছে, তার চোখের কালোমনিতে বিশাল বিশাল ভয়ের স্তুপ। ভয়ের স্তুপে কতখানি ডুবে গিয়েছিলো সেটা কেবল মনই জানে। ইসরাত ওয়াশরুমের দরজা খুলে মুখে হাত চেপে অশরীরী ভর করার মতো চুল ছেড়ে দাড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে নিশ্চুপে সে অনেকক্ষন ধস্তাধস্তি করেছে, চুল ফুলে পাখির বাসা হয়ে গেছে, এখন একটা কাক এসে ডিম পারলেই চলবে, ইসরাতের চুলের বাসায় কাকের সংসারকাহন শুরু। মাঝেসাজে কোকিলও বাসা খোজার তাগিদে কাকের বাসা হিসেবে ইসরাতে চুলের ফুলঝুড়িতে ডিম ছেড়ে যাবে। ইসরাত বালতির ভেতরে ছোটবাচ্চার গোসলের মতো তিরিংবিরিং পানি ছুড়ো খেলার মতো দুইপা ঢুকিয়ে দাড়িয়ে আছে। সার্কাস হলে হাসির একটা রোল পড়ে যেত। ওয়াশরুমের দরজার কাছে সাদা টাইলসের উপর তিনটা গুটি পাকানো তেলাপোকা ছিনিমিনি খেলছে, দেখতে খেজুরের কোয়া লাগলেও, কঠিন খোলসে পারা দিলে বুঝবেন ভাই “ইহা প্রতিটি মেয়ের হৃদয় কাপানো হৃদস্পন্দনের ঝাকুনি, নাম “তেলাপোকা শুদ্ধ বুলিতে তেইল্লাচোরা, মহা বিশুদ্ধ বুলিতে “ও মাগো” ডাকের গগনবিদারী চিৎকার। আপনি কোন্ ডাকে সাড়া দেন উহা না হাসিয়া বলিয়া দিয়েন!!
আমি মোবাইলে চুমা মারলাম! আরে ভাই! ইসরাত নামক ভীতুর ডিমকে “উড়ন্ত তেলাপোকার” নাকের তল দিয়ে নিয়ে আসা কি যুদ্ধের মতো কঠিন না?? সহজ? বহুত কঠিন ভাই! বহুত কঠিন!! শলার ঝাড়ু নিলাম। এক বারি দিয়ে ওর বাপের নাম উল্টিয়ে চোরাতেইল্লা বানিয়ে দেয়া ব্যাপক দরকার! রান্নাঘর থেকে ঝাড়ু এনে ‘ঝাপ’ করে মেরে দেই এক ঝটকা! গেম ফিনিশ! হি হা হা! তেলাপোকা ইজ গন! ইসরাত বালতি থেকে বেরিয়ে এসে আমায় জাপটে ধরল। বেচারী কতক্ষণ ধরে ভয় চেপে কলিজা শুকিয়ে বালতিতে দাড়িয়ে আছে কে জানে? মায়ের জন্ম দেয়া নবজাতক বাচ্চাটা ‘ওয়া ওয়া’ করার আগে চুপ করানোর জন্য যে থেরাপি দেয় আমিও ওমন করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আহ্লাদী গলায় বললাম-
–ওলেলে ছোট্ট কুট্টো বাচ্চা টা, কাদে না…না কাদে না…ভাউ তাড়িয়ে দিছি, ভাউ চলে গেছে…
ইসরাত বেকে বসল আমার কথায়! আমাকে ছেড়ে দিল। ঝাঝালো গলায় বলল-
— কুটনী ! কথা বলতে আসবি না! তোর উপর ছাই পড়বো দেখিস!! আমি কেমন ভয় পাইছি!! খোদা!
.
.
সকালে দুজন একসাথে রেডি হচ্ছি ভার্সিটি যাবো। আম্মু নাস্তা দিয়ে গেছেন, ও পরোটা ঘুরিয়ে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। আমি চুল আচড়াচ্ছি। গায়ে নীল কুর্তি, কালো ওড়না, কালো পায়জামা। চুলে খোপা করে কানের সাইডে ছোট চুল গুলো ক্লিপে আটকে নিচ্ছি। ঠোটে গোলাপী লিপবাম দিব, মনিরা বলল-
–তুই খাবি না? তোর পরোটা আমি খাই? ক্ষিদা লাগছে!
–তিনটা পরোটা খাওয়ার পর আমার পরোটা খেয়ে যদি তোর তৃপ্তি লাগে..তুই মুখে ঢুকা!
–কথাটা ভালোভাবে বললে তোর কিছু ক্ষয় হতো মম? রিডিকিলাস!
–ফাইন!
লিপবাম দিয়ে ঠোটজোড়া ঘষছি, যেন সবখানে লিপবাম সেট হয়ে যায়। ইসরাত ভুখা বিড়ালের মতো দুই গাল ফুলিয়ে পরোটা খেয়ে নিচ্ছে। আমি পিঠে ব্যাগপ্যাকটা নিয়ে দৌড়! ইসরাত পানিটুকু নাকি মুখে তুলে কাশতে কাশতে ছুট। রাস্তায় রিকশা নিয়ে জ্যামে পড়ে আছি। ক্যাম্পাসে নিউ নিউ লেট করে গেলে রুগ্ধ স্যার নারাজ হবেন প্লাস লেকচার মিস হয়ে যাবে! ইট উইল বি হ্যাল! ইসরাত ফোনে বফের সাথে খাজুরা আলাপ করছে, বিষয়টা উদ্ভট! বেস্টফ্রেন্ড পাশে থাকলে বয়ফ্রেন্ড আনা যায় না – এই নীতিটা থার্ড ক্লাস মাইয়ার ঘিলুতে ঢোকাতে পারিনি! যেই জায়গার সাদিকের সাথে ওর রিলেশনশিপের দুই বছর ওভার! যত্তসব। রিকশার হুট নামিয়ে বসলাম। সামনে – পিছনে শতশত গাড়ি রিকশা যানবাহন আটকে। এর মধ্যে “প্যা পু” করে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে। অসহ্যকর তো! এমনেই বিডি’র ট্রাফিক জ্যামে মানুষ হার্ট আট্যাক করে! তার মধ্যে কোন্ চন্দ্রালোকের বাসিন্দা এসে জ্যাম টপকে উড়াল দেওয়ার চিন্তা করছে দেখা দরকার !!মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। হর্ণটা যেন আমার জন্যই বাজাচ্ছিলো, আমি তাকাতেই বন্ধ। হাতের তুড়ি বাজিয়ে কপালকুচকে ইশারা করলাম,
–কি হ্যা?? হর্ণ কেন?
কটকটে গাঢ় নীল রঙের গাড়ি। একটা সিএনজির পরেই গাড়িটা থামানো। হর্ণ দিচ্ছে। ইসরাতের দিকে কড়া করে তাকালাম। ও বজ্জাত বফের সঙ্গে কথা বলতে খুব ব্যস্ত। থার্ড ক্লাস! হাতের ঘড়িতে সময় দেখছি আবার হর্ণ দিচ্ছে! রাগে জিদে ব্যাগটা ইসরাতের কোলে দিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম। কুর্তির হাতাটা ঠিক করে হাতের ঘড়িটা কবজি থেকে উপড়ে উঠিয়ে নিলাম। ঠাসঠুস থাপ্পর দিতে ঘড়ির কোনো সমস্যা না হয় সেদিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে নইলে বাসায় বিপদ! গাড়ির জানালার কাচে নক করলাম। জানালার কাচ নামালো। আমি তার চেহারাটা দেখে মনে করার চেষ্টা করছি, কোথায় দেখেছি!!
–এই যে হ্যালো! আমি কি আপনাকে চিনি? চেহারা তো চেনাচেনা লাগছে! ফরগেট ইট! জ্যামের মধ্যে বেহুদা হর্ণ কেন বাজাচ্ছেন! জানেননা বিনা কারনে হর্ণ বাজানো ক্রাইম!
চোখে কালো সানগ্লাস আটা। গায়ে সাদা শার্ট। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি। বাট মেমোরি লুজের কারনে মনে করতে পারছিনা। সে চশমাটা খুলল, আমাকে উদ্দেশ্য করে হাসি টেনে বলল,
–নাও দেখোতো চিনো কিনা???
–বিলাতি কুত্তার চামচা না? মুগ্ধের লেজ ধরে ধরে ঘুরে যে!
–হাও লেম ইন্ট্রোডাকশন? আমি মুগ্ধের…. কি কি যেন বললে?
–চামচা, লেজ,
–হ্যা হ্যা ওটাই। আমি মুগ্ধের চামচা না! আমরা সবাই সবার লিডার। নট অনলি মুগ্ধ।
–তুই তো শালা…সরি সরি তুমি তো ওই মুগ্ধের আগেপিছে ঘুরো। তাই ভাবলাম আর কি। যাইহোক! রাস্তায় বিনা কারনে হর্ণ বাজাবা না। না মানলে! নেক্সট গাড়ি তোমার ভাঙ্গবো।
থ্রেড, চ্যালেঞ্জ- যেটাই ভাবুক আমি আমার কথা পেশ করেছি। এখন সেটা রাখবে কিনা, হি নোউস বেস্ট! আমি পিছু ফিরে তাকাইনি শুধু কানে আসলো, “ফায়ার!”, কমপ্লিমেন্ট ওই চামচা করেছে জানি, ঠাটিয়ে কিছু করার সুযোগ পাইনি। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে রিকশা টানবে আমাদের, আমি আর রাস্তার মধ্যে সিনক্রিয়েট করিনি। এমনেই দুটো কথা শোনানোর সময় বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকাতে পারে ওভাবেই তাকিয়ে ছিলো। বিরক্তিকর!
ফাষ্ট ক্লাস ড্রপ। লেট হওয়ার কারনে রুগ্ধ স্যারের ক্লাস করতে পারিনি। এখন আড্ডাখানার নজরুল চত্বরে বসে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ইসরাত ফোনে চ্যাটিং। আমি কেমিষ্ট্রির নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে চোখ মেলে ডুবে আছি। ইসরাত বলে উঠল-
–দোস্ত! আমরা ভার্সিটিতে পড়তেছি। তুই ভাবতে পারছিস! ভার্সিটি!! এখনো চুটিয়ে প্রেম করিনি।
বইটা ধুপ করে বন্ধ করলাম। ও অলরেডি দুই ইয়ারের রিলেশিপে ঝাক্কাস টাইম স্পেন্ড করছে এখন ভার্সিটি এসে আরো প্রেম প্রেম শুরু! বইটা কোলে রেখে চোখ তীক্ষ্ম করে বললাম-
–একটু আগে কোন গুনের বচন বললা বনু? উপকার করো তো শুনিয়ে!
–ওওওইততো পপ্রেম..
–তাতাতা তোতলামি অফ করো! আর ভালো বাচ্চার মতো ঠনঠন করে বলো!
–ওই ছেড়ি! ডর লাগে তো! এমনে কথা বলস কেন!
–চামড়া তুলে লবন ঘষে দিবো! ভার্সিটি তুমি প্রেমগাথা মনে করছো? আব্বু-আম্মু আমাদের কষ্ট করে টাকা খরচ করে প্রেম শিখাতে পাঠায়!
–ফিলোসফি শুরু করলি কেন? নরমাল একটা কথা বলছি তুই নীতিনিষ্ঠ পেচাল পারছিস!
–শোন! ওইযে নোটিশ বোর্ডটা দেখছোস না? ওইযে বোর্ডটা! ওইখানে টপার লিস্টে যেই পযর্ন্ত আমার নাম না থাকবো , আমি ওই পযর্ন্ত প্রেম সম্পর্কে জড়াবো না! ইটস হারাম! নো লাভ! নো পাপ!
–এই যুগে আইসা তুই হারাম-হালাল বলছিস? লাইক সিরিয়াসলি?
–ইয়েস ওভিয়েসলি! আমি প্রেম-ট্রেম করার জন্য ভার্সিটি আসিনাই। টপার লিস্টে ফাস্ট নাম আমি উঠাবো দ্যাটস ফাইনাল!
–আরে ওরে সাব্বাশ! ঠুকো তালি!!
ইসরাত কথা শুনে হাততালি দিতে থাকলে কেউ সমান তালে ওর তালির ছন্দ ধরে জোরালো শব্দ করে। মনে হচ্ছে একের অধিক মানুষ মিলে হাততালি দিচ্ছে। চত্বরের পিছন দিকে দুজনে ঘুরে তাকালে দেখি কুখ্যাত হান্টার’স গ্যাং তালি দিচ্ছে। দ্রুত চত্বরের সিড়ি থেকে নেমে কপাল কুচকে তাকাই। ওরা ঢুলে ঢুলে এগিয়ে আসছে। জেনি এসেই বলল,
–ওহ্ মাই মাই!! পবিত্র পিউর ভার্জিন মেয়ে দেখছি! উপসসস!
চটাস করে আমি পাল্টা জবাব দেই-
–তোর মতো না হোটেলে শরীর দেখিয়ে প্রেমের প্রমান দিতে যাবো!!তুই নিজে কি সেটা চিন্তা কর।
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু কল মি “তুই” স্টুপিড খালাম্মা টাইপ গার্ল!
–খালাম্মা দিয়ে সংসার টিকে। তোদের মতো দু চারটা বিয়ে নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না! একটাই বিয়ে করি, একটাতেই থাকি।
–ওহ্ রিয়েলি? টাইম উইল সে!বায় দ্যা ওয়ে, সে “সরি”। স্পেশালি মুগ্ধ।
–কেন রে বেশশরম! তুই পোলা? পোলার মতো ভাব দেখাস কেন! ছেড়া জিন্স, পায়ে স্নিকার সুজ পড়লেই তুই ছেলে হবি ভাবিসও না! এটিটিউড তো দূরেই রাখ।
–ইয়াক! কি ভাষা। মুগ্ধ? মেয়েটাকে হোস্টেলের রুমে শক থেরাপি দিবো? মাথায় কারেন্ট দিলে কেমন হয়?
মুগ্ধ স্ট্রেট ফর্মাল ইগোওটিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ। কি যে খুশি খুশি লাগতাছে!! মাথাটা তাহলে ভালোই বাজিয়ে মেরেছি!! এর মধ্যে তন্ময় সানগ্লাস মাথায় পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে উঠলো-
–জেনি বিনা কারনেই রাগ হচ্ছো। রাগারাগী একটু স্লো করো তো। তোমার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন অবনরমাল দেখায়।
জেনি তন্ময়ের কথায় হা করে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিজেদের গ্যাং মেম্বার বাইরের মেয়ের সামনে গায়ে লাগানো কথা শোনাবে ভাবাটা মুশকিল!! মুগ্ধের কাধে হাত রেখে জেনি বলল,
–তুমি কিছু বলবে প্লিজ? এনি ওয়ান ইন দ্যা ক্যাম্পাস ইজ জাস্ট ইনসাল্টিং মি।
মুগ্ধ হাত মুঠোতে কেশে নিলো। গলা ঠিক করে বলল,
–জেনি?
আহ্লাদী ন্যাকান্যাকা করে জেনি বলল,
–ই..য়ে…স
–কাল কি যেন বলেছিলাম তুমি ভুলে গেছো। ডোন্ট ওরি, মনে করিয়ে দেই…মুখের ওয়ার্ডসে একটু চেক করে নিবে। ফিউচারে ট্রাবেল হবে।
জেনি কাচুমাচু করে মুখ থেতলে চুপ হয়ে গেল। নাসিফ সিগারেট টেনে ধোয়া ছেড়ে ফিসফিসিয়ে মুগ্ধের কানে কি যেন বলল, আমি শুনিনি। কথাটা কানে নিয়ে মুগ্ধ একটা বাকা হাসি দিল। নাসিফের পেটে একটা কিল মেরে কি যেন করতে ইশারায় বলল। ইসরাত আমার হাত টেনে ওখান থেকে নিয়ে যেতে নিলে পেছন থেকে বলল-
–এই শুনো! স্টপ যেও না।
আমি মাথা ঘুরিয়ে বইটা নিয়ে তাকালাম। মুগ্ধ কয়েক পা এগিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। চোখাচোখি নিশান। এসপার-ওসপার মামলা। এই ছেলে কিছু বললে ও করলে ডিরেক্ট ডিরেকশন চেন্জ করে ক্যাম্পাস টু হসপিটালের বাসিন্দা বানিয়ে দিব। ও বলল,
–তোমার রাস্টিগেট ক্যানসেল। ইউ ক্যান স্টে।
–ওহ্ ভালো। গুড গুড। ওয়েল ডান। ভবিষ্যতে এইভাবেই কথা মেনে চলবি। তাহলে আমি কিছু করবো না। আদারওয়াইজ, তোর গাড়ি উইথ মাথা হকিস্টিক দিয়ে মেরামত করে দিবো। (তুড়ি বাজিয়ে) ভুলিস না!
মুগ্ধের পেছন থেকে তন্ময় হুহা করে হেসে দিয়েছে অন্যদিকে সবার মুখ কালো। জেনি, রামিম, রিদিতার মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে রাগে ফেটে চৌচির অবস্থা। মুগ্ধ ধারালো দৃষ্টিতে চোখ ছোট করলো এবং আমার উদ্দেশ্যে বলল,
–সিনিয়র! আ’ম ইউর ফোর ইয়ার সিনিয়র। সো ডোন্ট কল মি “তুই”!
–এ্যাহ্! সিনিয়র! তোকে সিনিয়র ভাববো আমার জুতা!
-চলবে
#তুমিময়_প্রেম🥀♥
#PART_06
#FABIYAH_MOMO🍁
বিকেল চারটা। কড়া রোদের দাপুটে দেখিয়ে স্বর্নবর্নের প্রতিভা ফুটিয়ে পুরো আকাশ ছেয়ে আছে। ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর পেজো পেজো মেঘ। ফোন নিয়ে জানালার পাশে বিছানায় বসে আছি। শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে প্রচুর। এখন টিউশনিতে যেতে হবে আমার। সাড়ে চারটায় রওনা দিলে পাচঁটার আগেই ছাত্রের বাসায় পৌছাবো আমি। আম্মু ছোট ভাইকে নিয়ে মামার বাসায় গিয়েছে। তালা মেরে চাবি নিয়ে পাশের বাসার আন্টির কাছে দিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়বো একটু পর। ঘড়িতে চারটা পাচঁ। মনের ক্লান্তি, শরীরের একঘেয়েমি নিয়েই রেডি হচ্ছি। গা এলিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। চোখ দুটোতে ঘুম। বেজায় ঘুম। ইচ্ছা বিরুদ্ধে দ্রুত নিজেকে সংযত করছি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে মাতোয়ারা হওয়ার সময় নেই, এখন খুব করে জলদি জলদি বেরুতে হবে। রিকশা নিব না। নিলেই টাকা জমাতে পারবো না। আব্বুর ফোনটা নষ্ট।একটা ফোনের খুবই দরকার। মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরের ইলেকট্রিসির লাইন সব চেক করে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা পাশের ফ্লাটে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রোদের তপ্তটা বেশি। কপাল ঘিমে কানের পাশ দিয়ে টপ টপ করে ঘামের বিন্দু কনা গড়িয়ে পড়ছে। পায়ে শক্তি কম। আস্তে আস্তে হাটছি। ব্যাগে দশ টাকার একটা নোট ছাড়া বেশি টাকা নিয়ে বের হইনি। আগে ভার্সিটি ছিলো না, যাওয়া-আসা নিয়ে শরীর ক্লান্ত হতো না। এখন আমার খাটাখাটনি করতে হবে বেশি। চওড়া রাস্তার ফুটপাত ধরে যাচ্ছি। রাস্তায় আজ মানুষ কম। চলাচলের গাড়িও কম। সম্ভবত গরমের জন্যে এমনটা হয়েছে। অলস জাতি বাড়ি বসে অলসতা যাপন করছে। খুব করে মনে হচ্ছিলো পেছন থেকে কেউ অনুসরন করছে। কিন্তু আমি ঘাড় বাকাইনি। আপনমনে নিজগতিতে হেটে চলছি।
–এই শুনো? একটু দাড়াবে?
আচমকা কারোর অনুনয় সুর শুনে হাটা থামালাম। কপালকুচকে চিন্তা করছি পিছনে কি তাকাবো? কে না কে ডাকছে তাকানো ঠিক হবে? না..থাক। একবার দেখে নেই। আমি কপালের কাছে ঘোমটা একটু টেনে নিলাম। পেছন ঘুরে দেখি তন্ময়। ক্যাম্পাসে যে পোশাকে দেখেছিলাম তা এখন ভিন্ন। গায়ে কালো টিশার্ট , জিন্স প্যান্ট পড়নে।
–তুমি আমাকে ডেকেছো? তুমি এখানে কি করে? তোমার বাসা না ধানমন্ডি?
তন্ময় আমার কথায় স্বাচ্ছন্দ্যসূচক হাসি দিলো।
–হ্যা ধানমন্ডি। তুমি কি করে জানো??
–আশ্চর্য! তোমাদের ব্যাপারে ফুল তথ্য পুরো ক্যাম্পাস জানে আর আমি সেটা জানবো না? জবাব দাও! তুমি আমার পেছনে কি করছো? মতলব কি তোমার? আমায় ফলো করছো নাতো?
–নো নো…ফলো করছি না। এইতো নারায়ণগঞ্জ শহরে ঘুরতে এলাম। তোমাদের শহর নিয়ে অনেক আর্টিকেল পড়েছি। দেখতে ইচ্ছে করলো, তাই চলে এলাম।
–আসছো ভালো কথা। আমার পেছনে কি!
–তোমার পেছনে কি হবে ? আমি ঘুরতে এসেছি আর দেখি তুমি এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে হেটে হেটে যাচ্ছো।
–মানুষ তো হেটেই গন্তব্যে যায় তাইনা? আমিও হেটেই যাচ্ছি। আমায় ডাক দিবে না। আমি রাস্তায় অপরিচিত মানুষদের ডাকাডাকি পছন্দ করিনা। আল্লাহ হাফেজ।
তন্ময় কোন্ নেকি উদ্দেশ্য নিয়ে হঠাৎ করে নারায়ণগঞ্জ আসলো বুঝলাম না। ওর হুট করে আসাটা ভালো কিছুর পূর্বাভাস দেখাচ্ছে না। টানা পচিঁশ মিনিট পায়ে হেটে মেইন রোড ক্রস করে ছাত্রের বাসায় এসেছি। নাম জোবায়ের, অষ্টম শ্রেনীতে পড়ছে। মাথাভর্তি গোবর, পড়া বাদে সব কুটনামি ওর মাথায় ঢোকে। সপ্তাহে ছয়দিন পড়াই, বেতন দুইহাজার। আজ মাসিক বেতন দেওয়ার কথা, তিনমাসের ছয়হাজার টাকার বেতন আমার আটকে আছে। মুখ ফুটে বলতেও পারছিনা, আন্টি আমার বেতনের টাকাটা দরকার। আব্বুর স্যালারিতে সচ্ছল ভাবে কাটলেও আমার নিজের টাকায় শ্বাস নিতে বেশি শান্তি লাগে।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য একমাত্র সুখ- তার টিউশনির টাকা, নিজের টাকা। টানা দুইঘন্টা পড়ালাম। সকালে ক্লাসের চাপে, বতর্মানে ছাত্রকে পড়িয়ে টনটন করে মাথাব্যথা করছে। হাসি দিয়ে মুখোশ পড়ে আছি কেউ যাতে না দেখে। সবকিছু সবাই দেখার যোগ্যতা পায়না। আমি মনে করি এটা। । চায়ের কাপটা জোড়ালো শব্দ করে টেবিলে রাখলেন আন্টি। বুঝে গেছি, আমার কষ্টের প্রাপ্যটা চেয়ে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। মনটা আবেগপ্রবন হওয়া থেকে বিরত করছি, কিছুতেই কেদে দিবি না। না মানে একদম না। মানুষের কাছে হক চাইতে লজ্জায় কান্না করা শোভা পায় না। তুই কাদবি না!
.
.
বাথরুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছি, মনটা ভেঙ্গে চুরমার কাচের মতো ক্ষতবীক্ষত। সবার সাথে লড়াই, হেনস্ত, অপমান, উপেক্ষা করে দিনশেষে চোখ ভিজে কান্না চলে আসে। মনের মধ্যে অজানা কি পাওয়ার বাসনায় কান্না চলে আসে, বুঝিনা, জানি না। নিজের অক্ষমতা নয়তো ক্ষতচিহ্নের চোটে কান্না জুড়ে আসে। কি নিয়ে কান্না করি আমি, কি নিয়ে হাসি, কি নিয়ে নতুন দিন দেখি, কি নিয়ে পলক ঝাপটাই। মাথায় পানি ঢেলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভেজা চুলে তোয়ালে লাগাই। চুলের দিকে তাকাতে আমি ফুপিয়ে কেদে দেই, আমার চুলের একতালু পরিমান দৈর্ঘ্যতা নেই। কোনো ভুল ছাড়াই ওরা আমার চুল কেটে দিয়েছে। ওরা বড়লোক, আমি মধ্যবিত্ত। আমার স্ট্যাটাসের লঘুতায় ওরা আমাকে ছোটলোক ভাবে। ওদের খুব টাকা, কাড়িকাড়ি টাকা। আমার মতো না, একবেলা রিকশা দিয়ে গেলে আরেকবেলা খালি ব্যাগ পড়ে থাকে। সত্য এটাই, আমার জন্য খালি ব্যাগের শূন্যতাই শ্রেয়। রোদে হেটে টিউশনি করে টাকা ইনকাম ওদের করা লাগেনা। এসির নিচে বসেই ওরা কষ্টের ভোগান্তি বোঝেনা। আমার গালিগালাজ এবং আমার রূঢ় ব্যবহার সবাই আচ করে দেখে, কিন্তু হাসি শেষে নিবরতা দেখে না কেউ। নেই কেউ যে দেখবে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে চুল মুছে নিচ্ছি। বন্ধ চোখের পাপড়ি বেয়ে গালের সমিখে পানি পড়ে যাচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর কান্না। বেতনের চারহাজার টাকা হাতে পেয়েছি, বাকি টাকায় আশাহত । ওগুলো পাব না। নতুন বইয়ের কেনার লিস্টে দাম উঠেছে সাড়ে চার হাজার। খাতার রিম এবং কলমের পাতার হিসাব বাদই দিলাম। আব্বুর কাছে টাকা চাইতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, এ মাসের কারেন্ট বিল পূর্বের তুলনায় দেড়গুন বেশি এসেছে। ছোট ভাইয়ের স্কুল ফিস, মাসের বাজার সদাই, বাসাভাড়া নিয়ে আম্মু-আব্বুর সাথে আমিও চিন্তামগ্ন।কাউকে বোঝতে দিচ্ছি না আদৌ। আব্বুর প্রেসার বেড়ে যাওয়ার সমস্যা আছে, আম্মুর হার্টের সমস্যা, ছোট ভাইয়ের সাইনাসে সমস্যা,আমার পায়ের সমস্যা। এমন মেয়ের জন্য ভার্সিটি গিয়ে প্রেমপরায়ণ হওয়ার টাইম থাকে? লুতুপুতু চুটিয়ে প্রেম? বাবার টাকার ফূর্তিবাজ হওয়ার উপায় থাকেনা। বিলাসিতা দেখানোর প্রভাব বিস্তার করেনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা জীবনসদৃশে বাপের বাড়ি-শ্বশুড়বাড়ি দুই বাড়িতে যোদ্ধা। মানুষ তা কখনো জানবে না।
বালিশে মাথা দিয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। মাথা ভারী ভারী ঠেকছে, গলায় ঠান্ডাজনিত খুশখুশ। পায়ের হাটু থেকে গোড়ালী পযর্ন্ত অমাত্রিক ব্যাথা। ফোন বাজছে, হাতে নিলাম। নাম্বার চিনি না অপরিচিত।
–আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
–আমি কি মমর সাথে কথা বলছি?
–কে আপনি!
–মমকে দিন, ও চিনবে।
–চিনাচিনি বাদ! পরিচয় দিন!
–বলুন ওর সিনিয়র ব্যাচ থেকে কল করেছে। নাম রাদিফ মুগ্ধ।
ধরফরিয়ে উঠে বসি, চোখে মুখে পানসে লাগছে। কানে আঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। কানে ভুল শুনছি?আমি নিজের কানে ভুল শুনছি? মুগ্ধ? এই নাম বললো ? কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ফোনে কান বসালাম। ওপাশ থেকে কন্ঠ না পেয়ে রীতিমতো ‘হ্যালো হ্যালো’ করছে।
–কি চাই! চার বছরের জুনিয়র মেয়ের সাথে ইটিসপিটিস করতে মন চায়? কল কেন করছেন!
–শুনো, আমার রিলেশন করার জন্য মেয়ের কমতি নেই। তুমি নিজেকে নিয়ে কি ভাবো ইউ নো বেস্ট!
–তো? কোন্ খাজনার বাজনা দিতে ফোন করছেন!
–কি বললে? বুঝলাম না আবার বলো।
–তুই ফোন রাখবি! নাকি আবার তোর মাথায় ঢোল বাজাবো!
–আর একটা বাজে ওয়ার্ড বলবে, ইন্সট্যান্ট আমি তোমার রুমে এসে খারাপ কিছু করে ফেলবো! আই সয়ার!
–বলুন কি বলবেন!
–এইতো লাইনে এসেছো। আমার ভাতিজির জন্য একটা টিউটর লাগবে।
–তোহ্? টিউটর লাগবে আমার কি কাজ?
–এই মেয়ে চিল্লাচিল্লি বন্ধ করো! কানের পর্দা ফাটিয়ে চড় লাগাবো! চুপ করে কথা শুনতে পারো না!! শোনো! আমার ভাতিজি তোমার ভাইয়ের স্কুলে পড়ে, তোমার ভাইয়ের ক্লাসমেট ও। ইনফরমেশন পেয়েছি, ইউ আর এ্যা গুড টিউটর। দ্যাটস হোয়াই আই নিড ইউ…আই মিন আই নিড ইউ ফর মাই নিস। কাল দুইটায় ক্যাম্পাস শেষে আমার গাড়িতে চড়ে বাসায় আসবে।
–মগের মুল্লুক? আপনি আমায় গাধা ভেবেছেন? আমি কেন আপনার বাসায় আপনার ভাতিজিকে পড়াতে আসবো!
–ও হ্যালো হ্যালো! পুরো কথা না শুনে মনের মধ্যে ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ কর! আমার ভাতিজিকে তোমার চেয়ে ভালো কোয়ালিফিকেশনের মেয়ে এসে পড়াতে পারবে! ভালো করেই জানো, আমরা টাকার হিসাব করে চলিনা। মান্থলি স্যালারি সাতহাজার টাকা, মাসে মাসেই পেয়ে যাবে। সো, প্রবলেম হচ্ছে আমাকে নিয়ে।
–আপনি মেয়ে? রেপ করে ইজ্জত লুটবে আপনার? ভয় যে পাচ্ছেন ছেলে হয়েও আপনাকে গনধর্ষন করবে!
–ঠাটিয়ে একটা চড় দেওয়া দরকার ফালতু মেয়ে! কথা পুরোটা শেষ না করতেই কথা শুরু!
–আচ্ছা বলুন,
— এ যাবৎ পাচঁজন টিউটর চেন্জ করতে হয়েছে। আমি আমার ভাতিজিকে ছেলে দ্বারা পড়াই না। মেয়ে টিউটর রেখেছি সবগুলো ইডিয়ট! ড্যামিস!
–উল্টা চড় তো আপনার খাওয়া উচিত দেখছি! কেমন মানুষ রে বাবা!
–এগেইন কথায় বেঘাত ঘটালে!
–নো বলুন,
— ওরা পড়াতে এসে আমার খোজখবর রাখে। এভ্রিটাইম আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এসব মেয়েদের দেখতে পারিনা। আর তুমি তো মাশাআল্লাহ ফাস্টদিনেই জিরো টলারেন্স !আই নিড ইউ!
–ঠিকাছে ঠিকাছে আম্মুকে বলে দেখি তারপর জানাবো। খবরদার! টিউটর বানাতে গিয়ে প্রেমিকা বানানোর প্রয়াস চালাবেন না! ঘাড় মটকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিবো!
–বি রেডি !
-চলবে
-FABIYAH_MOMO🍁