গল্প- অনুভূতিরা মৃত
নবম পর্ব
.
মূহুর্তেই বুক ধক করে উঠে, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুয়েল। মিহির বাবার প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে? সত্যি বলতে হলে, মিহির এমন পাগলামির পিছনে সে নিজেই দায়ী। কিছু সময় মানুষ সত্যি বলতে পারে না। অজনা এক ভয় মিথ্যে বলতে বাধ্য করে। হতাশ হয় রুয়েল। সে মিথ্যে বলতে পারছে না। চুপ থাকে, ততো-সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছায় ব্যাংকের সামনে। রুয়েল সিট ছেড়ে উঠে, বিদায় বার্তা জানানোর আগে ভদ্রলোক বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। গাড়ি চলে যায়। রুয়েল ভাবে মিহির কথা। কেমন আছে মিহি? একবার তার বাবাকে প্রশ্ন করা যেতো। আগামীকাল মিহি হসপিটাল থেকে ছুটি পাবে। হসপিটাল ত্যাগ করার পূর্বে দেখা করবে, ক্ষমা চাইবে। মিহি কি তাকে ক্ষমা করবে? তা ভাবতে নারাজ। আর ভাবতে চাইছে না। ক্লান্ত শরীর তার। ঘুম ধেয়ে আসছে, ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
.
মেঘলা আকাশ। রাতের আকাশে মেঘ খেলা করছে, মূহুর্তেই বৃষ্টি নামতে পারে। দিনে প্রচণ্ড গরমের পর রাতের মেঘলা আকাশ দেখলে মনে প্রশান্তির ছাপ দেখা দেয়। এই ভেবে আজ রাতে বৃষ্টি হবে। গরমের রাতে আরাম হবে। রুয়েলের ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ মনে প্রশ্ন, ইট পাথরের ঘরে বসে বৃষ্টিতে রোমান্টিক খুঁজা মানুষগুলোর কাছে এক পশলা বৃষ্টি বিরিয়ানির স্বাদের মতো। অপরদিকে ফুটপাতের মানুষগুলি আকাশে মেঘ দেখলেই ভয় পেয়ে যান। এই বুঝি বৃষ্টি নামল। রাতের ঘুম হারাম হলো। ফুটপাত কিংবা ফুটওভারের নিচে কোনরকম জড়োসড়ো হয়ে ঘুমাতে থাকে, গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন তখন হঠাৎ করেই আগমন যমদূত নামক পুলিশ বাহিনীর। লাঠি-পেটা করতে থাকে, গালি দিয়ে বলতে থাকে এটা কী ঘুমানোর জায়গা? দৌঁড়ে পালায় তারা। নির্ঘুম কেটে যায় আরো একটি রাত। তাদের জন্য কি সরকার ভিন্ন কিছু করতে পারে না? ভাবতে থাকে রুয়েল। মনে অজানা সব প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
.
রাতের বৃষ্টি থেমে থেমে সকাল পর্যন্ত চলছে, সূর্যের দেখা মিলেনি। বৃষ্টিসিক্ত সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ চড়কগাছ, সকাল দশটা অতিক্রম করেছে, মিহির দেখা পাবে তো? কোনরকম ফ্রেশ হয়ে বের হয় রুয়েল। উদ্দেশ্যে হসপিটাল। কিছুদূর যেতেই রিকশা ঘুরিয়ে পিছনে হটে এবার উদ্দেশ্য ফুলের দোকান। শহরের এই একটি ফুলের দোকান যেখানে সদ্য গাছ থেকে উঠানো তাজা গোলাপ পাওয়া যায়। গোলাপ নিয়ে কম কথা হয়নি। প্রেমিকা চাইনি গোলাপ তারপরও প্রেমিকের পছন্দ লাল গোলাপ। প্রেমিক হৃদয়ে সর্বদাই গোলাপের চাহিদা। তা আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি! তৈরি করে গেছে এদেশের কবি লেখকগণ। অজস্র অসংখ্য কবিতায় এসেছে গোলাপের কথা৷ কমলকুমার মজুমদার তো লিখে ফেলেছেন- ‘গোলাপ সুন্দরী’ নামে উপন্যাস।
.
পারস্য প্রেমোপাখ্যানের সেই রাজপুত্র, পাখি ও গোলাপকে আমরা ভুলিনি। রাজপুত্রের ইচ্ছে তার প্রিয়তমাকে একটি টকটকে লাল গোলাপ দিবে। পৃথিবী তন্নতন্ন করেও লাল গোলাপ পাওয়া যাইনি। অতঃপর বেরিয়ে পড়লেন লাল গোলাপের খুঁজে, তার চাই গোলাপ। একটি লাল গোলাপ। সারাদিন খুঁজে শেষে সে ক্লান্ত, কোথাও পেলেন না। পৃথিবী তখন অন্ধকারে ছেয়ে পড়ল। পশ্চিমা আকাশে সূর্য ডুবতে বসল। ক্লান্ত শরীরে রাজপুত্র গোলাপ গাছের নিচে বসে কাঁদতে লাগল। আহা সে কী কান্না। তার এই কান্না দেখে, একটি পাখির মায়া হয়। পাখিটি রাজপুত্রকে বলল- সারা রাত ধরে আপনি এই গাছের নিচে বসে কাঁদতে থাকবেন। আর আমি নিজের বুকে গোলাপ কাঁটা বিঁধিয়ে রক্ত ঝরাব, এই রক্তভেজা প্রার্থনায় আগামী প্রত্যুষে জন্ম হবে পৃথিবীর প্রথম রক্ত গোলাপ৷ রাতের আঁধার মিলিয়ে সূয্যিমামা জেগে উঠে, ভোরের পৃথিবী ফর্সা হয়ে উঠে। পাখিরা গান গাইতে শুরু করে,পাখিদের গানে ঘুম ভাঙ্গে রাজপুত্রের। আশেপাশে তাকায় সে সকল পাখি গান গাইছে শুধু একটি পাখি গান গাইছে না। রাজপুত্র আবিষ্কার করলেন, অসংখ্য ফুলের মাঝে একটি লাল গোলাপ। রাজপুত্র তখন গোলাপের দিকে হাত বাড়ালেন আর সেই অচেনা পাখিটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মৃত্যু এমনই ভয়ংকর সুন্দর সত্য। যা পৃথিবীর সকল প্রাণীকে বরণ করতে হবে।
.
সদ্য গাছ থেকে উঠানো কুড়িটা তাজা গোলাপ হাতে ছুটছে রুয়েল। গোলাপগুলি হাতে দিয়ে বলবে, সদ্য ফোটা কুড়িটা লাল গোলাপ তোমার জন্যই ফোটা। লাল গোলাপ মিহির দিকে বাড়িয়ে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আরো বলবে, বন্ধু তুমি প্রিয়, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। হসপিটালে আসতে জানলে পারল মিহি নেই। ত্রিশ মিনিট আগে বাসায় চলে গেছে। মন খারাপ হয় তার। বিষন্ন মনে হাঁটতে শুরু করে। হাতে কুড়িটা লাল গোলাপ। রাস্তার পাশেই পথশিশু। পথশিশুদের হাতে হাতে গোলাপ বিলাচ্ছে, গোলাপ পেয়ে হেসে ওঠছে তারা৷
.
মিহির সাথে দেখা করা প্রয়োজন। বাসায় যাওয়া যেতে পারে। সে এবার মিহির বাসার গন্তব্যে। মিনিট বিশেক প্যাডেল ঘুরানোর পর রিকশা এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে গেইটে ঢুকতেই দারোয়ানের জবাব কি চাই? মিহির বন্ধু পরিচয়ে ঘরে ঢুকতেই তার বুক কেঁপে উঠল। এইতো আর কয়েক মিনিট এরপরই মুখোমুখি হবে পৃথিবীর বিখ্যাত চরিত্র মিহির সাথে। রুয়েল নার্ভাস ফিল করে, নার্ভাসনেস কাটাতে সে কল্পনায় চিন্তা করে। মিহিকে নিয়ে একটি উপন্যাস সাজাবে সেই উপন্যাসের মূল চরিত্র থাকবে মিহি। সারা পৃথিবী জুড়ে মিহি চরিত্রটি বিখ্যাত হয়ে যাবে। হলিউড, বলিউডে মিহিকে নিয়ে সিনেমা বানাবে। লেখক হিসেবে থাকবে সাকিব হাসান রুয়েল। তার হাত ধরে প্রতিটি সিনেমার মোহরত অনুষ্ঠান সম্পুর্ণ হবে। মিহির চরিত্রটি হবে একটা রাগী মেয়েকে ঘিরে কিন্তু রুয়েলের সামনে সে কোমল হৃদয় বহন করবে। যেমনটা এখন সে ভাবছে, মিহির সামনে দাঁড়াতেই তার কমল হৃদয় স্পর্শ করবে। সবকিছুর জন্য স্যরি বলে ঠিক করে নিবে। এবার তার নার্ভানেস দূর হয়। স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যায় মিহির রুমে। দরজা আনলক করা। ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেলো সে নেই। নেই মানে নেই, তাহলে কোথায়? বাসা ছেড়ে কোথায় থাকতে পারে? খাটের উপর একটি ডায়েরি খুলা। ফ্যানের বাতাসে ডায়েরির পাতাগুলো উল্টিয়ে দিচ্ছে, সে এগিয়ে যায়। মনে হচ্ছে, কিছুসময় আগে ডায়েরি লিখেছে, ভাবতে থাকে রুয়েল। মৃতপ্রায় মেয়েটি হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে ডায়েরি লিখেছে, কী লিখেছে? ডায়েরিটা হাতে নিতেই অপরাধবোধ হচ্ছে, অনুমতি ছাড়া কারো ডায়েরিতে হাত দেওয়া অন্যায়৷ জেনেশুনে সেই অন্যায়টি করতে যাচ্ছে রুয়েল।
.
চলবে……………….
— সাকিব হাসান রুয়েল