বিরহ_ভালোবাসা-১০,১১

0
304

#বিরহ_ভালোবাসা-১০,১১
#Tahmina_Akhter

১০.

শাদাদ ভাইয়ের সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই রাতের খাবার মাকে বলে নিজের ঘরেই এনে খেলাম। শিপলু রাত দশটার দিকে একবার ডেকে গিয়েছিল। সবাই মিলে নাকি লুডু খেলবে। কিন্তু, আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। শিপলুকে বারণ করলে ও বিনাবাক্য চলেই যায়।

রাতটা যেন কাটতেই চাচ্ছিলো না। শাদাদ ভাইয়ের জন্য আমার হৃদয়ে যে সুর বেজে ওঠছে তা কখনোই আমি চাইনি। কিন্তু, আমার অবচেতন মন কখন তার প্রতি এতটা দূর্বল হয়েছে আমি নিজেও জানি না কিংবা জানতে চাই না। সবকথা কিংবা সবপ্রশ্নের উত্তর জানতে নেই। সেই ছোট্ট বেলা থেকে কখনো শাদাদ ভাইকে অনেকগুলো দিন এই বাড়িতে কাটাতে দেখেনি। পড়াশোনা করেছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। ছুটি পেলে জেঠু গিয়ে কিংবা বাবা গিয়ে শাদাদ ভাইকে নিয়ে আসতেন। এসএসসি পাশের পর থেকে নিজে একা আসা শুরু করলেন। বাড়িতে আসতেন দুই এক সপ্তাহ থেকে চলে যেতেন।

সেই সময়টাতে সকল কাজিনরা মিলে একসাথে হতাম বেশ আনন্দ হতো। ক্লাস নাইন অব্দি শাদাদ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা আট-দশটা কাজিন সম্পর্কের মতোই ছিল। কিন্তু, অপরিণতবয়স থেকে যতই পরিণত বয়সের দিকে যাচ্ছিলাম ঠিক ততই মনের কোণের কালো মেঘের ঘনঘটা অদৃশ্য হয়ে একটি বার্তা বলছিল, আর তা হলো আমি শাদাদ ভাইকে পছন্দ করি। সেই পছন্দটুকু পৃথিবীর সবচেয়ে আলাদা পছন্দ। তাকে নিয়ে ভালোবাসায় ভরা একটি সংসার থাকবে আমার। জোসনা রাতে দিঘির পানিতে পা ডুবিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ঝিঝি পোকার ডাক শোনার অধিকারটুকু তার কাছ থেকে পাওয়ার অদম্য আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু, আজকের এই দিনশেষে আমার মন বলছে, শাদাদ ভাইকে পছন্দ করাটা আমার মস্ত বড়ো ভুল। তাকে না জেনে না বুঝে তার জন্য আমার হৃদয়টাকে উজাড় করে দেয়াটা ভুল। সে তো অন্যতে মত্ত। আমি তো তার হৃদয়ের আনাচে-কানাচেও নেই। খুব স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক আমাদের যেমনটা সকল কাজিনদের মধ্যে থাকে।

আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম দূর আকাশে ধ্রুব তারা মিটমিটিয়ে জ্বলজ্বল করছে। নিকেষ রাতে, মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা লতা আনমনে বলে উঠলো,

— আজকের পর থেকে আপনাকে নিয়ে ভাবব না শাদাদ ভাই। আপনাকে নিয়ে ভাবতে বসলে পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে যায় আমার। যেখানে আপনাকে আমি পাব না জানতে পেরেছি সেখানে আপানাকে পাওয়ার আশা করা এখন ভুল। ভালোবাসায় কাতর হয়ে এতদিন আপনাকে ভেবে কেঁপে উঠেছিল হৃদয়। আজ থেকে নাহয় বিরহের জের ধরে আমার আপনাকে বিহীন পথচলা শুরু হোক।

————————————-

ধীরে ধীরে একাকীত্ব কমে আসছে কারণ লোকের সমাগমে বাড়ি মুখরিত। শাদাদ ভাইয়ের নানা বাড়ির হাতেগোনা কয়েকজন এলো। আমার নানুরবাড়ির লোকজন এলো। বিষন্নতায় ঘেরা মনটা একটু একটু করে ঠিক হচ্ছিল সকলের উপস্থিতিতে।

রুপা আপার গায়ে হলুদের দিন সবাই যে যার মতো করে তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসে রইলাম। কারণ, রুপা আপার জামাইকে হলুদ পরিয়ে, সেই হলুদ এনে রুপা আপাকে ছোঁয়াতে হবে। জাভেদ ভাইদের বাড়িতে আমি, শিপলু, নূর আপা, শাদাদ ভাই এবং উনার খালাতো বোন তর্সা যাব বলে ঠিক করেছেন বড়ো জেঠু। আমি আর নূর আপা মিলে সোফায় বসে কানে ফুলের দুল পরছিলাম। কারণ সময় পাইনি। শাদাদ ভাই একধমক দিয়ে আমাদের রুম থেকে বের করে এনে ড্রইংরুমে বসিয়ে রেখেছেন সেই কখন থেকে । যেকোনো মূহুর্তে গাড়ি চলে আসবে। এদিকে কানের দুল পরতে পারছি না।

পলাশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শাদাদ ভাই ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। হুট করে চোখে পরলো একটা বিরক্ত মুখের দিকে। যে কি-না নিজের চুলের ওপর বিরক্ত। অবাধ্য চুলটাকে বারবার কানের পিছে গুঁজে দেয়ার পরও বারবার সামনে চলে আসছে। যার কারনে কানে দুল পরতে পারছে না। হুট করে সারাদিনের ধকল হাওয়া হয়ে গেছে শাদাদ ভাইয়ের।শরীর থেকে।

নীল পাড়ের হলুদ শাড়ি। নীল রঙের হাফ হাতা ব্লাউজ পরে থাকার কারণে ফর্সা রঙের হাতদুটো জ্বলজ্বল করছিল। অলংকারবিহীন গলা, বামহাতে ঘড়ি আর ডানহাতে হাফ ডজন চুড়ি। নাকফুলের সাদা পাথরটা যেন আজ চকচক করছে বেশি।

— মধু রে। তুই আজ আমাকে মেরে ফেলার পায়তারা করছিস। আ’ম শিউর আমি মরে গেলে তুই সবচেয়ে বেশি খুশি হবি। কারণ তোকে জ্বালানোর জন্য একমাত্র আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি তাই।

মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই সবার সামনে গিয়ে দিলো এক রামধমক। ব্যস, অমনি সকলে একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে শাদাদ ভাইয়ের দিকে বোকাচোখে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়।

— আমি কি বলেছি এখানে বসে বসে সাজগোছ করতে? তোরা যেভাবে সাজুগুজু করে টাল দিয়ে ফেলছিস আমার তো দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা তোদের রুপা আপার না। যাহ্ গিয়ে গাড়িতে উঠে বস।

ব্যস, যে যেভাবে পেরেছে ড্রইংরুম ছেড়ে গাড়ির পথে রওনা হয়েছে। বাকি রয়ে গেছে আমাদের লতা। যিনি কিনা এখনও কানের দুল নিয়ে ব্যস্ত। শাদাদ ভাই চারদিকে তাকালেন, দেখলেন কেউ নেই। চট করে লতার পাশে গিয়ে বসলেন। লতার হাত থেকে কানের দুলটা হাতে নিয়ে নিলো। লতা অবাক হয়ে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। তারপর, শাদাদ ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

— দুলটা দিন। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শাদাদ ভাই লতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আরেকটু লতার ঘনিষ্ঠে এসে বসলেন। হাত দিয়ে লতার মাথাটা একপাশে করে দিলো। লতা তো চুপ। ওর কোনো নড়াচড়া নেই দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর শরীরে এনথেশিয়া পুশ করে দিয়েছে। শাদাদ ভাই খুব যত্ন করে লতার চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিলো। তারপর, কানে দুল পরিয়ে দেয়। আরও একবার লতার ওপর চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো শাদাদ ভাই। এবার পার্ফেক্ট হয়েছে। লতা কিছু বলতে যাবে শাদাদ ভাইকে তারআগে চট করে লতার কানে চুকুস করে একটা চুমু খেলো।

শাদাদ ভাই কোনোকিছু হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বাড়ির বাইরের দিকে চলে যাচ্ছেন। আর আমাদের লতা আজ একটার পর একটা ঝটকা খেয়ে মনে হচ্ছে সে যেকোনো মূহুর্তে অচেতন হয়ে পরে যাবে। প্রেশার বোধহয় লো হয়ে গেছে শাদাদ ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে।

এতক্ষণ অব্দি লতা কিংবা শাদাদের মাঝে যা কিছু হয়েছে সবটাই দেখেছে রুপা আপা। মনে মনে ভীষন খুশি হয়েছেন তিনি। কিন্তু এই সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে রুপার খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা হচ্ছে না। কারণ, রুপার বাবা মনে হয় না এই সম্পর্ককে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিবেন! রুপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চলে গেলো ঘরের ভেতরে।

রুপা ছাড়াও আরও একজন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছে আজ। আর সেই মানুষটা হচ্ছে লতার মা তৃনা। উনার শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাড়ির মেয়ে বাড়ির ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন এটা তিনি কল্পনাও করেননি। লতা না হয় বুঝে না এই সম্পর্কের পরিণতির কথা। কিন্তু শাদাদ কি জানে না ওর বাবা এই সম্পর্কের কথা জানলে কখনো মেনে নিবেন না! তৃনার হুট করে শরীর খারাপ লাগছে। হুট করে এতটা চাপ তিনি নিতে পারছেন না।

লতা ধীরপায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠে বসলো। কিন্তু, কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! লতার পাশের সিটে শাদাদ ভাই বসে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন,

“তুমি এসেছিলে পরশু
কাল কেন আসোনি?
কাল ভালোবাসোনি”

শাদাদ ভাইয়ের গান শুনে লতা ভ্রু কুঁচকে শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে কি? ওকে দুল পরিয়ে দেয়ার বাহানায় চুকুস চুকুস চুম খেতে পারে। আবার কি না গাড়িতে বসে বসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরহের গান গাওয়া হচ্ছে! এই লোকটাকে প্রশয় দেয়া ভুল হয়েছে লতার। হুট করে কাছে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আবার প্রকাশ্যে অন্যকারো অপেক্ষায় থাকার কথা গানের মাধ্যমে বোঝায়।

সারা পথ জুড়ে লতা শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকালো না অব্দি। এদিকে তো আমাদের শাদাদ ভাই চোরা চোখে লতার দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন।

দু’জন মানুষ দু’জনকে ভালোবাসাে। একজন প্রকাশ করতে চায় না। আর অন্যজন ভুলভাল বুঝে গাল ফুলিয়ে বিরহের বীজ হৃদয়ে রোপন করে বসে আছে। ভালোবাসায় এতটা বিরহ কেন?

#চলবে….

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১১.

জাভেদ ভাইদের বাড়িতে যাওয়ার পর রবিন সাহেব আমার পেছনে হাত ধুয়ে পরে আছেন। মানে হলো একমিনিটের জন্যেও আমাকে একা ছাড়ছেন না। কি খাব? অনুষ্ঠান ইনজয় করছি কি-না? উনার দেয়া শাড়িটা কি আমার পছন্দ হয়নি? শাড়িটা পরলাম না কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

রুপা আপার দেবর বলে আজ রবিন সাহেবকে কিছুই বলিনি। অন্যকেউ হলে মুখে ট্যাপ লাগিয়ে বাথরুমে বসিয়ে রাখতাম।

জাভেদ ভাইকে হলুদ পরিয়ে দেয়ার জন্য জাভেদ ভাইয়ের আম্মু বারবার অনুরোধ করছিলেন আমাকে। কিন্তু, অন্য কারো গা ছুয়ে হলুদ লাগানোর ব্যাপারটা আমার কাছে বিশ্রী মনে হয়। কিন্তু, গুরুজনের অনুরোধ ফেলতে পারব না আজ। তাই হাসিমুখে নূর আপা আর তর্সাকে নিয়ে জাভেদ ভাইকে হলুদ ছুঁয়ে দিলাম। জাভেদ ভাই আমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছিলেন এমন সময় হুট করে কোত্থেকে এসে রবিন সাহেব আমার কপালে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ রবিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কাউকে কিছু না বলেই সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে সোজা জাভেদ ভাইদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের গাড়িতে গিয়ে বসে রইলাম।

কিছু সময় শুধু নিজেকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই যে রবিন সাহেব আমার প্রতি আলাদা খেয়াল রাখছেন এটা কেন করছেন তিনি? কারণ, তিনি হয়তো আমাকে পছন্দ করেন। দেখতে শুনতে উনি কিন্তু মোটেও খারাপ নন। হাইটে শাদাদ ভাইয়ের সমান সমান হবেন। গায়ের রঙ শাদাদ ভাইয়ের থেকেও উজ্জ্বল। গালে ঘন দাড়ি আছে। হাসেনও খুব মিষ্টি করে। কিন্তু, আমার উনাকে ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে আমাকে ভীষন কষ্ট দেয়া শাদাদ ভাইকে। যাকে প্রতিমূহর্তে ভালোবাসি বলতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় আহত আমি। শাদাদ ভাই যখন মিষ্টি চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেন, তখন আমার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা হাসছে। তার খুশিতে কারো নজর না লাগুক এই প্রার্থনা করতে থাকা আমার মন। কিন্তু, মানুষটা কেমন যেন! একটিবারও আমার মনের ভাষা কিংবা চোখের ভাষা বুঝতে পারেন না তিনি?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে লতার চোখের পানি গাল গড়িয়ে পরে। মনে মনে শাদাদ ভাইকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালাগাল করছিল লতা। এমনসময় গাড়ির জানালা ভেদ করে একটি হাত এসে লতার চোখের পানি মুছে দেয়। লতা ভয় পেয়ে আঁতকে উঠল। তাকিয়ে দেখলো শাদাদ ভাই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। লতা জানালার পাশ থেকে সরে বসলো। এবার কি করে লতাকে স্পর্শ করবে?

লতার কান্ড দেখে শাদাদ ভাই কিছু বললেন না। শুধু বড়ো একটা দীর্ঘ শ্বাস চেপে একটানে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে লতার সঙ্গে চেপে বসলো। লতা সরে যাচ্ছিলো কিন্তু শাদাদ ভাই লতার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। চুড়ির সঙ্গে হাতে চাপ লেগে লতা ভীষণ ব্যাথা পায়, চোখে জল চলে আসে। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের এসব দেখার সময় কই? উনি তো জোর খাটাতে ব্যস্ত। লতা হাতের ব্যাথাটুকু সহ্য করতে না পেরে আস্তে করে বললো,

—- ব্যাথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ুন।

লতার কান্না মাখা গলা শুনে শাদাদ ভাই হাত ছেড়ে দিলেন। লতা নিজের ডানহাতটা উচু করে দেখলো, লাল হয়ে গেছে আরেকটু হলে হয়তো চুড়ির চাপ লেগে হাতটাই কেটে যেত। শাদাদ ভাই ফোসফাস করতে করতে লতার গালে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

— যার তার সঙ্গে হাসাহাসি করা হচ্ছে। হলুদ মাখামাখি হচ্ছে। কই জীবনেও তো দেখিনি কাউকে তুই হলুদ পরিয়ে দিয়েছিস কিংবা কেউ তোকে হলুদ পরিয়ে দেয়ার সাহস করেছে? কিন্তু, ওই ছেলেটার সাহস কি করে হলো তোর এই জায়গায় ছুঁইয়ে দেবার?

কথাটি বলে শাদাদ আলতোহাতে লতার হলদে কপালে টোকা দেয়। লতা চোখ বন্ধ করে ফেলে জবাব দিতে চাচ্ছে না সে। কিন্তু, শাদাদ ভাই তো নাছোরবান্দা। তিনি জবাব না শুনে আজ নড়বে না বোধহয়। শাদাদ ভাই এরইমাঝে একটি ভয়ানক কান্ড ঘটালেন। লতার চোখদুটো যেন কোটর থেকে বের হওয়ার মতো উপক্রম।

টিস্যুতে করে হলুদ এনেছিলেন বোধহয়। সেই হলুদটুকু লতার গালে এবং লেপ্টে দিয়ে ক্ষান্ত হয়ে তবেই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন শাদাদ ভাই। এদিকে লতা রাগে-দুঃখে পারছে না হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে। এই জীবনের কোনো মানে আছে! কোত্থেকে পাগল-ছাগল সব এসে লতার সঙ্গে বাঁদরামি করে চলে যায়।

একে একে সবাই চলে এলে গাড়ি নিয়ে রওনা হয় নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্য। এবার লতা নূর আপার সঙ্গে বসে এসেছে। শাদাদ ভাই লতার সঙ্গে জোর করে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, লতার একটাই কথা ওর নাকি আজ ছেলেদের গায়ের পারফিউম নাকে লাগছে আর বমি বমি পাচ্ছে। তাই পলাশ, শিপলু কিংবা শাদাদ ভাই কেউ যেন ওর পাশে না বসে। ব্যস, আর কেউ সাহস করেনি লতার পাশে বসার জন্য।

একমাত্র শাদাদ ভাই জানে লতা যে মিথ্যা কথা বলছে। এই মেয়ের বাহানা তো দিতেই হবে। মাথায় তো শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করে কি করে শাদাদ ভাইকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখা যায়। শয়তান মাইয়া?

জাভেদ ভাইদের বাড়ি থেকে হলুদ দিয়ে রুপা আপাকে হলুদ পরিয়ে দেয়া হলো। একে একে সবাই রুপা আপাকে হলুদ পরিয়ে দেয়। বাকি শাদাদ ভাই আর লতা। অদূরে দাঁড়িয়ে নিজের বড়ো বোনকে দেখছে শাদাদ। বোনটা আজ বাড়িতে আছে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে বোনটা এই বাড়িতে থাকবে। মাঝে মাঝে শাদাদ ছুটি পাবে তখন হুট করে এসে বোনকে চমকে দেয়া যাবে না। মাকে তো ছোটবেলা থেকে পায়নি শাদাদ। মা সমতূল্য বড়ো বোনের কাছ থেকে মায়ের মমতা-আদর পেয়ে অভ্যস্ত শাদাদ। বোনটা চলে গেলে বড্ড একা হয়ে যাবে শাদাদ। হুট করে শাদাদের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে চোখের জমানো জলে। সবার আড়ালে এসে অতি সন্তর্পনে টিস্যু দিয়ে চেপে চোখের পানি মুছে ফেলে। তারপর, হাসিমুখে এগিয়ে যায় বোনের দিকে কারণ বোনের চোখে অপেক্ষা দেখতে পাচ্ছে।

শাদাদ রুপা আপার কপালে এবং গালে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। কারণ, মধু এবার হলুদ লাগাবে। কিন্তু, মধুটা আছে কোথায়? আসার পর থেকে গায়েব! এমনসময় সিঁড়ি বেয়ে নামছিল শাদাদের মধু সবুজ রঙের কটি যুক্ত কূর্তি আর ধুতি সালোয়ার পরে। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। পুরাই পাকিস্তানি নায়িকার মতে দেখাচ্ছে আমাদের মধুকে। শাদাদ ভাই ঢোক গিলে অন্যদিকে তাকালেন। কিন্তু, বেহায়া চোখের দৃষ্টি ঘুরে ফিরে সেই মধুর দিকে যাচ্ছে। শাদাদ ভাই খেয়াল করলেন মধুর কপালে, গালে হলুদ নেই। তারমানে, সব ধুয়েমুছে তারপর তৈরি হয়ে নীচে এসেছেন।

লতা রুপা আপার সামনে বসে একটু করে হলুদ নিয়ে গালে লাগিয়ে দিলেন। রুপা মুচকি হেসে লতাকে বললো,

— এবার তো আমার মনে হচ্ছে, আমার বিয়ের পর তোর বিয়ে। তাই তোকেই আমার হলুদটুকু লাগিয়ে দিলাম। যেন অতিশীঘ্রই তোর বিয়েটা সম্পন্ন হয়।

কথাটি বলে শাদাদের দেয়া কপালের হলুদটুকু এনে লতার কপালে লাগিয়ে দেয় রুপা। দূরে দাঁড়িয়ে বোনের কান্ড দেখে অবাক হয় শাদাদ। কারণ, লতার আগেই শাদাদ রুপা আপাকে হলুদ দিয়েছিল আর কপালে শুধু শাদাদ হলুদ লাগিয়েছিল আর কেউ নয়। তবে, কি রুপা ইচ্ছে করে শাদাদের দেয়া হলুদ লতাকে ছুঁয়ে দিয়েছে?

হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন। আগামীকাল সকাল থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু। শেষ রাতে থেকে বাবুর্চিরা কাজ শুরু করবেন। এক হাজার মানুষের আয়োজন বলে কথা।

মধ্যরাত হয়ে যায় রুপা আপার হাতে-পায়ে ভর্তি মেহেদি লাগিয়ে দিতে। রুপা আপার হলে সবাই চেপে ধরে আমাকে মেহেদী লাগিয়ে দিতে। কিন্তু, মা এসে সকলের মাঝে থেকে আমাকে উঠিয়ে মায়ের ঘরে নিয়ে যায়। আমি আমার মায়ের এমন আচরণের সঙ্গে পরিচিত না। কারণ, সবার অনুরোধকে অগ্রাহ করে মা আমাকে নিয়ে এসেছেন। অথচ,মা সবার আগে বাইরের মানুষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কি হলো আজ মায়ের?

লতা দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবছিল। এমন সময় দরজা লক করার শব্দ পেয়ে নড়েচড়ে বসে লতা। লতার মা এগিয়ে এসে চুপটি করে লতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা সময় চুপ থেকেই সর্বপ্রথম যে কথাটি বললেন,

— আমাদের পরিবারের কখনো আত্মীয়ের মাঝে আত্মীয়তা হয় না, এটা জানিস তো লতা?

লতা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়। লতার মা লতার মাথায় হাত রেখে বললেন,

— তাহলে, শাদাদকে ভুলে যা তোর মনে শাদাদের জন্য অনুভূতি থেকে থাকে।

লতা চমকিত দৃষ্টিতে তাকায় ওর মায়ের দিকে। ওর মা কি করে জানলেন এই কথা? লতা মাথা নিচু করে ফেলে। কি জবাব দেবে ওর মাকে? কিন্তু, শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়া লতার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের মনে কি লতা আছে? যদি না থাকে তবে একা একা ওর মায়ের কথার বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া ঠিক হবে না। কার জন্য লড়বে লতা?

সে রাতের পর থেকে লতা আগের থেকে আরও গম্ভীর হয়ে যায়। একদিকে মায়ের আদেশ অন্যদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চট করে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ? যে কিনা চোখের সামনে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরঘুর করে। চট করে মিষ্টি চোখে তাকায় আবার চোখে চোখে কঠিন ধমক দেয় তাকে কি করে ভুলে যাওয়া যায়? জানা নেই লতার। কিন্তু, শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়ার এই জার্নিটা কঠিনতম হবে লতার জন্য।

লতা যে শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে সেটা কি আমাদের শাদাদ ভাই জানবে? যেদিন জানতে পারবেন সেদিন লতার কি অবস্থা হবে কে জানে? লতার কথা বাদ কিন্তু এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের পরিবারকে কি করে মানাবেন শাদাদ ভাই?

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here