#বিরহ_ভালোবাসা-১৮,১৯ শেষ
#Tahmina_Akhter
১৮.
লাল বেনারসি, মাথায় লাল ওড়না, মায়ের দেয়া হালকা কিছু গহনা সাথে রুপা আপার ম্যাজিকাল মেক-আপ। ব্যস আমার ব্রাইডাল মেকআপ কমপ্লিট।
পাশের ঘর থেকে চেচামেচি শোনা যাচ্ছে দেখে রুপা আপা আমাকে একা রেখে ওঠে চলে গেলেন পাশের ঘরে।
খাটের ওপর রাখা ছোট্ট আয়না হাতে নিয়ে নিজের মুখটা দেখলাম। বৌ বেশে মন্দ দেখাচ্ছে না। এই যে বৌ বেশে থাকা আমি আজ দ্বিধান্বিত মনে ভাবছি শাদাদ ভাইয়ের বৌ হিসেবে সাজলে আমাকে কেমন দেখাতো? হয়তো শাদাদ ভাই আমাকে লাল শাড়ি পরতে দিতেন না। কারণ, শাদাদ ভাইয়ের লাল রঙ অপছন্দ। এই যে নাকফুল খুলে নোলক পরেছি এটাও হয়তো পরতে দিতেন না। শাদাদ ভাই বলতেন, নোলকের ভারে তোর বোঁচা নাকটা ছিঁড়ে যাবে রে লতা। হাতে গোল্ডের চুড়ি না থেকে ডজনখানেক কাঁচের চুড়ি থাকতো আমার। কিন্তু, রবিন সাহেবের স্ত্রী হিসেবে সেজেছি বলেই আজ আমার বৌ সাজে কতটা পরিবর্তন এসেছে!
মানুষটাকে পছন্দ করতে করতে একসময় তার সকল পছন্দ-অপছন্দকে নিজের পছন্দ-অপছন্দ হিসেবে মানিয়ে নিয়েছি। জানি না কবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাব? মনে শাদাদ ভাই কিংবা তার পছন্দ-অপছন্দ রেখে রবিন সাহেবের স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য। তবুও চেষ্টা করব আমি। নয়তো, মানুষটাকে ঠকানো হবে।
এমন সময় বড়ো জেঠুর চেচামেচি শুনে আমার ধ্যানভগ্ন হয়। মনে অজানা আশংকায় আঁতকে ওঠে। পড়নের শাড়িটা দুহাতে একটু উঁচু করে ঘরের কাঠের দরজা খুলে পাশের ঘরের দরজা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার চোখ এমন একটা দৃশ্য দেখে স্থীর হয়ে যায়। মন বলছে বিশ্বাস করে নে লতা। কিন্তু, মস্তিষ্ক বলছে, কারনটা জেনে নে কেন এমনটা হলো?
কিছুক্ষণ আগে……
লতার বড়ো জেঠু বিয়ের কেনাকাটা সেড়ে লতার বাবা এবং রবিনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারপর, নিজে এলাকার স্থানীয় কাজি অফিসে গিয়ে কাজি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হোন।
বাড়িতে আসার পর বিয়ের যাবতীয় বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। কাজি সাহেব, লতার বাবা,রুপার স্বামী জাভেদ এবং রবিন একঘরে বসে আছেন। লতার মা তাদের সামনে নানানপদের নাশতা রেখে গেছেন।
লতাক তখন রুপা বৌ সাজাতে ব্যস্ত। লতার মা বাইরে রান্নাবান্না সামলাচ্ছেন। পাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা এসে লতার মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছেন।
লতার জেঠু নিজের ঘরে বসে আলমারী খুলে কি যেন বের করছিলেন? এমন সময় ঘরে ঢুকে শাদাদ। দরজা খোলার শব্দ শুনে শাদাদের বাবা সাদিক চৌধুরী ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলেন ঘরে কে এসেছে? ছেলেকে দেখে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি। শাদাদ এসেছে প্রায় দশমিনিট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেই আগের মতো মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সাদিক সাহেব ছেলের কান্ড দেখে যারপরনাই বিরক্ত। আলমারী লাগিয়ে নতুন পাঞ্জাবি পরে গায়ে সুগন্ধি আতর মাখলেন। চোখে সুরমা ব্যবহার করলেন।
এদিকে নিজের বাবাকে নতুন পাঞ্জাবি, গায়ে আতর, চোখে সুরমা দিতে দেখে শাদাদ ভাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজের ছেলে বরবাদিতে পৃথিবীর এই প্রথম কোনো বাবা এত সুন্দর পরিপাটি হচ্ছেন!
— উল্লুকের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেন?
ছেলেকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন সাদিকে সাহেব। শাদাদ মনের কষ্টখানি ঢোক গিলে গলার নীচে নামালো। কষ্ট বেশি হলে গলা থেকে বুক পর্যন্ত এত বেশি ব্যাথা করে কেন?
— বাবা, আ..মি আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম মাসখানেক আগে।
চিঠির কথা শুনে সাদিক সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,
— কই আমি তো কোনো চিঠি পাইনি! ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিস হয়তো।
নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে শাদাদের মনে হলো, ও এই মূহুর্তে পৃথিবীর বাইরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পরেছে। কারণ, এই পৃথিবীতে ওর মতো ভীতু প্রেমিক বোধহয় একটাও নেই। যেখানে পৃথিবীতে কত মানুষ তাদের ভালোবাসাকে সকলের কাছে অমর স্মরণীয় করে রেখেছে। সেখানে ওর মতো প্রেমিকের কি প্রয়োজন? লতা রে তোকে ভালোবেসে গেলাম। কিন্তু, বলার সাহস টুকু কেন নিজের মাঝে ধারণ করলাম না! সাহস করে চিঠিতে বাবাকে যাও মনের কথা বললাম। কিন্তু সেই চিঠি বাবার কাছে এসে পৌঁছায়নি। তোকে বুঝি হারিয়ে ফেললাম রে লতা!
ভাঙা কাঁচের প্লেটের মতো শাদাদ ভাইয়ের হৃদয়টা শ’খানেক টুকরো হলো। ভাঙা হৃদয়ের টুকরো গুলো নিয়ে আমতাআমতা করে নিজের বাবাকে বললো,
— বাবা আপনি একবার ডাকঘরে খবর নিয়ে দেখুন না আপনার নামে কোনো চিঠি পরে আছে কি-না?
— এই তুই কি পাগল হলি? বলছিস চিঠি পাঠিয়েছিস মাসখানেক আগে। আমি হাতে পাইনি। তার মানে কি দাঁড়ায় তোর চিঠি ডাকঘরে আসেনি। আসলে আমার হাতে অবশ্যই আসতো। এখন চিঠি চিঠি করে আমার মাথা নষ্ট করিস না। একটু পর এই বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে। মাথায় কত চিন্তা আর উনি কিনা চিঠি নিয়ে পরে আছে! এমন মাথা নিয়ে অফিসার বানালো কে তোকে?
বড়ো গলায় কথাগুলি বললেন সাদিক সাহেব। উনার গলা শুনে পাশের ঘর থেকে লতার বাবা-মা, রুপা, জাভেদ চলে এলো। সবাই এসে বোকার মতো একবার শাদাদের দিকে তাকায়। তো আরেকবার সাদিক সাহেবের দিলে তাকায়। কিন্তু,দুজনের কেউই জবাব দেয় না।
রুপা এগিয়ে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে জানতে চায় কি হয়েছে? হয়তো, বোনের স্নেহের অপেক্ষায় ছিল শাদাদ। রুপার গলা জড়িয়ে ধরে একসময় শাদাদ নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে। নিজের কাঁধে গরম পানির স্পর্শ পেয়ে রুপা অবাক হয়ে শাদাদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ধরে দেখলো শাদাদের চোখ ভেজা। ভাইয়ের মনের কষ্টটা বুঝতে পারে রুপা। ভাইটা শুধু বাবার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। বাবার ইচ্ছায় আর্মিতে যোগ দিলো। কখনো নিজের ইচ্ছা বাবাকে বলতে চায়নি। কিন্তু, জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়ে কি বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায়? ভালোবাসিস লতাকে বলে দে সবাইকে শাদাদ?
রুপা আপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। বলা হয় না ; কারণ বাবাকে তারা জমের মতো ভয় পায়।
—- মহিলাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস কেন?
শাদাদকে উদ্দেশ্য করে এমন প্রশ্ন করলে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকায় শাদাদের দিকে। শাদাদ সবার দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে চোখের জল অতি সন্তর্পনে মুছে ফেললো।
—- ও কাঁদুক। হাঁদারাম একটা। প্রেম করতে পারে। বাবাকে সেই কথা চিঠিতে লিখতে পারে। সামনাসামনি বলতে যত লজ্জা-শরমে মরেন তিনি!
সাদিক সাহেব হুংকার দিয়ে কথাগুলো বলে খাটের ওপর বসে রাগে ফোসফাস করতে লাগলেন। নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে শাদাদ অবাক হয়ে যায়। তারমানে, ওর বাবা চিঠিটা পেয়েছে! কিন্তু, চিঠি না পাওয়ার ভান করলো কেন?
ততক্ষণে, দরজা খুলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বৌ বেশে থাকা লতা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো, শাদাদ ওর বাবার পায়ের কাছে বসে আছে। হয়তো, পা ধরে বসে আছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা লতার মতো বোকাচোখে তাকিয়ে আছে বাপ-ছেলের দিকে।
লতাকে দেখে শাদাদ মুখ নামিয়ে ফেলে। শাদাদের মুখ নামিয়ে ফেলাটা সাদিক সাহেব দেখে ফেললেন। তিনি শাদাদকে টেনে এনে নিজের পাশে বসালেন। এরপর, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিছুদিন আগে আমার নামে একটা চিঠি আসে। চিঠিটা পেয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম , কে দিতে পারে এই চিঠি? মনের কৌতুহল মেটাতে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। হুবহু এমনটাই লিখা ছিল চিঠিতে।
প্রিয় বাবা,
মনে অনেক সাহস নিয়ে আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। কারণ, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাঁচি দিতে ভয় লাগে। পাছে না আপনি বলে ফেলেন, দিলি তো সব ভাইরাস আমার শরীরে ঢুকিয়ে।
কথাটি লিখতে গিয়েও আমি লজ্জা পাচ্ছি। তবুও, বলতে তো হবেই। অনেকবছর ধরে আমি একজনকে পছন্দ করি। সোজা কথা বলতে গেলে তাকে আমি আমার স্ত্রী রুপে পছন্দ করি। কারণ, আপনি তো প্রেম-ভালোবাসা বিরোধী। তাই ডিরেক্ট তাকে স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছি আমি।
যদিও সে আমার পছন্দ সম্পর্কে অবগত নয়।ইদানিং, তার পরিবার উঠে পরে লেগেছে তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। তার বিয়ের দেয়ার জন্য আপনিও উঠে পরে লেগেছেন। কারণ, আপনার একমাত্র ছোট ভাইয়ের মেয়ে বলে কথা। আপনি কি নিজ হাতে আপনার ছেলের জীবন নষ্ট করতে চান, বাবা?
ইদানীং, আমার মনে হচ্ছে আপনার দেখাশোনা করার জন্য একটা লোকের দরকার। যে কিনা সার্বক্ষণিক আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। আমি থাকি বাড়ির বাইরে। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আপনি একা থাকছেন। চাচি বা আপনাকে আর কত দেখবেন? আপনার একমাত্র পুত্রকে বিয়ে করিয়ে। আপনি আপনার পুত্রকে তার বাবার জন্য করা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিন।
ইতি
আপনার পুত্র।
—আমার ছেলে তার পছন্দের কথা চিঠিতে লিখতে পারে অথচ মুখে বলতে পারে না। এই যে রবিনকে ধরে এনেছি লতার সঙ্গে বিয়ে দেব বলে। তাও হতচ্ছাড়াটা আমার সামনে এসে একবারও বলার সাহস পায়নি যে, বাবা আমি লতাকে বিয়ে করব। কেন রে তোদের ট্রেনিংয়ের সময় তোদের সোজাসাপটা কথা বলার ট্রেনিং দেয়নি? সাহস দেয়নি?
সাদিক সাহেবের কথা শুনে শাদাদ মাথা নিচু করে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাকি সবাই অবাক হয়ে যায়।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শাদাদ ভাই নামক মানুষটার দিকে। মানুষটা আড়ালে কতকিছু করেছে। আর আমি কিনা তাকে ভুল বুঝে, তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি!
লতার বাবা মুখ গম্ভীর করে বললো,
— সবটাই তো শুনলাম। কিন্তু রবিন ছেলেটা অনেক আশা নিয়ে বরবেশে বসে আছে। তাকে কি করে?
লতার বাবার কথা শুনে সবার টনক নড়ে। সাদিক সাহেব রবিনকে ডাক দিলে ও এই ঘরে আসে। লতার সামনে দাঁড়িয়ে রবিন বললো,
— তুমি আমার অনেক পছন্দের মানুষ লতা। তাই তুমি মনে কষ্ট পাও এমন কোনো কাজ আমি করব না। শাদাদ সাহেবকে পেলে তুমি খুশি হবে এটা আমি জানি। তাই তো সাদিক আংকেলের সাথে আমি মিলে তোমাদের মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এবং আমরা সফলও হয়েছি। তাই না সাদিক আংকেল?
রবিনের কথা শুনে আমি, শাদাদ ভাইসহ বাকি সবাই অবাক। এদিকে জেঠু আর রবিন সাহেব সবার চাহনি দেখে শব্দ করে হাসছেন।
#চলবে…
#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
শেষপর্ব…
লতা এবং শাদাদ ভাইয়ের বিয়েটা বেশ ঘটা করে আনন্দ সহকারে সম্পন্ন হলো। কবুল বলতে গিয়ে বেচারা শাদাদ ভাই উনার বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছেন। শাদাদ ভাইয়ের একটাই কথা উনার এমন একজন বাবা আছেন বলে,ই যুদ্ধসম ভালোবাসা হুট করে কোনো যুদ্ধ ছাড়া জিতে নিয়েছে। নয়তো,লতাকে পাওয়া চারটে খানা কথা নয়।
লতা বিয়ের কবুল বলেছে কিছুটা সময় নিয়ে। আনুমানিক আধঘন্টা তো হবেই। এই আধঘন্টায় শাদাদ ভাই কমপক্ষে প্রতি মিনিটে জাভেদ ভাইকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, লতা কবুল বলেছে তো? শেষমেষ জাভেদ ভাই বড়োসড়ো একটা ধমক দিয়ে শাদাদ ভাইকে চুপ করে বসিয়ে রেখেছিলেন।
লতা যখনি কবুল বলেছে, অমনি সবার আলহামদুলিল্লাহ উচ্চধ্বনি শুনে আমাদের শাদাদ ভাই অতি আনন্দ নিয়ে রবিনের গলা জড়িয়ে ধরে, “ঈদ মোবারক” জানায়।
রবিন শাদাদ ভাইয়ের মুখ থেকে মোবারক বাদ শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— আপনি ঠিক আছেন তো? মানে আপনার বৌ বললো কবুল আর আপনি আমাকে “ঈদ মোবারক” বলছেন!
শাদাদ ভাই লজ্জিত মুখে রবিন সাহেবকে বললো,
— ত্রিশদিন রোজা রাখার পর মানুষ যেমন ঈদের চাঁদ দেখলে আনন্দিত হয়। ঠিক তেমনি আজ অনেক বছরের সাধনার পর যখন লতা আমার নামে কবুল বলে সেটাই তো আমার জন্য ঈদ আনন্দের চেয়েও সমান।
রবিন মুচকি হাসি দিয়ে শাদাদের হাত ধরে বললো,
— ভাই আপনার মতো করে এত যত্ন নিয়ে ভালোবাসতে পারলে হয়তো ভালোবাসায় সফল হওয়া সম্ভব। পৃথিবীর সকল মানুষ যদি নিজেদের ভালোবাসায় সফল হতো?
শেষের কথাটি কিছুটা দুঃখ মিশ্রিত কন্ঠে বললো রবিন সাহেব। শাদাদ ভাই রবিন সাহেবের কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিয়ে বললো,
— ওপর ওয়ালার পরিকল্পনা আমাদের পরিকল্পনার চেয়েও উত্তম। হয়তো, আজ আপনি আক্ষেপ করছেন। কিন্তু, কোনো একসময় আপনার জীবনে এমন কেউ আসবে যার ভালোবাসা পেয়ে আপনি রবের শুকরিয়া আদায় করতে ভুলবেন না।
বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ; সবাই একে অপরকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। রুপা তো ভাইয়ের হাসিমুখ দেখে আনন্দের অশ্রু ঝড়াচ্ছে। নিজের স্ত্রীর চোখের কোণায় পানি দেখে জাভেদ হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রুপার সামনে গিয়ে বললো,
— তোমার ভাই তার ভালোবাসাকে পেয়েছে। তবে আজ কাঁদছ কেন?
রুপা জাভেদের কথায় চোখের কোণায় জমে থাকা পানি মুছে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
—- এগুলো হলো সুখের কান্না। ভাইটা আমার ভেঙে যেতো যদি আজ লতাকে না পেতো। দুনিয়ায় এলে নাকি মায়ের মুখ দেখে সন্তান তার কান্না থামিয়ে দেয়। কিন্তু, আমার ভাইটা পৃথিবীতে আসার পর মায়ের স্নেহটুকু পায়নি। দিনরাত এক করে কাঁদত। চাচি তখন এই বাড়িতে নতুন বৌ হয়ে এসেছিল। আমার এই চাচি সেদিন থেকে সাতদিন বয়সী আমার ভাইটাকে মাতৃস্নেহে বড়ো করেছে। চাচির কাছে আমরা সবাই ঋণী।
জাভেদ রুপাকে একপাশে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বললো,
— সবই আল্লাহর ইচ্ছা। উনি চেয়েছেন বলে সবটা হয়েছে। আমাদের উনার প্রতি শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
————————————-
বাসরঘরে….
বাসরঘর নামেমাত্র। ফুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। আটদশটা ঘরের মতো সাধারণ এই বাসরঘর। তবে, লতা আর শাদাদ ভাইয়ের কাছে এই বাসরঘরের বিশেষ্যত খুব বেশি।
লতা আতংকিত হয়ে বসে আছে। লতার মনে হচ্ছে শাদাদ ভাই ঘরে এলে ওকে দুচারটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিবে। এতদিন তো কোনো অধিকার ছিল না তারপরও কত খায়েশ ফরমায়েশ পূরণ করতো। আর আজ তো তারই স্ত্রী হিসেবে এই ঘরে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে লতা।
কাঠের দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে লতা স্ট্যাচু হয়ে যায়। ওড়নার কোণা একটু সড়িয়ে দেখে নিলেন শাদাদ ভাই এলো কিনা? সত্যি শাদাদ ভাই এসেছেন! লতার হৃদপিণ্ড যেন লাফাতে লাফাতে বুকের পাজর ভেঙে বের হয়ে আসবে। লতা বুকে একহাত দিয়ে চাপ দিয়ে মনে মনে দোয়া পড়ছে।
শাদাদ ভাই ঘরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে দরজায় বন্ধ করলেন। গায়ের ভারী শেরওয়ানি খুলে ঝুলিয়ে রাখলেন। পরনে সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি।
শাদাদ ভাইয়ের বিয়ে হবার পর মনে হচ্ছে, ওর লতাকে দেখলেই লজ্জা লাগছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শাদাদ ভাইয়ের শ্বাস নিতেও লজ্জা লাগছে। এই ঘরেও আসতে চায়নি। কিন্তু, দুলাভাই বেশি জোর করলো কি-না! বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু, অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে এখন। লতাকে একবার বলে দেখবে? না থাক লতা কি থেকে আবার কি ভেবে বসে!
চেয়ার টেনে বসে বসে নানান ধরনের ভাবনায় ডুবে আছে শাদাদ ভাই। এদিকে লতা শাদাদ ভাইকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখে অবাক হয়।
লতা প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করার পর সহ্য করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে খাট থেকে নেমে যায়। লতাকে খাট থেকে নামতে দেখে শাদাদ ভাই ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসে চেয়ারে। এই বুঝি লতা এসে টেনে হিঁচড়ে খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলবে। কিন্তু, না লতা এমন কিছুই করলো না। উল্টো ঘরের লাইট অফ খাটের পাশের পর্দা টেনে দেয় যেন কাপড় বদলানোর সময় শাদাদ ভাই ওকে দেখতে না পায়। এখন তো অন্য ঘরে গিয়ে শাড়ি বদলাতে পারবে না। সবাই কি ভাবতে কি ভেবে বসে? পরনের ভারি শাড়িটা কোনোমতে খুললো। বিছানা হাতড়ে নীল রঙের সুতি শাড়িটা নিয়ে আঁধারে পরে নিলো খুব যত্ন সহকারে।
তারপর, লাইটের সুইচ অন করে পর্দা সরিয়ে খাটের ওপর থেকে শাড়িটা নিয়ে অগোছালো অবস্থায় আলমারীতে রেখে দিলো। তারপর, খাটের এককোণায় বালিশ টেনে শুয়ে পরে।
এতটা সময় ধরে শক্ত হয়ে বসে ছিল শাদাদ ভাই। লতার শাড়ি খোলার সময় ওর হাতের কাঁচের চুড়ি রিনঝিন শব্দ শাদাদ ভাইয়ের কানে এসে লাগে। তখন শাদাদ শুধু এই শব্দগুলোকে উপভোগ করে। বহুকাল ধরে মনের মাঝে বুনে রাখা স্বপ্নেরা আজ পূরণ হলো।
এই যে লতা ওর ওপর রাগ করে পরনের শাড়ি বদলে ফেলেছে এটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে শাদাদ ভাই।
শাদাদ ভাই অন্ধকার ঘরটায় ধীরে ধীরে হেঁটে খাটের কিনারায় চলে যায়। যেখানটায় লতা শুয়ে আছে।
শাদাদ ভাইয়ের গাঢ় নিঃশ্বাস যখন লতার মুখের ওপর পরে তখন লতা চোখ খুলে তাকায়। নিকেশ আঁধার ঘরটায় মানুষটার শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছে লতা।
এমন সময় লতার কপালে দীর্ঘ চুমুতে ভরিয়ে দেয় শাদাদ। লতা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আজকের স্পর্শ শুধুই পবিত্র। আজকের পর থেকে মনের মাঝ থেকে কেউ বলে উঠবে না, লতা যা কিছু হচ্ছে সব ভুল।
— মধু????
শাদাদ ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে হয় না আমার। মনে হয় সে শুধু আমায় ডাকুক। আমি তার ডাক শুনে মন ভরি।
— জানিস আজ না আমি ভীষন লজ্জা পাচ্ছি। তাও তোর কাছে।বলতে পারিস কেন এমনটা হচ্ছে?
শাদাদ ভাইয়ের কথা শুনে লতা স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলো। যেই মানুষটা বিয়ের আগে নানান ছুতোয় লতাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। সেই মানুষটার কি না আজ লজ্জা লাগছে। লতার মনে মনে হাসছে।
এদিকে শাদাদ ভাই তার কথাগুলো অনর্গল বলেই যাচ্ছেন।
—-আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। কত কথা জমে আছে আমার বুকে শুনবি না আজ?
শাদাদ ভাইয়ের কথায় লতা মাথা নাড়ায় কিন্তু অন্ধকার কি শাদাদ ভাই তা দেখতে পেয়েছে?
লতার পাশে একটু খানি জায়গা ছিল। সেই একটুখানি জায়গায় শাদাদ শুয়ে পরে। একবারে লতার শরীর ঘেষে। লতা শিউরে ওঠে শাদাদ ভাইয়ের স্পর্শে পেয়ে, তাকে এত ঘনিষ্ঠে পেয়ে।
— মনের মাঝে অনেক কথা ছিল বুঝলি। সবটা উবে গেছে তোকে কাছে পেয়ে। কি বলব সবটা ভুলে গেছি!
— কিছুই বলার দরকার নেই। কত কথা জমা হবে আমাদের, কত কথা বলে শেষ করব তার ইয়ত্তা নেই। শুধু সময়ের পালাবদলের অপেক্ষা।
এই প্রথম বিয়ের পর লতা শাদাদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললো। শাদাদ ভাই চট করে লতার বুকে মাথা রাখলেন। লতা কিছু বললো না শুধুই চুপ করে রইলো।
এই রাতটা যেন কথা না বলার জন্য এসেছে। এই যে মুখে কত কথা। কিন্তু, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।। দুটো মানুষ তাদের প্রিয় মানুষটাকে পেয়েছে নিজের করে। কত ভালোবাসা আছে আদান-প্রদান করার জন্য। কিন্তু, সাহস নেই। যা আছে শুধু এই সময়টাকে উপভোগ করার অগণিত ধৈর্য।
এমনসময় টিনের চালে বৃষ্টির ছিটেফোঁটার শব্দে ভরে ওঠে। নভেম্বরে মুষলধারে বৃষ্টি মানে অবিশ্বাস্য। তবুও, বৃষ্টির ফোঁটারা আজ বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে।
টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটার আড়ালে। দুটো মানুষ একে অন্যতে বিলীন হয়। বহুকাল ধরে মনের মাঝে লালন করে আশা স্বপ্ন আজ সত্যিতে রুপান্তরিত হয়। ভালোবাসাময় রাত, বৃষ্টিস্নাত রাতে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদটা বুঝি আজ খুশিতে নিজেকে মেঘের আড়ালে করে নিয়েছে। যাতে দুটো মানুষের লজ্জার দেয়াল ভেঙে একে অপরকে নিজেদের মাঝে মিশিয়ে ফেলতে পারার অদম্য ইচ্ছে জাগে ।
বহুবছর পরের কথা….।
লতা তখন ব্যাংকে জয়েন করেছে। শাদাদ ভাই শান্তি মিশনে গিয়েছেন। প্রতিরাতে লতার বুকে ব্যাথা করে মানুষটা কেমন আছে ভেবে? কত মানুষ তো এই মিশনে গিয়ে শহীদ হয়েছে। শাদাদ ভাইকে হারিয়ে ফেললে লতা বুঝি মরেই যাবে। মানুষটাকে ভালোবাসার পর থেকে মনে হচ্ছে লতার তাকে হারানোর ব্যাথায় হার্টের সমস্যা বেড়েই চলেছে। হুটহাট বুকে ব্যাথা ওঠে যাচ্ছে।
রোজ নিয়ম করে তার নামে চিঠি লিখে লতা। কিন্তু, ডাকবাক্সে জমা করা হয় না। শাদাদ ভাই যেদিন দেশে আসবে। সেদিন সবগুলো চিঠি উনার হাতে দিবেন। শাদাদ ভাই চিঠিগুলো যত্ন নিয়ে পরবে।
মার্চের তেইশ তারিখে নাকি শাদাদ ভাই আসবেন দেশে। দেশে এলে লতার আটমাসের উঁচু পেটটা দেখলে শাদাদ ভাইয়ের কেমন রিয়াকশন হবে ভেবে লতার চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। পরিবারের লোকদের হাতে-পায়ে ধরে এমন একটা খুশির খবর শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে গোপন রেখেছে লতা। এখন শুধু তার দেশে আশার অপেক্ষায় আছে লতা। দেশে যেদিন আসবে লতা পাক্কা আধঘন্টা তাকে জড়িয়ে রাখবে নিজের বুকের মাঝে। আটমাসের প্রতিদিনকার জড়িয়ে ধরা আধঘন্টায় উসুল করবে, হুহ্।
লতা কিংবা শাদাদ ভাই। মানুষ দুটো একে অপরকে কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবেসেছে। জীবনের একটা সময়ে এসে “ভালোবাসি” কথাটি বলার প্রয়োজন পরে। কারণ, তাকে জীবনে পারমানেন্ট সঙ্গী হিসেবে পেতে হবে তাই। ভালোবাসার ব্যাপারটাকে যদি সাহস করে বুকের মাঝে ধারণ করা যায়। তবে, একটুখানি সাহস করে পরিবারের লোকের কাছে বললে কি হয়? হয়তো তাকে পাব কিংবা পাব না। তবুও, সাহস করে জানানো প্রয়োজন। “তাকে ভালোবাসি” বলার সাহস নেই বলে কত মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। সারাজীবন বুকের মাঝে চেনা কষ্ট ব্যাথা কিন্তু সেই ব্যাথাকে আমরা চিনেও না চেনার ভান করি। নিজের সঙ্গে আমাদের প্রতারণা চলে প্রতিনিয়ত।
…..সমাপ্ত…..