#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৫.
তুশিরাকে নিয়ে আমি আমার বাসায় প্রবেশ করলাম। তাকে দেখে আমার মা জননী গদগদ। আমার মা আমার বান্ধবী পছন্দ করার শুরুতে খোলা সিসিটিভির ভূমিকা পালন করে। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ শেষে গ্রীণ কার্ড স্বরূপ শান্ত চাহনি প্রদান অর্থ আমি বন্ধু বানাতে পারবো। আর লাল কার্ড স্বরূপ হাই ভলিউমে গালে আদর, সঙ্গে চেরি রঙ ধারণ; তার অর্থ ওই সঙ্গ থেকে আমাকে পাঁচশো হাত দূরে থাকতে হবে। ভুলেও যদি পাশাপাশি রাস্তা পার হই, তবুও আমার পিঠে ছালা বেঁধে প্রস্তুত থাকতে হবে।
এরমধ্যে তুশিরা কিভাবে কিভাবে যেন আম্মুর প্রিয় হয়ে ওঠে। যদি জানতো উনার আলাভোলা তুশিরা পিড়িতের আঠা গায়ে লেপন করে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে টেবিলের তলায় বসে সুখী সংসার জীবনের আলোচনা করে, তবে তার মা-বাবা লাগবে না। আমার মা-ই তাকে চ্যাঙদোলা করে বিয়ের আসনে বসিয়ে দিতো।
যাইহোক, তুশিরা আর আম্মু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প-গুছব করছে। আমি উঁকিঝুঁকি মেরে ঘরের অতিরিক্ত সদস্যদের খোঁজে চলছি।
এসব অতিরিক্ত সদস্যদের কারো বাসায় আগমনের পূর্বে উচিত অতিরিক্ত সচিব দপ্তরে টোকা মেরে রেখে আসা। তাদের আচার-আচরণ, খাবার প্রণালী, মনের কুচকুচে কালো গুহায় রাখা উদ্দেশ্যে উঁকি মেরে অতিরিক্ত সচিব দেখবে। যিনি মেজবান বা মাহরাম, তার পক্ষ হতে সম্মতি পেলেই অতিরিক্ত সচিব আতিথেয়তা গ্রহণের পেপারে সাক্ষর প্রদান করবেন। আর এইক্ষেত্রে ঘরের কনিষ্ঠ সদস্যের মতামত বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। এমন পদ্ধতি থাকলে আমি এই ফাক-আদ ছাগলের ক্যাচাল থেকে বেঁচে যেতাম।
আমি রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম। তুশিরা ছোট্ট টুলে বসে ফালুদা খাচ্ছে। আমি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। এটা আমার তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে কেনা ফালুদা। চল্লিশ টাকার ভাড়া বিশ টাকায় মিটিয়ে কষ্টে পিষ্ট হয়ে ছয়দিন বাদে কিনলাম। আর আমার মাতা তা নিজের হাতে বানানো রান্না ভাব ধরে তুশিরাকে খাওয়াচ্ছে। আমার এমন সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানমগ্ন অবস্থায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু ডাকলো,
“কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গোসল সেরে আয়। তুই এলে তোদের দুজনকে একসঙ্গে ভাত বেড়ে দেব।”
আমি কোমরে হাত রেখে আম্মুর দিকে তাকালাম। চোখে চোখে উনার ন্যায়বিচারের কথা জানিয়ে দিলাম। আম্মু আমাকে উল্টো ধমক মেরে বললো,
“যা গোসল করে আয়। শরীর থেকে ঘামের গন্ধ আসছে।”
আমার ফুলের মতো নরম মন থেকে সর্বদা পুষ্পের ন্যায় গন্ধ নির্গত হয়। দুই দিনের এই দেহ থেকে গন্ধ বের হলেই কি, আশ্চর্য!
তয়লা, বালতি নিয়ে গোসল করতে যাচ্ছি। তুশিরা তখন কানে কানে এসে জিগ্যেস করলো,
“চাঁদনী কোথায়? কথা হয়েছে?”
আমার ফালুদা গপ গপ করে খাওয়া কালপেত্নীকে ভেঙচি কেটে বললাম,
“হয়েছে কথা। সময় মতো চলে আসবে।”
“ও ঠিকানা চিনে তো?”
“তোর থেকে ভালো চিনে।”
গোসল করে এসেও কাউকে নজরে পড়লো না। না চাঁদনী, না আমার বাপের ঠিক করা শ্বশুরবাড়ি সদস্য নামক মুরগি ব্যাপারীগণ। তাই আমি লাফিয়ে লাফিয়ে আম্মুর চরণে গিয়ে পড়লাম। আমি বিছানায় শুয়ে আছে।
“মহীয়সী মাতা।”
আম্মু কোনো সাড়া দিলো না।
“আন্টি তারা কোথায়?”
এইবার উত্তরে বললো,
“জানি না।”
আমি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আম্মু এক চোখ খুলে আমাকে দেখে নিলো। এরপর দুই চোখ খুলে বললো,
“তোর আব্বু বাহিরে গেছে। তোর চাচ্চু আর আন্টিও সঙ্গে গিয়েছে।”
আশ্চর্য মা জননী। অর্ধেক কথা জিহ্বা দিয়ে ঠেলা দিয়ে বের করে, অর্ধেক কথা আল জিহ্বা দিয়ে চাটান মেরে গলাধঃকরণ করে। আমার বাপের ঠিক করা ভাতার থুক্কু থুক্কু, তওবা তওবা, আসতাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, হবু বর কোথায়?
আমি কেশে গলা ঝেরে আম্মুকে জিগ্যেস করলাম,
“ফাহাদ ভাই-ও গেছে?”
আম্মু আবার বন্ধ করা চোখ চট করে খুলে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে জিগ্যেস করলো,
“ওকে দিয়ে কি কাজ?”
“কি কাজ হবে? ঘরের মানুষজন কোথায় তা জানতে চাইছি। নাকি এই ফাহাইদ্দা মানুষ না? গরু-ছাগল। তাই শুধু ঘাস মুখে তোলে দেওয়ার সময় খবর নেবো? অবশ্য এমন বাদাইম্মা গরু-ছাগল থেকে কম কি।”
আম্মু চোখ পাকিয়ে উঠে বসলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে বললো,
“ফাহাদ বাহিরে গেছে। ছেলে মানুষ সারাদিন ঘরে বসে থাকবে নাকি?”
“ওহ, অবশ্য আমি তো বলিনি গরু মেয়ে লিঙ্গ। অর্থাৎ গাভী। ফাহাদ গরু, থুক্কু ছেলে আমি তা জানি।”
আম্মু কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
আমিও চুপচাপ আমার রুমে চলে এলাম।
সন্ধ্যার পরপর চাঁদনী হোস্টেল থেকে আমার বাসায় এসে পৌঁছেছে। তার রূপ দেখে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হলাম। সাপের মতো পেঁচিয়ে, নেতিয়ে, মুড়িয়ে চলা নারী আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত হয়ে এলো। দরজা খুলতেই লাজুক হেসে আমাকে বড় করে একটা সালাম দিলো। আমি জিলাপি খেতে খেতে দরজা খুলে ছিলাম। তার লাজুকমাখা চাহনি ঠাহর করে জিলাপি আমার মেঝেতে ঝাঁপ মেরে নিজের আহুতি দিলো।
“কি হলো, ভেতরে প্রবেশ করতে দেবে না ফাবলীহা?”
আব্বু আর মোজাম্মেল চাচ্চু তখন সোফায় বসে লুডু খেলছিলো। আর ফাহাদ তাদের পাশেই বই হাতে বসে আছে। তাদের খেলার উত্তেজনা, আনন্দের হিল্লোল দেখে সে মিটিমিটি হাসছে। ছাগল চোরা!
আব্বু আমাকে জিগ্যেস করলো,
“কে এসেছে ফাবলীহা?”
আমি কিছু বলার আগে চাঁদনী দরজা আরও বিস্তৃত করে ভেতরে প্রবেশ করলো।
বড় করে সালাম দিয়ে বললো,
“ভালো আছেন আঙ্কেল? আমি ফাবলীহার বান্ধবী চাঁদনী।”
“ভালো আছি। তুমি ভালো আছো মা? ফাবলীহা তোমার কথা বলেছিল, তুমি নাকি ওর সঙ্গে কিছুদিন থাকবে।”
“জি আঙ্কেল। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো? মানে…”
আব্বু ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
“না না মা কিসের সমস্যা। তুমি যতোদিন খুশি ততোদিন থাকো।”
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই ফাবলীহা যাও মা, ওকে একটু ঠান্ডা খেতে দাও। ফ্যানের নিচে নিয়ে বসতে দাও। কতদূর থেকে এসেছে।”
চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার আন্টি আসলে একটু অসুস্থ। হঠাৎ করেই আছরের পর গায়ে জ্বর এলো।”
চাঁদনী আঁতকে উঠা গলায় বললো,
“এ কি! আন্টির জ্বর! এখন ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, জ্বর তো কিছুক্ষণ বাদেই নেমে গেছে। এখন মাথা ব্যথা নাকি খুব। নাপা খেয়ে শুয়ে আছে।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাদের কথোপকথন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোমর হাত দিয়ে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চশমা দেখছে আব্বুকে কিন্তু চোখ দেখছে আরেকজনকে।
ফাহাদের দিকে সে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। ফাহাদ তা ভালো করেই ঠের পেয়েছে। সে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে একবার চাঁদনীকে দেখছে, একবার আমকে দেখছে। আরেকবার তার বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।
আমি চাঁদনীর পাশে সরে গিয়ে ওর বাহুতে একটা চিমটি কাটলাম।
সে চিৎকার করে ওঠলো,
“আহ, ফাবলীহা চিমটি কাটছিস কেন?”
আমি পুরো হতভম্ব। এমন গর্দভ আদৌ কেউ হয়! ইচ্ছে করছে চাঁদনীকে ফুটবলের মতো মুক্তবেগে কিক মেরে চাঁদের দেশে পাঠিয়ে দেই। মুক্তবেগে দিলে তো আবার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যেতে পারবে না। পৃথিবীর বুকে বসবাসরত হাজারো সুদর্শন যুবকের মোহ-মায়ায় আবদ্ধ হয়ে স্যাটেলাইটের মতো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে আর গ্রীক রাজা জিউসের মতো লুলুপ দৃষ্টিতে আমার ভাই জাতিকে দেখে বজ্রপাতের সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
“এই ফাবলীহা, কি হয়েছে তোমার?”
আব্বুর অমর্ষিত গলা শুনে আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে চাঁদনীকে আমার রুমে টেনে আনলাম।
তার নিতম্বে কড়া করে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম,
“এখন যদি এতটুকুও চিৎকার করেছিস তো আমি তোর জিহ্বা টেনে রাবারের মতো লম্বা করবো।”
চাঁদনী বড় করে খোলা মুখের চিৎকার গপ করে গলাধঃকরণ করে মুখ বন্ধ করলো।
এরপর আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
“দোস্ত তোর ভাইটা তো সেই। গায়ের কালার আমার দাঁতের কালারের সাথে একদম খাপে খাপ মিলে। এখন তো বাচ্চা-কাচ্চা সব ইয়েলো-ইয়েলো নাহলে ব্রাউন-ব্রাউন।”
বলেই সে দুহাতে মুখ ডাকলো।
আমি তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। বললাম,
“যাক শেয়ালের তবে মুরগি পছন্দ হয়েছে। এবার বগলের চিপায় ঢুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পালা।”
চাঁদনী বাঁকা চোখে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে লাজুক হাসলো।
“ওহ ব্যাগটা তো দরজার ওখানে রাইখা আসছি। এমনে টান মারলি মাগো মা। খাড়া নিয়া আসি। আর ওই লোকটা কেডারে?”
আমার জবাবের অপেক্ষা না করে চাঁদনী তার ব্যাগ আনতে আমার রুম থেকে বের হলো। তখন আব্বুর গলা ভেসে এলো,
“তোমার নাম যেনো কি আম্মু?”
“চাঁদনী, আঙ্কেল।”
“তোমার জন্য কি আনাবো বলো। বার্গার পছন্দ করো নাকি পিজ্জা বা অন্য কিছু?”
“কষ্ট করে এখন আবার কিছু আনতে হবে না আঙ্কেল।”
“আহা কিসের কষ্ট। বলো, বার্গারই আনাই? সবার জন্য আনাচ্ছি।”
চাঁদনীর কথা শোনা গেলো না। মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ আছে কি-না কে জানে। আমি আমার রুম থেকে বের হতে হতে ফাহাদের গলা শুনলাম,
“আমি তাহলে যাচ্ছি আঙ্কেল।”
“হ্যাঁ, যাও।”
দেখলাম ফাহাদ দরজা বেজিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার মানে আব্বু ওকে সন্ধ্যার নাস্তা আনতে বাহিরে পাঠিয়েছে। যাইহোক.. না! যা-ই তো হওয়া যাবে না। আমি চাঁদনীর মুখের দিকে তাকালাম। সে-ও চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা মেকি হাসি দিয়ে পিছপা হই। সে কাঁধে ব্যাগ তুলে এগিয়ে আসে।
দুজন রুমে আসতে চাঁদনী তার দুই বাহুর মাঝখানে আমাকে চেপে ধরে।
“কিরে শালি, তোর ভাই তোর বাপেরে চাচা ডাকে কেরে? মেন্টাল ভাই? এইজন্যই আমারে বাগিয়ে গলায় ঝুলায় দিতে চাস? ঠিক আছে। এখনও পাবনার বাসিন্দা নাকি না? না হলে সমস্যা নাই। এই চাঁদনী তোর ভাইরে হান্ড্রেড পার্সেন্ট পাগল কইরা পাবনায় পাঠামু।”
আমি বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে ককরতে বললাম,
“আরে ছাড় তো। কথা শোন আমার।”
চাঁদনী আমাকে ছেড়ে দিলো। এরপর আমি পানি খেয়ে অপরাধী নয়নে তাকালাম। তার কাছে গিয়ে কাচুমুচু করে বসে গেয়ে ওঠলাম,
“চাঁদনী ও চাঁদনী আমি অপরাধীরে। আমার বাপের ঠিক করা হবুরে নে ফিরাইয়া নে। তার অনুভূতির সাথে খেলা করে তাকে লুলা বানায় দে। একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দেইখা আমারে নিকাহ করায় দে।”
(চলবে)