যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ১

0
2033

অন্ধকার কেবিনে লোকটা আমার কোমড় জড়িয়ে ধরতেই তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাম আমি। এবার খানিকটা রেগে গেল সে। আমার কাছে এসে গাল চেপে বলে উঠল,
— “সমস্যা কি তোমার? আমাকে ধাক্কা দিচ্ছো? রায়হান আহমেদ রেয়ান কে? সাহস তো কম না!”

আমি ভীতু দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। উনি বিরক্তি নিয়ে জবাবের আশায় তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। জবাব না পেয়ে আবারও বললেন,
—” তুমি কি কালা, বয়রা? শুনতে পাও নি? কিছু বলেছি!”

আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
—” একটু দূরে সরে দাঁড়ান! ”
—” হাঁ? ”

উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। অনেকটা দূরে সরে দাঁড়াতেই মনের মধ্যে সাহস জেগে উঠল আমার। ঢোক গিলে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
—” আপনি কি সাধু? একটা মেয়েকে অন্ধকারের মাঝে জড়িয়ে ধরেছেন আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন ধাক্কা দিয়েছি? পাগল নাকি?”

রেয়ান খানিকটা তেড়ে এলেন আমার দিকে। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তেজি গলায় বললেন,
—” ওয়াট? আমি পাগল? লিসেন বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে তুমি ভয় পেয়ে এসেছিলে আমার কাছে। আমি না।”

আমি তোতলিয়ে বললাম,
—” ত-তো তাই বলে আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরবেন নাকি?”
—” দেখো মিস! তোমার ওপর আমার কোনো ইন্টেন্সন নেই। আমি তো জাস্ট তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম কারণ তুমি ভয় পাচ্ছিলে। নাহলে তোমার মতো এভ্রেজ সরি! সরি! পিলো এভ্রেজ মেয়েদের আমি পাত্তাও দেই না। আন্ডাস্টেন?”

কথাটা বলেই নিজের সীটের বার্থে বসে পড়লো ছেলেটা। আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। একটু আগে ঝড়ো বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকালেও এখন আকাশটা পুরো পরিষ্কার। বর্ষণের গতি কমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই আকাশের কালো মেঘের একটু ফাঁক থেকে একরাশ চাঁদের আলো তীর্যকভাবে এসে ছড়িয়ে পরছে সর্বত্র। কেবিনের লাইট বন্ধ থাকলেও সেই চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ছেলেটার মুখ। কেমন বিরক্তি নিয়ে জানালার পাশে বসে বাহিরের আধারে ঘেরা পথে চেয়ে আছে। তার চেয়ে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে আমি তাকিয়ে আছি ছেলেটির দিকে। পরক্ষণেই দাঁত কটমট করে অন্য পাশের বার্থে জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ি।

আল্লাহ জানেন কার মুখ দেখে ট্রেনে উঠেছিলাম। একে তো এতো বৃষ্টি ছিল, তারওপর স্টেসনে মানুষজন নেই বললেই চলে। প্রথমে একজন আন্টি পড়েছিলেন আমার কেবিনে। তার স্টেসন এসে পড়ায় তিনি অনেক আগেই নেমে গেছেন ট্রেন থেকে। এরপরের স্টেসনেই এই মহাসয় এসে জুটলেন আমার কপালে। আসলে ওই আন্টিটাই আমার জন্য বেড লাক! নাহলে এই ছেলে আমার কপালে পড়ে? তাও আবার কেবিনে শুধু আমার দু’জনই।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খেয়ালই ছিল না ছেলেটার দিকে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বিষয়টা বুঝতে পারলেন উনি। সীটে বসা অবস্থায় আমার দিকে ঝুঁকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—” আমাকে কি বেশি সুন্দর লাগছে মিস? হাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন, স্টুপিড!”

আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে ফেললাম। বাহিরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—” আমার বয়েই গেছে আপনার মতো একটা ছেলেকে দেখতে।”

উনি বাঁকা হেসে বললেন,
—” তাই তো এভাবে হাবলার মতো তাকিয়ে ছিলে। ওয়েট! তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে গেছো নাকি মেয়ে?”

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম ছেলেটির দিকে। সে হু,হা করে হেসে উঠল। সীটে হেলান দিয়ে বসে হাসতে হাসতে বলল,
—” এভাবে তাকাবে না মেয়ে। গভীর প্রেমে পড়ে যাবে।”

আমি দাঁত কটমট করে বললাম,
—” জাস্ট শাট ইউর মাউথ। আপনাকে আমার বিরক্ত লাগছে।”

এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন উনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—” একা একটা মেয়ে, একা একটা ছেলের সাথে, একা একটা কেবিনে বসে আছো, ভয় লাগছে না?”
—” জ্বী?”

হকচকিয়ে গিয়ে বললাম আমি। পরক্ষণে মনে হলো ঠিকই তো। আমি একা একটা মেয়ে উনার সাথে এক কেবিনে তাও কেবিনের লাইট অফ! এতক্ষণ ভয় না লাগলেও এখন ঠিকই ভয় লাগতে শুরু করল আমার। অনেকটা গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম আমি। দৃষ্টি বাহিরের ঝিরিঝির বৃষ্টির দিকে। আমাকে অনুসরণ করে উনিও তাকালেন বাহিরের। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলে উঠলেন,
—” ভাগ্যিস এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না। ইউ নো, নাহলে তো অনেক মেয়ে আছে ভয়ের নাটক করে সেধে সেধে জড়িয়ে ধরে অচেনা একটা ছেলেকে। পরে ব্লেম কিন্তু ওই অচেনা ছেলেকেই দেয়।”

বুঝতে পারলাম কথাটা সে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। তাই কিছু বলতে যাবো তার আগেই ছেলেটার ফোন বেজে উঠল। উনি আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে সীটে হেলান দিয়ে বসে ফোন রিসিভ করেই বলে উঠলেন,
—” হ্যাঁ, কি হয়েছে? ”

ওপাশ থেকে কিছু বলতেই উনি আবারও বলে উঠলেন,
—” না ঠিক আছি। বাট আশেপাশের অবস্থা খারাপ। বিরক্তিকর একটা অবস্থা!”

এ পর্যায়ে উনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। বুঝতে পারছি না কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন? নাকি অন্য কিছু? এদিকে উনি গম্ভীর কণ্ঠে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে আবারও বললেন,
—” সবুজ! বেশি বেশি হচ্ছে এটা। আমি কখন কি করব এটা তোকে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কাজ একটু আগে শেষ হয়েছে বিধায় আমি এত রাতে এত বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। এরপর আবার রাঙামাটি চাচ্চুর বাসা থেকে তোর বাসা। তোর কি ভালো লাগছে না এত কিছু? নাকি তোর নামের মতো তোকেও এখন সবুজ রঙের আকার-আকৃতি বানিয়ে দিলে খুশি হবি?”

উনার কথায় এবার খানিকটা ভাবতে লাগলাম। কেননা আমিও রাঙামাটি যাচ্ছি। এর মাঝে ছেলেটা কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। মাথার নিচে দু’হাত রেখে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল সীটে। এবার খানিকটা অস্বস্থি হতে লাগলো আমার। অন্ধকার কেবিনে আমার সামনেই একটা ছেলে শুয়ে আছে। ব্যাপারটা কেমন না? তাই খানিক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
—” শুনছেন? ভাইয়া? কেবিনের লাইটটা কি জ্বালাতে পারি প্লিজ?”

উনি একটু সময় নিয়ে বললেন,
— ” কেন? ”
— ” আমার অন্ধকার প্রচন্ড ভয় লাগে। তাই..!”
—” কেবিনে যথেষ্ট চাঁদের আলো আছে। ভয় পাওয়ার তো কথা না।”

আমি অস্বস্থি নিয়ে বলে উঠলাম,
—” আসলে ভাইয়া আমার অস্বস্থি লাগছে। প্লিজ! লাইটটা জ্বালাই?
—” আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে এতে৷ সো পার্মিশন দিতে পারছি না।”

অতি বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললেন উনি। রাগে, দুঃখে নিজেরই চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে আমার। কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম আমি। নিজের জায়গায় বসতেই খেয়াল করলাম সামনে শুয়ে থাকা ছেলেটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বোধহয় আমি লাইট জ্বালানোতে রেগে গেছে। পরপরই কিছু না বলে সে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এটা কি হলো? লোকটা চলে গেলো কেন? পরক্ষণেই ভাবলাম, চলে গেছে ভালোই হয়েছে। তবে নিজের কাঁধের ব্যাগ নিয়ে যায় নি কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হয়তো ছেলেটা কিছুক্ষণ পর আবারও এসে পড়ে কেবিনে। কেবিনের লাইট বন্ধ করে আগের মতো সীটে শুয়ে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
—” আমি অতি অভদ্র ছেলে মিস। তবে মেয়েদের প্রতি যথেষ্ট ভদ্র। কিন্তু রেগে গেলে সেই ভদ্রতাটাও থাকে না। তাই নিজের প্রতি একটু সর্তক থাকবেন মিস! আশা করি কি বলতে চাচ্ছি বুঝতে পেরেছেন।”
মনে মনে ভাবছিলাম আবারও কেবিনের লাইটটা জ্বালাবো আমি। কিন্তু এমন থ্রেট শুনে ইচ্ছেটা মরে গেল আমার৷ তুমি থেকে একেবারে আপনিতে চলে যাওয়াটা হজম না হলেও ভীতি জিনিসটা কাজ করছে আমার মধ্যে। গুটিসুটি মেরে জালানার কাছ ঘেঁষে বসে রইলাম। একটু পর পর ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছি। সে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে আছে। হয়তো ঘুমাচ্ছে! আমার ঘুম হারাম করে নিজে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আহা! কি শান্তি! যত্তসব।

________________

চলবে…
#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here