হৃদয়ের সুখ আপনি – পর্ব 15

0
424

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-১৫
#Nishi_khatun
সেই যে বনবাসী হওয়ার সময় গ্রামটা দেখেছিলাম।
সেই আগের রুপে গ্রামটা আমার আর নেই। আমিও সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়েছি। আমার সাথে সাথে আশেপাশের সব কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
আমি বাড়িতে আসার পথে দেখি রুপসী খাল। এই খালের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক মনোমুগ্ধকর। আশেপাশের সব গ্রামের মানুষেরা এখানে ঈদের সময় ঘুরতে আসে। আমাদের আশেপাশে গ্রামের মানুষের বিনোদনের একটা স্থান।
তবে আমি আজকে দেখছি এখানে শহুরে ওভার স্মার্ট, বেয়াদব টাইপের ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। বাবাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার উত্তর এমন ছিল,” আম্মু যে কোন স্থানের প্রকৃতিক সৌন্দর্যের উপর সে স্থান ব্যতীত অন্য স্থানের মানুষদের উপভোগ করার অধিকার আছে। প্রকৃতি আমাদের সবার জন্য। তার সৌন্দর্য কোন একটা স্থানের মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ না।”
তখন বুঝেছিলাম আমার বাবাকে কিছু জিজ্ঞাস করে লাভ হবে না। সে আগে থেকে এমন স্বভাবের মানুষ। তবে আমার এসব মোটেই পছন্দ না। বাঙালি যেখান নিরিবিলি পরিবেশ দেখে, সেখানে দলবল বেধে চলে যাই। তাদের নিজেদের তো প্রাইভেসি নাই আবার অন্যদের প্রাইভেসির খবর রাখে না। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখলেই হলো। স্থান টা কে একদম জঙ্গলে পরিণত করে ছাড়ে।
বাড়িতে আসার পরপর আম্মুর কড়া আদেশ দরকার ছাড়া রুমের বাহিরে একপা রাখবে না। আমি জানি আম্মু আমার উপরে কেনো এমন ধারা জারি করেছে। কারণ আমি রুমের বাহিরে গেলে বাড়ির বাহিরে যাব তখন গ্রামের লোকেরা আমাকে দেখে অপমান জনক কিছু বাক্য প্রয়োগ করবে। তাদের সে সমস্ত কটু কথা শুনে আমার মনটা বিষাদগ্রস্ত হবে। আমিও চাইছি না তাদের এই সমস্ত বাজে কথা কানের ভেতর প্রবেশ করাতে। তা-ই নিজেই নিজেকে সংযত রাখলাম কিছুদিন।
ভাইয়ার বিয়েতে সে ভাবে খুব আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় নি। তবে গ্রামে বাস করে যে টুকু না করলে চলে না সেই পরিমাণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় ছোটখাটো ভাবে হলুদের আয়োজন। পরেরদিন বিয়ে বরযাত্রী যাওয়া। বিয়েরপর দিন বউভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই তিন দিন আমি নিজেকে নিজেই বাবার বাড়ির মেহমান মনে করেছি।
আমার গ্রামে থাকার মেয়াদ বউভাতের দিন পর্যস্ত ছিলো। পরেরদিন সকালে বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামা-মামী আর বাবার সাথে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরি।
হঠাৎ রুপসী খালের রাস্তার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি শত শত মানুষের ভিড়। এতো মানুষের ভিড় দেখে খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সেখানে পুলিশের গাড়ি, এম্বুলেন্স এসব দেখে কিছুটা অনুমান করেছিলাম, হয়তো এখানে কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আমাদের গাড়িটা সেখানে কিছু সময়ের জন্য থেমেছিল।
বাবাকে কিছু জিজ্ঞাস করলে কোন উত্তর দিতে পারে না।
সেখানে অনেক স্কুলের মেয়েরা উপস্থিত ছিলো।
সাথে আশেপাশের গ্রামের লোকেরা। এই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভিকটিমের বাড়ির লোকদের আর্তনাদ বাতাসে বাতাসে ভেসে কানে এসে বাঁজছিল। কি এক ভয়াবহ পরিবেশ। যে কোন দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে অন্যদের কিছু না হলেও ভিকটিমের পরিবার হারায় তাদের বাড়ির একজন ভালোবাসার সদস্য। হয়তো সেই সদস্য তাদের বাড়ির একমাত্র উপার্জিত ব্যক্তি হতে পারে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো তার বাড়ির প্রাণ হয়ে থাকে।
আমাদের গাড়িটা হঠাৎ সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তখন খালপাড় থেকে ভিকটিমের লাশটা এম্বুলেন্সের ভেতরে প্রবেশ করাতে নিয়ে আসছিল। দূর থেকে কিছু বুঝতে না পারলেও লাশটা ভেতরে রাখার দৃশ্যটা হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করছিল। জানি না কোন মা তার কলিজার টুকরো সোনার ধন হারিয়েছে। আল্লাহ তুমি যাকে নিজের কাছে নিয়েছ তাকে বেহেশত দান করিও, আর সেই অভাগী মা’কে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করবেন, আমিন।
আমি বিষাদগ্রস্ত মনটা নিয়ে বাড়িতে আসতেই নিজের রুমে এসে ছুটে যাচ্ছি। তবে সেখানে যেতেই একরাশ হতাশা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমার ছোট্ট হৃদয়টাকে। কারণ বারান্দার ওপাশের জানালাটা বন্ধ ছিলো। এতোবছর তার সাথে সম্পর্ক কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো জানালা বন্ধ পায়নি। তাহলে আজ কেনো বন্ধ? বাড়িতে যেয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি বলে কি সে রাগ করেছে? আসলে সেখানে মোবাইলে নেটওয়ার্ক সমস্যা ছিলো। কিন্তু সে আমার উপরে রাগ করবে কেনো? আমি কখনো আমার অনুভূতি তার নিকটে প্রকাশের সাহস করা হয়নি।
বিষাদগ্রস্ত মনটা নিয়ে মামা-মামীর সাথে কথা বলতে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই পা দুটো আমার বরফের মতো জামাটা বেধে গেলো। মামা দেখি মামী কে উদ্দেশ্য করে বলছে, “জানো আমাদের পাশের বাড়ির ছেলেটা তিনদিন আগে মারা গেছে আল্লাহ ছেলেটার বাবা- মা কে ধৈর্যশীল করুণ।”
এতটুকু কথায় যথেষ্ট ছিলো আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার করে দেওয়ার জন্য। আমি সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নাই। এক দৌড়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বাথরুমে প্রবেশ করি।তারপর হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পরি। এটাই বুঝি আমার প্রাপ্য ছিলো? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না আবার তাকে ছাড়ে বেঁচে থাকবো এটা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতোবছর আমি যে আমার আপনিতে আসক্ত। তাকে ভুলে যাবো কি করে? তার সাথে যোগাযোগ না করাটা আমার ভুল। একটু দূরত্ব সারাজীবনের কান্নার কারণ হয়ছে। এসব আকাশ পাতাল চিন্তায় আমার হৃদয়ের মাঝে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছিল।
পরেরদিন সকালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম ভার্সিটিতে যাবার জন্য। তখন মামা এসে বলে,”রিমশা আজকের পর থেকে তোমাকে একা একা চলাফেরা করতে হবে। আহীদের পক্ষে আর তোমাকে প্রটেকশন দিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।”
বাকিটা আর শোনবার মতো শক্তি আমার ছিলো না। তা-ই তো দ্রুত সামনে আসা ফাঁকা রিক্সাতে উঠে পরি। দ্রুত মামাকে বিদায় দিয়ে নিজের চোখের অশ্রু আড়ালে করতে তড়িঘড়ি শুরু করি।
আমি জানি, আমি যেমন কোয়ালেটির মেয়ে! তার এভাবে ভেঙ্গে পড়া ডোলে সাজে না। তা-ই নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে নরমাল ভাবে জীবনযাপন করতে চেষ্টা করব। নয়তো সবাই জেনে যাবে আমার মনের ভেতরে থাকা গোপন অনুভূতির কথা। আমি চাইছি না সবাই আমার আহীদের প্রতি থাকা অনুভূতি সম্পর্কে জানুক। কী দরকার একজনের অনুপস্থিতি তে তাকে সবার সামনে অপমানিত করার।
এরপর থেকে শুরু হয় নতুন যুদ্ধ! আমি সবার সামনে প্লাস্টিক হাসি দিয়ে জীবন্ত লাসের ন্যায় বাঁচতে শুরু করি। খুব কষ্ট হতো এভাবে মুখোশের আড়ালে থাকতে।
এভাবে কীভাবে যেএকটা বছর কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না
আমি আহীদ কে ছাড়া বেঁচে আছি জীবন্ত লাশে মতো।
চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে ম্যাচিউ হয়েছে।
যে ফোনে তার সাথে কাটানো হাজারো মূহুত্ব লুকিয়ে ক্যামেরা বন্দী করে রেখেছিলাম। সেই ফোনটাও আমাকে ধোঁকা দিয়ে বসে। পড়ে অবশ্য ভাইয়া নতুন ফোন আর সিম কিনে দিয়েছিল।
এরপর জীবনে ঘটে আরেকটা কাহিনী। মামাত দুই ভাই হঠাৎ করে বিয়ে করে তাদের বউদের নিয়ে বাড়িতে এসে ওঠে। তাদের সাথে মামা-মামী’র নানারকম পারিবারিক সমস্যা শুরু হয়। তাদের বাড়ির নতুন দুই বউয়ের আমাকে নিয়ে সমস্যা হতে শুরু করে। এবাড়িতে আমাকে নিয়ে চলমান সমস্যা সম্পর্কে আমি আমার পরিবারকে অবগত করি। এসব কথা শুনে বাবা গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে।
চেয়ারম্যান সাহেব অনেক ভালো মানুষ দেখে সে বাবাকে বলে,”যাও তুমি তোমার মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে চলে আসো। এখানে আসার পর তার দায়িত্ব আমার। তোমার মেয়ে মানে আমার মেয়ে, আর কতোদিন মেয়েটা কে দূরে রাখবে। বিয়েরপর তো মেয়ে পরের বাড়িতে চলে যাবে।”
এরপর বাবা আমাকে নিতে চলে আসে। আমিও চাইছিলাম না আমার জন্য মামা-মামী’র তার সন্তানদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হোক। বাবার সাথে গ্রামের ফিরে আসার সময় খুব খারাপ লেগেছিল। কারণ মানুষ সহজে কোন কিছুর মায়া কাটাতে পারে না। আমিও এ শহরের সাথে ঐ মানুষটার মায়াতে আবদ্ধ তা কি সহজেই ভুলে যাওয়া সম্ভব?
গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি বেশ কিছুদিন হয়েছে।
আমাদের বাড়ির আশ্রিত ইফা আর তার মা।
ইফার মা বেশ ভালো ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তবে তার মেয়েটা কে আমাকে তেমন সুবিধের মনে হয় না। আমি বাড়িতে ফিরে আশাতে সে খুশি হয়নি। আমার সাথে সে কথা বলতে আগ্রহী না। এমন একটা ভাব করে আমি মনে হয় ওর পাকা ধানে মই দিয়েছি। তবে কি আর করার ইফা গ্রামের সব কিছু ভালোমতো চেনে জানে। আমি এতো কিছু সম্পর্কে ঠিকঠাক ভাবে অবগত না। তাছাড়া আমি বেশ কয়েকবছর গ্রামের বাহিরে ছিলাম। বাবা- মা ইফার বেপারটা ঠিকি বুঝতে পারে। তারা আমার সাথে ইফার সম্পর্ক সুন্দর করতে নানারকম চেষ্টা করতে থাকে। তবে সবটা স্বাভাবিক হবে এর কোন গ্যারান্টি ছিলো না
(ইনশাআল্লাহ এখন থেকে রেগুলার গল্প দিতে চেষ্টা করবো)



চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here