#রূপবানের_শ্যামবতী
#১২তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
রাত ১০ টা।
খান ভিলাতে রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। হরেক রকমের পদের বাহারি আয়োজন। বিশাল বড় ডাইনিং টেবিল ভর্তি হয়ে আছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই ফারহার পছন্দের খাবার। গোল টেবিলের শুরুর দিকে কারুকার্যখচিত রাজকীয় সিংহাসনের ন্যায় বিশাল এক চেয়ার। এটি গুলবাহারের জন্য নির্ধারিত। সেই চেয়ারে বেশ দাপটে ভঙ্গিমায় বসে আছেন। চোখে মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে রেখেছেন। অপেক্ষা করছেন বাকি সদস্যদের জন্য। কিছু সময়ের মধ্যে একে একে সকলেই চলে এলেন। বড় ছেলে আফজাল ও ছোট ছেলে আফতাব এসে মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়েন। আয়াজ, আহিয়া, ফারহা আগেই উপস্থিত ছিল। এবার বাকি আছে শুধু আহরার। সার্ভেন্টরা সকলে খাবার রেডি করা শেষে কিছুটা দূরে রান্নাঘরের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ফারজানা আর তাসফিয়া সকলকে খাবার বেরে দেওয়ার উদ্দেশ্য টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আফতাব খান কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলে ওঠেন,
— কি ব্যাপার, আহরার এখনো আসছে না কেন?
গুলবাহার কঠোরস্বরে জবাব দেন,
–আমার নাতি বেকার বসে থাকেনা, সে সারাদিনের ব্যস্ততা সেরে ফিরছে। অবশ্যই এটুকু সময় লাগতে পারে। তাই বিরক্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
এর মাঝে তাসফিয়া বলে উঠে,
— আপনারা শুরু করুন আম্মা। আহরার এখুনি চলে আসবে।
— না, ছোট বউ। আমার নাতিকে রেখে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হবে না। তোমার যদি অপেক্ষা করতে কষ্ট হয় তবে তুমি যেতে পারো। খাবার তুলে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই এই বাড়িতে।
তাসফিয়া আর কিছু বলে না। কারণ সে জানে যদি আর বাড়তি কিছু সে বলে তবে শাশুড়ী রেগেমেগে শেষে না খেয়েই উঠে যাবেন। আজ এতগুলো বছর ধরে সংসার করে, শাশুড়ির এতো এতো সেবা করেও তার মন পেল না সে। ভাবতে ভাবতেই ভেতর চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
— ওইতো ভাইয়া চলে এসেছে।
আহিয়ার কথায় সকলের দৃষ্টি যায় সিঁড়ির দিকে। সদ্য গোসল সেরেছে আহরার। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ঘন কালো চুল গুলোতে তখনও পানির ফোটা লেপ্টে আছে। সাদা টি-শার্ট ও কালো ট্রাউজার তার শুভ্র শরীরে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চিকচিক করছে পানির কারণে। হলদে ফর্সা মুখে এক অন্যরকম দীপ্তি ফুটিয়ে তুলেছে। হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝারতে ঝারতে নিচে নামছে সে। সকলেই তার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। গুলবাহার নিজ মনেই বিরবির করে বলেন,
— “মাশা আল্লাহ, মাশা আল্লাহ”। আমার এই রাজপুত্রের মতো নাতির সৌন্দর্যে কারো নজর না লাগুক।
ফারহা তাকাবে না তাকাবে না করেও চোখ চলেই যায়। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে চেয়েও পারে না। পলকহীন দৃষ্টিতে দেখতে থাকে সে আহরারকে। হুট করে মনে হলো যেন দম আটকে আসছে। চোখ বুজে নিলো সে। বহুদিনের তৃষ্ণা। এটুকু দেখাতে কি মিটবে? কিন্তু ওই আগুনঝরা রূপের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকাও দায়। আহরার এসে বসে পড়ে তার নির্ধারিত চেয়ারে। আড়চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে মনে বলতে থাকে ফারহা,
— “কবে তোমার ওই পাশের চেয়ারটাতে বসার অধিকার পাবো আহরার ভাই? আদৌ কি সেই দিন আসবে?”
সকলে খাওয়া দাওয়া শুরু করতেই গুলবাহার বলে উঠেন,
–ফারহা আসা উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাচ্ছি।
আফজাল সাহেব বলেন,
–জি আম্মাজান। কিন্তু কবে?
–আগামীকাল সন্ধ্যায়।
আফতাব সাহেব বলে ওঠেন,
–পরিসর কেমন হবে আম্মাজান? সকল আত্মীয় স্বজন থাকবে নাকি হাতে গোনা কিছু মানুষ?
গুলবাহার কিছুটা ক্রুদ্ধ স্বরে জবাব দেন,
–ভারি আশ্চর্য কথা তোমার আফতাব। আমার আদরের নাতনি এতো বছর পর ফিরেছে ধুমধাম আয়োজন হবে। বরাবরই ছোটো চিন্তা ভাবনা রয়ে গেলো তোমার।
গুলবাহার কথাটা ঠিক কোনদিকে খোঁচা মেরে বললেন তা বুঝতে পারলেন আফতাব সাহেব। একবার আড়চোখে স্ত্রী তাসফিয়ার দিকে তাকান। আজও তাকে মায়ের কাছে খোঁচা খেতে হয় সেই একটাই বিষয় নিয়ে। তার মায়ের ভাষ্যমতে যেটা অনেক বড় ভুল ও অন্যায়। আফতাব সাহেব আর কিছু বলেন না। আফজাল সাহেব পরিস্থিতি বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্যে বলেন,
–তাহলে কাদের কাদের ইনভাইট করবো তার একটা লিস্ট করা দরকার। কি বলিস আফতাব।
–জি ভাইজান।
–খাওয়া দাওয়া শেষ করে চল তাহলে, লিস্ট করতে বসি।
এরইমাঝে গুলবাহার পুনরায় বলে ওঠেন,
–হ্যা তাই ভালো। শুধু আত্মীয় স্বজন নয়, তোমাদের বন্ধু বান্ধব, বিজনেস পার্টনার ফ্যামিলি সহ সকলে যেন ইনভাইটেড হয়।
দুই ভাই একসাথে জবাব দেন,
–জি আম্মাজান।
গুলবাহার মনে মনে বলেন,
“কাল আমার অনেক বড় একটা অ্যানাউন্সমেন্ট আছে।”
আফজাল সাহেব এবার আহরারের উদ্দেশ্যে বলেন,
–আহরার, বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন কাটলো?
–অনেক ভালো ছিলো বড় আব্বু। গ্রামে বিয়ে ভিষণ এনজয় করেছি।
–কোনো মেয়ের পাল্লায় পরিসনি তো বাবা?
বলতে বলতে হেসে ওঠেন আফজাল সাহেব। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরাও হাসছেন।
আহরার জবাব দেয়,
–তা আর বলতে বড়আব্বু। মুখ ঢেকে চলাফেরা করা সত্ত্বেও পিছু পড়েছিলো। আর একদিন তো হুট করে সামনে পড়ে গেছিলো। মুখ তখন খোলাই ছিলো। সেই মেয়ে আমাকে দেখা মাত্রই ভুত দেখার মতো চমকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো। আর পালানোর সময় চিৎকার করে কি বলছিলো জানো?
সবাই অধীর আগ্রহে জানার জন্য আহরারের দিকে তাকিয়ে আছে। আহরার সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে ঠিক রূপার মতোই অভিনয় করে বলে উঠে,
“ও মাগোওওও জ্বীইইইননন!”
আহরারের কথা শুনে সকলেই চোখ বড় বড় করে তাকায়। তারপর হো হো করে সকলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আফতাব সাহেব ছেলের পিঠ চাপড়ে বলেন,
–সেরা সম্বোধন পেয়েছিস এবার।”
বলতে বলতে তিনিও হাসিতে ফেটে পড়েন। এদিকে তাসফিয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। তার ছেলে কোনো মেয়ের নজরে পড়ুক তা তিনি চান না। মন তো চায় ছেলেকে একেবারে সিন্দুকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল মেয়েরাও বড্ড ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে। ছেলেকে নিয়ে তার বড় ভয়।
~~~
খান ভিলা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সজ্জিত আজ। উৎসব চলছে। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফেরার উৎসব। বাইরের মেইন রোডে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে এক আগন্তুক। হাতে জ্বলন্ত সি গা রেট। গভীর দৃষ্টিতে দেখছে সে বাড়িটাকে আর কিছু সময় পরপর সিগারেট মুখে লাগিয়ে টানছে, তারপর ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে বাতাসে। সেই ধোঁয়াতে ধোঁয়াময় হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। হুট করে সেদিকে তাকিয়ে আপনমনে বলতে থাকে,
“ঠিক এভাবেই ধোঁয়ায় বিলীন হয়ে গিয়েছে আমার জীবনটা। খুঁজে পাচ্ছি না যে কিছুই। সবটাই ঝাপসা।”
পরপর আরো দুবার টান দিয়ে সিগারেটের শেষ অংশটুকু মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিলো। অতঃপর পুনরায় বাড়িটির দিকে চেয়ে বলতে থাকে,
“বাড়িতে উৎসব। সকলেই উপস্থিত। কিন্তু অনুপস্থিত মানুষটাকে নিয়ে কি কারো কোনো মাথাব্যাথা থাকবে? হাহ!”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সে শব্দ করে। মনের ভেতরে চেপে রাখা অব্যক্ত কিছু কষ্ট নিয়ে ধীরে ধীরে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
ছেলের ছবি সামনে নিয়ে সমানে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন ফারজানা। তাসফিয়া তাকে ডাকতে এলে এভাবে কাঁদতে দেখে দ্রুতপায়ে ছুটে আসে। পাশে বসে কাঁধে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
–কি হয়েছে বুবু? তুমি কাঁদছো কেন?
তখনই তার চোখ পড়ে হাতের ছবিটার দিকে। আয়মানের ছবি দেখে যা বুঝার তা বুঝে গেলো সে। তপ্ত শ্বাস ফেলে শান্তনার সুরে বলতে থাকে,
–তোমাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা তো আমার জানা নেই বুবু। শুধু এটুকু বলবো, কষ্ট পেয়ো না। আমাদের আয়মান খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে দেখো।ও ওর মাকে ছেড়ে কতদিনই বা দূরে থাকবে।
–৫ টা বছর হয়ে গেলো রে তাসফি আমার ছেলেটাকে আমি দেখি না। ওকে একটু আদর করে দিতে পারিনা। ওর পছন্দের খাবার বানিয়ে দিতে আবদার করে না। সারাক্ষণ মা মা করে করে কান ঝালাপালা করে না। ওর মা ডাক শোনার জন্য আমার বুকটা খাঁ খাঁ করছে রে। কবে শুনবো আমার আয়ুর ডাক? কবে শুনবো?
তাসফিয়া আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তার নিজের কাছে নিজের বড্ড খারাপ লাগছে। আয়মানের এই বাড়ি ছাড়া হওয়ার পেছনে কোনো না কোনোভাবে তো তার ছেলেটা দায়ী। কি করবেন তিনি? কিভাবে এই সংসারটাকে আবার পরিপূর্ণ করবেন? বুঝে উঠতে পারেন না।
~~~
সন্ধ্যা নামতেই খান ভিলাতে সকল আত্মীয় স্বজন আসা শুরু হলো। এরই মধ্যে বাড়ির বড় নাতনি অর্থাৎ আফজাল খানের বড় মেয়ে ফারনাজ এবং তার স্বামী নাদিম হাসান চলে এসেছে। ফারনাজ এসেই মা, চাচী আর বোনদের সাথে আলাপে মশগুল হয়েছে। নাদিম ঘুরে ঘুরে বাড়ি ঘর দেখছে। এমন নয় যে সে প্রথমবার এসেছে এই বাড়িতে। মূলত সে যতবার এ বাড়িতে আসে ততবারই এভাবেই সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে। দেখতে দেখতেই একটা সময় সে আয়মানের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রুরভাবে হেসে ওঠে। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাতে হাত বুলাতে থাকে। মুখখানি মলিন করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
–আহারেএএ! খান বংশের বড় নাতি। যে কিনা সবকিছুর যোগ্য উত্তরসূরী ছিলো আজ সে এই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একেবারে বাড়ির বাইরে।
বলেই পরপর কয়েকবার মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে দুঃখ প্রকাশের ভান করতে থাকে সে। তারপরই হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে মুখে হাত চেপে ধরে আশেপাশে দেখে নেয়। কেউ আবার শুনে ফেললো নাকি। নাহ! কেউ শোনেনি। হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। এবার সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুদূর যেতেই আহরারের রুমটা চোখে পড়ে তার। সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুখ বিকৃত করে একপ্রকার ক্ষোভের স্বরে বলে উঠে,
–আহরার খান! হাহ!
দৃষ্টি ফেরাতেই চমকে ওঠে নাদিম। সামনে ফারহা দাঁড়িয়ে।
–আপনি এখানে কি করছেন ভাইয়া?
–আম..না.. মানে অনেকদিন পর এলাম তাই একটু ঘুরে দেখছিলাম। তা শালী সাহেবার কি অবস্থা? লং টাইম বাদে বাড়ি ফিরেছো। কেমন লাগছে?
ফারহা হালকা হেসে জবাব দেয়,
–অনেক ভালো লাগছে ভাইয়া। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছি।
–বাহ! গুড, গুড। ঠিকাছে এনজয় করো। আমি বরং নিচে যায়। সবার সাথে একটু সময় কাটাই।
–ঠিকাছে ভাইয়া।
নাদিম চলে যায়। ফারহা কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে নাদিমের চলে যাওয়া দেখলো। কারণ সে স্পষ্ট নাদিমের চোখে মুখে বিরক্তি দেখেছে যা আহরারের ঘরের দিকে তাকিয়ে প্রকাশ করছিলো। কিন্তু কেন? কোনোকিছুই ফারহার বোধগম্য হয় না।
খাওয়া দাওয়া শেষে সকলেই যার যার মতো গল্প আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ফারহা তার সমবয়সী কাজিন বোন আর বান্ধবীদের সাথে গল্প করছে। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে,
–এই ফারহা, তোর সেই কাজিন ভাইটা কই রে? রূপের বাহার।
ফারহা চোখ রাঙিয়ে জবাব দেয়,
–এই একদম নজর দিবিনা।
–আহহ! যা দেখতে না, ওমন পাগলকরা রূপ নিয়ে চললে নজর না দিয়ে উপায় আছে। কিন্তু সহজে তো দেখাই পাওয়া যায় না তার।
পাশ থেকে অারো একজন বলে ওঠে,
–আরে রাখ এখন সেই কথা, ফারহা বল। তোর বিয়ের দাওয়াত কবে দিচ্ছিস?
ফারহা একটু লজ্জা পায়। হালকাস্বরে জবাব দেয়,
–ফ্যামিলি যখন চাইবে।
–সিরিয়াসলি! তুই এতো আপগ্রেডেড হয়েও কেমন ব্যাকডেটেডের মতো কথা বলছিস। ফ্যামিলি যখন চাইবে? তোর নিজস্ব কোনো চয়েস নেই?
চয়েসের কথা শুনে ফারহা একবার আশেপাশে তাকালো। আহরার এই ত্রিসীমানায় নেই। না থাকারই কথা। সে এসব মানুষজন বরাবরই এড়িয়ে চলে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
–কিরে চুপ করে আছিস কেন? আছে নাকি কোনো চয়েস বল?
ফারহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই গুলবাহার এর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা গেলো। সকলের আড্ডা, হৈ হুল্লোড় বন্ধ হয়ে গেলো। পিনপতন নীরবতায় সবার মনোযোগ এখন গুলবাহারের দিকে। সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করার পর গুলবাহার বলে ওঠেন,
“খান বাড়িতে আজ আত্মীয় স্বজনসহ গণ্য মান্য অনেক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত রয়েছেন। তাই এখনই উপযুক্ত সময় কিছু কথা বলার।”
কথাটুকু শেষ করে গুলবাহার ফারহাকে ডাকেন,
–ফারহা দাদুমনি এদিকে এসো তো।
ফারহা এগিয়ে আসতেই গুলবাহার তাকে একহাতে আগলে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে আবারও বলে ওঠেন,
“এই আমার এক আদরের নাতনি যে আট বছর পর আমাদের কাছে ফিরেছে, তা তো আপনারা সবাই জানেনই। মেয়ে বড় হলে পরিবারের মানুষদের সবচেয়ে বেশি চিন্তা যা থাকে তা হলো মেয়েকে ভালো পরিবার ও ভদ্র ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া। আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমার নাতনির জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে সবকটা প্রস্তাবই উত্তম ছিলো। তবে আমি কাওকেই জবাব দেইনি। তাই এখন সবার উদ্দেশ্যে বলছি, আমি আমার নাতনি ফারহার বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। ফারহাকে আমি আর দূর যেতে দিতে চাইনা। তাকে এই বাড়িতে নিজের কাছেই রেখে দিতে চাই। আর তাই আমি ফারহা দাদুমনির বিয়ে দিতে চাই আমার আরেক আদরের নাতি, আমাদের বংশের তাজ আহরার দাদুভাইয়ের সাথে।”
গুলবাহারের কথা শুনে সকলেই হতভম্ব। ফারহা স্তব্ধ হয়ে দাদীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঠিক শুনছে তো। তার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ইচ্ছে এভাবে পূরণ হয়ে যাবে? ভাবতে পারছেনা। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছেনা সে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাদীর পাশে। বাড়ির কেউ ধারণাও করেনি গুলবাহার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ইতিমধ্যে সকলে হাততালি দিতে শুরু করেছে। আফতাব বেশ খুশিই হয়েছেন। ফারহাকে তিনি মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। সে তার ছেলের বউ হলে তার কাছে ব্যাপারটা মন্দ হবে না। তিনি এগিয়ে এসে বড় ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করেন। আফজালও অনেক বেশি খুশি। মেয়েকে বিদায় দিতে হবেনা আর। মেয়ে তার কাছেই থাকবে সর্বদা। ফারজানা, তাসফিয়া, ফারনাজ, আহিয়া, সকলেই খুশি। তারা হই হই করে আনন্দ প্রকাশ করছে। কিন্তু আয়াজ খুশি হতে পারছে না। ফারহা তার নিজের আদরের ছোটো বোন। আহরারও তার বড় ভাই। চাচাতো ভাই হলেও আপন ভাইয়ের চেয়ে কম নয়। সেই ভাইয়ের চোখে সে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা দেখেছে। তাই সে কিছুতেই খুশি হতে পারলো না। ওদিকে দোতালায় রেলিং এর কাছে দাঁড়ানো আহরার সবটাই শুনেছে। ভয়ংকর রাগে তার চোখ মুখ লাল আকার ধারণ করেছে। শক্ত মুঠোয় এমনভাবে রেলিং ধরে রেখেছে যেন এখুনি এটি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। তাসফিয়ার চোখ যায় ছেলের দিকে। ছেলের এমন অশান্ত রূপ দেখে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। তবে কি আহরার রাজি নয়? ছুটে যান তাসফিয়া ছেলের কাছে। আহরারকে টেনে ঘরে নিয়ে আসেন। দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়ে ছেলের গালে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
–আহরার, কি হয়েছে বাবা? তুই এতো রেগে গেছিস কেন?
ক্ষুব্ধ স্বরে আহরার জবাব দেয়,
–মা, দাদীজান এটা কি করলো? আমাকে না জানিয়ে, আমার মতামত না নিয়ে কি করে আমার জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।
–কি বলছিস কি আহরার? তুই কি তাহলে খুশি নস এই প্রস্তাবে?
–খুশি? তোমার কেন মনে হলো মা আমি খুশি হবো? ফারহাকে নিয়ে আমি কোনোদিন কোনো কিছু বলেছি বা ইঙ্গিত দিয়েছি। মা, আমি তো ওকে কখনোই সেই নজরে দেখিনি।
–তুই শান্ত হ বাবা শান্ত হ। এদিকে আয়। বস এখানে।
আহরারকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসে পড়েন তাসফিয়া। ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন তিনি।
–মা আমি কিছুতেই ফারহাকে বিয়ে করতে পারবোনা। আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
–এভাবে বলছিস কেন আহরার? তোর তো কোনো পছন্দ ছিলো না? তাহলে ফারহাকে বিয়ে করতে তোর আপত্তি কোথায়? তুই চিনিস না মেয়েটাকে? ওর মতো মেয়ে আজকাল পাওয়া যায়? ও তোকে কতোটা সুখী করবে তা তুই ভাবতে পারিস?
–মা ফারহা যথেষ্ট ভালো মেয়ে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মন? এই মনের পছন্দেরও একটা ব্যাপার আছে।
–সত্যি করে বলতো তুই কি অন্য কাওকে পছন্দ করিস?
দম নেয় আহরার। নিজেকে শান্ত করে। চোখ বুজে মানসপটে ভাসিয়ে তোলে তার শ্যামবতীর মুখখানা। অতঃপর ধীর কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
–হ্যা করি। ভিষণ পছন্দ করি।
বিস্ময়ে হতবাক তাসফিয়া। তার ভাবনাতেও আসেনি কখনো, আহরার কাওকে পছন্দ করতে পারে। কন্ঠে বিস্ময় রেখেই তিনি বলে ওঠেন,
–কে সেই মেয়ে? তবে তুই তার কথা আগে বলিসনি কেন?
–বলার সুযোগটা কখন পেলাম মা। তার সাথে সাক্ষাৎ ও তো বেশিদিনের নয়।
–বেশ তবে তোর দাদীজানকে বুঝিয়ে বল তার ব্যাপারে। আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই ওই মেয়ের বাড়ি।
–না মা, এখন তা সম্ভব নয়।
–কেন সম্ভব নয়?
–কারণ আমি তাকে পছন্দ করলেই হবে না। তারও তো আমাকে পছন্দ করা লাগবে?
–তোকেও কেউ পছন্দ না করে থাকতে পারে?
–জানিনা মা। তবে তার মনের কথাটা এখনও জানা হয়নি আমার। যতদিন না তার সম্মতি পাচ্ছি আমি সামনে এগোতে পারবোনা। আমি তার ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাইনা।
ঝট করে মায়ের দিকে ঘুরে বসে আহরার। মায়ের দু হাত নিজের মুঠোয় পুরে করুণ স্বরে বলে ওঠে আহরার,
–প্লিজ মা, তুমি এটা আটকাও। আমাকে শুধু একটু সময় দাও। খুব শীঘ্রই তার সম্মতি অর্জন করে নিব আমি। ততদিন পর্যন্ত এসব ঝামেলা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করো। প্লিজ।
তাসফিয়া যেন বড্ড সংকটে পড়ে গেলেন। একদিকে ছেলের আবদার অন্য দিকে শ্বাশুড়ির ভয়। কি করবেন তিনি। মনে মনে বলতে থাকেন,
“আমার ছেলে কাওকে পছন্দ করেছে, নিশ্চয়ই সে অসম্ভব রূপবতী হবে। ছেলে আমার সুন্দরের পূজারী। তার পছন্দ নিশ্চয়ই তার বাবার মতো হবেনা। যেভাবে ওর বাবা আমার মতো শ্যামবর্ণ মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে এনেছিলো আর তার জন্যই আজও শ্বাশুড়ির কাছে অবহেলিত হয়ে আছি। কতো কতো ঝড় ঝাপ্টা পেরোতে হয়েছে তা কল্পনা করলেও শিউরে ওঠে শরীর। আমার ছেলের জীবনটা অবশ্যই এমন হবে না। সেও নিশ্চয়ই তার রূপের সমকক্ষ কাওকে নিয়ে আসবে। আমাদের মতো জীবন আমার ছেলেটার না হোক। না হোক।”
চলবে…..