রূপবানের_শ্যামবতী #১৩তম_পর্ব #এম_এ_নিশী

0
550

#রূপবানের_শ্যামবতী
#১৩তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

আহরারের ঘরে চলছে গোপন মিটিং। উপস্থিত আছে চার বন্ধু। আহরার, দাইয়ান, ঈশান আর রাদিফ। আলোচনার বিষয়বস্তু, “আহরারের বিয়ে।”
অনুষ্ঠানে তিনবন্ধু আসতে পারেনি কিছু ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে। তাই আজ আহরারের জরুরি তলবে তিনবন্ধুই পড়িমরি করে ছুটে এসেছে। দাদীজান গুলবাহার যে এতোবড় একটা ধামাকা দেবেন তা কেউই কল্পনা করেনি। চার বন্ধুই গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভাবনার রেশ রেখেই রাদিফ বলে,

–দোস্ত, আমার মাথায় তো কিছুই খেলছে না। এখন এই প্যাঁচ ছুটাবি কি করে?

দাইয়ান সোজা হয়ে বসে। গম্ভীর স্বরে বলে,

–দাদীজান সবার সামনে এতোবড় একটা এনাউন্সমেন্ট করে দিলেন এখন এর বিপরীত কিছু ঘটালে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হয়ে যাবে।

ঈশান সায় জানিয়ে বলে,

–একদম ঠিক। দাদীজান মনে করেন তার কথার ওপর কোনো কথা চলবে না। তার ইচ্ছে হয়েছে আহরারের সাথে ফারহার বিয়ে দিবেন তাই তিনি হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা সবাইকে জানিয়ে দিলেন জাস্ট। কারো মতামতের তোয়াক্কা করলেন না। তার মানে উনি এটা এতেটাই চান যে কারো বাঁধা মানতে রাজি নন।

আহরারকে উদ্দেশ্য করে দাইয়ান বলে,

–ঈশানের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয় আহরার। আমার মনে হয় তুই দাদীজানকে অরুনিকার ব্যাপারে বলে দে। তারপর ওর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যা।

একে একে তিন বন্ধুর কথা মন দিয়ে শুনলো আহরার। অতঃপর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,

–তোরা কেউ অরুনিকাকে চিনিসনি। ও আমাকে ভয় পায়?

তিন জনই অবাক স্বরে একসাথে বলে ওঠে,

–ভয়?

–হ্যা। আমি যে ওকে মন থেকে কতোটা চাই এটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারেনা। হতে পারে আমিই সেই বিশ্বাসটা এখনো অর্জন করতে পারিনি। আজ দাদীজানকে অরুর ব্যাপারে বলতেই পারি। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব এখনই এভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ যেহেতু অরু এখনে আমাকে বিশ্বাস করেনা ও এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিবে। আর ও একবার অসম্মতি প্রকাশ করা মানে দাদীজান আর কোনোকথা শুনবেননা। ধরে বেঁধে হলেও ফারহার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন। তারপর? তারপর কি হবে?

ঈশান বলে,

–তুই কি ভয় পাচ্ছিস?

–ভয় নয় ঈশান, দাদীজানকে সবাই মান্য করে চলে। তার প্রতি সবাই একটা সম্মান রাখে যার জন্য কেউ উনার মতের বিপক্ষে কিছু বলেননা। তবে আমার বিশ্বাস দাদীজান এই ব্যাপারটা৷ আমার ওপর চাপিয়ে দিবেন না যদি আমি বুঝিয়ে বলি। শুধু অরু একবার রাজি হয়ে যাক। ব্যাস! সব সলভড হয়ে যাবে।

দাইয়ান আহরারের কাঁধে হাত রেখে বলে,

–যাই কর বন্ধু, আমরা তোর সাথে আছি।

ঈশান, রাদিফ এসে দুই দিক থেকে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,

–সবসময় আছি।

~~~

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিজের ঘরে বিশ্রাম নেন গুলবাহার। আজও তাই করছেন। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। চোখ দুটো বোজা। মাঝে মাঝে চেয়ারটা হালকা দোলাতে থাকেন। ঠকঠক করে দরজায় নক পড়ে। চোখ বুজে রেখেই খানিকটা উঁচু স্বরে বলে উঠেন,

–ভেতরে এসো।

হালকা শব্দে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো আহরার। মৃদুস্বরে ডেকে ওঠে,

–দাদীজান।

চোখ মেলে তাকান গুলবাহার। নাতিকে দেখে খুশি হন বেশ।

–দাদুভাই, তুমি এসেছো? এসো এসো, বসোতো আমার কাছটিতে।

বেতের একটি টুল টেনে এনে দাদীর কাছে বসে পড়ে আহরার। দাদীর কোলে মাথা রাখতেই পরম যত্নে গুলবাহার নাতির ঘনকালো চুলগুলোতে হাত বোলাতে থাকেন। আহরার নম্রস্বরে বলে ওঠে,

–দাদীজান, আপনি তো জানেন আমি কখনো আপনাদের আদেশ অমান্য করিনা। কিন্তু আজ প্রথমবারের মতো আমি আপনার কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি।

গুলবাহার ঠাওর করতে পারছেননা আহরারের অভিসন্ধি। তবুও তিনি আদুরে স্বরেই জবাব দেন,

–কি আবদার দাদুভাই?

–দাদীজান, আমি ফারহাকে বিয়ে করতে পারবো না।

হাত থেমে যায় গুলবাহারের। অবাকস্বরে তিনি প্রশ্ন করেন,

–কি বললে দাদুভাই? ফারহাকে বিয়ে করতে পারবে না? এসব কি বলছো তুমি?

মাথা তুলে তাকায় আহরার। গুলাবাহারের হাত ধরে আবদারের সুরে বলে ওঠে,

–দাদীজান, আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। আর আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই।

বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকেন গুলবাহার। আহরার যে কাওকে পছন্দ করতে পারে এবং সেই পছন্দ গুলবাহারের পছন্দকে এড়িয়ে তার সামনেই উপস্থাপন করার সাহস রাখবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি কখনো। নিজের বিস্ময়ের রেশ খুব তাড়াতাড়িই কাটিয়ে উঠলেন তিনি। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করেন,

–মেয়েটি কে দাদুভাই? তার ব্যাপারে সবকিছু বলো।

আহরার সবকিছুই তার দাদীকে খুলে বলে। মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় সবটা ভালোভাবে শুনলেন এবং বুঝলেন গুলবাহার। আহরারের কথা শেষে গুলবাহার নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে কোমলস্বরে বলেন,

–আমি কি কখনো তোমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিয়েছি দাদুভাই? যাও সেই মেয়েকে রাজি করাও। তারপর বলো। আমরা যাই গিয়ে শুভকাজটা সম্পন্ন করিয়ে আনি।

গুলবাহারের কথা শুনে আহরার স্বস্তি পেলো। দাদীর হাত দুটো টেনে তাতে চুমু খেয়ে বললো,

–ধন্যবাদ দাদীজান। আমি জানতাম আপনি আমাকে বুঝবেন।

গুলবাহার হাসলেন। আরো একবার নাতির মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দেন। আহরার চলে যায়। গুলবাহার পুনরায় গা এলিয়ে চোখ বুজেন। নিজমনে বলতে থাকেন,

“আমি কখনোই তোমাদের কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দেইনা দাদুভাই, শুধু এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করি যেন তোমরা নিজেরাই তা মেনে নিতে বাধ্য হও যা আমি চাই।”

ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি তার। ঝট করে চোখ খোলেন। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করেন এক নাম্বারে। ওপর পাশ থেকে রিসিভ হতেই বলে ওঠেন,

“আব্দুল্লাহ আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোমায়।”

~~~

কালো গোলাপের বাগান। দেখেছো কখনো? ওই দেখো?

সারি সারি গাছ। সেসব গাছভর্তি কালো গোলাপ। নিজেদের যেন পরিপূর্ণভাবে মেলে দিয়ে ফুটে রয়েছে সব ফুল। কি অভূতপূর্ব! সেই বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অরুনিকা। দুহাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। ফুলগুলোর কাছে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে অরু। কিন্তু পাচ্ছে না। বড় বড় চোখ করে হা করে দেখছে সে বাগানটি। কতো সুন্দওওররর! কালোও এতো সুন্দর হয়?

“হ্যা হয় তো। ঠিক তোমার মতো সুন্দর।”

আড়াল থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর শুনে বলে ওঠে অরু,

“কে? কে আপনি? সামনে আসুন। আড়ালে কেন?”

গাছেদের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো কেউ একজন। কে সে? তাকাতে গিয়ে যেন চোখ ঝলসে গেলো অরুর। দুহাতে চোখ ঢেকে নেয় সে। ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে পুনরায় তাকায়। আকাশের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে কি? এতো সুন্দর রূপ কোনো পুরুষমানুষের হয়? কিভাবে সম্ভব? এতো রূপ কেন তার? বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না। চেয়ে যদি না-ই থাকা গেলো তবে তৃষ্ণা মিটাই কি করে? দেখবার স্বাদ মিটবে কি? তৃপ্তি হবে না যে?

মানুষটি এগিয়ে আসছে। পথে আলগোছে তুলে নিলো একটি কালো গোলাপ। সেই গোলাপ হাতে মানুষটা এগিয়ে আসছে অরুনিকার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে মনকাড়া হাসি। হাসিমাখা সেই ঠোঁটে উচ্চারিত হয় কিছু শব্দমালা,

“আমার প্রিয় শ্যামবতী, আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে। তোমাকে আমার করে নিতে। এবার তুমি আমার হবেই। তোমার আর পালানোর পথ নেই।”

অরুনিকা পিছিয়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে তার। ভিষণ ভয়। সে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,

“এই যে রূপবান, দূরে যান। কাছে আসবেন না আপনি? আপনার রূপের আগুনে আমি পুড়ে যাই। ছারখার হয়ে যায় আমার মন, প্রাণ, অন্তর। আমি সইতে পারিনা ওই রূপ। আমার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের পাশে ওমন ঝাঁঝালো রূপ মানায় না, মানায় না। চলে যান আপনি, চলে যান, চলে যাআআআআনননন…..

ধরমড়িয়ে ওঠে অরুনিকা। সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। কি অদ্ভুত স্বপ্ন। হুট করে কেন সে এমন স্বপ্ন দেখলো?
তারপরই তার মনে পড়লো আজ দুপুরের ঘটনা। কলেজ থেকে ফেরার পথে এক লোক এসে পথ আটকায় অরুর। ভদ্রপোশাকের লোকটির সাজসজ্জা দেখে বোঝায় যাচ্ছিলো বেশ উচ্চ পরিবারের মানুষ। অরুনিকার উদ্দেশ্যে কাঠখোট্টা স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,

–তুমি অরুনিকা?

অরুনিকা ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। লোকটি পুনরায় বলে ওঠেন,

–আহরার খান। চেনো নিশ্চয়ই।

চমকে ওঠে অরু। শেষপর্যন্ত কোনো বিপদে পড়ে গেলো না তো সে ওই মানুষটার জন্য? ভাবতে ভাবতেই লোকটার কড়াস্বর শুনে ভয় পেয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, সে চেনে। লোকটা এবার খানিকটা শাসানোর সুরে বলে উঠলো,

–সে খান বাড়ির ছেলে। তার অবস্থান কত উচ্চ পর্যায়ের তা তোমার ধারণারও বাইরে। আর তার রূপ, জানোই তো। নিজের যোগ্যতাটা একটু ভালোভাবেই বুঝে চলবে। আহরার যতই পাগলামি করুক, তোমাদের মতো মেয়েরা ওর মোহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এর বেশি কিন্তু আগাবে না। আমার মনে হয় তুমি বুদ্ধিমতী। বাকিটা নিজেই বুঝবে। আশা করি আহরার খানের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো বোকামি তুমি করবে না। ওর অভিভাবক কিন্তু যথেষ্ট পাওয়ারফুল। ওকে! ভালো থেকো। আসি।

এই বলে লোকটি গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। একটা প্রাইভেট কারে উঠে মুহুর্তের মধ্যে স্থান ত্যাগ করলেন। এদিকে অরুনিকা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। অপমানে, অসম্মানে তার চোখে জল চলে এলো। সেই জল কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তার। লোকটার কথাগুলোর সারমর্ম বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি অরুর। এমন অপমান তো সে কত সহ্য করেছে। কিন্তু আজ.. আজ যেন হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার। কেন? কারণ অজানা…

~~~

ফোনের অপর পাশ থেকে দাইয়ানের অস্থির কন্ঠস্বর,

–আহরার তুই শিউর? তুই এভাবে গ্রামে যাবি? যদি কেউ সন্দেহ করে তবে তার ভয়াবহ প্রভাব কিন্তু অরুনিকার ওপর পড়বে।

–আরে চিল দোস্ত। আহরার থাকতে অরুনিকার কোনো ক্ষতি হতে পারে না। আই উইল ম্যানেজ। আমাকে শুধু একটা থাকার ব্যবস্থা করে দে। কেউ যেন জানতে না পারে এমন একটা প্লেস ঠিক করবি।

–আর বাড়িতে কি বলেছিস তুই?

–বলেছি অফিসিয়াল কাজে কিছুদিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবো।

–তুই আসলে পাগল হয়ে গেছিস আহরার।

–পাগল নয় বন্ধু পাগল নয়। বল দিওয়ানা। অরুনিকার জন্য এই আহরার দিওয়ানা হয়ে গেছে। এবার বল থাকার ব্যবস্থা করছিস?

–ওকে আমি করছি। বাট কতোদিন এভাবে? যদি অরুনিকা তোকে ফিরিয়ে দেয়?

–জানি ও ফিরিয়ে দিবে। তবে আমি হাল ছাড়বো না। আর আমার নিজের প্রতি সেই কনফিডেন্স আছে। এবার আমি খালি হাতে ফিরবো না।

–দেখ দোস্ত, যাই কর কিন্তু সাবধানে।

–ডোন্ট ওয়ারি। সব ঠিক থাকবে।

দাইয়ানের সাথে কথা শেষ করে আহরার মৃদু হেসে আপনমনে আওড়াতে থাকে,

“আমি আসছি অরু। তোমাকে নিজের করে নিতে, আমি আসছি।”

চলবে…

(রূপবানের শ্যামবতী হওয়ার পথটা বেশ কঠিন। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরোতে হবে। এবার আহরারের ভালোবাসার জোর কতোটা তাই দেখার পালা। সব বাঁধা পেরিয়ে রূপবান তার শ্যামবতীকে নিজের করে নিতে পারবে কি?

আজকের পার্টটা ছোটো হয়েছে, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here