#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩]
_____________________
৬.
পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ ভঙ্গিমায় বসে আছে ঈশান।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আজ বেশ খোশ মেজাজে আছে একটু আগে কি হয়েছে,না হয়েছে এসব ব্যপার-স্যপারে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।রাসেল তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে পাইচারি করছে।ঈশানের পেছনে দাঁড়িয়ে চারজন কালো পোশাকের গার্ড।হসপিটালে থাকা অনন্য সদস্যরা বেশ অবাক চাহনীতে তাদের পরখ করছে এমন অদ্ভুত কীর্তি হয়তো এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।তবে কেউ কেউ ধরে নিয়েছে নিশ্চই ভিআইপি কোন রুগী হসপিটালে এডমিট হয়েছে তাই তো এত গার্ড সিকিউরিটি।
ঈশানের তিন সিট দূরে বসে আছে অনু।মেয়েটা ফ্যাচফ্যাচ শব্দে কাঁদছে তার নাক টানার বিদঘুটে শব্দে মনোযোগ ভঙ্গ হলো ঈশানের।মাথার উপর থাকা কালো সানগ্লাসটা খুলে পাশে রেখে বলে,
” এই মেয়ে নাম কী তোমার?”
ঈশানের রুক্ষ স্বরে চকিতে তাকায় অনু।আজকের কান্ডে ঈশানের প্রতি তার বড্ড ভয় জমা হয়েছে মনে।
” অনু।”
” বাসা কোথায়?”
” ঈশাদের পাশের ফ্লাটে।”
” তোমার ফ্রেন্ড কি মরে গেছে?এমন ভাবে কাঁদছো কেন?”
বেশ গরম চোখে তাকালো ঈশান।ঈশানের ব্যবহারে তেঁতে উঠলো মীরা তবে ভয়ের দরুনে দু’কথা মুখ ফুটে বলার সাহস পেল না।অনু চোখ মুছে নির্বোধ চোখে তাকালো ঈশানের দিকে মানুষটা এমন কেন?একটা পাষাণ নিষ্ঠুর লোক।
” আরেকবার কাঁদলে তোমাকেও ওটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।একদম চুপ থাকবে।”
অনু ঘাবড়ানো চোখে তাকালো রাসেলের দিকে।রাসেল বুঝতে পেরে এগিয়ে আসে ঈশানের কাছে।
” ঈশান এত রেগে যাচ্ছিস কেন?চুপ করে বসে থাক।”
” আরে আমি তো চুপ ছিলাম এই মেয়েটা ডিস্ট্রাব করছিল।”
” ঈশান প্লিজ…”
রাসেলের কথার মাঝে নার্স এগিয়ে এলো তাদের জানিয়ে রাখলো ঈশাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে।বান্ধবীর খোঁজ পেয়ে চপল পায়ে ছুটে চলে অনু তার পেছন পেছন চলতে থাকে মীরা।রাসেল ঈশানের হাত টেনে এগিয়ে নেয় ঈশার কেবিনে।
গলার নিচের অংশে ভয়াবহ ভাবে না কাটলেও চামড়াটা বেশ বাজে ভাবে কেটে যায় ঈশার।ড্রেসিং এবং সেলাই শেষে ঈশাকে কেবিনে রাখা হয়।তার পাশে ছিল দিহান ছেলেটার চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেছে।ডাক্তার ঈশাকে বারণ করেছে অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলাই উচিত কেননা গলার চামড়ায় টান লেগে ব্যথা হতে পারে।
অনু ঈশার পাশে বসে হাউমাউ সুর তুলে কেঁদে যাচ্ছে তাকে থামকে ইশারা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ঈশা।এছাড়াও মীরা দিহান অনুকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত মুখে বসে যায় পাশের সিটে।কেবিনের এক কোনে বসে আছে ঈশান সে গেমস্ খেলায় ব্যস্ত তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাসেল।অনুর কান্নায় এবারো বিরক্ত ঈশান, যখন অনুর কান্না সবাই থামাতে ব্যর্থ সেখানে ঈশানের এক ধমকে চুপসে যায় মেয়েটা।
” স্টপ!তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে বান্ধবী বেঁচে যাওয়ায় কাঁদছো।অদ্ভুত মেয়ে।বের হও কেভিন থেকে।”
” ঈশাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”
” না গেলে এখানে চুপচাপ বসে থাকবে আর এত বিরক্ত করছো কেন?”
অনু চুপসে গেল চোখের পানি মুছে তাকালো ঈশার দিকে।ঈশা চোখ ইশারায় থামতে বলছে তাকে।ঈশানের কান্ডে পাশে দাঁড়িয়ে রাসেল নিঃশব্দে ঠোঁট টিপে হাসছে।রাসেলের হাসিতে অপমানে গা জ্বলে উঠলো অনুর তবে ঈশানের ভয়ে দ্বিতীয়বার মুখ খুললো না সে।
ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে গেল সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে।হাতে থাকা স্যানাইল শেষ পর্যায়ে এখন বাড়ি ফিরতে পারবে ঈশা।ঈশানের উপস্থিতিতে তাকে বড্ড বিরক্তিতে ফেলছে। তবে ছেলেটার ধ্যান জ্ঞান মুঠোফোনে সীমাবদ্ধ।নীরবতা মাড়িয়ে মুখ খুললো ঈশান রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” রাসেল যা লাগে ওষুধপত্র,ফ্রুটস সব কিনে এই উটকো ঝামেলাটাকে বাসায় পাঠিয়ে দে।”
‘উটকো ঝামেলা’ এত বড় অপমান!তীব্র অপমানে দাঁতে দাঁত পিষলো ঈশা।এতক্ষণ যাবৎ চুপচাপ থাকলেও গলায় টান লাগা স্বত্ত্বেও ভাঙা গলায় বলে,
” এই যে আপনি উটকো ঝামেলা কাকে বলছেন?”
” আপনাকে বলছি মিস।উটকো ঝামেলা না হলে কি দুপক্ষের মাঝে আপনার অবস্থান হয়?আমরা দুপক্ষ মিলে সবটা সমাধান করতাম কিন্তু কথায় আছে না অতি চালাকের গলায় দড়ি।সেই দিক থেকে অতি চালাকের গলায় কাটা।”
অপমান!এতো ঘোর অপমান।এই লোকটা তাকে এভাবে পদে পদে অপমান করছে।কাটা স্থানের কাঁচা ঘা নড়াচড়া হতে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো ঈশার তবুও তর্কে জয়ী হতে হলে থামা যাবে না।
” উটকো ঝামেলা আপনি।এই যে আমাদের পরিবারে ঢুকে এতটা অশান্তি বাঁধিয়েছেন।এলাকায় আমাদের নামে নিন্দা রটানোর ব্যবস্থা করেছেন।দিহান আর মীরার মাঝে ঢুকে ফাটল ধরাচ্ছেন।এর পরেও নিজেকে ভালো ভাবছেন?আপনি নিম্নশ্রেণির মানুষ আপনার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়।”
হাতে থাকা ফোনটা রাসেলের দিকে ছুড়ে উঠে দাঁড়ায় ঈশান।এই মেয়ের কতটা সাহস হলে ঈশান শাহরিয়ারের মুখে মুখে তর্ক করে।এই দুই দিনেও কি ঈশান শাহরিয়ারের ক্ষমতা সম্পর্কে সে যানে না?তবে তার সাহস কী করে হয় তর্কে জড়ানোর।
” চুপ একদম চুপ।একদম গলা টিপে মে/রে ফেলবো একটা কাক পক্ষিও জানবে না লা/শ কোথায় গুম করেছি।”
” মারবেন?মেরে দেখান তবে।”
ঈশান তেড়ে এলো তবে তার আগে রাসেল তাকে ধরে নেয়।ঈশার সামনে দুই হাত তুলে বাঁধা হয় দিহান।
” রাসেল এই উটকো ঝামেলাকে থামতে বল।আমার মাথায় কিন্তু রক্ত উঠে যাচ্ছে।এই ঝামেলাটাকে চোখের সামনে থেকে সরা।”
” একবছর পর আর একবছর পর মুখোমুখি হবো আপনার।সুধে আসলে সব টাকা ফেরত দিবো।”
” কি করে টাকা দেও আমিও দেখবো।”
” টাকা তো দিবই তবে তার আগে আমাদের জানলা যে ভেঙ্গেছেন সেই টাকার শোধ তুলে ছাড়বো।”
” রাগের মাথায় কাল তো জানলা ভেঙ্গেছি,আগামীতে তোমার হাড্ডিগুড্ডি সব ভেঙ্গে ফেলবো।এটা এই ঈশান শাহরিয়ারের চ্যালেঞ্জ।”
দুজনের চ্যাঁচামেচিতে দরজায় এসে উপস্থিত হয় নার্স সহ অনন্য স্টাফরা।কিন্তু তাদের ঝগড়া চলমান রইলো। রাসেল,অনু,দিহান কেউ তাদের থামাতে পারলো না তারা যেন একাই একশ।
৭.
কক্ষে উপস্থিত তিনজন মানব তবুও কক্ষ জুড়ে নিরবতা কারো মুখে রা নেই।ঈশানের পায়ের কাছে বসে আছে রাজীব, রাসেল পাশে বসে মোবাইল স্ক্রুলে ব্যস্ত তার কাছে আপাতত এই বিষয়টির গুরুত্ব নেই তাই তো সে নিজের মতো করে চলছে।চোখের কোনে তর্জনী এবং বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে মর্দন করে নিজেকে স্থির করলো ঈশান।মেজাজটা আজ বড্ড চটে আছে ঈশানের নিরবতায় ফোড়ন কাটলো রাজীব।
” ভাই এবারের মতো মাফ…”
রাজীব থেমে গেল তবে হাত চলতে থাকলো ঈশানের।চড়ের ঠাস ঠাস শব্দে ফোনের স্কিন থেকে চোখ তুলে তাকায় রাসেল।এক চড়ে যেখানে গালের অবস্থা করুন সেখানে আরেকটা চড় পড়া মানে ডান পাটির দাঁত বাম পাটিতে চলে আসা।নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত সরে এলো রাজীব।ঈশান ততক্ষণেও দমেনি কোমড়ে থাকা বেল্ট খুলে হাতে নিতে দ্রুত এগিয়ে আসে রাসেল।
” ভাই থাম আর মারিস না।”
” ওঁরে জিজ্ঞেস কর এত বড় সাহস তাকে কে দিয়েছে?ওঁর হাতে এন্টিকাটার এলো কোথা থেকে?”
রাজীব খানিকটা সাহস পেয়ে এগিয়ে এলো জড়িয়ে ধরলো ঈশানের পা।
” ভাই আমি বুঝতে পারিনি মেয়েটা হঠাৎ এসে যাবে।”
” মেয়েটার সাবজেক্ট বাদ তুই আমাকে বল দিহানের বিষয়ে যেখানে আমি সুরাহা করতে গেলাম সেখানে তুই এত হাতাহাতি করতে গেলি কেন?নিজেকে বড্ড লায়েক ভাবিস?ফয়দা তুলতে গেছিলি নাকি?”
” ন…না ভাই আমার কথাটা শু…”
” চুপ কর।মীরার সাথে তোর বিয়ে তো দূরের কথা মেয়েটার আশেপাশে দেখলে তোর কি যে করবো আমি চামড়া তুলে ঝুলিয়ে রাখবো।”
.
ঈশা বাসায় ফেরার পর থেকে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়েছেন মুজাহিদ হাসান এবং সুলতানা।ঈশা বাড়ি ফিরে তাদের মিথ্যা বলে যে এটা একটা এক্সিডেন।
কিন্তু তারা কিছুতেই মেনে নিতে চাইছেন না এক্সিডেন্টের কথা।মনের মাঝে যে সন্দেহ তাদের দানা বেধেছে এই সন্দেহ হয়তো কিছুতেই কমবে না।ঈশার ক্ষতির পেছনে ঈশান শাহরিয়ারের হাত নেই তো?
অনু আজ নিজের বাসায় ফেরার জন্য আগ্রহ দেখালো না।অসুস্থ ঈশার পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে থেকেই গেল।রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি গলায় আরাম অনুভবের তাগিদে বিছানায় হেলান দিয়ে কফি নিয়ে বসলো ঈশা।তার পাশে বসে খোশগল্পে মেতে ছিল অনু। সে বিরতিহীন ঈশান শাহরিয়ারের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছে।তাদের গল্পের মাঝে ঈশার ফোন আসে।নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি তিনটা বাচ্চাকে পড়ায় ঈশা এতে মাসের শেষে নিজের হাত খরচ হিসেবে টিউশনের টাকাটা কাজে আসে হঠাৎ পরপর তিনজনে ফোন করে ঈশাকে পরের দিন থেকে আসতে বারণ করে তারা জানিয়ে দেয় ঈশার কাছে আর বাচ্চা পড়াবে না।পুরোনো টিউশনি হারিয়ে ঈশা যেন বড়সড় ধাক্কা খেল।তার মাথার উপর বড় ঋণের বোঝা।এই মুহুর্তে টিউশনি হারানো মানে সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পড়া।
ফোনটা রেখে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠে ঈশা।অনু বোঝানোর পরেও মেয়েটার কান্না থামার নাম নেই।
” ঈশা আমি যা ধারণা করছি সেটাই ঠিক ঈশান শাহরিয়ার তোর এমন ক্ষতিটা করেছে।”
” তিনি জানবেন কীভাবে আমি সেই বাচ্চাদের পড়াই।”
” তুই বোকা নাকি?আজকে সে কি বললো মনে নাই?তোকে চ্যালেঞ্জ করেছে একবছরে কীভাবে টাকা পরিশোধ করিস সে দেখবে।”
.
বারান্দায় বসে গুনগুন সুরে গান গাইছে ঈশান।তার আনন্দেরা যেন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে।
” রাসেল আমার কাজ শেষ এবার একটা আরামের ঘুমের প্রয়োজন।”
” আমি বুঝলাম না আর্থিক ভাবে ঈশাদের ক্ষতি করে তোর লাভ কী?ঈশা যদি টিউশনির টাকা জমিয়ে তোর টাকার ব্যবস্থা করতে পারে এতে তোর ভালো নিজের টাকা অতি সহজে পাবি।কিন্তু তুই তাদের ইনকাম সোর্সটা এভাবে বন্ধ করছিস কেন?”
রাসেলের কড়া জবাবে কপাল কুচকালো ঈশান।ঠোঁটে থাকা সিগারেট হাতে নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিল রাসেলের মুখে।
” কিছু কিছু বিষয়ে নিজের লাভ ভাবতে নেই।আরেকটা কথা বলে রাখি ওই মেয়েটার ব্যপারে তোর কোন মতামত আমি শুনতে চাই না।”
#চলবে___
❌কার্টিসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।❌
গল্পটা কেমন হচ্ছে পাঠক মহল?