#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫
” তুমি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছো ইরহাম! ”
গর্জে উঠলেন এজাজ সাহেব। ইরহাম কিচ্ছুটি বললো না। অধরে বাঁকা রেখা ফুটিয়ে টেবিল হতে পেপার ওয়েট তুলে নিলো। এ মুহূর্তে তারা পিতা-পুত্র অবস্থান করছে এজাজ সাহেবের স্টাডি রুমে। উনি চেয়ারে বসে। নৈশভোজ সেরে কিছু দরকারি ফাইলপত্র নিরীক্ষা করছিলেন। সে মুহূর্তে উপস্থিত হলো ইরহাম। কথায় কথায় শুরু হলো দু’জনার মতবিরোধ। হাতের মুঠোয় গোলাকার পেপার ওয়েট নিয়ে খেলা করতে করতে বাবার দিকে তাকালো ইরহাম। থামলো হস্ত খেলা। অত্যন্ত শীতল স্বরে বলে উঠলো,
” একটা ক্যারেক্টারলেস ছেলের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিতে চাইছো। সেখানে লিমিট ক্রস হচ্ছে না? ”
চমকালেন এজাজ সাহেব! পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে অনমনীয় স্বরে বললেন,
” বড় ঘরের ছেলেরা জোয়ান বয়সে একটু আধটু মাস্তি করেই থাকে। একে ক্যারেক্টারলেস বলে না। ”
কঠিন স্বরে শুধালো ইরহাম,
” মাস্তি করা বলতে বিবাহ বহির্ভূত বেড শেয়ার করাও বোঝায়? ”
” ইরহাম! ” উঁচু হলো মাঝবয়সী লোকটির কণ্ঠস্বর।
ইরহাম এতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে টেবিলে রাখলো গোলাকৃতির পেপার ওয়েট টি। বেশ শান্ত স্বরে বাবার চোখে চোখ রেখে বললো,
” স্ট্যাটাসের দোহাই দিয়ে দিয়ে তোমার চোখের সামনে নকল পর্দা উঠেছে। তাই ভালোমন্দ কিছুই দেখতে পাচ্ছো না। ”
” একদম বাজে কথা বলবে না। ভুলে যেয়ো না ইনু তোমার বোন হওয়ার আগে আমার মেয়ে। কোনো বাবাই তার মেয়ের মন্দ চায় না। ”
কেমন অদ্ভুতুড়ে হাসলো ইরহাম। সে হাসিতে জ্ব’লে উঠলো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন এজাজ সাহেব। ছেলে ওনার চরম অবাধ্য এবং বেয়াদব হয়ে গেছে। কারোর ধার ধারে না।
” তোমার যা করার করছো। আমিও সেটাই করবো যেটা আমি ভেবেছি। ”
” তুমি কি… ”
আর জিজ্ঞেস করা গেল না। ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইরহাম। বাবা নামক মানুষটির একবিন্দু পরামর্শ তার চাই না। অ”হংকার, দা”ম্ভিকতা ছড়িয়ে পড়েছে ওনার শিরায় উপশিরায়। বদলে যাওয়া মানুষটি আরো বদলে যাচ্ছে। যা কারোর কাম্য নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক! মানুষটি তার জন্মদাতা পিতা মাঝেমধ্যে ভাবতেও অবাক লাগে! এত অহং!
•
সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইনায়া। ডান পাশে হৃদি। ওর হিজাবটি সুন্দর রূপে পরিপাটি করে দিলো। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো। কোমল স্বরে বললো,
” এসব না করলেই নয়? ”
অক্ষিকোলে পানি জমলো। তা গোপন করে শুকনো ঢোক গিললো ইনায়া। বললো,
” জানি না ভাবী এ কোন সর্বনা’শা খেলায় মেতেছি আমি। কোথায় এর শেষ। খেলতে খেলতে এই আমিটাই না নিঃশেষ হয়ে যাই। ”
ত্বরিত অপ্রয়োজনীয় শব্দমালায় বাঁধা দিলো হৃদি,
” ইশ্! কিসব বলছো? চুপ করো। একটু ভরসা রাখো আল্লাহ্’র ওপর। আমাদের ওপর। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
বেদনার ছাপ স্পষ্ট হলো চোখেমুখে। ইনায়ার মন বলে উঠলো, ভাবী তুমি ভুল ভাবছো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কিচ্ছুটি ঠিক হবে না। এ জনমে রাহি ভাইয়া আর আমার হলো না। হলো না তার বুকে মাথা রেখে সুখদুঃখ ভাগ করা। হয়তো পরকালে..! চক্ষু ছাপিয়ে অশ্রু নামলো। দ্রুততার সহিত ডান হাতে অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো ইনায়া। মেকি হেসে বললো,
” ভাবী আসছি তাহলে। আসসালামু আলাইকুম। ”
ওর গালে হাত রেখে হৃদি বললো,
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। সাবধানে যেয়ো। কোনোরকম সমস্যা হলেই ইমিডিয়েটলি কল করবে। ঠিক আছে? ”
মাথা নাড়ল ইনায়া। ভাবীর থেকে বিদায় নিয়ে ধীরপায়ে ঘর হতে বেরিয়ে গেল। যাচ্ছে আজ হবু বরের সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় সাক্ষাৎ করতে। দুপুরে একসাথে মধ্যাহ্নভোজ করবে তারা। এমনটা জুনায়েদ শিকদার কর্তৃক পূর্ব পরিকল্পিত। সে শুধু কলের পুতুলের ন্যায় যাচ্ছে। মন তো পড়ে অন্যত্র।
•
” মা এসব হচ্ছেটা কি? এবার কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? ”
বিরক্তি প্রকাশ করলো হৃদি। সোফায় বসে শাশুড়ি- বৌমা যুগল। মালিহা এবং রাজেদা খানম। তারাও বোধহীন হয়ে বসে। বুঝে উঠতে পারছে না কি থেকে কি বলবে। কি করবে।
গোধূলি লগ্ন। পশ্চিম দিগন্তে ডুবন্ত রবি’র মোহনীয় রূপে আকর্ষণীয় লাগছে চারিদিক! ইনায়া সে-ই দুপুরে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে কল করেছিল। বাড়ির কাছাকাছি রয়েছে। ফিরছে সে। তন্মধ্যে এই নয়া ঝামেলা। এগিয়ে আনা হয়েছে ইনায়া এবং জুনায়েদের আকদ এর তারিখ। আগামী মাসের তেরো তারিখ আকদের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ পঁচিশ দিন পর। সেটা আরো এগিয়ে আনা হয়েছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে আগামী সপ্তাহে হতে চলেছে আকদ। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্বয়ং এজাজ সাহেব। বিকেলের দিকে স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন উনি। জানালেন ওনার আকস্মিক সিদ্ধান্ত। এতে চরম আশ্চর্যান্বিত ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর সদস্যরা। ফোনালাপের সময় হতবিহ্বল হয়ে একপ্রকার বোবা হয়ে গিয়েছিলেন মালিহা। বলতে পারলেন না কিছুই। প্রতিবাদ তো দূরের কথা। চিরাচরিত কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী এই নারী বরাবরই শান্ত। স্বামীর অনুগত। তাই আগেও পারেনি স্বামীর মুখের ওপর কথা বলতে, নিজের অধিকার খাটিয়ে দু’টো প্রতিবাদ করতে। আজও পারলো না। চুপচাপ মেনে নিলো সবটা। আসলেই কি তাই? নাকি এবার ভিন্নতা আসতে চলেছে? হুঁ?
” তুই চিন্তা করিছ না বুইন। আইজ এজাজ ঘরে আউক। অর লগে আমার কথা আছে। শুরু করছে ডা কি এইসব? মঞ্চনাটক পাইছে নি? ”
অসন্তোষ ঝড়ে পড়লো রাজেদা খানমের কণ্ঠে। হৃদি তখন অন্য ভাবনায় ডুবে। ইরহাম ফিরলে এই নিয়ে আজ কথা বলতেই হবে। এসব আর মেনে নেয়া যাচ্ছে না। কেন অপূর্ণ থাকবে দু’জনের অব্যক্ত অনুভূতি!
•
নিশুতি রাত। নিশ্চুপ চারিদিক। ঘড়ির কাঁটা তখন একের কাছাকাছি। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে মেয়েটি। চোখে জমায়িত নোনাজল এখন চিবুক গড়িয়ে গ্ৰীবায় (গলায়) ধাবিত হচ্ছে। লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে দু চোখ। অন্তরে বিষাদের সুর বেজে বেজে উঠছে। চক্ষুতারায় ভেসে উঠছে এক লোলুপ দৃষ্টি।
হয়তো বয়স কম। তবুও মেয়ে সে। ইন্দ্রিয় শক্তি জানান দেয় কোন পুরুষের চাহনিতে কি প্রকাশ পাচ্ছে। আজ তার ইন্দ্রিয় শক্তি বারবার তাকে সতর্ক করেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে তোর বিপরীতে বসে থাকা জুনায়েদ এক মুখোশধারী। তার চরিত্র সুবিধার নয়। চাহনিতে প্রকাশ পায় লোলুপ ভাব। কথার ফাঁকে ফাঁকে কমনীয় দেহের আনাচে কানাচে চক্ষু সফর কিংবা মাঝেমধ্যে হাত ধরার বাহানা খোঁজা। এগুলো সুপুরুষের লক্ষণ নয়। বরং! বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে ইনুর। জেদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ কি করে ফেললো সে! রাহি ভাইয়ার ওপর রাগ কিংবা সুপ্ত অভিমান দেখাতে গিয়ে এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। অবুঝের মতো আগেপিছে না ভেবে সরাসরি সম্মতি। ভাবেনি এর ভবিষ্যৎ কি হতে পারে। আজ প্রথমবারের মতো ওই জুনায়েদ নামক মানুষটির সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ। রেস্তোরাঁর মতো পাবলিক প্লেসে যার চরিত্রে অমন ভাবভঙ্গি ফুটে ওঠে না জানি নিরালায় সে কোন রূপে অবতীর্ণ হবে। আচ্ছা বিয়েটা যদি সত্যি সত্যিই হয়ে যায় তখন? তখন কি হবে? তখন তো শুধুমাত্র চক্ষু নয় গোটা মানুষটি ডুব দেবে তার দেহবল্লরীতে। কি করে সইবে সে অনাকাঙ্ক্ষিত-ঘৃণ্য স্পর্শ! সে মনেপ্রাণে যে একজনার ই অস্তিত্ব চিরকাল কল্পনা করে এসেছে। সে বিহীন অন্য কারোর ছোঁয়া বি-ষধর রূপে দং শ ন কি করবে না? করবে তো। তনুমনে কারোর বি-ষাক্ত ছো”বল সয়ে বাঁচবে কি করে সে? এর চেয়ে কি ম”রণ শ্রেয় নয়। না না। জীবনে যা কিছু হয়ে যাক না কেন মৃ ত্যু যথার্থ সমাধান হতে পারে না। আ-ত্মহনন মহাপাপ। এর কোনো ক্ষমা নেই। নিঃসন্দেহে আত্মহ”ত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। ভীতি কিংবা কাপুরুষোচিত আচরণের বহিঃপ্রকাশ। সে তো কাপুরুষ হতে চায়নি। চেয়েছে শুধু স্বপ্নের নায়কের একবিন্দু ভালোবাসা! খুব বেশি চেয়ে ফেলেছিল বুঝি! তাই তো আজ এই দুরাবস্থা!
হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো ইনায়া। বালিশে লুকালো মুখ। আঁধার রাতে তার সবটুকু যন্ত্রণা, ক্লেশ সকলের অগোচরে রয়ে গেল। জানলো না দেখলো না কেউই। এদের ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে! শেষমেষ জুনায়েদ নামক এক চরিত্রহীন ই লেখা তার ভাগ্যে!
•
স্বামীর পানে অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে হৃদি। তাতে কি মানুষটির বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ রয়েছে? সে তো দাঁড়িয়ে আরশির সম্মুখে। বাহিরে যাওয়ার জন্য ভুংভাং বাবু সেজে নিচ্ছে।
” আপনি কিন্তু আমার কথাটা শুনছেন না। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। বিষয়টা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। ”
হাতে ঘড়ি গলিয়ে ইরহাম ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
” এখন সময় নেই মিসেস শেখ। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। যেতে হবে। ”
” এইরকম বাহানা দিয়ে গতকাল রাতেও শুনলেন না। ফিরলেন অত রাতে। কোনোমতে নাকেমুখে খেয়েই ঘুম। বলেছিলেন সকালে শুনবেন। এখন আবার নতুন বাহানা! ”
পকেটে দরকারি জিনিসপত্র পুরে নেয়ার ফাঁকে ইরহাম পরিচিত গম্ভীর স্বরে বললো,
” আসলেই বিজি আছি হৃদি। বোঝার চেষ্টা করো। ”
” আপনিই তো বুঝতে চাইছেন না। ”
অভিমানিনীর চওড়া অভিমান হলো। ফিটফাট হয়ে আরশিতে নিজেকে একঝলক দেখে নিলো মানুষটি। অতঃপর তাকালো অর্ধাঙ্গীর পানে। অবনত মস্তকে একাকী বিড়বিড়িয়ে চলেছে বুঝি! মুচকি হেসে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো ইরহাম। পুরুষালি ডান হাতটি রাখলো স্ত্রীর কপোলে। ললাটে চুম্বন করতে উদ্যত হতেই অভিমানী কন্যা মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিঃশব্দে নজরকাড়া হাসলো মানুষটি। স্ত্রীর অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করে চুম্বন এঁকে দিলো ললাটের ত্বকে। একটু হলেও গলে গেল কি অভিমান! উঁহু! এক চিমটি পরিমাণও নয়।
” আসছি তাহলে। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
মিহি স্বরে সালামের জবাব দিলো মেয়েটি। ইরহাম হাতঘড়িতে সময় দেখে ব্যস্ত পায়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল। তার গমন পথে শূন্য চাহনিতে তাকিয়ে হৃদি।
•
প্রথমবারের মতো নে শায় বুঁদ হয়ে দুঃখ বিলাস করছিল ছেলেটি। আকস্মিক এক দুর্দান্ত শট। বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রাহিদ। টলে উঠলো দেহ। এটা কি হলো? সে কি নে”শার ঘোরে ওলটপালট দেখছে!
চলবে.
[ ছোট পর্ব আজ। চমক থাকছে কাল। কেমন লাগলো পর্বটি? আর নয় রষকষহীন পর্ব। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]
📌 আসসালামু আলাইকুম পাঠক বন্ধুরা….
লেখিকার লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে মতামত পেশ করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে…
গ্রুপ লিংক 🍁
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share