#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৩
মৃদু আলোয় উজ্জ্বল বদ্ধ ঘর। মাথার ওপরে টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। হলদে আলো ছুঁয়ে রয়েছে দেহ। দেয়াল ঘেঁষে বসে সে সর্বহারা ব্যক্তি। নাম তার জহির। কয়েক হাত দূরেই মেঝেতে অবহেলিত রূপে পড়ে স্টিলের থালা। তাতে নৈশভোজের খাদ্য। দু’টো রুটি তা-ও হালকা কালচে রঙা। আর হলুদ পানিতে গোলানো নামমাত্র ডাল। তিনদিকে দেয়ালের বাঁধা। সম্মুখে লোহার শক্তপোক্ত আস্তরন। বন্দী হয়ে কাটছে দিবারাত্রি। একদিন আরাম আয়েশ, আভিজাত্য, অর্থের লো ভে পড়ে অবৈধ পথ বেছে নিয়েছিলেন। আজ সে-ই অবৈধ রাস্তা তাকে লৌহ ঘেরাটোপে বন্দী করে ফেললো। একের পর এক কেস ফাইল হয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক ভাবেই আন্দাজ করা যাচ্ছে এত দ্রুত মিলবে না ছাড়। সমস্ত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে করতে মৃ:ত্যু না দেখা দেয়। কেড়ে নেয় অমূল্য প্রাণ। আজ এতটা দুর্দশা, অপমান, সম্মানহানি…! একটুও কি অনুতপ্ত জহির আহসান? নাহ্। এখনো অনুতপ্ত নয় লোকটি। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে প্রতিশোধস্পৃহা। ওই ইরহাম চৌধুরী আর নিজ কুপুত্রের জন্য জীবনটা শেষ হয়ে গেল। দেখা মিললো এই করুণ পরিণতির। অপমান, সম্মানহানি, কারাবন্দী জীবন। সব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এই স্পর্ধা, দুঃসাহসের জন্য কাউকে ছাড়বেন না উনি। কাউকে না। এরা কতদিন আঁটকে রাখবে ওনায়? হুঁ? একবছর, পাঁচবছর নাকি দশ বছর? একদিন না একদিন নিশ্চয়ই বেড়োবেন উনি। নিজ হাতে বুঝিয়ে দেবেন জহির আহসান ঠিক কতটা নি-ষ্ঠুর! এই নির্মম দু হাতে সে কি কি করতে সক্ষম হাতেকলমে বুঝিয়ে দেবেন। এলোমেলো ভাবনাগুলো অকস্মাৎ ভেঙ্গে গেল। শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর,
” খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে উপোস করা হচ্ছে? কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? বউয়ের শোকে নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে ফেলেছেন? ”
চমকিত নেত্রে সম্মুখে তাকালেন জহির সাহেব! এ কাকে দেখছেন উনি! সত্যিই সে দণ্ডায়মান! নাকি এ অভাবনীয় স্বপ্ন! স্বপ্ন যেন সত্যি হয়। উনি এই মুহুর্তটুকু মন ভরে উপভোগ করতে চান। ছেলে ওনার পিতার বিপদে এগিয়ে এসেছে। এ যে ওনার চরম সৌভাগ্য! সত্যিই কি তার রাহিদ দাঁড়িয়ে! হাঁ। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে রাহিদ। মুখাবয়ব কাঠিন্যতায় মোড়ানো। জন্মদাতা পিতাকে কারাবন্দী দেখেও আজ নেই কোনোরূপ সহানুভূতিশীল অনুভূতি। ওই দু চোখে নেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। আছে শুধু এক সমুদ্র ঘৃণা। জহির সাহেব সবটুকু উপলব্ধি করতে পারছেন। লহমায় ধক করে উঠলো বক্ষস্থল। নিজ কুকর্মে আজ সর্বহারা সে। ছেলের কাছে পরিচিত এক নি-ষ্ঠুর পশু হিসেবে। বাপ হিসেবে নেই বিন্দুতুল্য ছাড়। সহানুভূতি তো দূর কি বাত। মানুষটির দু চোখে প্রকাশ পেল কাতরতা। করুণ বদনে আস্তে ধীরে দেয়ালে হাত রাখলেন। দেয়ালে হাতের ভারসাম্য বজায় ছেড়ে মন্থর গতিতে উঠে দাঁড়ালেন উনি। রাহিদ সবটাই দেখলো। মুখশ্রীতে কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। একই অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে। জহির সাহেব ধীরপায়ে অগ্রসর হলেন পুত্রের দিকে। একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পিতা ও পুত্র। মধ্যখানে লোহার শিকের ব্যবধান। চোখে চোখ পড়লো দু’জনার। জহির সাহেব যথাসম্ভব অসন্তুষ্ট কণ্ঠে শুধোলেন,
” এখানে কি চাই? অন্ধকার জেলে বাপ কেমন আছে মজা দেখতে এসেছো? ”
” দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আপনার মতো লোকের চেহারা দর্শন করে কোনো মজা পাওয়া যায় না। হয় শুধু আফসোস। পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে আপনার মতো একটা পশুকেই আমার বাবা হতে হলো? ”
অত্যন্ত নি-ষ্ঠুর ছিল সে শব্দমালা। বুকের বাঁ পাশে অবলীলায় র:ক্তক্ষরণ ঘটালো। আঁধার ঘনিয়ে এলো চেহারায়। তবে তা বহিঃপ্রকাশ করলেন না। বরং তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠলেন জহির সাহেব,
” মুখ সামলে কথা বলো রাহিদ। জেলে আছি বলি পঙ্গু হয়ে যাইনি। কু-লাঙ্গার বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে আকাশে উড়ছো তো? সাবধান। জমিনে মুখ থুবড়ে পড়তে সময় লাগবে না। ”
কেমন বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো রাহিদ। শব্দহীন হাসি। জহির সাহেব ক্রু-দ্ধ নয়নে তা অবলোকন করে চলেছেন। ভেতরটা জ্ব’লেপুড়ে হচ্ছে ছারখার। নিজের র ক্ত আজ বে-ইমানি করছে! এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে?
” মুখ থুবড়ে পড়বো! কেমন করে? ঠিক আপনার মতো? ” ব্যাঙ্গ করে শুধালো রাহিদ।
জহির সাহেব বি:ষাক্ত সাপের ন্যায় হিসহিস করে চলেছেন। অপেক্ষায় মোক্ষম সময়ে ছো”বল মা:রার। উত্তর না পেয়ে রাহিদ বিদ্রুপাত্মক হাসি উপহার দিলো। এই মানুষটি শুধরে যাওয়ার নয়। আমৃ”ত্যু একই থাকবে। নির্দয়-নিষ্ঠুর। রাহিদ ভোলেনি কয়েক রাত পূর্বের সে-ই বর্বর দৃশ্যপট। চোখের সামনে পড়ে ছিল র ক্তা ক্ত মায়ের দেহটি। সে সন্ধ্যায় মা’কে কল করেছিল নিত্যদিনের মতো খোঁজখবর নেয়ার জন্য। স্বপ্নেও ভাবেনি ফোনকলের মাধ্যমে পিতার অত্যধিক ক্রু র রূপটি ধরা দেবে। ফোনে সংযুক্ত ছিল রাহিদ। মায়ের সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা হয়ে ওঠেনি। তবে স্পষ্ট রূপে শুনেছে বাবা নামক লোকটির কুটিলতা। শুনেছে তার মায়ের প্রতিটি আর্তনাদ। ছিঁড়ে আধখান হয়েছে কানের পর্দা। সে কি আর্তনাদ মায়ের! বাঁচার জন্য আকুতিমিনতি! বাড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে ছিল সে। একটা কাজে এসেছিল। তাই তো সময়মতো বাড়ি ছুটে আসতে পেরেছিল। নইলে স্বামীর বাঁধভাঙা প্রহারে মা;রা পড়তো তার জন্মদাত্রী-মমতাময়ী মা। বাড়ি পৌঁছানোর ফাঁকে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে ভোলেনি রাহিদ। আল্লাহ্ সহায় ছিলেন তাই তো প্রাণে বেঁচে গেছে মা। কল রেকর্ডে লোকটার স্বীকারোক্তি বন্দী হয়েছে। সে-ই ছোট্ট কল রেকর্ড এর সূত্র ধরে ইরহাম ভাইয়া পেয়েছে হৃদি ভাবী সম্পর্কে ক্লু। ধরা পড়েছে এই লো’ভাতুর আত্মা। সে-ই নির্মমতা আজও নিদ্রায় তাড়া করে বেড়ায়। আর এক ফোঁটাও নি:ষ্ঠুরতা সহ্য করার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। এবার সব শেষ করে তবেই ক্ষ্যা’ন্ত হবে ছেলেটা।
রাহিদ কাঁধে থাকা ব্যাগটি নামিয়ে হাতে নিলো। দ্রুত হস্তে খুলে ফেললো ব্যাগের চেইন। বের করলো সফেদ রঙা এক ডকুমেন্ট। কিসের কাগজ এটি? জহির সাহেব কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। রাহিদ একটি কলম বের করে কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে নিলো। ডকুমেন্ট আকারের কাগজ ও কলম বাড়িয়ে দিলো অপরাধী বাবার নিকটে। মধ্যখানে কারাগারের বাঁধা। জহির সাহেব ওগুলো হাতে নিলেন না। বরং প্রশ্ন করলেন,
” এটা কি? ”
” ডিভোর্স পেপার। ”
ব’জ্রাহত চাহনিতে তাকিয়ে জহির সাহেব! এসব কি শুনছেন উনি? ডিভোর্স পেপার! ছেলে ওনার অতি শোকে পা গ ল হয়ে যায়নি তো? উল্টোপাল্টা কিসব বলছে! বক্র হাসলো রাহিদ।
” এমন রিয়েকশন দিচ্ছেন যে? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা। খুশিতে নৃত্য করা উচিত। আফটার অল জীবন থেকে এক আপদ বিদায় নিচ্ছে। এবার আপনি জেলে বসে আপনার ওই সো কল্ড প্রেমিকা থুরি পি.এ মারিয়ার সাথে রাশলীলা করবেন নাকি রঙ্গলীলা, উই ডোন্ট কেয়ার। শুধু সাইনটা করেন আমাদের মুক্তির দিন। আফসোস এটাই যে আপনার মতো এক নষ্ট পুরুষকে ভালোবেসে আমার মায়ের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সর্বহারা আজ সে। আর কিছু হারানোর মতো অবস্থায় নেই। তাই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও ওই নারীকে দয়া করুন। ডিভোর্স পেপারে সাইনটা করে দিন। মুক্তি দিন মা’কে। ”
” যদি না দেই? ” দাঁতে দাঁত চেপে শুধোলেন জহির সাহেব।
দুর্বোধ্য হাসলো রাহিদ,
” বাধ্য করবো। আপনার জন্য কাপুরুষের জন্য আমার মা আর এক ফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন দেবে না। মায়ের ছেলে হিসেবে এ আমার প্রতিশ্রুতি। ”
জোরালো গম্ভীর স্বরে ভড়কে গেলেন জহির সাহেব। আজ এ কি দৃশ্য দেখছেন উনি? ছেলে ওনার এতখানি বদলে গেছে! প্রতিটি বাক্যে কঠোরতার ছাপ। কাট-কাট অবিচল কণ্ঠস্বর। এতটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব? বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উনি বলে উঠলেন,
” ভেবেচিন্তে বলছো তো? ডিভোর্স হয়ে গেলে আমার সহায়সম্পত্তির কানাকড়িও পাবে না কিন্তু। তোমাকে আমি ত্যাজ্য পুত্র.. ”
আর বলা হলো না। দু পা পিছিয়ে গেল রাহিদ। পিতার পানে তাকিয়ে অসন্তুষ্ট অথচ দৃঢ় স্বরে বললো,
” আপনি কি ত্যাজ্য করবেন? আজ এ মুহূর্তে আপনাকে আমি ত্যাজ্য পিতা করলাম জহির আহসান। ”
সে স্থানে যেন গগন কাঁপানো বজ্রপাত হলো। স্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে পিতা। ছেলে ওনার এতবড় কথাটা বলতে পারলো? একটুও বুক কাঁপলো না? নির্দয় রূপে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেললো! এতটাই ঘৃণ্য উনি! রাহিদ বলে চলেছে,
” আপনার সাথে মায়ের ডিভোর্স তো নামমাত্র সামান্য ফর্মালিটিজ। আমাদের মন থেকে আপনি অনেক আগেই আউট হয়ে গেছেন। ভাবলেন কি করে আপনার ওই হারাম পয়সায় আমাদের ইন্টারেস্ট আছে? থাকুন আপনি আপনার ওই হারাম সহায় সম্বল নিয়ে। তার আগে আমাদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন। ”
এই ছিল শেষ কথা। পিতার অবয়ব বরাবর ডিভোর্স পেপার এবং কলম ছুঁড়ে দিলো রাহিদ। কাগজের ঝাপটানি ছুঁয়ে গেল বুক বরাবর লোহার শিক। কলম আছড়ে পড়লো মেঝেতে। অদ্ভুতুড়ে শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। পিছু ঘুরে তাকালো না নির্দয় পুত্র। কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে বড় বড় কদম ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো। রয়ে গেল এক একাকী ব্যক্তি। অপরাধী সত্তা কেড়ে নিয়েছে যার সবটুকু। আজ প্রকৃতপক্ষে সর্বহারা সে। কিচ্ছু নেই। এতবড় দুনিয়ায় একাকী সে।
•
‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ বসেছে আজ আনন্দমেলা। ব্যস্ত সময় পাড় করছেন মালিহা, রায়না, নাজরিন, নীতি, নিদিশা। যেকোনো মুহূর্তে এসে পৌঁছাবে বাড়ির গর্ব, তাদের আদরের হৃদি। পুত্রবধূকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত মালিহা। অবশেষে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত। গাড়ির হর্ন প্রবেশ করলো শ্রবণেন্দ্রিয়ে। খুশিতে আটখানা হয়ে ছুটে গেল রায়না ও নিদিশা। উন্মুক্ত হলো সদর দরজা। অপেক্ষারত সকলে। উপস্থিত দুই পরিবারের সদস্যরা। কিয়ৎক্ষণ বাদে সকলের অপেক্ষার অবসান হলো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো উজ্জ্বলতা। ফিরে এসেছে বাড়ির মেয়ে। তাদের হৃদি। তবে অভাবনীয় দৃশ্যে চমকালো সব! শ্বেতশুভ্র বেশধারী ইরহাম প্রবেশ করেছে অভ্যন্তরে। তার শক্তপোক্ত বাহুতে আবদ্ধ সঙ্গিনী। পাঁজাকোলে ঠাঁই মিলেছে হৃদির। লাজে রাঙা মেয়েটি। বারংবার উশখুশ করছে নামিয়ে দেয়ার জন্য। বড়রা, ছোটরা সবাই উপস্থিত। কি ভাবছে তারা! বেপরোয়া-বেলাজ পুরুষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করলে তো? নিজ কর্মে লিপ্ত রইলো। অন্দরে উপস্থিত হলো তারা দু’জন। যতন করে স্ত্রীকে সোফায় বসিয়ে দিলো মানুষটি। বরাবরের মতোই মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য বিদ্যমান। রাহিদ ও ইনায়া দু পাশ হতে হাত ধরে পল্লবীকে নিয়ে আস্তে ধীরে হেঁটে ভেতরে এলো। নীতি ও রায়না এগিয়ে গেল। ওনায় হাত ধরে সোফায় বসতে সহায়তা করলো। মালিহা ও ফারহানা চঞ্চল পায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন। হাতে ট্রে। তাতে ইস্পি ড্রিংক এবং পানি। যে যেটা পছন্দ করে আর কি। মালিহা ট্রে বাড়িয়ে কোমল স্বরে বললেন,
” ভাবী, হৃদি! এই নাও। পানি খাবে নাকি শরবত? ”
হৃদি নরম স্বরে বললো,
” মা আমরা ঠিক আছি। অস্থির হয়ো না। তুমি বসো তো পাশে। ”
মালিহা মৃদু হেসে বললেন,
” সোনা মা আমার। আমরা ঠিক আছি। তুই একটু ইস্পি খা। ভালো লাগবে। এই নে। ”
ওর হাতে ইস্পির গ্লাস দিলেন। থুতনিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে চুমু এঁকে দিলেন মালিহা। হৃদি লজ্জালু হাসি উপহার দিলো। মালিহা হাস্য বদনে ভাবীর হাতে ঠাণ্ডা পানির গ্লাস দিয়ে ওনার খোঁজখবর নিতে লাগলেন। হৃদি ইস্পির গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আপনজনদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। কতদিন বাদে একত্রিত হয়েছে সকলে। আবার দেখছে তাদের। ভেবেছিল আর বুঝি দেখা হবে না। ইউরোপের বুকেই হারিয়ে যাবে এক হৃদি। তবে আলহামদুলিল্লাহি আলা কু’ল্লি হাল। রাসূল ( সাঃ ) বলেছেন,
‘মুমিনের ব্যাপারটি কতই না বিস্ময়কর! তার সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর, এটা মুমিন ছাড়া আর কারো জন্য হয় না। যদি তার কোন মঙ্গল স্পর্শ করে, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যখন তাকে কোন মন্দ স্পর্শ করে, তখন সে ধৈর্য ধারণ করে। আর এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৯; মিশকাত, হা/৫২৯৭)
ধৈর্য ধারণ করে আজ সফলকাম হৃদি। ফিরে এসেছে আপনজনের কাছে। সকল প্রশংসা মহান রবের। হৃদির দু চোখে জমলো বাষ্প। অধরকোলে ফুটে তৃপ্তির আভা। মিষ্টিমধুর আলাপণে হঠাৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো ইরহাম। এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে বউপাখিটির চঞ্চলতা, হাসিমুখ উপভোগ করছিল। তবে আর নয়। বিশ্রাম প্রয়োজন। শরীর এখনো দুর্বল। তাই বরাবরের মতো গম্ভীর স্বরে বললো,
” মামী, হৃদি! পড়ে কথাবার্তা বলবে। এখন রুমে চলো। রেস্ট দরকার। ডক্টর কি বলেছে আশা করি মনে আছে? ”
হৃদি করুণ চোখে তাকিয়ে। সে এখুনি ঘরে যেতে ইচ্ছুক নয়। আরো থাকতে চায়। ফারহানা মেয়ের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলেন। তাই তো মেয়ের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এগিয়ে এলেন। ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে বললেন,
” রাত অবধি আমরা এখানেই আছি মা। যা রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নে। চনমনে শরীরে সন্ধ্যায় নাহয় আড্ডা দিস? ”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হলো হৃদি। আহ্লাদী সুরে বললো,
” ঠিক আছে। তোমরা কিন্তু যাবে না। এখানেই থাকবে।”
” আচ্ছা মা। আমরা আছি। তুই রুমে যা। বিশ্রাম দরকার। ”
ইরহামের ইশারা পেয়ে রায়না ও নিদিশা এগিয়ে এলো। ওরা দু’জনে মিলে হৃদির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে ওকে নিয়ে দোতলায় অগ্রসর হলো। ইরহাম ও রাহিদ পল্লবীকে নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে রওনা হলো। সুস্থ না হওয়া অবদি পল্লবী এখানেই থাকবেন। তারপর নাহয় ছেলের সংসারে ঠাঁই হবে ওনার। স্বামী তো আজ থেকেও নেই। এখন একমাত্র পুত্র ই আশ্রয়স্থল। চৌধুরী পরিবার অবশ্য রয়েছে। তবে উনি আর কারোর করুণার পাত্রী হতে চান না। ওনার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছে ইরহাম ও তার পরিবার। তাই কিছুদিন পর পল্লবী ছেলের নতুন আবাসে চলে যাবেন। সেথায় গড়ে উঠবে নতুন সংসার। রাহিদ, ইনায়া, পল্লবী এবং রায়না। ছোট পরিবার।
.
বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে হৃদি। ঘন্টা দুয়েক পূর্বে নৈশভোজ সেরেছে। তারপর থেকে শয়নকক্ষে। বিশ্রাম নিচ্ছে এবং আদুরে ননদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। দু পাশে বসে ইনায়া ও রায়না। বাবার বাড়ির লোকেরা নৈশভোজ সেরে ফিরে গিয়েছে। নীতি ও নিদিশা বলেছে আগামীকাল আবার আসবে। কিন্তু বড় আপু? সে কেমন গুমোট হয়ে ছিল। কোনো কারণে কি মন খারাপ?
” অ্যাই ভাবী? যে ডক্টর রোজ তোমার কেবিনে রাউন্ডে আসতো তার নাম কি যেন? ”
হৃদি তাকালো ইনায়ার দিকে। কিছু একটা ভেবে দুষ্টু হেসে বললো,
” স্যরি ডিয়ার। নাম বলতে অপারগ আমি। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। ভুলে গেছো কি? সো পরপুরুষে নো হাঙ্কিপাঙ্কি। ওকে? ”
থতমত খেল ইনায়া। ত্বরিত বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো,
” আসতাগফিরুল্লাহ্! এসব কি খাতারনাক কথাবার্তা বলছো ভাবী? তোমাদের প্রিয় রাহি ভাইয়া যদি জানতে পারে না? আমার দুই চোখ রীতিমতো তুলে নেবে। এরপর মার্বেল খেলবে। ”
হৃদি ও রায়না ফিক করে হেসে উঠলো। রাহিদ কি আসলেই প্রিয়তমার সঙ্গে এমনটি করতে পারবে? অসম্ভব। রায়না দৃঢ় স্বরে বললো,
” ভাবীপু। তুমি কিন্তু আমার সহজ-সরল মাসুম ভাইয়ের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছো। আমার ভাই ভদ্রলোক। সাইকো না যে কেউ তার বউয়ের দিকে তাকালে চোখ তুলে নেবে। ”
ইনায়া তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালো,
” এক মিনিট। এক মিনিট। আমি কখন বললাম যে সেই ডক্টর আমার দিকে তাকিয়ে থাকে? আমি তো তোমার জন্য জিজ্ঞেস করছিলাম। ”
শেষের কথাটা দুষ্টু হেসে বললো ইনায়া। রায়না বিস্ময়ে বাকশূন্য! ভাবীপু এসব কি বলছে! হৃদি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” ইনু! এসব কি শুনছি? কেচ্ছা সত্যি নাকি? ”
ইনায়া আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,
” পঁচাশি পার্সেন্ট সত্য। ওই হ্যান্ডসাম ডক্টর কেবিনে এসে রোগী মানে তোমাকে কম রায়নাপু’কে দেখতো বেশি। ”
মুখ টিপে হাসছে ইনু। রায়না থতমত খেল। লাজে লাল হলো গাল। এ কেমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি! লুচু ডক্টর আসলেই এমনটি করতো? কই? সে তো লক্ষ্য করেনি!
” ইশ্। কিসব বলছো তুমি? মোটেও এমনটা হয়নি। ”
রায়না মানতে নারাজ। হৃদি শব্দহীন হেসে উঠলো। দুষ্টুমির ছলে শুধালো,
” কি গো নন্দিনী? কেয়া চাল রাহা হ্যায়? সম্বন্ধ ঠিক করবো কি? হা? ”
সম্বন্ধ! নো ওয়ে। রায়না তৎক্ষণাৎ লাজশরম বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদ জানালো,
” একদমই না। আমার ওই ডক্টর মক্টর পছন্দ না। রোগী দেখতে দেখতে ওরা সব পাথর দিলের হয়। আমার তো.. অফিসওয়ালা হ্যান্ডসাম চাই। ”
শেষোক্ত কথাটায় কেমন লাজুকতা প্রকাশ পেল। টোন করে বলে উঠলো হৃদি-ইনায়া,
” ওহ্ আচ্ছা? ”
” কর্পোরেট হ্যান্ডু চাই তাই তো? ঠিক আছে। তোমাদের ভাইয়া ফিরুক। বলবো নে। ”
হৃদির কথায় আঁতকে উঠলো রায়না। দ্রুততার সহিত দু হাতের মুঠোয় ভাবীর কোমল হাতটি বন্দী করে করুণ স্বরে বললো,
” ভাবী। মে রে দেবে নাকি? আমি তো এখনো বাচ্চা। কিয়ের বিয়েশাদী? আমি এখনো ফিডার খাই বুঝেছো? ভুল করেও ইরু ভাইয়াকে এসব বলবে না। ভাইয়া শুনলে কি ভাববে বলো তো? যে তার ভদ্র সভ্য রায়ু বোন এতটা বেশরম? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ভুল করেও এসব বলতে যেয়ো না। ”
” কি বলতে নিষেধ করা হচ্ছে? ”
গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর ধাক্কা দিলো ওদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সর্বনা’শ! ভীত দৃষ্টিতে দরজা বরাবর তাকালো রায়না। ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ইরহাম। হৃদি ও ইনায়া একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মিটিমিটি হাসছে। রায়না ত্বরিত লাফ দিয়ে বিছানা হতে নেমে এলো। ইরহাম সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে। ধীরপায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। রায়না কি বলবে কি বলবে ভাবতে ভাবতে শেষমেষ লম্বা করে সালাম দিলো,
” আ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছো? ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্। তোর কি খবর? ”
ঘন্টাখানেক আগেও দেখাসাক্ষাৎ হলো। এখন সৌজন্যতার খাতিরে কুশল বিনিময় করতে হচ্ছে মানুষটিকে। রায়না বোকা হেসে বললো,
” আমিও আলহামদুলিল্লাহ্। তোমরা তাহলে থাকো। আমি আসছি কেমন? বাই বাই। ”
রায়ু’কে আর কে পায়। উসাইন বোল্টের গতিতে দৌড়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো মেয়েটা। হৃদি ও ইনায়া একত্রে শব্দ করে হেসে উঠলো। ভাই ভাবীকে বিরক্ত করতে চায় না বিধায় ইনায়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভাবীকে বললো,
” ভাবী আমিও আসছি তাহলে। নিজের যত্ন নিয়ো। ঠিক আছে? গুড নাইট। ”
হৃদি মুচকি হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ল। ইনায়া একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। সে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতঘড়ি খুলছে। ইনায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঘর হতে প্রস্থান করলো। এতক্ষণে হৃদি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। প্রায় দশ বারো দিন বাদে সে-ই চেনা পরিচিত দৃশ্য! বাহির হতে ফিরেছে মানুষটি। স্বেদজল উপস্থিত মুখশ্রীতে। পরিপাটি মসৃণ চুল হালকা এলোমেলো। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও সুদর্শন লাগছে! নজরকাড়া সুপুরুষ সে! তার একান্ত পুরুষ। লাজুক আভা ছড়িয়ে পড়লো দু গালে।
” মায়াবী দু চোখে লাজুকতা, গালে লেপ্টে লালিমা। সিডিউস করতে চাইছেন বিবিজান? ”
চলবে.
[ বিশাল বড় একটি পর্ব দিয়ে দু’দিনের ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে দিলাম। সুন্দর মন্তব্য চাই কিন্তু। হৃ’হাম আর ব্যাক 💜 ]
◾ পাঠক বন্ধুরা….
তাহিরাহ্ ইরাজ এর লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে পোস্ট করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে।
গ্রুপ লিংক 🍁
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share