মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_৩০ ( প্রথমাংশ )

0
591

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩০ ( প্রথমাংশ )

আদিত্যর মিঠি আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহ। বেলকনিতে আরামদায়ক ফ্লোর ম্যাটে বসে পাঁচ মাসের গর্ভবতী হৃদি। দেয়ালে হেলান দেয়া দেহ। কোলে শুয়ে স্বামী ইরহাম। শালীনতার সহিত ওড়নায় আবৃত মেয়েটির কৃষ্ণবর্ণ কেশ। মুখজুড়ে মুগ্ধতার রেশ! উরুতে শায়িত স্বামীর হাতে পবিত্র কুরআন শরীফ। সুমধুর কণ্ঠে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করে চলেছে মানুষটি। কি মধুরতম কন্ঠ! শ্রবণপথ যেন আজ সার্থক। প্রতিটি হরফ, প্রতিটি আয়াত স্পষ্ট রূপে শ্রবণ হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবেশে মুদিত হচ্ছে চোখ। আলতো করে স্বামীর বক্ষপটে হাত বুলিয়ে চলেছে হৃদি। শুনছে অসংখ্য ফজিলত সম্পন্ন সূরা ইয়াসিন। অনুভব করার চেষ্টা করছে প্রতিটি আয়াতের মর্ম। শুধুমাত্র আরবি নয়। সঙ্গে বঙ্গানুবাদ শুনিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। হৃদি শুনছে। মহান রবের বাণী শুনছে। অন্তরে একরাশ প্রশান্তি। শ্রবণপথে পৌঁছাচ্ছে সে-ই আয়াত ও তার অর্থ,

” ইন্না-নাহনুনুহয়িল মাওতা-ওয়া নাকতুবুমা-কাদ্দামূওয়া আ-ছা-রাহুম ওয়া কুল্লা শাইয়িন আহসাইনা-হু ফীইমা-মিম মুবীন।

বাংলা অর্থঃ আমিই মৃ*তদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি। [ সুরা ইয়া-সীন ৩৬:১২ ] ”

হৃদি শুনলো। গেঁথে নিলো হৃদয়ে। হাশরের ময়দানে সকল পাপ ও পূণ্যের হিসাব হবে। জয়লাভ করবে পূণ্য। অতীব ভ”য়ঙ্কর পন্থায় কুপোকাত হবে পাপ ও পাপী। কল্পনার বাহিরে সে-ই মুহুর্ত। বড় করে তপ্ত শ্বাস ফেললো মেয়েটি। মনোযোগ দিলো সুমধুর তেলাওয়াতে। একসময় তেলাওয়াত সম্পন্ন হলো। পবিত্র কুরআন শরীফকে সম্মান প্রদর্শন করে চুমু অঙ্কন করলো ইরহাম। হৃদি আলতো করে দু হাতে কুরআন শরীফ স্পর্শ করলো। চুমু এঁকে সাবধানে রেখে দিলো এক হাত দূরত্বে অবস্থিত সেন্টার টেবিলের ওপর। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে। ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বিমুগ্ধ কণ্ঠে বললো,

” মাশাআল্লাহ্! তুমি খুব সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করো। ”

‘তুমি’ হ্যাঁ সেদিনের পর থেকে হৃদি অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছে। প্রথম প্রথম ভালোই অসুবিধা হতো। তুমির বদলে বারবার বলে ফেলতো ‘আপনি’। তবে সময়ের পরিক্রমায় বদলেছে অভ্যাস। এখন পুরোপুরিভাবে স্বামীকে তুমি বলে সম্বোধন করে মেয়েটি। ইরহাম শোনে। পুলকিত হয় তার তনুমন। অর্ধাঙ্গীর কণ্ঠে দুই বর্ণের সামান্য শব্দটি এতখানি অসামান্য কেন! ইরহাম প্রসন্ন বদনে স্ত্রীর প্রশংসার বিপরীতে বললো,

” জাঝাকিল্লাহু খায়রান মিসেস। ”

হৃদি মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বললো,

” এটা অর্থ ধন্যবাদ তাই না? ”

ইরহাম তার সঙ্গিনীকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,

” ঠিক ধন্যবাদ বোঝায় না। হাদিস শরিফে এসেছে, একবার উসাইদ বিন হুযাইর রাযি. কোন এক প্রেক্ষিতে শুকরিয়া স্বরূপ রাসূল ﷺ -কে বললেন, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান’ বা ‘জাযাকাল্লাহু আত্বইয়াবাল জাযা’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘ফা জাযাকুমুল্লাহু খায়রান’ বা ‘ফা’জাযাকাল্লাহু আত্বইয়াবাল জাযা’। (নাসাই কুবরা ৮০২৪ ইবনে হিববান ৭২৭৭ মুসতাদরাক হাকিম ৪/৭৯)। জাযাকাল্লাহু খায়রান একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইসলামি বাক্য। যার অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। তবে এই বাক্যের প্রধান বা মূল অর্থ হলো ‘আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার বা প্রতিদান দিন’। তবে কোথাও কোথাও উল্লেখিত আছে যে লিঙ্গভেদে উচ্চারণে তারতম্য ঘটে। মেয়েদের ক্ষেত্রে জাঝাকিল্লাহু খায়রান আর ছেলেদের ক্ষেত্রে জাঝাকাল্লাহু খায়রান। বুঝলে? ”

হৃদি ইতিবাচক মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পেরেছে। অজানা বিষয়টি আজ জানা হলো। এ বিষয়ে এতকাল অজ্ঞাত ছিল সে। কথায় কথায় থ্যাংক ইয়্যু বা ওয়েলকাম বলা মেয়েটি আজ জানতে পারলো ইসলামে এর প্রতিশব্দ হিসেবে কি চমৎকার বাক্য রয়েছে। ‘আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দিন’। অপূর্ব না! স্বামীকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো মেয়েটি,

” জাযাকাল্লাহু খায়রান জনাব। ”

বিনিময়ে হৃদয়কাড়া হাসি উপহার দিলো ইরহাম। হৃদি প্রাণ ভরে অবলোকন করলো সে হাসি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো ভালোলাগার উত্তাল তরঙ্গ। গর্ভকালীন সময়ে হৃ’হাম দম্পতি এক নতুন অভ্যাস তৈরি করেছে। রোজ ফজরের সালাত আদায় করে বেলকনিতে উপস্থিত হয় তারা। একে অপরের সান্নিধ্যে কাটায় সময়। কুরআন তেলাওয়াত করে। কখনোবা ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে। দেশ-বিদেশের তথ্য নিয়েও আলাপচারিতা হয়। মাঝেমধ্যে হাতে বেশি সময় পেলেই ইরহাম শুয়ে পড়ে স্ত্রীর উরুতে। সে অবস্থায় করে কুরআন তেলাওয়াত। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

” স্ত্রী কোলে শুয়ে তিলাওয়াত করা সুন্নাত। (সহীহ বুখারী; ২৯৭, ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা’আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮২) ”

এ সুন্নতটি প্রসন্ন হৃদয়ে পালন করার চেষ্টা করে হৃ’হাম দম্পতি। নিঃসন্দেহে অনাগত সন্তানের সঙ্গে অতিবাহিত হচ্ছে চমৎকার মুহুর্ত! হৃদি গর্বিত ইরহামের মতো একজন চমৎকার পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে। জীবনসঙ্গী তো এমন একজন হওয়াই উচিত, যে শুধুমাত্র ইহকালে নয় পরকালেও হবে তোমার সঙ্গী। হৃদি যে পরিবারে বড় হয়েছে সেখানে ইসলামী অনুশাসন অতটাও গুরুত্ব সহকারে পালন করা হতো না। ছোট থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছে সেভাবেই বড় হয়েছে। চালচলন ছিল ইসলামী অনুশাসন বহির্ভূত। তবে সকল প্রশংসা মহান রবের। ওনার অশেষ রহমতে ইরহাম নামক একজনকে সঙ্গী রূপে পেয়েছে। যে মানুষটি একটু একটু করে বদলেছে ওকে। ওর মধ্যে বপন করেছে ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করার স্পৃহা। স্বামী নামক মানুষটির তাগাদায় হৃদি এখন ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে জানছে। নিত্যনতুন স্বামীর কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখছে। এ পৃথিবীতে নবী রাসুল ব্যতীত কোনো মানব সন্তান ই পুরোপুরি পারফেক্ট নয়। তবে হৃদির দৃষ্টিতে তার স্বামী নামক মানুষটি অতুলনীয়! আস্ত এক ভালোবাসার ভাণ্ডার। এই যে হৃদি বিয়ের আগে যেমন স্বামী কল্পনা করতো সেরকমটা কিন্তু পায়নি। হৃদি বরাবর কল্পনা করে এসেছে তার স্বামী হবে অত্যন্ত রোমান্টিক পুরুষ। বিনা দ্বিধায় সকলের সামনে বুক ফুলিয়ে বলবে ‘ভালোবাসি হৃদি’। সে ওর মতোই এক্সট্রোভার্ট হবে। দু’জনের হাস্য কলরব, মধুরতম আলাপণে মুখরিত হবে সারা ঘর। কিন্তু মানুষ যা চায় তা সবসময় পায় না। সে স্বামী রূপে পেল এক ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি। যে মানুষটি নিজের অনুভূতি প্রকাশে বড্ড অপটু। নিজস্ব অনুভূতি বুকের মাঝে যতন করে রাখতে জানে। জনসম্মুখে যখন তখন অযাচিত প্রদর্শন করে নয় বরং সঙ্গিনীকে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো পন্থায় অনুভব করানো যে ‘ভালোবাসি তোমায়’… এরই নাম ভালোবাসা। প্রকৃত ভালোবাসা। ইরহাম এই কাতারে অন্তর্ভুক্ত। সর্বদা তার চাহনি, অনুভূতিপ্রবণ স্পর্শ, সীমাহীন যত্নের পরশ বুঝিয়ে দেয় হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি কতটা প্রগাঢ়। আলহামদুলিল্লাহ্। হৃদি গর্বিত এ মানুষটিকে সঙ্গী রূপে পেয়ে। সুখেদুঃখে আম’রণ থাকতে চায় এ মানুষটির সনে। তার প্রশস্ত বক্ষপটে মাথা এলিয়ে খুঁজে পায় ভরসা, নিরাপত্তা ও অসীম ভালোবাসা।

আন্ধার মুখ করে ঘুরছে বেচারা। চোখেমুখে অনুতাপের ছাপ। একটু পরপর তাকাচ্ছে রান্নাঘর বরাবর। কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। এখনো জোরে জোরে শব্দ ভেসে আসছে। সব রাগ কি বেচারা-মূক-জড় বস্তুর ওপর ঝাড়ছে? হয়তো তাই। বেচারা ছেলেটার আগত ঝড় হতে বেঁচে গিয়েও মুখে আঁধার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এসবের কি খুব দরকার ছিল? সে না হয় ছোট্ট বাচ্চা সাইজ একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে এত ভ-য়ঙ্কর শাস্তি! গুনে গুনে পুরো একঘন্টা বউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। কি মারাত্মক ব্যাপার! বউটার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে তার যে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে এর দায় নেবে কে? হুঁ? আজকাল ডক্টরদের যে লোমহর্ষক ভিজিট! ভুল করেও ও তল্লাটে যাওয়া যাবে না। টাকা বাঁচাতে হবে। নাহলে অদূর ভবিষ্যতে তার হালি হালি সোনামনিরা দুর্ভিক্ষের শিকার হবে। হবু বাবা হিসেবে সে এতবড় অন্যায়, অবিচার হতে দিতে পারে না। কিন্তু ওই মূর্খ মহিলা থুড়ি মেয়েকে এসব বোঝাবে কে! ভাবতে না ভাবতেই আবার শব্দ। থালা বাসন ঝনঝন করে শব্দ করছে। রাহিদ এ পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঁচু স্বরে মা’কে ডেকে উঠলো,

” মা ও মা। তোমার আদরের দুলালী বউমা তো সব ভেঙ্গেচুরে ফেললো। তোমার শখের রান্নাঘর বাঁচাও। সেভ দ্য কিচেন। ”

পল্লবী শোবার ঘর হতে অপ্রসন্ন কণ্ঠে সাড়া দিলেন,

” বাপ আমার। তুমি তো চুপ ই থাকো। নিজে রান্নাঘরের যে বেহাল দশা করেছো তার চেয়ে বৌমা আমার শতগুণ ভালো করে গুছগাছ করছে। ”

মুখখানি কেমন আমসক্তের মতো শুকিয়ে গেল। এত মোটা অপমান! সে নাহয় পণ্ডিতি করে একটুখানি থুড়ি একটু বেশিই বেহাল দশা করে ফেলেছে। তাই বলে এভাবে মুখের ওপর বলবে! পিঠের ওপর বললেও পারতো। যন্ত্রণা একটু কম হতো। তা না খালি বৌমা বৌমা করছে। বলি ছেলে না থাকলে বৌমা আসতো কোথা থেকে? এবার শত হাজার ভেবেচিন্তে বলুক। ছেলে বড় না বৌমা বড়? রাহিদ ম্লান বদনে সোফায় বসে পড়লো। মানসপটে ভেসে উঠলো এমনতর অদ্ভুদ ঘটনার মূল সূচনা।

গত দুই সপ্তাহ ধরে রাহিদ বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে। পরিবারের অগোচরে চুপিসারে কোথায় কি করছে জানে না তার মা, বউ। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাড়িতে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিল না ছেলেটা। অজান্তেই স্ত্রীকে অবহেলা করছিল। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সময় পেল রাহিদ। বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। এবার বোধগম্য হলো বউ তার অভিমানে এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে। আহত বাঘিনীর ন্যায় যখন তখন তর্জন গর্জন করছে। ব্যাস। বউয়ের মান অভিমান ভাঙচুর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছেলেটা। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো আজ সে নিজের হাতে রান্না করবে। মা, বোন, স্ত্রী। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিন নারীকে চমকে দেবে। সে-ই মতো খুব সকাল সকাল সবার অগোচরে রান্নাঘরে হানা দিলো। ঘুমিয়ে পরিবারের সদস্যরা। সে-ই সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো রাহিদ। এরপরের সময়টা ছিল কল্পনাতীত। আইলা-সুনামি-ক্যাটরিনা সব একত্রে বয়ে গেল রান্নাঘরে। এমন হুলস্থুল অবস্থা যে বলার বাহিরে। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে শাক-সবজি। হরেক রকমের মশলা পড়ে রয়েছে যেখানে সেখানে। আটায় মাখামাখি মানুষটির মস্তক, বক্ষ। থালা বাসন কাঁদো কাঁদো চেহারায় তাকিয়ে। ব্যাস। তখনই সেথায় উপস্থিত হলো ইনায়া। অনাকাঙ্ক্ষিত তুলকালাম কাণ্ড সইতে না পেরে গর্জন করে উঠলো মেয়েটা। হাওয়া ফুঁস! পরাজিত বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে রান্নাঘর হতে পলায়ন করতে বাধ্য হলো রাহিদ। এরপর থেকে চলছে মৌন লড়াই। বউটা তার শেষমেষ জামাইকে ভুলে বাসনপত্রকে আপন করে নিলো! এতবড় দুঃখ রাখবে কোন পকেটে? ভার সইতে না পেরে ছিঁড়ে যাবে তো! ওহ্ হো! কি দুঃখ!

গর্ভকালীন সময়ের পাঁচ মাস চলছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ স্ফীত উদর। গুরুজনেরা ধারণা করছে হয়তো এক নয় আসছে দু’জন নয়া সদস্য। সে থেকে রোজ আনন্দ বয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। মালিহা অত্যন্ত খুশি। পুত্রবধূর সেবাযত্নে উনি বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখছেন না। বলতে গেলে নিজের মায়ের চেয়েও বেশি মমতাময়ী রূপে নিজেকে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। এজাজ সাহেব। রাশভারী লোকটাও আজকাল ভাবনাতীত খুশি। মাঝেমধ্যে সময় পেলে সন্ধ্যায় লিভিংরুমে কথার আসর বসে। পুত্রবধূর সঙ্গে টুকটাক কথা বলেন পাপা এজাজ। ওর খোঁজখবর নেন। ওদিকে এমপি সাহেব? বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে ইরহাম। তার অনুপস্থিতিতে এজাজ-মালিহা দম্পতি তাদের পুত্রবধূর সর্বোচ্চ খেয়াল রাখছেন। ছেলে যেন অভিযোগ করার বিন্দুতুল্য সুযোগ না পায়। এজাজ সাহেব অবশ্য ছেলের ওপর অসন্তুষ্ট। স্ত্রীর এমন গুরুত্বপূর্ণ, আবেগী সময়কালে সে কোন রাজকার্যে ব্যস্ত শুনি! হ্যাঁ এটা সত্য যে ইরহাম নিজের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। যথাসাধ্য স্ত্রীর দেখভাল করছে। তাতে হৃদির অসন্তোষ না থাকলেও এজাজ সাহেব অসন্তুষ্ট। উনি কখনোই চান না ছেলে ওনার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন হোক। সন্তানের চোখে বাজে পিতা হিসেবে পরিচিত হোক। তাই তো ওনার যত অসন্তুষ্টি, বিরক্ত ভাব। ছেলেটা কি একটুও বুঝতে পারছে না! কে জানে হয়তো বুঝতে পারছে কিংবা নয়।
.

দিনমণির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। উত্তরার এক নামকরা হাসপাতাল। গাইনোকলজি বিভাগের বাহিরে ওয়েটিং জোন। সেথায় পাশাপাশি বসে হৃদি ও মালিহা। হৃদির নিয়মিত চেকআপের জন্য আজ এখানে আগমন। এসে থেকেই মলিন বদনে বসে মেয়েটা। তার মমতাময়ী শাশুড়ি মা সঙ্গে রয়েছে। তবুও অনুভূত হচ্ছে একাকীত্ব। গর্ভকালীন এ সময়ে প্রতিটি মেয়েই স্বামী সঙ্গ প্রত্যাশা করে থাকে। হৃদিও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এই যে আজ এখানে আগমন। স্বামী মানুষটি পাশে থাকলে একাকীত্ব কি পারতো জড়িয়ে ধরতে? পারতো না। তার তনুমন উভয়েই ফুরফুরে থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ইরহাম অনুপস্থিত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে দু’দিন ধরে শহরের বাহিরে অবস্থান করছে। বলেছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। কিন্তু সে কাজটি যে কি মোটেও বলেনি। ইদানিং মানুষটা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। যখন তখন চিন্তায় ডুবে যায়। কিসব ভাবতে থাকে। হৃদি উপলব্ধি করতে পারে সব। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। কিন্তু বলেনা না গম্ভীরমুখো মানুষটি। চতুরতার সহিত সব গোপন করে যায়। ওকে এটাসেটা বুঝিয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। একদিন দু’দিন তিনদিন। আর কত? একসময় হৃদি ঠিক সব জানতে পারবে। তার যে বড় ভয় হয়। না জানি মানুষটি কোন মুসিবতে জড়িয়ে! দীর্ঘশ্বাস ফেললো হৃদি। ভাবনায় ছেদ পড়লো শাশুড়ি মায়ের ডাকে। চোখ তুলে তাকালো হৃদি।

” চল মা। এবার আমাদের সিরিয়াল। ”

মালিহা সাবধানে হাত ধরে হৃদির ভারী শরীরটি উঠাতে সহায়তা করলেন। সে মুহূর্তে বাম পাশ হতে বলে উঠলো রাহিদ,

” ভাবী ভয় পেয়ো না। আমরা আছি তো। ”

হৃদি যেন এই ‘আমরা’ শব্দে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। একান্ত পুরুষ ই যে অনুপস্থিত। প্রেমিক পুরুষ রাহিদ ঠিক বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলো। তাই তো কোমল স্বরে ভাবীকে আশ্বস্ত করতে বললো,

” ইরু ভাইয়া সত্যিই ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ফেঁ সে গেছে ভাবী। নইলে ঠিক ছুটে আসতো। তুমি তো ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চেনো, তাই না? বিশ্বাস করো তো? ”

হৃদি ইতিবাচক মাথা নাড়ল। হ্যাঁ সে বিশ্বাস করে। ওই মানুষটি যে তার অর্ধাঙ্গ। তাকে বিশ্বাস বিনা কাটাবে কি করে সংসার জীবন! বিশ্বাস যে সম্পর্কের অন্যতম মূল ভিত্তি। আর কথা বৃদ্ধি পেল না। মায়ের হাত ধরে সাবধানে পা ফেলে ডক্টরের চেম্বারে প্রবেশ করলো হৃদি, মালিহা যুগল।

_

” মিসেস হৃদি! আপনার বেবি বাম্পের অতিরিক্ত ওজন পিঠের নিচের দিকে ব্যথার কারণ বলে মনে করছি। এটা একটি নিস্তেজ ব্যথার মতো অনুভূত হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার পরে এই ব্যথা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। ”

লেডি গাইনোকলজিস্টের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মালিহা। শুধোলেন,

” ডক্টর এর জন্য আমরা কি করতে পারি? এই ব্যথা নিরাময়ের কোনো উপায়? ”

” জ্বি। এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করতে উনি যোগব্যায়াম করতে পারেন। যা ওনার মূল পেশীকে শক্তিশালী করার উপর ফোকাস করে। একটি প্রসবপূর্ব ম্যাসেজও স্বস্তি আনতে পারে। বিশেষ করে যদি মেল্টিং ম্যাসেজ বাম ব্যবহার করেন।”

হৃদি মৃদু স্বরে বললো,

” ইনশাআল্লাহ্ আমি যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করবো। আপাতত কোনো ম্যাসেজ বাম লাগবে না। ”

” মিসেস চৌধুরী আরেকটা কথা। আপনার ডটার ইন ল এর ব্লা ড প্রেশার কিন্তু হালকা হাই দেখছি। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত না। প্রেগন্যান্সির সময় হাই ব্লা ড প্রেশার বেশ চিন্তার কারণ। এতে মা ও সন্তানের প্রবলেম হতে পারে। মাচ রিস্কি। মেক শিওর করবেন পেশেন্টের প্রেশার যেন সবসময় নরমাল থাকে। ”

” জ্বি ডক্টর। আমরা খেয়াল রাখবো। ”

বলে মালিহা তাকালেন পুত্রবধূর পানে। মেয়েটা আজকাল নিজের অযত্ন করতে আরম্ভ করেছে। আর ওনার ছেলেটা! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টরের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হলেন মালিহা।

” ভাই! জহির আহসান জেল থেকে পালিয়েছে। ”

অনাকাঙ্ক্ষিত এক সংবাদ যথেষ্ট ছিল সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর চিন্তার উপদ্রব বৃদ্ধি করতে। হঠাৎ এ কি হয়ে গেল! কি করে পলায়ন করলো জহির! কোনোভাবে এ পলায়ন বিপদ না ডেকে আনে।

চলবে.

[ বিশাল বড় একটি পর্ব। আগামী পর্বে কাহিনীর মোড় ঘুরে যাবে ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে। কি হতে পারে কোনোরূপ আন্দাজ? আপনাদের অনুভূতি জানার অপেক্ষায় রইলাম 🤎 ]

◾ জয়েন করুন আমাদের গ্রুপে 👇

https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here