#মেঘের_শহর
#পর্ব_৪
Saji Afroz
.
আয়নায় তাকানোর আগেই মোখলেসের কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসলো-
জিকো কোথায়? আমি ভেবেছি ও দরজা খুলেছে। আমি ওর বন্ধু।
.
মোখলেসের কথা শুনে আয়নায় নিজেকে দেখার আর প্রয়োজন মনে করলো না জিকো। সে মোখলেস কে ভেতরে আসতে বলল।
সত্যিটা সে জানালো না। কি লাভ হবে জানিয়ে? কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। করলেও তার জীবন নিয়ে উপহাস করবে।
.
জিকোর দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে মোখলেস বলল-
আপনি কি ওর বোন? চেহারায় মিল আছে কিছুটা।
-হুম।
-তবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে আছেন কেনো? আর জিকোই বা কোথায়?
-আসলে আমি রাগ করে গ্রামের বাড়ি থেকে চলে এসেছি। কাপড়চোপড় আনা হয়নি। ভাইয়া ওখানেই আছে একটা কাজে।
-ও আচ্ছা! আপনার নাম?
.
নাম জিজ্ঞাসা করতেই জিকোর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কোনো মেয়ের নাম বলতে হবে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা মেয়ের নামও জিকোর মাথায় আসছে না। ভাবতে লাগলো সে কি বলবে।
.
মোখলেস আবারো জিজ্ঞাসা করলে সে বলে দিলো-
জেসিকা।
-বাহ! সুন্দর নাম৷ তা এই সুন্দর নামের সুন্দরী রমনী টা কি সুন্দর করে এক কাপ চা বানাতে পারবে?
-জি।
.
ছোট্ট রান্নাঘর টায় চা বানাতে এল জিকো। চোখ জোড়া বন্ধ করে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এখন থেকে জেসিকা নামেই তাকে চিনবে আনন্দ নগর বাসী। সে জিকো নয়। জিকোর বোন, জেসিকা হয়েই বাঁচবে!
.
.
অন্তরা আহম্মেদের চেঁচামেচির শব্দ কানে ভেসে আসছে সাইয়ারার। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, মেঘ বাড়িতে এসেছে। জানালার ধারে কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা করলো সে। চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেলেও তিনি কি বলছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে মেঘের উপরে ছোটখাটো ঝড় বয়ে যাচ্ছে ভেবে হেসে ফেললো সে। এই মুহূর্তে মেঘের মুখের অবস্থা কেমন হয়েছে তার দেখতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে ওখানে গেলে নির্ঘাত হেসে ফেলবে। ফলে সব ভেস্তে যাবে। তাই আর গেল না সে।
এদিকে মায়ের কান কে ভারি করেছে তা জানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো মেঘ। অনেক বুঝিয়ে অন্তরা আহম্মেদ কে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়নি, তার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি একথা বিশ্বাস করলেন না। মেঘ কে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে বললেন।
মায়ের মাথায় এসব কিভাবে ঢুকেছে বুঝতে পারলো না মেঘ। সে জানে, তার মা প্রেমে বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া সে তো প্রেম করছেই না। তাহলে শুধু শুধু কেনোই এসব ভেবে কষ্ট পাবে তার মা!
মায়ের রাগ ভাঙাতে তার রুমের সামনে এসে দেখলো, দরজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পরেও দরজা খুললেন না তিনি। মেঘ হতাশ হয়ে নিজের রুমে চলে গেল। তারও খাওয়ার ইচ্ছে নেই।
.
.
দুপুর হতেই কলেজ থেকে আসলো মিন্নী। সে প্রতিদিন কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে নিজের খাবার নিজেই নিয়ে খায়। আজও ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে আসলো সে। পাতিলে ভাত, তরকারির নড়চড় না দেখে অবাক হলো সে। বুঝতে পারলো কেউ এখনো ভাত খায়নি। এত বেলা হয়ে গেল কিন্তু তার মা ও ভাই ভাত খায়নি কেন তা দেখার জন্য মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে এল সে।
ডাকাডাকির পরেও অন্তরা আহম্মেদ দরজা না খুললে সে ভাই এর রুমে আসলো। তারা ভাত খেলো না কেনো জানতে চাইলে মেঘ তাকে সবটা খুলে বলল।
মিন্নী বলল-
আমার মনে হচ্ছে এসব সাইয়ারা আপুর কাজ। সে এভাবে আমাকেও বকা শুনিয়েছে কয়েকবার। আমি তো তাই তার কাছ থেকে দূরে থাকি। ভালো লাগে না তাকে আমার।
-কিন্তু এসব কেনো করে ও?
-গ্রামের মেয়ে তো! স্বভাব আর কি সহজে বদলাতে পারবে?
-এভাবে বলা ঠিক না মিন্নী। আমি সাইয়ারার সাথে কথা বলব এই বিষয়ে।
-তোমার যা খুশি করো। আমি খেতে গেলাম। খেলে আসো।
-তুই খেয়ে নে। মায়ের সাথে পরে খাব আমি।
.
ব্যাপার টা সঠিক কি না তা জানার জন্য মায়ের রুমের সামনে এসে মেঘ বলল-
এসব তোমাকে সাইয়ারা বলছে?
.
কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবারো বলল-
আমি ওকেই জিজ্ঞাসা করি তবে।
.
এবার মুখ খুললেন অন্তরা আহম্মেদ। রাগে গজগজ করতে করতে তিনি বললেন-
মেয়েটি যা বলেছে সত্যি বলেছে। ওর কি দোষ!
.
মিন্নীর কথায় সঠিক বুঝতে পারলো মেঘ। সময় নিলো না সে। সাইয়ারার সাথে দেখা করতে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
.
.
সাইয়ারা খালার বাসায় অর্থ্যাৎ এই বাড়ির মালকিন নাজিফা হাসনাতের বাসায় এল মেঘ। নাজিফা তাকে দেখে বেশ অবাক হলো। পাশাপাশি হলেও মেঘ কখনো তাদের বাড়িতে আসেনি। মেঘের বাড়িতেই তার সাথে আলাপ হয়েছিল নাজিফা হাসনাতের।
তিনি মেঘকে দেখে অবাক হলেও খুশি কম হোননি। প্রথমবার মেঘ এসেছে এখানে, তাই তাকে দেখেই নাজিফা হাসনাত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাকে বসতে বলে কাজের বুয়াকে চা, নাস্তা আনতে বললেন। মেঘ তাকে এত ব্যস্ত হতে নিষেধ করলে তিনি বললেন-
এই প্রথম তুমি আমার বাসায় এসেছ। ব্যস্ত হব না? কি যে বলোনা! তা তুমি চা খাও তো নাকি কফি দিতে বলব?
-একটা হলেই চলবে আন্টি৷ আসলে আমি সাইয়ারার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ও কি বাসায় আছে?
-হ্যাঁ আছে। কয়েকদিন ধরে তো ভার্সিটিতেও যাচ্ছে না সে। কেনো বলো তো? কিছু করেছে?
-আপনার কেনো মনে হলো ও কিছু করবে?
.
হেসে উঠলেন নাজিফা হাসনাত। হাসতে হাসতেই বললেন-
এই দুই বছরে তার নামে কম নালিশ তো আসেনি। বয়স বাড়ছে কিন্তু স্বভাব বদলাচ্ছে না। বলো শুনি কি করেছে?
.
মেঘের কাছে সবটা শুনে তিনি বললেন-
মানলাম সাইয়ারা এটা ঠিক করেন নি। কিন্তু এই যুগে এসে অন্তরা আপা এমন করছেন কেনো? তুমি বড় হয়েছ৷ প্রেম করতেই পারো!
-আসলে মা এসব পছন্দ করেন না।
-কেনো?
-ঠিক বলতে পারি না। উনি রাগ করে দুপুরে খান নি। এখনো দরজা বন্ধ৷ সাইয়ারা যদি বলে সে দুষ্টুমি করেছিল, তবে হয়তো বিশ্বাস করবে।
-ঠিক আছে। তুমি বসো। আমি তাকে পাঠাচ্ছি।
.
চা, নাস্তাও চলে এসেছে ততক্ষণে।
নাজিফা হাসনাত দাঁড়িয়ে বললেন-
চা টা নাও।
-জি।
-আরেকটা কথা বাবা। মেয়েটাকে বোকা দিওনা। ওর স্বভাব এমন হলেও মনটা অনেক ভালো। আসলে মানুষ বলেনা? আদরে বাদর হয়। ওর অবস্থাও হয়েছে এমন। সাইয়ারার মায়ের বিয়ের পর কয়েকটা সন্তান মারা যাওয়ার পর ওর জন্ম হয়েছে। তাই তাদের চোখের মনি ও। যখন যা ইচ্ছে তাই করতো সে। গ্রামের দস্যি মেয়েও বলতে পারো। না বকে বুঝাবে একটু। কেমন?
.
প্রতিউত্তরে মেঘ বলল-
জি আন্টি।
.
তিনি সাইয়ারা কে ড্রয়িংরুমে পাঠালেন। কেনো আসতে বললেন তা জানালো না। সাইয়ারা ড্রয়িং রুমে এসে চমকে গেল মেঘকে দেখে। চলে যেতে চাইলে মেঘের ডাকে থামলো সে। মেঘ তাকে তার পাশে আসতে বলল।
সে বুঝতে পারলো মেঘ সবটা জানতে পেরেছে।
সে ভাবেনি এই বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বলতে মেঘ এখানে চলে আসবে। তার মানে পরিস্থিতি কি বেশি বিগড়ে গেল!
ভয়ে ভয়ে সাইয়ারা এসে সোফার উপরে বসলো। মেঘ চা খেতে খেতে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি লাগছে সাইয়ারার। ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না সে৷ হঠাৎ টিভির দিকে চোখ পড়লো তার। টিভিটা চলছে কিন্তু মিউট করা। হয়তো তার খালা মেঘ কে দেখে মিউট করেছে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকার চেয়েও টিভি দেখাই ভালো। এটা ভেবে সামনে থাকা টেবিলটা থেকে রিমোট হাতে নিলো সাইয়ারা। স্টার জলশার সিরিয়াল চলছে টিভিতে। সিরিয়াল সে খুব একটা দেখে না। তাই রিমোট টিপে চ্যানেল বদলাতে লাগলো। তার দিক থেকে নজর সরালো না মেঘ। আড়চোখে তা দেখে অস্বিরতা আরো বেড়ে গেল সাইয়ারার। সে সে শুধু শুধুই চ্যানেল পরিবর্তন করতে থাকলো। কিছু দেখারও ইচ্ছে নেই এখন তার।
চ্যানেল পরিবর্তন করতে করতে হঠাৎ একটা হিন্দি চ্যানেলে নোরা ফাতেহির নাচ দেখতে পেল। তাড়াহুড়ো করে চ্যানেলটি বদলাতে গিয়ে সাউন্ড টা বেড়ে গেল।
সাথে সাথে তারা শুনতে পেল-
সাকি সাকি রে…
ও সাকি সাকি!
.
টিভির পর্দার দিকে চোখে পড়তেই শব্দ করে কেশে উঠল মেঘ।
সাইয়ারা চ্যানেল পরিবর্তন করতে চাইলেও পারলো না। রিমোট কাজ করছে না!
ওদিকে নোরা ফাতেহির এসব পোশাকে নাচ দেখে লজ্জায় মেঘের মাথা কাটা যাচ্ছে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে।
সাইয়ারা দৌড়ে গিয়ে টিভির সুইচ টিপে টিভি বন্ধ করলো।
মেঘ বলল-
নিশ্চয় বুঝেছ আমি কেনো এসেছি?
-কেনো?
-বুঝছ না? বোঝার দরকার নেই। চলো আমার সাথে।
-কোথায়?
-আমার বাসায়।
-আপনি যান, আমি নাচটা দেখে আসি। আমার ফেবারিট।
-ছিঃ!
-ছিঃ বললেন কেনো?
-মেয়েটার পোশাক কেমন! প্রায় অর্ধউলঙ্গ। নাচেরও কি ছিরি! তুমি এসব দেখো?
.
খানিকটা লজ্জা পেয়ে সাইয়ারা বলল-
গানটা ভালো লাগে।
.
মেঘ গলার স্বর গম্ভীর করে বলল-
তুমি কি যাবে আমার সাথে?
.
মুখটা বাঁকিয়ে মেঘের আগেই সাইয়ারা হাঁটা শুরু করলো।
.
.
ছাদে এসেছে জিকো। আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে না প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
গ্রামের ছেলে সে। শহরে আসা হয়েছে কাজের তাগিদে। ছোটখাটো একটা চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু স্বভাব দোষে সেটাও হারিয়েছে। বর্তমানে বেকারই আছে। ভেবেছিল কিছু একটা করবে। কিন্তু তার শরীরটাও যে পুরো বদলে গেল! সার্টিফিকেটে নাম রয়েছে জিকো। জেসিকা কে চাকরি কে দিবে!
একরাশ বিষন্নতা এসে ভর করলো তার মনে। নিজেকে অসহায় ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না তার।
কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করে হঠাৎ পরণের কাপড়ের দিকে চোখ পড়লো জিকোর। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে আছে সে। এসব তো মেয়ের পোশাক নয়। কিন্তু এখন তার শপিং মলেও যেতে ইচ্ছে করছে না। ওখানে যাওয়ার মতো তার কাছে কোনো মেয়ের পোশাক নেই৷ এভাবে গেলে তাকে পাগল ছাড়া কিছুই ভাববে না কেউ।
ছাদের রশিতে কাপড় শুকোতে দেয়া আছে। বাড়িওয়ালা বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়া রা শুকোতে দেয় এখানে।
বেশ কয়েকটা মেয়ের কাপড় দেখছে সে।
আশেপাশে তাকিয়ে একটি সালোয়ার কামিজ ভাজ করে পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো সে। ছয়তলার এই বাড়িটায় ভাড়াটিয়ায় ভরপুর। নিশ্চয় বুঝতে পারবে না কে চুরি করেছে!
.
কাপড় নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এল জিকো। খাটের উপরে মোখলেস কে দেখে অবাক হলো সে। মোখলেস হেসে বলল-
আপনি একা আছেন। তাই আবার এলাম। আসলে আপনি তো জিকোর বোন। তাই আপনার প্রতি আমারো কিছু দায়িত্ব রয়েছে। দেখতে এলাম কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কি না।
.
জিকো জানালো, কোনোকিছুর প্রয়োজন নেই। সে ঠিক আছে৷
.
এটা শুনে মোখলেস তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল।
সে আশা করেছিল, জেসিকা তাকে বসতে বলবে। আবারো এক কাপ চা খাওয়াবে। চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জেসিকা কে দেখবে সে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে তার ভালো লেগে গেল!
কিন্তু মেয়েটি তার সাথে সহজে মিশতে পারছে না। হয়তো প্রথম দেখছে বলে! ব্যাপার না। ধীরেধীরে মিশতে পারবে৷ দুজন দুজন কে জানতে পারবে। এসব ভেবে মুচকি হেসে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো মোখলেস।
.
চলবে