মেঘের_শহর #পর্ব_৩ Saji Afroz

0
123

#মেঘের_শহর
#পর্ব_৩
Saji Afroz
.
মিন্নী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাগানের দিকে হাঁটতে যায়। এই বাগান ঘিরে শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছোট বেলায় ভাই এর সাথে এখানে খেলাধুলা করে সময় কাটাত। আর এখন ঘুম ভাঙলেই হাঁটতে আসে সে।
বাগানটিতে নানাধরণের ফুল ও ফলের গাছে ভরে আছে। সে হেঁটে হেঁটে স্মৃতি চারণ করতে লাগলো।
আগে কত মধুর ছিল সময় গুলো। আর এখন? ভাই এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। কিন্তু একসাথে বসে দুই মিনিট কথাও বলেনি তারা।
এসব মনে পড়তেই মিন্নীর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সে ভাই এর রুমের দিকে।
.
মেঘ কে বেঘোরে ঘুমোতে দেখে সে আর ডাকল না। বাড়িতে আসলেই ঘুম থেকে উঠতে উঠতে তার বেলা গড়িয়ে যায়।
মিন্নীরও ক্লাসের সময় হয়ে এসেছে। সে দরজাটা ঠেলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ফিরে এসেই নাহয় কথা বলা যাবে।
.
সাইয়ারা বিছানায় আধশোয়া হয়ে সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসটি পড়ছে। এটি তার প্রিয় উপন্যাস। সময় পেলেই সে উপন্যাসটির কয়েক পাতা হলেও পড়তে চেষ্টা করে। যতবার পড়ে ততবার যেন চরিত্রগুলোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে সে।
আর ভাবে, কবে আসবে তার জীবনে এমন একজন? যে তাকে ভালোবাসার সাগরে ডুবিয়ে রাখবে!
.
.
বাড়ির সব কাজ শেষে ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ল হুরায়রা। আজ ছেলেটিকে ছাতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই ভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে তার। নাহলে বাসায় বসে বসে অনেক কিছু পড়া হয়ে যেত।
ক্লাস না থাকলে সময় টিকে কাজে লাগায় সে। অহেতুক অন্য কাজে সময় নষ্ট করে পড়াশোনার ক্ষতি করতে পছন্দ করে না হুরায়রা।
.
.
মেঘ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি তার। বারবার হুরায়রার মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসছিল। শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে আসে তার। এখন তার মা এসে সাধের ঘুম ভাঙায়।
আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল-
এত ডাকছ কেনো মা? কি হয়েছে?
-কি আর হবে! তুই তো এমনিতেই এখানে এলে দেরীতে উঠিস। কিন্তু কাল রাতে যে বললি তাকে তাড়াতাড়ি ডেকে দিতে, তাই তো ডাকছি!
.
মায়ের কথা শুনে এক লাফে বসে পড়ল মেঘ। এইরে!
আজ তার হুরায়রার সাথে দেখা করার কথা। আর সে কি না এখনো ঘুমোচ্ছে!
দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো মেঘ।
নাহ, খুব বেশি দেরী হয়নি। তাড়াহুড়ো করে উঠে সে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে তৈরী হয়ে নিলো সে।
ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো, তার মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে।
কিন্তু তার হাতে সময় নেই। দেরী করলে যদি হুরায়রা কে না পাওয়া যায়! কাল থেকে তাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে মেঘের।
অন্তরা আহম্মেদ তাকে খেতে বসতে বললে সে পরে খাবে জানায়। পরে খাওয়ার কারণ জানতে চান। মেঘ জানায় সে এখুনি একটা কাজ সেরে ফিরে আসবে।
সকালের নাস্তা করা ছাড়াই সে বাইরে যাবে শুনে অন্তরা আহম্মেদ রেগে যান।
মায়ের অভ্যাস সম্পর্কে অবগত মেঘ। এখুনি তিনি চেঁচামেচি করে মেঘকে আটকানোর চেষ্টা করবেন। এতে তার সময় নষ্ট হবে। তাই মেঘ আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তার পেছনে অন্তরা আহম্মেদ ও ছুটে এল। মেঘের সাথে কি আর তিনি ছুটে পারবেন?
উঠোনে এসেই থেমে গিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগলেন।
এদিকে উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সাইয়ারা। অন্তরা আহম্মেদের চেঁচামেচি শুনে বারান্দায় এসে বলল-
আজ আবার কি হলো আন্টি?
-ছেলেটা নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল। যেখানে যাবে যাক, নাস্তাটা করতে পারবে না?
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে সাইয়ারা বলল-
এখন থেকে নাস্তা কেনো? দুপুর ও রাতের খাবারও বাইরে খাবেন তিনি।
-কেনো?
-বুঝছ না? ছেলে বড় হয়েছে৷ মায়ের সাথে আর কতদিন খাবে?
-কার সাথে খাবে?
-এখন গার্লফ্রেন্ডের সাথে আর পরে বউ এর সাথে।
.
কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল অন্তরা আহম্মেদের৷ সাইয়ারার খুব হাসি পাচ্ছে। এই মহিলা টা কারণে অকারণে চেঁচামেচি করলেও ভালো মনের মানুষ। আর খুব সহজ সরলও বটে!
.
কিছুক্ষণ নীরব থেকে চিন্তিত স্বরে তিনি বললেন-
এখানে এসেছে বেশিদিন হচ্ছে না। এর মাঝেই প্রেমিকা জোগাড় করে ফেলেছে?
-তোমার ছেলে কত হ্যান্ডসাম! যেকোনো মেয়েই তো তার সাথে প্রেম করতে রাজি হয়ে যাবে। আর ভালো লাগার বিষয়টায় অন্যরকম। সময় লাগে না কি! কখন কাকে ভালো লেগে যায় বলা মুশকিল।
-তোকে কিছু বলেছে?
-নাহ! তবে বুঝেছি।
-কি?
-ছাতা যাকে দিয়েছে তার সাথেই প্রেম চলছে তোমার ছেলের।
.
অন্তরা আহম্মেদ কিছু বললেন না। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তার এমন অবস্থা দেখে হেসে ফেললো সাইয়ারা। সে জানে, অন্তরা আহম্মেদ প্রেমে বিশ্বাসী নয়। তাই তাকে রাগানোর জন্যই মজা করলো সে। এবার মেঘ আসলে তার উপরে ঝড় বয়ে যাবে, ঝড়!
.
.
কালই বৃষ্টি ছিল আর আজ এত গরম পড়ছে!
বাসায় থাকতে সেটা টের পায়নি হুরায়রা। এখন মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্বস্থি লাগছে তার। হুরায়রায় চোখেমুখে গরমের হলকা এসে লাগছে। সে মুখটাকে বাঁচাতে দু’কদম পিছিয়ে আসে।
এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে যাবে সে৷ তাই হুরায়রা পাশের ভবনের নিচে এসে দাঁড়াল।
একটু পরেই মেঘ এল। হুরায়রা কে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলো সে। তার দেরী হবার কারণে সে কি চলে গেল কি না ভাবছে মেঘ।
নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার৷ কেনো যে তাড়াতাড়ি ঘুমটা ভাঙলো না!
-শুনছেন?
.
পেছনে ফিরে হুরায়রা কে দেখে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললো মেঘ। তার দিকে ছাতাটি এগিয়ে দিলো হুরায়রা। ছাতাটি নিয়ে মেঘ তাকে ধন্যবাদ জানালো। হুরায়রা চলে যেতে চাইলে তাকে আটকে মেঘ একসাথে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলো। হুরায়রা রাজি না হলে মেঘ বলল-
আমার থেকে নাইবা খেলেন। কিন্তু আপনার আমাকে খাওয়ানো উচিত৷ কাল আপনাকে ছাতা দিয়ে সাহায্য করেছিলাম কিন্তু আমিই।
.
হুরায়রা ভ্রু কুচকালে মেঘ তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। হুরায়রা ধীর কণ্ঠে বলল-
চলুন।
.
হুরায়রা হাঁটতে লাগলো। তার পিছু নিলো মেঘ।
ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার ধারে বড় একটি আম গাছের নিচে এসে থামলো হুরায়রা। এতক্ষণ দুজনে কোনো কথা বলেনি। মেঘের কথা বলতে ইচ্ছে হলেও কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
হুরায়রা কে থামতে দেখে সেও থামলো৷ আশেপাশে নজর বুলালো। এদিক টায় এসেছে বেশ কয়েকবছর হচ্ছে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। তবে এখন কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান চোখে পড়লো তার। একটু দূরেই কাশবন দেখা যাচ্ছে। মেঘ জানে, কাশবনের মাঝে ছোট ছোট রাস্তা বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। কাশবনের পরে রয়েছে একটি নদী। যেটি ‘আনন্দ নদী’ নামে পরিচিত৷ বিকেল হলেই সেখানে মানুষের ঢল নামে।
হুরায়রা বলল-
করিম চাচার হাতের বানানো চা এই শহরের সবচেয়ে বেস্ট চা। একবার খেলে কফি টফি খেতে ইচ্ছে করবে না। সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই। টঙের দোকানে বসে এক কাপ চা চলবে?
.
মৃদু হেসে মেঘ বলল-
দৌড়বে।
.
টঙের দোকানের সামনেই দুটো বেঞ্চ রাখা আছে। মেঘ এসে বসলো। হুরায়রা তার পাশে বসলো না। পাশের বেঞ্চটিতে বসে করিম চাচা কে দুকাপ চা বানাতে বললো।
আমগাছের উপরে অসংখ্য পাখি এসে ভিড় করেছে। তাদের কলকাকলিতে চারপাশটা হয়ে আছে মুখোরিত। হুরায়রা সেদিকে তাকিয়ে আছে।
এই সুযোগটা হাত ছাড়া করলো না মেঘ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সে হুরায়রা কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
হালকা সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজে পরণে তার, কোনো সাজগোছ নেই, কোমর সমান লম্বা খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে তার। এতেই কতই না ভালো লাগছে তাকে! ঠিক যেন এই শহরের রাণী সে।
আমগাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টঙের দোকানের দিকে তাকায় হুরায়রা।
করিম চাচা কাপে চা ঢালতেই তার কাছে এগিয়ে গেল মেঘ। দুকাপ চা নিয়ে হুরায়রার পাশে এসে তার হাতে দিলো। তার পাশেই বসে অপরটিতে চুমুক দেয়।
কিছুটা বিরক্ত হলো হুরায়রা। তার পাশে বসার জন্য মনে মনে মেঘকে বকা দিতে লাগলো। মেঘ যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে বসেছিল তবুও ব্যাপারটি পছন্দ হলো না তার। সে আরো দূরে সরে বসলো।
চায়ে চুমুক দিয়ে স্বাদ নিয়ে তৃপ্তির অভিব্যক্তি ছেড়ে মেঘ বলল-
বাহ! দারুণ তো!
.
হুরায়রা বলল-
করিম চাচার হাতে জাদু আছে।
-এখন থেকে এখানে এসেই চা খেয়ে যাব।
.
হুরায়রা কিছু না বলে কাপে আরেকবার চুমুক দিলো।
মেঘ বলল-
পরিবারে কে কে আছে আপনার?
-মা, বাবা, আমি, ছোট বোন।
-ঠিক আমার মতো! তবে…
-কি?
-আমার বাবা নেই। কয়েকবছর হলো তিনি একটা এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।
.
মুখটা মলীন হয়ে গেল মেঘের। তার মুখের দিকে তাকাতেই হুরায়রার মনে অজানা এক মায়ার সৃষ্টি হলো।
ছেলেটি নিশ্চয় তার বাবা কে ভীষণ ভালোবাস তো। তাই তো বাবার কথা বলতেই মুখটা ওমন হয়ে গেছে।
চা টা শেষ করে হুরায়রা বলল-
কষ্ট পাবেন না। এই সুন্দর পৃথিবীটা সবাইকে ত্যাগ করতে হবে একদিন। কেউ আগে করবে কেউ পরে। এটাই তো জগতের নিয়ম!
-হ্যাঁ, এটাই চরম সত্যি। কিন্তু প্রিয় মানুষ হারানোর ব্যথা টা তো সহজে যায় না। যে যাওয়ার সে চলেই যায়। আমাদের দিয়ে যায় একরাশ কষ্ট!
.
দুজনেই চুপচাপ৷
নীরবতা ভেঙে হুরায়রা বলল-
আপনার নাম?
-মেঘ। মেঘ আহম্মেদ।
.
মেঘ নামটা শুনে হুরায়রার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
বেঞ্চের উপরে কাপটা রেখে সে বলল-
মেঘ! এই নামটা আমার বেশ পছন্দের।
-তাই বুঝি?
.
মেঘের সাথে আরো কিছুক্ষণ এখানে বসতে ইচ্ছে করলেও সে বসলো না৷ কিছু একটা ভেবে বসা থেকে উঠে সে করিম চাচার কাছে এসে চায়ের দাম দিলো।
মেঘ তাকে দিতে বারণ করলেও সে শুনলো না৷ মেঘের পাশে এসে বলল-
খাওয়ানোর কথা আমারি ছিল। চলুন যাওয়া যাক।
-বেশ তো লাগছিল এখানে।
-তবে আপনি থাকুন। আমার যেতে হবে।
.
হুরায়রা দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করলো। হঠাৎ এই মেয়ের কি হলো বুঝতে পারলো না মেঘ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে হুরায়রার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
.
.
একটু পর পর সাইয়ারা জানালায় উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেঘ এসেছে কি না। বেশ কয়েকবার বারান্দায় ও ছাদে গিয়েছিল সে। ছাদের রেলিং পার হয়ে সোজা অন্তরা আহম্মেদের বাড়ির ভেতরেও গিয়েছে একবার। কিন্তু মেঘ কে দেখতে পায়নি।
মেঘের নামে তার মায়ের কাছে কানভারী করেছে সাইয়ারা। আজ নিশ্চয় মেঘের উপরে সুনামি চলবে।
উফফ কখন যে আসবে মেঘ, আর সাইয়ারা মজা উপভোগ করবে! ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে।
.
.
কাল বেশ কয়েকজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল জিকো। তারা কেউই তার সমস্যাটি বোঝার চেষ্টাও করেনি। কেউ কেউ তাকে চরম অপমানও করেছে পাগল বলে।
হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছিল সে। সেই থেকে পেটে কিছু পড়েনি তার।
মদও ছঁুয়ে দেখেনি। বিছানার পাশে বসে সারারাত চোখের পানি ফেলেছিল।
সকাল সকাল চোখটা লেগে এসেছিল তার। কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেল বুঝতেই পারেনি।
তাই এত বেলা হয়ে গেল, তবুও তার ঘুম ভাঙেনি।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ জিকোর কানে ভেসে এল।
ঘুম থেকে উঠে দরজা টা খুলে তার প্রিয় বন্ধুর মোখলেস এর দেখা পেল সে।
দরজা খুলতেই মোখলেস বলল-
কি ব্যাপার জিকো, এতক্ষণ কেনো লাগলো দরজা খুলতে?
.
বন্ধুর মুখে নিজের নাম শুনে খুশির সীমা রইলো না জিকোর! মোখলেস তাকে চিনতে পেরেছে। তার মানে সে কি ঠিক হয়ে গেছে? দৌড়ে সে আয়নার পাশে এল নিজেকে দেখার জন্য।
.
চলবে
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here