#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ১৫)
সায়লা সুলতানা লাকী
লিখন কে সাথে নিয়ে হিমেল আসল লাবন্যদের বাসায় তখন ঘড়ির কাটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
রুশ ওর আব্বুকে দেখে দৌড়ে গেল কাছে। সারাদিন পর বাসায় পেয়ে মনে হল ওর বুকে পানি আসল। এতক্ষণ সবার ভয়ে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলো না আব্বুর কথা। আপুর সাথে সবার যে নিরব সংঘর্ষ চলছে তার উত্তাপ কিছুটা যে ওর গায়েও পড়ছে তা ও আপুর কাছে প্রকাশও করেনি। আপুর পাশেই চুপচাপ বসে ছিল সারাটা সময়।
লিখন বাসায় ঢুকে কারউ সাথে কোন কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। লাবন্য ইচ্ছে করেই ওর আব্বুকে পিছু ডাকল না। হিমেল ওর সামনে গিয়ে বসতেই আস্তে করে জিজ্ঞেস করল
“আব্বুকে কোথায় পেলে?”
“গোরস্থানে, দুপুরে তুই খাবার দিতে মানা করলি তাই খাবার নিয়ে গোরস্তানে গিয়েছিলাম। ওখানে বিলিয়ে খালামনির কবর যিয়ারত করতে গিয়ে দেখি খালুজি চুপচাপ বসে আছেন। ”
“সকাল থেকেই বাসায় ছিল না। ভাবছিলাম কোথায় যেতে পারে! ” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লাবন্য ।
“ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার কষ্টটা কারউ সাথে শেয়ার করা যায় না। খালুজির সব কিছুতেই খালামনি মিশে ছিল, এখন তারই বেশি অসুবিধা হবে সার্ভাইব করতে।”
“তোমরা শুধু তোমাদেরটাই বোঝো। অন্যদেরটা কেউ বুঝতে চাও না।”
“খেয়েছিস?”
“হুমম, কয়দিন না খেয়ে থাকা যায়। যত কিছুই হোক ক্ষুধাতো আর মরে না।”
“এভাবে বলিস না, খালামনি তোকে যথেষ্ট স্ট্রং করে গড়েছেন। অমন পুতুপুতু করা মেয়ে তুই না। তুই পারবি। সবসময়ই মা বাবা কারউ সাথে থাকে না। আর এই পৃথিবী কোন একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য আটকেও থাকে না। তবে প্রথম কিছুদিন অভ্যস্ত হতে সময় নেয়,তখন কষ্টও দেয় মানিয়ে নিতে। অতটুকু কষ্ট আমাদের সবাইকেই সহ্য করতে হয়।”
“যত সহজ বলছো ততটা কি আর সহজ? আল্লাহ ভালো জানে কতটুকু পারবো, যেখানে ঘরের শত্রু বিভিষন।”
“আবার কি হল? ঘরে আবার কি সমস্যা? ”
“কি যেনো হয়েছে আমার? আম্মুর সাথে হওয়া সব অনিয়ম গুলো আমার মাথায় এখন চড়ে বসেছে। যারা যারা আম্মুকে কষ্ট দিত তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে, মনে হচ্ছে সব ভণ্ডামি গুলো গুড়িয়ে দিয়ে মনের কষ্ট কমাই।”
“মাথা ঠান্ডা কর, কন্ট্রোল ইউর সেলফ। এমনিতেই সময়টা খুব নাজুক, এর মধ্যে কোন বাড়তি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না।”
“পারতেছি না, এদের চেহারা দেখলেই আম্মুর ক্লান্ত শ্রান্ত চেহারাটা চোখে ভেসে উঠে। কাউকেই সহ্য হচ্ছে না।”
“তোর রাগ হওয়াটা ঠিক আছে। আজ আম্মুকে যা বলছিস, তা শুনে আম্মুও কষ্ট পেয়েছিল পরে আমরা সবাই বুঝিয়ে বলাতে আম্মু বুঝেছে। তারপরও বলি এখনই প্রতিবাদ করিস না। সবাইকে একসাথে ক্ষেপিয়ে তুলিস না। একা একা চলতে পারবি না। এতে কষ্ট বেশি হবে।”
লাবন্য কিছু একটা বলতে যাবে তখনই শুনতে পেলো। ওর আব্বুর কাছে তার মা বোনদের নালিশ চলছে। লাবন্য হিমেলকে থামিয়ে দিয়ে চুপ করে শুনতে চাইল। তখনই হিমেল বলল
“সবার সব কথায় কান দিস না। এখন এরাই তোর আপন জন। ”
“ভুল, তুমি আবেগ নিয়ে থাকো। আমি পারব না। আমি ঠিক করে ফেলছি আমাকে কি করতে হবে। প্রথম থেকেই অবস্থান স্থির রাখতে হবে। আম্মু নাই এখন আমাদেরকেই আমাদের ভালো দেখতে হবে। তোমার কথা মতো অপেক্ষা করলে তারা দুর্বল ভেবে চেপে বসবে ঘাড়ের উপর। তখন উৎখাত করতে কষ্ট বেশি হবে।”
হঠাৎ করেই লিখনের গলার আওয়াজ পেয়ে লাবন্য চুপ হয়ে গেল শোনার জন্য।
“আহ! তোমরা কি শুরু করলা বলোতো? আমার বাচ্চা একটা মেয়ে, মাত্রই ও ওর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদকে হারালো। ওর মা’কে হারালো। বোঝো তোমরা মা, মা হারালো। ওর মাথা এখন কতটুকু ঠিক আছে তা চিন্তা করছো? কই ওকে সাপোর্ট করবা তা না ও কি কি করছে তার ফিরিস্তি দিতে শুরু করছো। আজব মানুষ তোমরা।”
“আরে তুই উঠোস কেন? খাবার রেখে উঠিস না। খেয়ে নে। আচ্ছা যা কেউ কিছু বলবে না।” লাবন্য ওর দাদির কন্ঠটা শুনে হেসে ফেললো।
“আমরা কেউ খাচ্ছি কি খাচ্ছি না তা দেখার সময় নাই। অথচ আব্বুর খাবার নিয়ে কত চিন্তা! ”
“হুমম, কারন উনি খালুজির মা।”
“ধুর, ওসব কিছু না। এসবই দেখানো। ছেলেকে ধরে রাখার অভিনয়। বিশ বছর ধরে দেখে আসছি এই একই সীন। আব্বুর পিঠ পিছে সারাক্ষণ ফোনকলে চলে বদনাম। সামনে সমনে এগুলো বলে ছেলেকে হাতে রাখে তার অন্য ছেলে মেয়েদের সুবিধা দিতে। এগুলো এখন আর চলবে না। আম্মুর সংসারে অন্যকারউ দখলে যেতে দিব না। আম্মুর কষ্ট অন্য কেউ নষ্ট করবে, নিজের মতো ইউজ করবে তা হবে না। ”
“বন্য তুই শোকে পাথর হয়ে গেছিস। কি বলছিস তা বুঝতেছিস না। মাথা ঠান্ডা কর। খালামনির জন্য দোয়া দরুদ পড়। খালামনির আত্মার মাগফেরাত কামনা কর। এসব চিন্তা ছাড়।”
আর কিছু বলতে পারল না। রৌশন এসে ডাকল লাবন্যকে ওর আম্মুর রুমে যাওয়ার জন্য। বলল ওর আব্বু দাদি আর ফুপুদের সাথে রাগ করে না খেয়ে রুমে চলে গেছে।
সবটা শুনে হিমেল উঠে গেল, বলল “আমার থাকাটা ঠিক হবে না। তুই নিজে গিয়ে খালুজিকে বুঝিয়ে খাইয়ে দিস। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করিস।এখন চরম ধৈর্যের পরীক্ষা চলছে তোর উপর। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।”
হিমেল চলে যেতেই লাবন্য উঠে ওর আব্বুর রুমে চলে গেল টেবিল থেকে খাবারগুলো গুছিয়ে নিল সাথে করে।
“আব্বু তুমি মাত্রই আম্মুর কাছ থেকে আসলে আর এখনই আম্মুর অপছন্দের কাজটা করলে? খাবার রেখে উঠতে হয় না। এখন আর আম্মু নাই যে তোমাকে যত্ন করে ভালোবেসে খাওয়াবে। এখন নিজেরটা নিজেকেই খেতে হবে। নাও খাবার শেষ কর।”
“এই রুমেই নিয়ে এলি কেন?”
“কারন রুমটায় এখনও আম্মুর গন্ধ মিশে আছে। তোমার মনে হবে আম্মুর পাশে বসেই খাচ্ছো।”
“তুই আসলেই অনেক বড় হয়ে গেছিস।”
“মোটেও না, তুমিএভাবে একটু আগে বাচ্চামি করেছো, তাই আমাকে বড় মনে হচ্ছে, আমি আগের মতোই আছি। খাও একটু ঝোল দেই খাও।”
“ফ্রিজে আর কিছু ছিলো না? ”
“ছিলো, কিন্তু সবাই শোকের মধ্যে আছে।এর মধ্যে কি আর বেশি কিছু খাওয়া যায়? বাসি করে কি লাভ, তাছাড়া খাবার নষ্ট করা আম্মুর অপছন্দ ছিলো। তাই শুধু মুরগীই রাধতে বলছি খালাকে।”
“বাসাভরা মেহমান……”
“আব্বু তারা সবাই এখানে শোকে সামিল হতে এসেছে, যখন আনন্দ যাপনে আসতো তখন আর এখনতো এক না। আর তাদের মন পছন্দ সব করার মানুষটাইতো নাই। শোকের মধ্যে কেউ কি খাবারের জৌলুশ খোজে? তখনতো সবাই শুধু খাওয়ার জন্য খায়। যেমন তুমি আমি আর রুশ খাচ্ছি। বাঁচার জন্য খাচ্ছি। আম্মুকে ছাড়া বাঁচা। এ এক অন্য রকম..” আর বলতে পারল না লাবন্যের কন্ঠ ধরে এল।
লিখন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিল।
“আমার আগামীকাল একটা এক্সাম আছে, কিন্তু আমি দিতে চাচ্ছি না।” কাঁদো কাঁদো গলায় রৌশন জানালো।
“দিতে হবে না। আমি তোর ক্লাস ম্যাডামের সাথে কথা বলব। আমাকে তার নাম্বারটা দিস।”
“আব্বু আম্মু মোবাইল আর আলমারি চাবিটা তোমার কাছে রাখো। ” বলে লাবন্য ড্রয়ার থেকে বের করে ওড আব্বুর সামনে ধরল।
“নারে মা আমি অফিসে যাব। কাজের মধ্যে চলে গেলে তখন তোদের প্রয়োজনে চবি পাবি না। তার চেয়ে এগুলো তোর কাছেই রাখ। ”
“ঠিক আছে আব্বু, তুমি যেমনটা চাও। দাঁড়াও আমি রুশের টিচারদের নাম্বার সবগুলো টেক্সট করে দেই তুমি এখনই কথা বলো। রুশ কয়েকদিন স্কুলে যাবে না তা-ও বলে দিয়ো। এরপর তুমি একটু রেস্ট নাও। চল রুশ আমার রুমে চল। তোর এখন পড়ার চিন্তা করতে হবে না। তুই কিচ্ছু ভাবিস না আমি দেখব এখন থেকে তোর পড়াশোনা। চল ভাই আমরা যাই।” বলে লাবন্য রুশকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এল।
রুশকে বিছানায় শুয়ায়ে ওর পাশে লাবন্য শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগল আস্তে আস্তে। মনে মনে ভাবছে নিজের কথা, হঠাৎ এতটা রুড হয়ে যাচ্ছে কীভাবে ও। কেন নিজেকে কন্ট্রেল করতে পারছে না। কেন সবাইকে অপরাধি বলে মনে হচ্ছে। ওর আম্মুর প্রতি সবার আচরন এত সহ্য হয়েছে তবে কেন এখন এগুলো সব বড় অসহ্য লাগছে? ভাবনার ছেদ পড়ল রুশের কথায়
“আপু সবার আম্মু আছে শুধু আমাদের আম্মুই কেন মরে গেল। আমাদের আম্মুকেই কেন আল্লাহ তুলে নিল? আমরা এখন আম্মুকে ছাড়া কীভাবে থাকবো। আমারতো এখন খুব খারাপ লাগছে শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করছে।” বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ও।
লাবন্য কি উত্তর দিবে, ওর যে কোন উত্তর জানা নাই। শুধু ভাইয়ের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে নিরবে চোখের পানি ঝরাতে লাগল।
একটু পরেই মোবাইল বেজে উঠল। নানির নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করল।
“হ্যালো লাবু, নানুমনি কি কর?”
কথাটা শুনে কি হল বুঝলো না কিছু, কেবল বুঝল ভিতরে চাপা পড়া ক্ষোভ বানের জলে ভেসে এক ধাক্কায় বের হয়ে এল। লাবন্য হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল
“নানি তুমি সেইতো কল দিলা, তবে কেন আম্মু বেঁচে থাকতে একটা দিন কল দিলা না। আম্মু যে চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকতো তোমাদের সাথে একটা কথা বলার জন্য। আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে, আমি শুনেছি নিরবে আম্মুর বুকের হাহাকার গুলো। সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে সবার সামনে সুখী মানুষের অভিনয় করে গেছে আম্মু। আমার আম্মু এক বুক কষ্ট নিয়ে চলে গেলো নানি। তুমি জানো না আম্মু কত কত কষ্ট নিরবে হজম করেছে জীবনে। ”
“বল তুই আমাকে যা মন চায় তাই বল। রেশমা বেঁচে থাকতে ও আমাদের অপরাধী হয়ে মনে কষ্ট পেয়েছে। আর এখন ও মরে গিয়ে আমাদেরকে ওর অপরাধী করে ফেলে গেল। যতদিন বেঁচে থাকব এই কষ্ট মনের মধ্যে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। মেয়েটা এভাবে মরে যাবে বলেই হয়তো এবার ওর আব্বার মিলাদে শরীক হয়েছিল। এমন করে মাফ চেয়ে ছিলো আমার কাছে। আমি মাফ করেছি শুনে কি কাঁদাটাই না কেঁদেছিল আমার বুকটার উপর পড়ে। কতবছর পর মেয়েটাকে বুকে নিয়েছিলাম। এখনতো আমি ঘুমাতেও পারছি না ওর কথাগুলো মনে করে। ভেবেছিলাম মেয়েটা আমার স্বামীর সংসারে সুখে আছে। মুখ ফুটে কোন কষ্টের কথাও বলেনি কখনও আমার অভিমানী মেয়েটা। আমি যে ওর মা, আমিতো ওর এভাবে চলে যাওয়াটাকে মানতে পারছি না। আমিতো কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছি নারে। কেন এমন হল? কেন ও এত অল্প বয়সে সবাইকে ফাঁকি দিল? আল্লাহ তুমি বলে দাও আমি এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব।” কথা গুলো তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন।
দুই প্রান্তে দুইজন অঝোরে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল। যে কান্না থামবে না সহজেই। রৌশনও বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল মায়ের জন্য।
রাতে খাবার টেবিলে বসে লিখন লাবন্যকে ডাকল ভাইকে নিয়ে আসতে। ততক্ষণে লাবন্যের দাদি আর দুই ফুপুও এসে বসল টেবিলে। সবার মুখ থমথমে হয়ে আছে কেউ কোন কথা বলছে না। লাবন্য রুশকে নিয়ে এসে টেবিলে বসতেই লিখন জানাল যে রুশের টিচারের সাথে কথা হয়েছে। ওর যে কয়দিন স্কুলে যেতে ইচ্ছে না করে ততদিন বাসাতেই থাকবে। আব্বুর মুখে কথাটা শুনে রুশের চেয়ে মনে হল লাবন্যই বেশি স্বস্তি পেল। ভাবলো “যাক কিছু সময় পাওয়া যাবে ওর পড়াশোনা গোছানোর।”
খাবার সার্ভ করল লাবন্যই এর মধ্যে লাবন্যের বড় ফুপু বলে উঠল
“রাখ আমাদেরটা আমরাই নিয়ে নিতে পারব। তোকে আর কষ্ট করতে হবে না।”
লাবন্য সাথে সাথে রেখে দিল। এমনিতেই খেতে ইচ্ছে করছে না শুধু রুশের জন্যই উঠে আসা তার উপর এখন এসব ক্যাটক্যাট একেবারেই ভালো লাগছিলো না।
“আহা আপা শুধু শুধু মেয়েটার উপর রাগ করছো কেন? বাদ দাও না, ওর মনটার দিকে একটু তাকাও।এখন কি রাগ করার সময়?”
তুই আর কথা নাই বল! দুপুরে কি এমন বলছে মা, যে তুই খাবার রেখে চলে গেলি?
“আপা মনটা খারাপ তার উপর মাথা ব্যথা করছিল। সরি, মাফ করে দাও। ”
“তোর মেয়ে জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে আমরা নাকি রেশমাকে অনেক অত্যাচার করেছি। এসব শুনলে কেমন লাগে বল? এসব শোনার জন্যই কি আমরা আসছি? আমরা কি ওকে ভালোবাসতাম না?”
“ওকে না ওর সেবা যত্নকে বল”। রুশকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছিলো তখনই আস্তে করে বলল লাবন্য।
“কি সেবাযত্ন করছে? হুমম, এত বেশি তেজ দেখাস কারে? যা করছে তা আমার ছেলের কামাই দিয়েই করছে। ওর বাপেরবড়ি থেকে এনেতো আর করে নাই।” লাবন্যের দাদি মনে হল বোম ফাটার মতো ফেটে পড়লেন।
লিখন ইশারা করায় লাবন্য আর কোন উত্তর দিলো না। চুপচাপ নিজেদের খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
উত্তর না পেয়ে তেমন সুবিধা করতে না পেরে পরে নিজেই আবার বলতে শুরু করল।
“রেশমারে ঠাই দিলে আমিই দিছি। এটা ও কোনদিনও ভুলে না। ও যা করতো নিজ থেকেই করতো। এখন ও নাই তাই সবাই আসছে ওর সংসারটার দেখভাল করতে আর তোর মেয়ে টিপ দিলে নাক দিয়ে এখনও দুধ পড়বে, সেই মেয়ে কেমন চটাংচটাং কথা বলছে সবার সাথে। মায়ের আস্কারা পেয়ে মেয়ে একটা বেয়াদব হইছি। মা মরছে কই এখন শোকে নরমতরম হয়ে থাকব তা না কেমন পাগল পাগল আচরন শুরু করছে। মুরুব্বিও মানে না। আমি যে ওর দাদি তাও ভুলগেছে মনে হয়।”
“মা এসব কথা এখন না বললেই কি না? মরা মানুষটাকে এবার একটু শান্তি দাও, এখন ওকে নিয়ে টানাহেঁচড়া নাই করো।” লিখন একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দিল।
“মা বলছিলাম এখানে কোন কথা বইলো না। এবার শুনলাতো তোমার ছেলের কথা! সেই চায় না আমরা এই সংসার দেখা শোনা করি। শুধু শুধু তুমি বলো থাকতে, ভেবেছিলাম চারদিনের মিলাদ শেষে যাব। এখন মনে হয় মান সম্মানের সাথে কাল সকালেই চলে যাওয়া উচিত। ”
এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার লাবন্য ওর বড় ফুপুর কথার জবাবে বলল
“তা দাদিকে কে সাথে নিচ্ছো?”
“মানে?”
“মানে, দাদি কার সাথে যাচ্ছে? এখানে দাদিকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ নেই। দাদির পার্মানেন্ট সেবা করার মানুষটা বিদায় নিয়েছেন। এখন এখানে দাদিকে কে দেখাশোনা করবে? আমি রুশ আব্বু কেউই দিনের বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকবো না। তখন দাদিকে কে দেখবে? পরে একটা অঘটন ঘটলে কে দায় নিবে? তারচেয়ে বরং তোমরা এখন দাদিকে নিজেদের কাছে রাখো। তাতে দাদিও মানসিকভাবে শান্তি পাবে আর নিরাপদে থাকবে। তোমাদেরকেও দুদিন পর পর মা’কে দেখতে দলবেঁধে এখানে এসে পার্টি করতে হবে না। আর করবেই বা কীভাবে হোস্ট তো গন পরপারে।তোমাদের গেস্টের সেবা কে করবে? তার চেয়ে তোমরা তোমার মাকে নিজের কাছে রাখো। ভয় পেও না আমরা তোমাদের ওখানে বন্ধু বান্ধব নিয়ে পার্টি করতে যাবো না।”
“ওরা আমাকে নিয়ে টেনশন করে তাই আসে। ওরা আমাকে ভালোবাসে তাই আসে। তোদের মতো নাকি ওরা? ”
“আমি বুঝি তোমাকে ভালেবাসি না?”
“ভালো যদি বাসবিই তবে তোর মেয়ে এতবড় কথা বলল তুই কিছু বললি না কেন?”
“লাবু যা বলছে তাতে যুক্তি আছে। এখানে তুমি পড়ে মরে গেলে কে দেখবে? এখনতো রেশমা নেই তোমাকেতো বিষয়টা বুঝতে হবে। কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে। প্রতিবেলা ঔষধ কে দিবে? তার চেয়ে তোমার অন্য সন্তানের কাছেই এখন থাকো। তাতে সবার মঙ্গল।”
“আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমার থাকার ব্যবস্থা অন্য সন্তানই করবে।তোকে আর আমার মঙ্গল দেখতে হবে না।”
“বিশ বছরতো ভাবলো, তাহলে আর এভাবে বলছো কেন আব্বুকে। শোনো সবাইতো মুখে মুখে মা মা করে। এখন দেখো কোন সন্তান তোমাকে কতটা আদর যত্ন করে। এই সুযোগে তুমিও তোমার সন্তানদের একটা ছোটখাটো পরীক্ষা নাও। আগেতো বেড়াতে যেতা তাই মন টিকতো না।এখন নিজের করে থাকবা তবেই মন টিকবে।” বলে আর বসল না রুশকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মনে মনে বলল, “জানি সবাই আমাকে খারাপ বলবে, স্বার্থপর ভাববে কিন্তু এই মুহুর্তে এছাড়া আর কোন পথ নেই। আমি একা এতসব দিক সামাল দিতে পারব না। দাদি বাসায় থসকা মানে তাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকা।এই মুহুর্তে তা সম্ভব না।”
চলবে