ছায়া মানব ২
১৮.
অহনা দ্বিধান্বিত! সত্যিই কি মাহতিম তাকে চুমু খাবে? অহনা মাহতিমের থেকে অনেকটাই সরে আসে। খেয়াল করেনি সরে গিয়ে বিপত্তি বাঁধবে। এলোপাথাড়ি পড়ে যায় খাটের ওপর। মাহতিম বিলম্ব করেনি। নিজেও অহনার মুখোমুখি সংঘর্ষে। অহনা ওঠে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করল তবে সেটা খুবই হালকা পরিমাণ। অর্থাৎ বোঝা গেল সেও চায়। মাহতিম ঠোঁট টিপে হাসল। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে নিজের মাঝে। উন্মাদনা বেড়ে গেল। বলেই বসলো,’জোর করব কি? নাকি তুমিও চাইবে? আমি কিন্তু জোর করে পেতে চাইব না কিছুই।’
অহনা টু শব্দও করল না। অর্থাৎ তার মর্জি আছে। মাহতিমের চোখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। শ্বাস-প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। এ কেমন অনুভূতি! ভালোবাসা বলা যায়? এখনো দ্বিধান্বিত অহনা। তার মত নেই তবুও কেমন নিজেকে সঁপে দিল। একটুও বাধা দিচ্ছে না মাহতিমকে। মাহতিম একহাতে অহনার এলো কেশ স্পর্শ করে। অহনা চোখ সরিয়ে নেয়। নিজেকে এলোমেলো লাগছে। বড্ডো উদাসীন, খাপছাড়া লাগছে। সহ্য করতে পারছে না এতোটা কাছাকাছি কাউকে। বিছানার চাদর খামচে ধরে। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। যেন চোখ বন্ধ করলেই কিছুই দেখতে পাবে না, নিশ্চিন্ত! মাহতিম অহনার বেপরোয়াভাব দেখে আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। মুহুর্তেই জাগতিক সকল নিয়ম-কানুন ভুলে নিজের শুষ্ক অধর স্পর্শ করে অহনার কপালে। মেয়েটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু’হাতে মাহতিমের শার্ট খামচে ধরে। মাহতিম দীর্ঘ চুম্বন করে নিজেকে কিছুটা হালকা করে নেয়। অহনার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। দুটি মন মিশে একাকার তাদের সম্মতিতেই। কেউ কাউকে বাধা দেয়নি। বাধা দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণও নেই। ভালোবাসায় বেহায়াপনা বলে কোনো শব্দ নেই। সবকিছুই সঠিক বলে মনে হয়। দুনিয়াবি নিয়মে যেটা অপরাধ, কলঙ্কের তকমা, ভালোবাসার জালে সেটাই স্বর্গসুখ। তাহলে কেন বাধা দেবে?
দুজনেই যখন প্রেম বিলাতে ব্যস্ত তখনই কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হয়। মাহতিম দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নেয় অহনার ওপর থেকে। অহনাও বন্ধ চোখ সহসাই খুলে ফেলল। প্রাণভরে শ্বাস নিল। শব্দ তার কানে আসেনি। শুধু অনুভব করেছে মাহতিম সরে গিয়েছে। এতক্ষণের অনুভূতি ঘেরা সময়টা চলে যেতেই অহনার শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে ওঠে। দুহাতে নিজেকে আঁকড়ে ধরে সামলানোর চেষ্টা করে। মুহুর্তেই মনে পড়ে একটু আগের কথা। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে আসে তার সাথে অজানা ভয় জেঁকে বসে। অহনা ছলছল চোখে মাহতিমের দিকে তাকায়। সে ওঠে গিয়ে বাহিরটা দেখল। কেউ নেই, তবে ফুলদানিটা পড়ে আছে। এ থেকে নিশ্চিত, কেউ তাদের একসাথে দেখেছে। মাহতিম কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেও প্রকাশ করল না। অহনার কাছে এলো দ্রুত। অহনা এখনো মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়ালো। হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না। মাহতিম নিজেকে যেন অপরাধী মনে করছে। সে আবেগের বশে ভুল করে বসলো। এই মুহুর্তে অহনাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে? একটা সরি বললেই কি সব সমাধান হবে? ভাবনায় পড়ে গেল সে। একখানা টিস্যু এগিয়ে দিল সে। অহনা সেটা হাতে নিল না। মাহতিম ওপরে তাকিয়ে বড়ো করে শ্বাস নিল। পরপরই তার পাশেই বসলো। লেপটা অহনার গায়ে জড়িয়ে দিল। টিস্যু দিয়ে নিজ হাতে অহনার চোখের পানি মুছে দিল। অহনার কান্নার মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেল। ভেজা কন্ঠে বলল,’এটা ভুল হয়েছে। এমনটা করা উচিত হয়নি আমার। আপনাকে বাধা দেওয়া উচিত ছিল।’
মাহতিম লজ্জিত, সেও ভুল করেছে। অপরাধী এই মুহূর্তে দুজনেই, তাহলে কে, কাকে সান্ত্বনা দেবে? মাহতিম কাঁচুমাচু মুখে বলল,’আমি সরি! তুমিও বাধা দাওনি, আমিও নিজের হুঁশে ছিলাম না। মাফ করে দিও।’
‘মাফতো করেই দিতে পারব কিন্তু চুমুর কী হবে?’
‘মানে?’
‘আমার জীবনের প্রথম চুমুটা আপনি নিয়ে নিলেন। খুব খারাপ লাগছে আমার।’
মাহতিম তাড়াতাড়ি ওঠে দাঁড়াল। অহনার কথাটা পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করল। সে ভেবেছে লজ্জা হরণ করার জন্যই অহনা কাঁদছে, কিন্তু এ দেখি অন্য কারণে। মাহতিম রয়েসয়ে বলল,’তুমি কি চেয়েছিলে প্রথম চুমুটা অন্য কারো থেকে পেতে?’
‘নাতো! ছি! আমি এমনটা কখনোই চাইব না।’
‘তাহলে এ নিয়ে কান্না করার কী আছে?’
‘সেটাই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে। বেসামাল লাগছে খুব। কেমন লাগছে, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। অনেক বড়ো অন্যায় করলাম আমি।’
‘যদি বলো, তবে তোমার চুমু তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব। এর জন্য আবার কষ্ট পেলে আমি কেস খেয়ে যাব। তাই বলছি ফিরিয়ে দিই আবার?’
‘কিভাবে ফেরত দেওয়া যায়? আমার জানা নেই।’
‘তুমি চোখ বন্ধ করো, আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।’
অহনা কিছুক্ষণ ভেবেই চোখ বন্ধ করল। মাহতিম কিছুটা এগিয়ে আসতেই চোখ খুলে ফেলল,
‘না, ফেরত দিতে হবে না। আমি বোকা নই। ফেরত দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়।’
‘তোমার মর্জি! আমি তাহলে আসি।’
অহনা কেমন ধ্যানে পড়ে গেল। কিছুই বলল না। পুরো শরীর জুড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে। মাহতিম গেল না, পুনরায় ফিরে এলো। অহনার কাছে এগিয়ে আসে,
‘আমি কখনো ভালোবাসা শব্দটা উপলব্ধি করিনি। কাউকে নিজের একদম কাছে পেলে কেমন অনুভূতি হয় তাও জানা ছিল না। কাউকে দেখে হৃদকম্পন হয়, সেটাও জানা ছিল না। জানা ছিল না ছুঁয়ে দেওয়ার মায়া। অথচ তোমাকে দেখার পর থেকেই আমি উপলব্ধি করলাম একের পর এক। শুধু ছোঁয়াটাই বাকি ছিল। তাও আজ পূরণ হলো। বলতে দ্বিধা নেই, ভালোবেসে ফেলেছি খুব করে। এই অল্প সময়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা বা ছোঁয়ার ইচ্ছে কখনোই হবে না।’
মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। বের হয়ে গেল। অহনা বিভোর হয়ে মাহতিমের বলা কথাগুলো আওড়ে নিল। বার কয়েক উচ্চারণ করল শেষ দুটি লাইন। হৃদয় জগত থেকেই যেন তাকে জানানো হলো,’তুমিও পথ হারিয়েছ অঙ্গনা।’
সকাল হতেই রোস্তম এসে হাজির হলো চৌধুরী বাড়িতে। মেয়েকে কোথায় থাকার অনুমতি দিয়েছে তা দেখতেই মূলত আসা। সদর দরজায় পা রাখতেই নিহার চোখাচোখি হলো। রোস্তমকে ততটা সম্মান প্রদর্শন না করেই বলল,’কী চাই?’
রোস্তম এদিক ওদিক তাকাল। কাউকেই তেমন চোখে পড়ল না। নিহার কথায় উত্তর দিল,’অহনা আছে? আমার মেয়ে। বলল, এখানেই এসেছে।’
‘ও আচ্ছা, আপনি তাহলে মিষ্টি মেয়েটার বাবা। ভেতরে আসুন।’
অহনা এবং মোহনা কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। ইতমধ্যে আনিফাও হাজির। অহনা নিজের বাবাকে অনেকদিন পর দেখে আবেগে কেঁদেই দিল। শহরেই তার বেড়ে ওঠা। নিজ গ্রামের খবর তার অনেকটাই অজানা। মাঝে সাঝে যায়, তাও অনেক বছর পর। গ্রামের অবস্থা ততটা ভালো নয় বলেই রোস্তম মেয়েকে সেখানে রাখেনি।
মাহতিম হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। বর্ষণও নেমে এলো। মাহতিমের পাশ কাটিয়ে এসে আনিফাকে বলল,’আম্মা, আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি।’
আনিফা ব্রু কুঁচকে বলল,’এই সকালে কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ কিছু কাজ আছে। চিন্তা করোনা। কাল-পরশু ফিরে আসার চেষ্টা করব। না পারলেও আমি জানিয়ে দেব। এখন বিদায় দাও।’
আনিফার মন মানতে চাইল না। তবুও ছেলের জোরাজুরিতে রাজি হলো। সবার থেকেই বিদায় নিল বর্ষণ। মোহনা, নিহা, মাহিনূরের থেকে বিদায় নিয়ে শেষে অহনার কাছে গেল। মলিন মুখে মলিনতার হাসি ফুটে ওঠল। অহনা বুঝতে পারল, জোর করেই হাসিটা মুখে এনেছে। তারপর মাহতিমের মুখোমুখি দাঁড়াল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সবশেষে বলল,’আসছি ভাই!’
যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই মাহতিম সামনে এসে দাঁড়াল,
‘কান্না করেছ নাকি ভাই? তোমার চোখ-মুখ এমন ফোলা কেন?’
বর্ষণ বিচলিত হাতে চোখ-মুখ মুছে বলল,’কই? আমি কান্না করব কেন? রাতে ভালো ঘুম হয়নি। জানিসতো অনেক কাজ করতে হয়। আসি তাহলে। ভালো থাকিস!’
‘কিন্তু!’
‘ কোনো কিন্তু নয়। আসছি!’
বর্ষণ চলে যেতেই মাহতিম কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। এতদিন ভাইয়ের চোখে নিজের জন্য স্নেহ দেখেছে আজ কেমন অন্যকিছু দেখল। যেন বহু কষ্টে দাঁত খিঁচে সমস্ত কথা বলে গেল।
সবার সাথে অনেক ভালো রয়েছে অহনা সেটা দেখে খুশি হলো রোস্তম। তাকে নিয়ে যেতে চাইল। একজন সফল কৃষক হওয়ায় সাধারণের থেকে ভালোই তার রোজগার। ভেবেছে একটি বাংলো ভাড়া করবে মেয়ের জন্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো, মেয়েটা একা কী করে থাকবে? রান্নাওতো করতে পারেনা। বসে বসে খাওয়ায় মামার বাড়িতেও আপত্তি ছিল বলে ম্যাচে দিয়েছে। ভেবেছিল বড়ো মেয়েদের সাথে ভালোই থাকবে। রান্নার জন্য কাজের লোকও ছিল। এখন তবে কে দেখবে? অহনার মা সব ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকতে পারবে না, না পারবে রোস্তম। অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেও মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইল। তবে আনিফা বাধা দিল। কিছুটা নরম গলায় বলল,’আপনি হয়ত আমাদেরকে ভরসা করতে পারছেন না। তাই মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছেন। যতটুকু জেনেছি, শহরে একা মেয়েটা কী করে থাকবে? তার চেয়ে ভালো হয় ও আমাদের সাথেই থাকুক। আমার মেয়ের মতোইতো অহনা। সমস্যা হবে না কোনো। তাছাড়া আমি ভিন্ন কিছুও ভেবেছি। আপনার সাথে আলাপ করব বলেও ঠিক করলাম। এখন যদি নিয়ে যান, তবে আমি কষ্ট পাব।’
‘মেয়ের নিরাপত্তার জন্যই বললাম। যদি ও এখানে থাকতে চায় তাহলে আমার আপত্তি থাকবে না। আপনাদের বিনয় দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে ভালোই থাকবে।’
রোস্তম অনেকটা নিশ্চিত মনেই চলে যেতে চাইল। যাওয়ার আগে কিছু একটা ভেবে অহনাকে ডাকল। কাছে যেতেই বলল, ‘ঐশ্বর্য কখনো তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে না, বার বার ধোঁকা দেবে। সাবধান, কখনো লোভ করোনা। এটাও মনে রাখবে, মিথ্যে ভয়ঙ্কর। যেখানে আছ, এখানে সত্য দিয়ে সবার মন জয় করবে। আর শোনো, অযথা বিনয়ী বা মাথা ঠেকাবে না। সম্পদে দৃষ্টি দেবে না। তুমি তোমার আদর্শে ঠাঁই দেবে সরলতা এবং বিচক্ষণতাকে।’
‘আমি তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব বাবা।’
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় নিল রোস্তম। আনিফা তাকে বিদায় দেওয়ার আগে কিছু বলল। তবে আড়াল থাকল অহনার কাছে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্প সম্পর্কে জানতে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership