#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৩৫
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )
”
”
”
”
কেটে গেল কয়েকটা দিন। বদলেছে অনেক কিছু। ফায়াজ, রিফা এবং রুদ্ধর বাবা এখন হুর আর রুদ্ধর সাথে খাবার খায়।তবে রুদ্ধ কারো সাথে কথা বলে না। হুর মাঝে মাঝে কয়েকটা কথা বলে। এবং অনেক সময় ফায়াজের কথা তাকে শুনতে হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বে।আর রিফা যতবার কথা বলেছে ততবারই হুরের মনে হয়েছে সে তার ওপর রাগ ঝাড়ছে। কিন্তু কিসের জন্য রাগ ঝাড়ছে তা বুঝতে পারছে না।
সময়টা এখন রাতের। একত্রে সবাই খাবার খেতে বসেছে। চুপচাপ ভাবে যে যার মত খাবার খাচ্ছে। তখনই হুর ফায়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
“কেমন হলো ভাইয়া আপনার ইন্টারভিউ?
হতাশ সুরে ফায়াজ বলে,
“আর বলো না হু..আব আই মিন ভাবি।কয়েক জায়গাতেই ইন্টারভিউ দিলাম।কিন্তু ফিডব্যাক পেলাম না।এক জায়গাতে ইন্টারভিউ দিয়ে মনে হল হয়তো কাজটা পেতে পারি।তবুও পুরোপুরিভাবে শিওর হতে পারছি না।
আড় চোখে রুদ্ধের দিকে তাকালো হুর। রুদ্ধর ভাবগতি আগের মতই। মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে।ভাতখানা এমন আশেপাশে কি হচ্ছে কে আছে তা তার দেখার বিষয় না।হতাশ হল হুর। বলল,
“ও..
আবারো নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।ফায়াজের মন খুট খুট করছে কিছু বলার জন্য। তবে রুদ্ধের কারণে বলতে পারছেনা। একটা মানুষকে এতটা ভয় পাওয়া খুবই লজ্জাজনক বিষয়।আকস্মিক ফায়াজের মনে এক প্রশ্ন আসলো।
“আচ্ছা বাবা, ভাইয়া কার মত হয়েছে?
সোহেল শেখ ফায়াজের দিকে তাকালেন।ঠোঁটের কোনে চলে আসলো এক চিলতে হাসি। হাসিমুখে নিয়ে বেশ আনন্দের সহিত বললেন,
“তোমার বড় মায়ের মত হয়েছে। তোমার বড়মা এমনই রাগী ছিল। এমনকি চেহারাটাও তোমার বড় মায়ের মতই পেয়েছে।
ঠা/স করে প্লেটে চামচ রাখল রুদ্ধ। সবাই রুদ্ধর দিকে তাকালো। থমথমে মুখ রুদ্ধর। সোহেল শেখ ভুলে গিয়েছিলেন তাদের মাঝে রুদ্ধ ও আছে। রুদ্ধের থমথমে মুখ দেখে তৎক্ষণাৎ তিনি নিজের মুখ বন্ধ করে নিলেন। শুধু সোহেল শেখ না ফায়াজ ও আর কথা বলল না।নিরব রইলো সকলে।
——————–
“যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আপনার দাড়ি কাটবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমার কাছে আসবেন না।আব..কাছে আসবেন তবে চু’মু খাবেন না।
আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল আর দাড়ি সেট করছিল রুদ্ধ। তখনই হুরের কথা কর্ণ পাতে আসে। হুরের এমন শর্ত শুনে ভ্রু খানিক কুচকে আসে।কপালে ভাঁজ নিয়ে বলে,
“আমার দাড়ির সাথে চু’মুর কি সম্পর্ক?
মিনমিন স্বরে হুর বলে,
“আপনি যখন আমায় চুমু দেন তখন আপনার দাড়ি আমার ভীষণভাবে জ্বালাতন করে।বড্ড সুড়সুড়ি লাগে। মাঝে মাঝে চু’মু খাওয়াতেও ব্যাঘাত ঘটায়।যা মেনে নিতে পারছি না আমি।
রুদ্ধ কিছু বলেনা এক দৃষ্টিতে হুরের দিকে তাকিয়ে থাকে।অনেকক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে বলে।
“আই সি!চু’মু খাওয়ার জন্য দেখছি উতলা হয়ে যাচ্ছো। কাছে গেলেই তো থরথর করে কাঁপা শুরু করে দাও। আর আজ নিজে থেকে চু’মুর কথা বলছো!ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক হয়ে গেল না?
ধরা খেয়ে চুপ হয়ে গেল হুর। দৃষ্টি বদল করলো। নিম্ন স্বরে বলল,
“আমি আপনার এত বড় বড় দাড়ি চুল দেখতে চাই না। দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগে। মনে হয় জঙ্গল থেকে উঠে এসেছেন। এখন আপনি ডিসাইড করে নেন আপনি চুল দাড়ি কাটবেন,নাকি আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন?
বিদ্রুপের স্বরে রুদ্ধ বলে,
“কে আটকাবে আমায় তোমার কাছে যেতে চাইলে?আমি জঙ্গল থেকে উঠে আসি বা আমায় অদ্ভুত লাগে তাতে কোন কিছুই করার নেই। আমি যেমন আছি তেমনি তোমায় গ্রহণ করতে হবে। হয় ইচ্ছেয় না হয়,বাধ্যকতায়।
পরদিন সকাল…
সকালে রুদ্ধ বেরিয়ে গেছে বাহিরে। হুরকে বলে গেছে আর্জেন্ট কিছু কাজ আছে।রুদ্ধ যাওয়ার পর আর হুরের ঘুম আসে না। তাই সে টেবিলে বসে পড়ে পড়ার জন্য। কয়েকদিন পরেই টেস্ট হবে। তাই খামখেয়ালী না করে পুরো দমে পড়তে বসেছে। টেবিলে বসে পড়তে ভালো লাগছে না। তাই বই নিয়ে চলে আসলো বিছানায়। কম্বল দিয়ে ভালোভাবে নিজেকে জড়িয়ে বসে পায়ের ওপর বই রেখে পড়তে লাগলো।ঘন্টা খানিক অতিক্রম হল। রুমের দরজা খোলা আর শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছালো। দরজার দিকে তাকাল হুর। লম্বা শক্তপক্ত এক মানুষকে দেখতে পেল। চেহারার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটা বড্ড চেনা তার।তার ই স্বামী।তবে তার আদল পুরো বদলে গেছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকে পরখ না করলে বোঝা যাবে না যে সে রুদ্ধ। হুরেরও কিছুটা সময় লেগেছে রুদ্ধকে চিনতে।চুল আগের মত বড় নেই। মার্জিতভাবে কেটেছে তবে স্টাইলের সাথে। আর রইল কথা দাড়ির!সেটাও কেটে চাপ দাড়ি রেখেছে।দেখতে খুবই চার্মিং লাগছে।বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্ধের দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এটা রুদ্ধ। চোখের দৃষ্টি সরছেনা। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই আনমনে বিড়বিড় করে বলে,
“ইশ্,আমার জামাই টা কত্ত কিউট!
হুর এর রিঅ্যাকশন দেখে রুদ্ধ রুমের ভিতর এসে হুরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হুরের পলক এখনো পড়ছে না। তা দেখে রুদ্ধ গলা খাকাকি দিল। সম্বিৎ ফিরে পেল হুর। রুদ্ধ কপাল কুঁচকে বলে,
“এখন ঠিক আছে?
“ঠিক আছে মানে, দুর্দান্ত আছে।
আর কোন কথা না বলে রুদ্ধ চলে গেলে ওয়াশরুমে।হুর হা করে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটাকে আজকে সুন্দর লাগছে।এক কথায় অসাধারণ। হুর যদি জানতো রুদ্ধ তার কথা শুনে চুল দাঁড়ি কেটে আসবে তাহলে অনেক আগেই বলতো। বলতে পারত না ভয়ে ভয়ে। যদি মানুষটা তাকে মেরে বসে!তাই নিজের মধ্যে সবকিছু চাপা রাখতো। তবে এখন বুঝলো রুদ্ধ যাই করুক না কেন তাকে হয়তো কোনদিন মারবে না। আর মারলেও এক দুইটা থাপ্পর নসিবে পড়বে। তা সহ্য করার মত শক্তি হুরের কাছে আছে। খুশিতে ডানা মেলে উড়তে মন চাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে রুদ্ধকে তার আঙ্গুলে নাচাতে। নিজেকে রানী মনে করে আর রুদ্ধকে প্রজা মনে করে এক একটা আদেশ দিতে ইচ্ছে করছে।
সকালের নাস্তা করে রুদ্ধ চলে যায় তার অফিসে।রুদ্ধ অফিসে যেতেই ফায়াজ মেতে উঠে দুষ্টামিতে। কখনো কখনো হুরের সাথে লেগে যাচ্ছে তো আবার জেরিন আর লিলির সাথে। কথার ঝুলি তার খতম ই হচ্ছে না। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটায় চলে যায়। হুরের মত জেরিন আর লেলিও প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল ফায়াজের এত কথা বলায়। তবে এখন সয়ে গেছে তাদের। হুরের মতো তাদের ভাবতে কষ্ট হয় যে,ফায়াজ রুদ্ধর ভাই। তবে এই ভেবে খুশি যে ফায়াজ রুদ্ধর মত হয়নি।
দুপুরের খাবার সময় প্রায় চলে এসেছে।ফায়াজ, হুর আর রিফা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ফায়াজের হাতে টিভির রিমোট। সে একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করছে। আর হুর মনোযোগ সহকারে তা দেখছে। চ্যানেল চেঞ্জ করার মাঝে হঠাৎ পুরের মনে হল সে রুদ্ধকে দেখতে পেয়েছে। তাই হুর তড়িঘড়ি করে ফায়াজকে বলল,
“ভাইয়া ব্যাক এ যান!
তাই করল ফায়াজ।টিভির স্ক্রিনে থাকা রুদ্ধের ছবি দেখে এবং সাংবাদিকদের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল হুর।ফায়াজ আর রিফা ও চমকে গেল।টিভিতে ফাঁকা একটি সাংবাদিক বলছে,
“কিছুক্ষণ পূর্বেই ধানমন্ডি লেকের পাড়ে পুলিশরা একটি লাশ উদ্ধার করেছে। লা/শের অবস্থা খুবই করুন, বিধ্বস্ত। অর্ধ গলাকাটা। দেখে মনে হচ্ছে কেউ ষড়যন্ত্র করে খু/ন করেছে। লা/শের কাছ থেকে একটি তথ্য ও পাওয়া গেছে। সেটি হচ্ছে খু/নির এনআইডি কার্ড। লা/শের কাছ থেকে যার এনআইডি কার্ড পাওয়া গেছে সে আর কেউ নয় “দ্যা গ্যাংস্টার অফ রুদ্ধর”হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন আপনারা। গ্যাংস্টার রুদ্ধ নির্মমভাবে এই লোকটিকে খু/ন করে পলাতক হয়েছেন। আরো জানা গেছে,গ্যাংস্টার রুদ্ধর শত্রুপক্ষ দলের লোককে তিনি খু/ন করেছেন।এখন লা/শটির ময়না তদন্ত চলছে।এবং গ্যাংস্টার রুদ্ধকেও তালাশ করছে পুলিশ। পরবর্তী আপডেট পেতে হলে রাখুন “টুয়েন্টি ফোর চ্যানেলে”
সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল হুরের হৃদয়।মনে হচ্ছে অতি প্রিয় জিনিসটিকে সে হারাতে যাচ্ছে। শূন্য লাগছে বুক। আর্তনাদ ও করছে। ধপ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। জ্ঞানশূন্য হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। কোথাও ফোন পাচ্ছে না। বিচলিত হয়ে খুঁজছে। উত্তেজনার শরীর কেঁপে উঠছে। ফায়াজ বোধহয় হুরের মনোভাব বুঝতে পারল। তাই তাকে অভয় দিলো।
“হুর কাম্ ডাউন!এত হাইপার হয়ো না। নিজেকে শান্ত রাখো। তুমি বস আমি তোমার ফোন খুঁজে আনছি।
জোর করে হুরকে বসালো। শূন্য থেকে শূন্য হচ্ছে হুরের হৃদয়। টলোমলো হয়ে গেল আখি পল্লব। যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে পারে।শুধু পলক ঝাপটানো বাকি।ফায়াজ হন্তদন্ত হয়ে হুরের ফোন খুঁজছে। ড্রয়িং রুমে না পেয়ে দৌড় মারলো হুরের রুমের দিকে। হুরের বিছানায় ফোন রাখা। ফোন হাতে নিয়ে দৌড়ে নিজে এসে হুরের হাতে ফোন দিল।কাঁপা কাঁপা হাতে হুর রুদ্ধর নাম্বার ডায়াল করল।ফোন রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। আরো ভীত হল হুর। একনাগাড়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। তবুও ফোন রিসিভ হচ্ছে না। এবার সে কান্না করে দিল। কান্না করতে করতে ফোন আবার লাগালো। এবারও ফোন রিসিভ হচ্ছে না দেখে ফ্লোরে বসে কান্না করতে লাগলো। হুরের কান্না শুনে লিলি, জেরিন আর সোহেল শেখ রুমে আসলেন।হুকর কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তারা আশ্চর্য হলেন। জেরিন এসে হুরকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? হুর তুমি এভাবে ফ্লোরে বসে আছো কেন? আর কান্নাই বা করছ কেন?
কান্নার জোরে কোন কিছু বলতে পারছে না হুর। অসহায় চোখে জেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে।জেরিনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না স্বরে বলে,
“আপু, আপু উনার ফোন লাগছে না। নিউজে দেখাচ্ছে উনি নাকি কাউকে খু/ন করেছেন।আমি জানি এসব মিথ্যা। উনি কাউকে খু/ন করতে পারেন না। আমি উনার কাছে যেতে চাই।আমাকে প্লিজ উনার কাছে নিয়ে যাও।
কিছু বুঝতে না পেরে ফায়াজের দিকে তাকালো জেরিন।ফায়াজ ঘটনা বলল।হতবিহ্বল হয়ে গেল জেরিন,লিলি,সোহেল শেখ।হুরের বিধ্বস্ত অবস্থার কারণ বুঝতে পারল। হুরের হঠাৎ খেয়াল হল তার ফোনে ইমতিয়াজের ও নাম্বার সেভ করা। দুগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া লবণাক্ত পানিগুলো হাতের তালু দিয়ে মুছে ঘোলাটে চোখ নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো।চোখ স্থির করতে কিছুটা সময় লাগলো। তারপর ইমতিয়াজের নাম্বার এ কল দিল। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেছে। এবার যখন ফোন দিল কল কেটে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ হলো। হুরের কলিজায় যেন এক ফোঁটা পানি আসলো। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া আপনি কোথায়?আর উনি!উনি কোথায় আছেন?আমাকে প্লিজ তার সাথে কথা বলিয়ে দিন।
হুরের কন্ঠস্বর শুনে ইমতিয়াজ বুঝলো হুর কান্না করেছিল।হুরকে আশ্বস্ত করে ইমতিয়াজ বলল,
“ভাবি ভাইয়া একটু ঝামেলার মধ্যে আছে। ঝামেলা থেকে ফ্রি হলে আমি বলব আপনাকে ফোন করতে।
আরো উত্তেজিত হয়ে গেল হুর ।মন তার কু ডাকছে। মনে হচ্ছে রুদ্ধকে কেউ তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিবে। হেঁচকি তুলে হুর বলে,
“নিউজে যা দেখিয়েছে তা কি সত্য ভাইয়া?
ওপাশ থেকে কোন কথা আসছে না। তা থেকে ফোন সরিয়ে হুর দেখল ফোন কেটে যায়নি। বুঝলো ইমতিয়াজ স্বইচ্ছায় চুপ করে আছে। তা দেখে হুর আবার বলে,
“বলোনা ভাইয়া নিউজে যা দেখিয়েছে তা কি সত্য?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমতিয়াজ বলে,
“যতটুক আমি ভাইয়াকে চিনি ভাইয়া কোন খু/ন করেনি। বাকিটা ভাইয়ের মুখ থেকে শুনলে বোঝা যাবে।
“উনি এখন কোথায় প্লিজ? উনার কাছে ফোনটা দিন না!
কাঁপা কন্ঠস্বর ইমতিয়াজের,
“ভাই তো এখন পুলিশ স্টেশনে।
গলগল করে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে হুরের।শব্দ করে কেঁদে উঠে।বলে,
“আপনি না বললেন উনি কোন খু/ন করেনি? তাহলে পুলিশ কেন নিয়ে গেছে তাকে?আপনি কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে তাই না?প্লিজ সত্যিটা বলুন আমায়।
“ভাবী আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি কোন কিছুই মিথ্যা বলছি না। যতটুকু আমার ধারণা ভাইয়া খু/ন করতে পারে না। আর পুলিশ স্টেশনে থাকার কারণ হচ্ছে পুলিশরা ভাইয়াকে সন্দেহ করছে। তাই তাকে নিয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাচ্ছি।
ইমতিয়াজ হুরকেও ভয় দিলেও ভয় কমে না তার। কান্না করতে করতে বলে,
“আমিও যাবো পুলিশ স্টেশনে।
“আপনাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে ভাইয়া অনেক রাগ করবে।
“আমি কোন কিছু জানি না, আমি পুলিশ স্টেশনে যাবো মানে যাবো।
ইমতিয়াজ নিরাশ হল। বুঝলো হুর এভাবে মানবে না। তাই বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি কিছুখন অপেক্ষা করুন আমি আপনাকে নিতে আসছি।
কল কেটে দিল ইমতিয়াজ।হুরের কান্না কমলো না। একনাগাড়ে কান্না করে যাচ্ছে। বিমূঢ় হয়ে ফায়াজ হুরের কান্না দেখছে।মেয়েটা সে কখন থেকে কান্না করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। থামাথামি নাম নেই। চোখ দিয়ে এত পানি কোত্থেকে আসছে তার!কই আজ অবধি তো তার চোখ থেকে এক ফোটাও পানি পড়েনি।হুর মেয়ে দেখে কি তার চোখ দিয়ে এত পানি পড়ছে?হতেও পারে!সোহেল শেখ সোফার মাথা নিচু করে বসে আছে। তারও চোখে পানি টলমল করছে। নিজেকে এবং হুরকে দেয়ার মত কোন সান্তনা খুঁজে পাচ্ছে না।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইমতিয়াজ আসলো ।ইমতিয়াজকে দেখে তড়িঘড়ি করে ফ্লোর থেকে উঠে ইমতিয়াজের কাছে গেল হুর।গালের পানি আবারো হাতের তালু দিয়ে মুছে বলল,
” চলুন!
থামিয়ে দেয় ইমতিয়াজ ।পকেট থেকে কিছু একটা বের করে হুরের সামনে ধরে। হুর তাকিয়ে দেখে একটি মাস্ক। ইমতিয়াজ বলে,
“মাস্ক পড়ে ভালোভাবে মাথায় ঘোমটা দিন।
ইমতিয়াজের কথা মত কাজ করলো হুর।সময় ব্যয় না করে দুজন চলে গেল পুলিশ স্টেশনে।সোহেল শেখ আর ফায়াজ ও আসতে চেয়েছিল তাদের সাথে। কিন্তু ইমতিয়াজ তাদের মানা করে দেয়। তাদের দেখে যদি রুদ্ধ ক্ষেপে যায় তাহলে ব্যাপার হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।তাই আর তাদের নিলোনা।দশ মিনিটে পুলিশ স্টেশনে তারা পৌঁছায়। স্টেশনের বাহিরে মানুষের অনেক ভিড়। মিডিয়া,জনগণ ,এমনকি পুলিশরাও ভিড় জমিয়েছে।হুর ভিড়ের কারণে সামনে যেতে পারছিল না। গার্ডরা সবাইকে চাপিয়ে হুরকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দিল। বড় বড় পা ফেলে ইমতিয়াজের পিছে পিছে যাচ্ছে হুর।স্টেশনের ভিতর প্রবেশ করে বড় কক্ষের ভেতর চোখ বুলিয়ে রুদ্ধকে দেখার চেষ্টা করল। চোখ আটকে গেল বাম পাশের টেবিলের দিকে। চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে রুদ্ধ। মুখোমুখি হয়ে সামনে বসে আছে অফিসার। অফিসার কে ক্ষিপ্ত দেখা যাচ্ছে।তবে রুদ্ধ স্বাভাবিক। হাফ ছেড়ে বাঁচলো হুর। হুর মনে করেছিল গতবারের মতো এবারও রুদ্ধকে লকআপে ঢোকাবে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সামনে এগিয়ে আসলো।
ইমতিয়াজের পিছনে সে।ইমতিয়াজ রুদ্ধ এবং অফিসার কে পরখ করে বলল,
“কোন সাহসে আপনি আমার ভাইয়াকে স্টেশনে নিয়ে এসেছেন?
অফিসার উপহাস করে বললেন,
“খু/নিকে তার আসল ঠিকানায় নিয়ে এসেছি। এতে সাহস দেখানোর কি আছে?
প্রতিবাদ করে ইমতিয়াজ বলে,
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার।আমার ভাইয়া খুন করেনি।
অফিসার বলে,
“লাশের পাশে আপনার ভাইয়ের এনআইডি কার্ড পাওয়া গেছে।গ্যাংস্টার রুদ্ধ খু/ন করার সময় হয়তো খুব জোশে ছিলেন। তাইতো তিনি তার হোস হারিয়ে ফেললেন। ভুলে লা/শের কাছে নিজের এনআইডি কার্ড রেখে আসলেন। তবে এতে লাভ আমাদেরই হয়েছে। খুব সহজে ক্রিমিয়ালকে ধরতে পেরেছি। আগেরবার তো টাকার জোরে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার তাকে কে বাঁচাবে?এবার খু/নের চার্জ লেগেছে তার উপর।এবার তো তার বেঁচে ফেরা খুবই মুশকিল।
বাঁকা হেসে অফিসারের দিকে তাকালো রুদ্ধ।বলল,
“দেখি কতক্ষণ আটকে রাখতে পারেন।
অফিসারের চাহনি কঠিন হলো।যার দরুন বোঝা গেল রুদ্ধর কথা তার পছন্দ হয়নি।অপরাধ করে তাকে উপহাস করা হচ্ছে দেখে ভীষণ রাগ লাগলো তার। কঠিন কিছু বাণী শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। বলার জন্য মুখ খুলবে ,সে সময় রুদ্ধর লয়ার হাজির হয়। তিনি তার চশমা ঠিক করতে করতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন,
“সরি, একটু লেট হয়ে গেছে। আসলে ট্রাফিক জ্যাম অনেক ছিল।
বলে তিনি তার ফাইল থেকে একটি পেপার সামনে এগিয়ে দেন অফিসারের দিকে। তা দেখে অফিসার। বেইলপেপারস। ক্রুদ্ধ নয়নের রুদ্ধর দিকে তাকালো। তা দেখে রুদ্ধ তাচ্ছিল্য হাসলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোট ঠিক করতে করতে বলল।
“কি হলো? সব হাওয়া শেষ? আমাকে আটকে রাখার সাধ্য কেউর কাছে নেই। আর রইল কথা আপনার লা?শের পাশে পাওয়া এনআইডি কার্ডের।
রুদ্ধ তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে নিজের এনআইডি কার্ড বের করল।সোজা করে অফিসারের দিকে দেখালো।বলল,
“ইট’স মাই এনআইডি কার্ড।আর আপনারা যেটা পেয়েছেন সেটা ফেইক।আপনাদের সোর্স তো অনেক দূর দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। এখন ফেইক এনআইডি কার্ড দ্বারা খুঁজে বের করুন আসল ক্রিমিনাল কে।
বলেই ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রুদ্ধ।ইমতিয়াজ তার পিছনে তাকাতে ইশারা করলো। ইশারা বুঝে রুদ্ধ কপাল কুঁচকে পিছনে তাকালো। মাথা নত করা নারীকে দেখে মুখভঙ্গি বদলে গেল।মাথায় বড় করে ঘোমটা টানা। আবার মাথাও ঝুকানো। মুখ একদমই দেখতে পাচ্ছে না।মুখ না দেখেই বুঝল,এই নারীটা কে!আরেকটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝল মেয়েটা কাঁদছে। বারবার তার শরীর কেঁপে উঠছে।ইমতিয়াজ কে সরে যেতে বলল। সরে গেল ইমতিয়াজ। রুদ্ধ এগিয়ে হুরের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসল।রুদ্ধের স্পর্শ পেয়ে হুর মুখ তুলে চাইল।হুরের ভেজা চোখ দেখে স্মিত হাসল রুদ্ধ।হুরের হাত থেকে হাত সরিয়ে পিঠে রাখে।হুরের সাথে ঘেঁষে দাঁড়া হল।অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা করতে পেরে ভালো লাগল।টাটা..
স্টেশন থেকে বের হয়ে গেল রুদ্ধ আর হুর।লয়ারের সাথে ইমতিয়াজ স্টেশনে থেকে কিছু ফর্মালিটিজ পূরণ করতে লাগলো।গাড়িতে হিচকি তুলে কান্না করছে হুর। আর তা এক দৃষ্টিতে দেখছে রুদ্ধ। আচানক হুর তার কান্না থামিয়ে রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে রুদ্ধ ওর হাত পা পরখ করতে লাগলো। গা থেকে কোট খুলে শার্টের হাতা উপরে উঠিয়ে দেখতে লাগলো,কোন জখম আছে কিনা!কোন জখম নেই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ।পরক্ষণে আবার কান্না শুরু করে দিল। দুহাত হাটুর উপর হাত রেখে তালুতে নিজের দুগাল ঠেকিয়ে হুরের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্ধ। বাম হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলালো। ক্যালকুলেট করে বুঝল তার বউ গুনে গুনে ২৬ মিনিট ধরে কান্না করছে।মুখ থেকে এখনো মাস্ক সরাইনি। এমনকি ঘোমটা টাও তুলেনি।
কান্না থামবার নাম নিচ্ছে না দেখে রুদ্ধ হুরকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।মুখ থেকে মাস্ক খুলে চোখের পানি মুছে দেয়।বউকে বুকে নিয়ে অদূরে স্বরে ডাকে,
” হুরপাখি..
আগের আরো শব্দ করে কান্না শুরু করল হুর। তা দেখে রুদ্ধ কড়া স্বরে বলল,
“আর একবার ফ্যাচ প্যাচ করে কান্না করলে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।
কান্না বন্ধ করে দিল হুর। শুধুমাত্র মুখের শব্দ বন্ধ করল। চোখ থেকে পানি এখনো গড়িয়ে পড়ছে।পুনরায় চোখের পানি মুছে রুদ্ধ নরম স্বরে বলে,
“এখন কান্না বন্ধ কর। সবকিছু ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি। এখন কান্না না করে একটু জড়িয়ে ধরো তো ভালোভাবে। শান্তি পাচ্ছিনা আমি।
রুদ্ধের বলতে দেরি ,কিন্তু হুরের জড়িয়ে ধরতে দেরি হয়নি। জাপ্টে ধরে আছে। খুব শক্ত করে। কান্না করতে করতে নাক বন্ধ হয়ে এসেছে তার।নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ খুলে হা হা করে শ্বাস ছাড়ছে।হুরের মাথা থেকে ঘুমটা সরিয়ে চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে হাতে বোলাতে বোলাতে বলে।
“এখানে আসার কি দরকার ছিল।বাড়িতেই থাকতে। এমনিতেও কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ছুটেই যেতাম।শুধু শুধু কষ্ট করে আসতে গেলে।
রুদ্ধর কাধে মাথা রেখে হুর ভাঙ্গা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আপনি হীনা কষ্টের আগুনে ঝলসে যাচ্ছিলাম আমি। বিষাক্ত লাগছিল চারপাশ। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল এই ভেবে যে আপনি আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।অসহনীয় পীড়া হচ্ছিল বক্ষস্থলে।#বৃষ্টিস্নাত প্রেমের গল্প
#পর্ব-৩৫
#লেখনীতে-আসমিতা আক্তার ( পাখি )
”
”
”
”
কেটে গেল কয়েকটা দিন। বদলেছে অনেক কিছু। ফায়াজ, রিফা এবং রুদ্ধর বাবা এখন হুর আর রুদ্ধর সাথে খাবার খায়।তবে রুদ্ধ কারো সাথে কথা বলে না। হুর মাঝে মাঝে কয়েকটা কথা বলে। এবং অনেক সময় ফায়াজের কথা তাকে শুনতে হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বে।আর রিফা যতবার কথা বলেছে ততবারই হুরের মনে হয়েছে সে তার ওপর রাগ ঝাড়ছে। কিন্তু কিসের জন্য রাগ ঝাড়ছে তা বুঝতে পারছে না।
সময়টা এখন রাতের। একত্রে সবাই খাবার খেতে বসেছে। চুপচাপ ভাবে যে যার মত খাবার খাচ্ছে। তখনই হুর ফায়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
“কেমন হলো ভাইয়া আপনার ইন্টারভিউ?
হতাশ সুরে ফায়াজ বলে,
“আর বলো না হু..আব আই মিন ভাবি।কয়েক জায়গাতেই ইন্টারভিউ দিলাম।কিন্তু ফিডব্যাক পেলাম না।এক জায়গাতে ইন্টারভিউ দিয়ে মনে হল হয়তো কাজটা পেতে পারি।তবুও পুরোপুরিভাবে শিওর হতে পারছি না।
আড় চোখে রুদ্ধের দিকে তাকালো হুর। রুদ্ধর ভাবগতি আগের মতই। মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে।ভাতখানা এমন আশেপাশে কি হচ্ছে কে আছে তা তার দেখার বিষয় না।হতাশ হল হুর। বলল,
“ও..
আবারো নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।ফায়াজের মন খুট খুট করছে কিছু বলার জন্য। তবে রুদ্ধের কারণে বলতে পারছেনা। একটা মানুষকে এতটা ভয় পাওয়া খুবই লজ্জাজনক বিষয়।আকস্মিক ফায়াজের মনে এক প্রশ্ন আসলো।
“আচ্ছা বাবা, ভাইয়া কার মত হয়েছে?
সোহেল শেখ ফায়াজের দিকে তাকালেন।ঠোঁটের কোনে চলে আসলো এক চিলতে হাসি। হাসিমুখে নিয়ে বেশ আনন্দের সহিত বললেন,
“তোমার বড় মায়ের মত হয়েছে। তোমার বড়মা এমনই রাগী ছিল। এমনকি চেহারাটাও তোমার বড় মায়ের মতই পেয়েছে।
ঠা/স করে প্লেটে চামচ রাখল রুদ্ধ। সবাই রুদ্ধর দিকে তাকালো। থমথমে মুখ রুদ্ধর। সোহেল শেখ ভুলে গিয়েছিলেন তাদের মাঝে রুদ্ধ ও আছে। রুদ্ধের থমথমে মুখ দেখে তৎক্ষণাৎ তিনি নিজের মুখ বন্ধ করে নিলেন। শুধু সোহেল শেখ না ফায়াজ ও আর কথা বলল না।নিরব রইলো সকলে।
——————–
“যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আপনার দাড়ি কাটবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমার কাছে আসবেন না।আব..কাছে আসবেন তবে চু’মু খাবেন না।
আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল আর দাড়ি সেট করছিল রুদ্ধ। তখনই হুরের কথা কর্ণ পাতে আসে। হুরের এমন শর্ত শুনে ভ্রু খানিক কুচকে আসে।কপালে ভাঁজ নিয়ে বলে,
“আমার দাড়ির সাথে চু’মুর কি সম্পর্ক?
মিনমিন স্বরে হুর বলে,
“আপনি যখন আমায় চুমু দেন তখন আপনার দাড়ি আমার ভীষণভাবে জ্বালাতন করে।বড্ড সুড়সুড়ি লাগে। মাঝে মাঝে চু’মু খাওয়াতেও ব্যাঘাত ঘটায়।যা মেনে নিতে পারছি না আমি।
রুদ্ধ কিছু বলেনা এক দৃষ্টিতে হুরের দিকে তাকিয়ে থাকে।অনেকক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে বলে।
“আই সি!চু’মু খাওয়ার জন্য দেখছি উতলা হয়ে যাচ্ছো। কাছে গেলেই তো থরথর করে কাঁপা শুরু করে দাও। আর আজ নিজে থেকে চু’মুর কথা বলছো!ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক হয়ে গেল না?
ধরা খেয়ে চুপ হয়ে গেল হুর। দৃষ্টি বদল করলো। নিম্ন স্বরে বলল,
“আমি আপনার এত বড় বড় দাড়ি চুল দেখতে চাই না। দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগে। মনে হয় জঙ্গল থেকে উঠে এসেছেন। এখন আপনি ডিসাইড করে নেন আপনি চুল দাড়ি কাটবেন,নাকি আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন?
বিদ্রুপের স্বরে রুদ্ধ বলে,
“কে আটকাবে আমায় তোমার কাছে যেতে চাইলে?আমি জঙ্গল থেকে উঠে আসি বা আমায় অদ্ভুত লাগে তাতে কোন কিছুই করার নেই। আমি যেমন আছি তেমনি তোমায় গ্রহণ করতে হবে। হয় ইচ্ছেয় না হয়,বাধ্যকতায়।
পরদিন সকাল…
সকালে রুদ্ধ বেরিয়ে গেছে বাহিরে। হুরকে বলে গেছে আর্জেন্ট কিছু কাজ আছে।রুদ্ধ যাওয়ার পর আর হুরের ঘুম আসে না। তাই সে টেবিলে বসে পড়ে পড়ার জন্য। কয়েকদিন পরেই টেস্ট হবে। তাই খামখেয়ালী না করে পুরো দমে পড়তে বসেছে। টেবিলে বসে পড়তে ভালো লাগছে না। তাই বই নিয়ে চলে আসলো বিছানায়। কম্বল দিয়ে ভালোভাবে নিজেকে জড়িয়ে বসে পায়ের ওপর বই রেখে পড়তে লাগলো।ঘন্টা খানিক অতিক্রম হল। রুমের দরজা খোলা আর শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছালো। দরজার দিকে তাকাল হুর। লম্বা শক্তপক্ত এক মানুষকে দেখতে পেল। চেহারার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটা বড্ড চেনা তার।তার ই স্বামী।তবে তার আদল পুরো বদলে গেছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকে পরখ না করলে বোঝা যাবে না যে সে রুদ্ধ। হুরেরও কিছুটা সময় লেগেছে রুদ্ধকে চিনতে।চুল আগের মত বড় নেই। মার্জিতভাবে কেটেছে তবে স্টাইলের সাথে। আর রইল কথা দাড়ির!সেটাও কেটে চাপ দাড়ি রেখেছে।দেখতে খুবই চার্মিং লাগছে।বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্ধের দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এটা রুদ্ধ। চোখের দৃষ্টি সরছেনা। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই আনমনে বিড়বিড় করে বলে,
“ইশ্,আমার জামাই টা কত্ত কিউট!
হুর এর রিঅ্যাকশন দেখে রুদ্ধ রুমের ভিতর এসে হুরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হুরের পলক এখনো পড়ছে না। তা দেখে রুদ্ধ গলা খাকাকি দিল। সম্বিৎ ফিরে পেল হুর। রুদ্ধ কপাল কুঁচকে বলে,
“এখন ঠিক আছে?
“ঠিক আছে মানে, দুর্দান্ত আছে।
আর কোন কথা না বলে রুদ্ধ চলে গেলে ওয়াশরুমে।হুর হা করে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটাকে আজকে সুন্দর লাগছে।এক কথায় অসাধারণ। হুর যদি জানতো রুদ্ধ তার কথা শুনে চুল দাঁড়ি কেটে আসবে তাহলে অনেক আগেই বলতো। বলতে পারত না ভয়ে ভয়ে। যদি মানুষটা তাকে মেরে বসে!তাই নিজের মধ্যে সবকিছু চাপা রাখতো। তবে এখন বুঝলো রুদ্ধ যাই করুক না কেন তাকে হয়তো কোনদিন মারবে না। আর মারলেও এক দুইটা থাপ্পর নসিবে পড়বে। তা সহ্য করার মত শক্তি হুরের কাছে আছে। খুশিতে ডানা মেলে উড়তে মন চাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে রুদ্ধকে তার আঙ্গুলে নাচাতে। নিজেকে রানী মনে করে আর রুদ্ধকে প্রজা মনে করে এক একটা আদেশ দিতে ইচ্ছে করছে।
সকালের নাস্তা করে রুদ্ধ চলে যায় তার অফিসে।রুদ্ধ অফিসে যেতেই ফায়াজ মেতে উঠে দুষ্টামিতে। কখনো কখনো হুরের সাথে লেগে যাচ্ছে তো আবার জেরিন আর লিলির সাথে। কথার ঝুলি তার খতম ই হচ্ছে না। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটায় চলে যায়। হুরের মত জেরিন আর লেলিও প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল ফায়াজের এত কথা বলায়। তবে এখন সয়ে গেছে তাদের। হুরের মতো তাদের ভাবতে কষ্ট হয় যে,ফায়াজ রুদ্ধর ভাই। তবে এই ভেবে খুশি যে ফায়াজ রুদ্ধর মত হয়নি।
দুপুরের খাবার সময় প্রায় চলে এসেছে।ফায়াজ, হুর আর রিফা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ফায়াজের হাতে টিভির রিমোট। সে একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করছে। আর হুর মনোযোগ সহকারে তা দেখছে। চ্যানেল চেঞ্জ করার মাঝে হঠাৎ পুরের মনে হল সে রুদ্ধকে দেখতে পেয়েছে। তাই হুর তড়িঘড়ি করে ফায়াজকে বলল,
“ভাইয়া ব্যাক এ যান!
তাই করল ফায়াজ।টিভির স্ক্রিনে থাকা রুদ্ধের ছবি দেখে এবং সাংবাদিকদের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল হুর।ফায়াজ আর রিফা ও চমকে গেল।টিভিতে ফাঁকা একটি সাংবাদিক বলছে,
“কিছুক্ষণ পূর্বেই ধানমন্ডি লেকের পাড়ে পুলিশরা একটি লাশ উদ্ধার করেছে। লা/শের অবস্থা খুবই করুন, বিধ্বস্ত। অর্ধ গলাকাটা। দেখে মনে হচ্ছে কেউ ষড়যন্ত্র করে খু/ন করেছে। লা/শের কাছ থেকে একটি তথ্য ও পাওয়া গেছে। সেটি হচ্ছে খু/নির এনআইডি কার্ড। লা/শের কাছ থেকে যার এনআইডি কার্ড পাওয়া গেছে সে আর কেউ নয় “দ্যা গ্যাংস্টার অফ রুদ্ধর”হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন আপনারা। গ্যাংস্টার রুদ্ধ নির্মমভাবে এই লোকটিকে খু/ন করে পলাতক হয়েছেন। আরো জানা গেছে,গ্যাংস্টার রুদ্ধর শত্রুপক্ষ দলের লোককে তিনি খু/ন করেছেন।এখন লা/শটির ময়না তদন্ত চলছে।এবং গ্যাংস্টার রুদ্ধকেও তালাশ করছে পুলিশ। পরবর্তী আপডেট পেতে হলে রাখুন “টুয়েন্টি ফোর চ্যানেলে”
সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল হুরের হৃদয়।মনে হচ্ছে অতি প্রিয় জিনিসটিকে সে হারাতে যাচ্ছে। শূন্য লাগছে বুক। আর্তনাদ ও করছে। ধপ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। জ্ঞানশূন্য হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। কোথাও ফোন পাচ্ছে না। বিচলিত হয়ে খুঁজছে। উত্তেজনার শরীর কেঁপে উঠছে। ফায়াজ বোধহয় হুরের মনোভাব বুঝতে পারল। তাই তাকে অভয় দিলো।
“হুর কাম্ ডাউন!এত হাইপার হয়ো না। নিজেকে শান্ত রাখো। তুমি বস আমি তোমার ফোন খুঁজে আনছি।
জোর করে হুরকে বসালো। শূন্য থেকে শূন্য হচ্ছে হুরের হৃদয়। টলোমলো হয়ে গেল আখি পল্লব। যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে পারে।শুধু পলক ঝাপটানো বাকি।ফায়াজ হন্তদন্ত হয়ে হুরের ফোন খুঁজছে। ড্রয়িং রুমে না পেয়ে দৌড় মারলো হুরের রুমের দিকে। হুরের বিছানায় ফোন রাখা। ফোন হাতে নিয়ে দৌড়ে নিজে এসে হুরের হাতে ফোন দিল।কাঁপা কাঁপা হাতে হুর রুদ্ধর নাম্বার ডায়াল করল।ফোন রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। আরো ভীত হল হুর। একনাগাড়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। তবুও ফোন রিসিভ হচ্ছে না। এবার সে কান্না করে দিল। কান্না করতে করতে ফোন আবার লাগালো। এবারও ফোন রিসিভ হচ্ছে না দেখে ফ্লোরে বসে কান্না করতে লাগলো। হুরের কান্না শুনে লিলি, জেরিন আর সোহেল শেখ রুমে আসলেন।হুকর কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তারা আশ্চর্য হলেন। জেরিন এসে হুরকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? হুর তুমি এভাবে ফ্লোরে বসে আছো কেন? আর কান্নাই বা করছ কেন?
কান্নার জোরে কোন কিছু বলতে পারছে না হুর। অসহায় চোখে জেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে।জেরিনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না স্বরে বলে,
“আপু, আপু উনার ফোন লাগছে না। নিউজে দেখাচ্ছে উনি নাকি কাউকে খু/ন করেছেন।আমি জানি এসব মিথ্যা। উনি কাউকে খু/ন করতে পারেন না। আমি উনার কাছে যেতে চাই।আমাকে প্লিজ উনার কাছে নিয়ে যাও।
কিছু বুঝতে না পেরে ফায়াজের দিকে তাকালো জেরিন।ফায়াজ ঘটনা বলল।হতবিহ্বল হয়ে গেল জেরিন,লিলি,সোহেল শেখ।হুরের বিধ্বস্ত অবস্থার কারণ বুঝতে পারল। হুরের হঠাৎ খেয়াল হল তার ফোনে ইমতিয়াজের ও নাম্বার সেভ করা। দুগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া লবণাক্ত পানিগুলো হাতের তালু দিয়ে মুছে ঘোলাটে চোখ নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো।চোখ স্থির করতে কিছুটা সময় লাগলো। তারপর ইমতিয়াজের নাম্বার এ কল দিল। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেছে। এবার যখন ফোন দিল কল কেটে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ হলো। হুরের কলিজায় যেন এক ফোঁটা পানি আসলো। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া আপনি কোথায়?আর উনি!উনি কোথায় আছেন?আমাকে প্লিজ তার সাথে কথা বলিয়ে দিন।
হুরের কন্ঠস্বর শুনে ইমতিয়াজ বুঝলো হুর কান্না করেছিল।হুরকে আশ্বস্ত করে ইমতিয়াজ বলল,
“ভাবি ভাইয়া একটু ঝামেলার মধ্যে আছে। ঝামেলা থেকে ফ্রি হলে আমি বলব আপনাকে ফোন করতে।
আরো উত্তেজিত হয়ে গেল হুর ।মন তার কু ডাকছে। মনে হচ্ছে রুদ্ধকে কেউ তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিবে। হেঁচকি তুলে হুর বলে,
“নিউজে যা দেখিয়েছে তা কি সত্য ভাইয়া?
ওপাশ থেকে কোন কথা আসছে না। তা থেকে ফোন সরিয়ে হুর দেখল ফোন কেটে যায়নি। বুঝলো ইমতিয়াজ স্বইচ্ছায় চুপ করে আছে। তা দেখে হুর আবার বলে,
“বলোনা ভাইয়া নিউজে যা দেখিয়েছে তা কি সত্য?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমতিয়াজ বলে,
“যতটুক আমি ভাইয়াকে চিনি ভাইয়া কোন খু/ন করেনি। বাকিটা ভাইয়ের মুখ থেকে শুনলে বোঝা যাবে।
“উনি এখন কোথায় প্লিজ? উনার কাছে ফোনটা দিন না!
কাঁপা কন্ঠস্বর ইমতিয়াজের,
“ভাই তো এখন পুলিশ স্টেশনে।
গলগল করে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে হুরের।শব্দ করে কেঁদে উঠে।বলে,
“আপনি না বললেন উনি কোন খু/ন করেনি? তাহলে পুলিশ কেন নিয়ে গেছে তাকে?আপনি কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে তাই না?প্লিজ সত্যিটা বলুন আমায়।
“ভাবী আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি কোন কিছুই মিথ্যা বলছি না। যতটুকু আমার ধারণা ভাইয়া খু/ন করতে পারে না। আর পুলিশ স্টেশনে থাকার কারণ হচ্ছে পুলিশরা ভাইয়াকে সন্দেহ করছে। তাই তাকে নিয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাচ্ছি।
ইমতিয়াজ হুরকেও ভয় দিলেও ভয় কমে না তার। কান্না করতে করতে বলে,
“আমিও যাবো পুলিশ স্টেশনে।
“আপনাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে ভাইয়া অনেক রাগ করবে।
“আমি কোন কিছু জানি না, আমি পুলিশ স্টেশনে যাবো মানে যাবো।
ইমতিয়াজ নিরাশ হল। বুঝলো হুর এভাবে মানবে না। তাই বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি কিছুখন অপেক্ষা করুন আমি আপনাকে নিতে আসছি।
কল কেটে দিল ইমতিয়াজ।হুরের কান্না কমলো না। একনাগাড়ে কান্না করে যাচ্ছে। বিমূঢ় হয়ে ফায়াজ হুরের কান্না দেখছে।মেয়েটা সে কখন থেকে কান্না করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। থামাথামি নাম নেই। চোখ দিয়ে এত পানি কোত্থেকে আসছে তার!কই আজ অবধি তো তার চোখ থেকে এক ফোটাও পানি পড়েনি।হুর মেয়ে দেখে কি তার চোখ দিয়ে এত পানি পড়ছে?হতেও পারে!সোহেল শেখ সোফার মাথা নিচু করে বসে আছে। তারও চোখে পানি টলমল করছে। নিজেকে এবং হুরকে দেয়ার মত কোন সান্তনা খুঁজে পাচ্ছে না।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইমতিয়াজ আসলো ।ইমতিয়াজকে দেখে তড়িঘড়ি করে ফ্লোর থেকে উঠে ইমতিয়াজের কাছে গেল হুর।গালের পানি আবারো হাতের তালু দিয়ে মুছে বলল,
” চলুন!
থামিয়ে দেয় ইমতিয়াজ ।পকেট থেকে কিছু একটা বের করে হুরের সামনে ধরে। হুর তাকিয়ে দেখে একটি মাস্ক। ইমতিয়াজ বলে,
“মাস্ক পড়ে ভালোভাবে মাথায় ঘোমটা দিন।
ইমতিয়াজের কথা মত কাজ করলো হুর।সময় ব্যয় না করে দুজন চলে গেল পুলিশ স্টেশনে।সোহেল শেখ আর ফায়াজ ও আসতে চেয়েছিল তাদের সাথে। কিন্তু ইমতিয়াজ তাদের মানা করে দেয়। তাদের দেখে যদি রুদ্ধ ক্ষেপে যায় তাহলে ব্যাপার হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।তাই আর তাদের নিলোনা।দশ মিনিটে পুলিশ স্টেশনে তারা পৌঁছায়। স্টেশনের বাহিরে মানুষের অনেক ভিড়। মিডিয়া,জনগণ ,এমনকি পুলিশরাও ভিড় জমিয়েছে।হুর ভিড়ের কারণে সামনে যেতে পারছিল না। গার্ডরা সবাইকে চাপিয়ে হুরকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দিল। বড় বড় পা ফেলে ইমতিয়াজের পিছে পিছে যাচ্ছে হুর।স্টেশনের ভিতর প্রবেশ করে বড় কক্ষের ভেতর চোখ বুলিয়ে রুদ্ধকে দেখার চেষ্টা করল। চোখ আটকে গেল বাম পাশের টেবিলের দিকে। চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে রুদ্ধ। মুখোমুখি হয়ে সামনে বসে আছে অফিসার। অফিসার কে ক্ষিপ্ত দেখা যাচ্ছে।তবে রুদ্ধ স্বাভাবিক। হাফ ছেড়ে বাঁচলো হুর। হুর মনে করেছিল গতবারের মতো এবারও রুদ্ধকে লকআপে ঢোকাবে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সামনে এগিয়ে আসলো।
ইমতিয়াজের পিছনে সে।ইমতিয়াজ রুদ্ধ এবং অফিসার কে পরখ করে বলল,
“কোন সাহসে আপনি আমার ভাইয়াকে স্টেশনে নিয়ে এসেছেন?
অফিসার উপহাস করে বললেন,
“খু/নিকে তার আসল ঠিকানায় নিয়ে এসেছি। এতে সাহস দেখানোর কি আছে?
প্রতিবাদ করে ইমতিয়াজ বলে,
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার।আমার ভাইয়া খুন করেনি।
অফিসার বলে,
“লাশের পাশে আপনার ভাইয়ের এনআইডি কার্ড পাওয়া গেছে।গ্যাংস্টার রুদ্ধ খু/ন করার সময় হয়তো খুব জোশে ছিলেন। তাইতো তিনি তার হোস হারিয়ে ফেললেন। ভুলে লা/শের কাছে নিজের এনআইডি কার্ড রেখে আসলেন। তবে এতে লাভ আমাদেরই হয়েছে। খুব সহজে ক্রিমিয়ালকে ধরতে পেরেছি। আগেরবার তো টাকার জোরে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার তাকে কে বাঁচাবে?এবার খু/নের চার্জ লেগেছে তার উপর।এবার তো তার বেঁচে ফেরা খুবই মুশকিল।
বাঁকা হেসে অফিসারের দিকে তাকালো রুদ্ধ।বলল,
“দেখি কতক্ষণ আটকে রাখতে পারেন।
অফিসারের চাহনি কঠিন হলো।যার দরুন বোঝা গেল রুদ্ধর কথা তার পছন্দ হয়নি।অপরাধ করে তাকে উপহাস করা হচ্ছে দেখে ভীষণ রাগ লাগলো তার। কঠিন কিছু বাণী শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। বলার জন্য মুখ খুলবে ,সে সময় রুদ্ধর লয়ার হাজির হয়। তিনি তার চশমা ঠিক করতে করতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন,
“সরি, একটু লেট হয়ে গেছে। আসলে ট্রাফিক জ্যাম অনেক ছিল।
বলে তিনি তার ফাইল থেকে একটি পেপার সামনে এগিয়ে দেন অফিসারের দিকে। তা দেখে অফিসার। বেইলপেপারস। ক্রুদ্ধ নয়নের রুদ্ধর দিকে তাকালো। তা দেখে রুদ্ধ তাচ্ছিল্য হাসলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোট ঠিক করতে করতে বলল।
“কি হলো? সব হাওয়া শেষ? আমাকে আটকে রাখার সাধ্য কেউর কাছে নেই। আর রইল কথা আপনার লা?শের পাশে পাওয়া এনআইডি কার্ডের।
রুদ্ধ তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে নিজের এনআইডি কার্ড বের করল।সোজা করে অফিসারের দিকে দেখালো।বলল,
“ইট’স মাই এনআইডি কার্ড।আর আপনারা যেটা পেয়েছেন সেটা ফেইক।আপনাদের সোর্স তো অনেক দূর দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। এখন ফেইক এনআইডি কার্ড দ্বারা খুঁজে বের করুন আসল ক্রিমিনাল কে।
বলেই ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রুদ্ধ।ইমতিয়াজ তার পিছনে তাকাতে ইশারা করলো। ইশারা বুঝে রুদ্ধ কপাল কুঁচকে পিছনে তাকালো। মাথা নত করা নারীকে দেখে মুখভঙ্গি বদলে গেল।মাথায় বড় করে ঘোমটা টানা। আবার মাথাও ঝুকানো। মুখ একদমই দেখতে পাচ্ছে না।মুখ না দেখেই বুঝল,এই নারীটা কে!আরেকটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝল মেয়েটা কাঁদছে। বারবার তার শরীর কেঁপে উঠছে।ইমতিয়াজ কে সরে যেতে বলল। সরে গেল ইমতিয়াজ। রুদ্ধ এগিয়ে হুরের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসল।রুদ্ধের স্পর্শ পেয়ে হুর মুখ তুলে চাইল।হুরের ভেজা চোখ দেখে স্মিত হাসল রুদ্ধ।হুরের হাত থেকে হাত সরিয়ে পিঠে রাখে।হুরের সাথে ঘেঁষে দাঁড়া হল।অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা করতে পেরে ভালো লাগল।টাটা..
স্টেশন থেকে বের হয়ে গেল রুদ্ধ আর হুর।লয়ারের সাথে ইমতিয়াজ স্টেশনে থেকে কিছু ফর্মালিটিজ পূরণ করতে লাগলো।গাড়িতে হিচকি তুলে কান্না করছে হুর। আর তা এক দৃষ্টিতে দেখছে রুদ্ধ। আচানক হুর তার কান্না থামিয়ে রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে রুদ্ধ ওর হাত পা পরখ করতে লাগলো। গা থেকে কোট খুলে শার্টের হাতা উপরে উঠিয়ে দেখতে লাগলো,কোন জখম আছে কিনা!কোন জখম নেই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ।পরক্ষণে আবার কান্না শুরু করে দিল। দুহাত হাটুর উপর হাত রেখে তালুতে নিজের দুগাল ঠেকিয়ে হুরের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্ধ। বাম হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলালো। ক্যালকুলেট করে বুঝল তার বউ গুনে গুনে ২৬ মিনিট ধরে কান্না করছে।মুখ থেকে এখনো মাস্ক সরাইনি। এমনকি ঘোমটা টাও তুলেনি।
কান্না থামবার নাম নিচ্ছে না দেখে রুদ্ধ হুরকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।মুখ থেকে মাস্ক খুলে চোখের পানি মুছে দেয়।বউকে বুকে নিয়ে অদূরে স্বরে ডাকে,
” হুরপাখি..
আগের আরো শব্দ করে কান্না শুরু করল হুর। তা দেখে রুদ্ধ কড়া স্বরে বলল,
“আর একবার ফ্যাচ প্যাচ করে কান্না করলে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।
কান্না বন্ধ করে দিল হুর। শুধুমাত্র মুখের শব্দ বন্ধ করল। চোখ থেকে পানি এখনো গড়িয়ে পড়ছে।পুনরায় চোখের পানি মুছে রুদ্ধ নরম স্বরে বলে,
“এখন কান্না বন্ধ কর। সবকিছু ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি। এখন কান্না না করে একটু জড়িয়ে ধরো তো ভালোভাবে। শান্তি পাচ্ছিনা আমি।
রুদ্ধের বলতে দেরি ,কিন্তু হুরের জড়িয়ে ধরতে দেরি হয়নি। জাপ্টে ধরে আছে। খুব শক্ত করে। কান্না করতে করতে নাক বন্ধ হয়ে এসেছে তার।নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ খুলে হা হা করে শ্বাস ছাড়ছে।হুরের মাথা থেকে ঘুমটা সরিয়ে চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে হাতে বোলাতে বোলাতে বলে।
“এখানে আসার কি দরকার ছিল।বাড়িতেই থাকতে। এমনিতেও কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ছুটেই যেতাম।শুধু শুধু কষ্ট করে আসতে গেলে।
রুদ্ধর কাধে মাথা রেখে হুর ভাঙ্গা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আপনি হীনা কষ্টের আগুনে ঝলসে যাচ্ছিলাম আমি। বিষাক্ত লাগছিল চারপাশ। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল এই ভেবে যে আপনি আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।অসহনীয় পীড়া হচ্ছিল বক্ষস্থলে।