#Journey episode 13
#১৩
সিসিলতে ছুটি নিয়ে বন্ধুকে খুঁজতে আসা জেসমিনের ছুটির দিন গুলো আর বাকি নেই,আজকের দিনটাই ওর শেষ।শেষ দিন সেলিব্রেট করতে দুজন আজ সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে।পেলারমো,মেসিনা, সেখানকার পার্ক,বড় বড় ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো,গীর্জা,দুর্গ,সব ঘুরে ঘুরে শেষে আসে এটনা পাহাড়ে।
মাউন্ট এটনা কাটানিয়ার অনেক দূর থেকেও দেখা যায়,যেন পুরো এলাকাটা তার রাজ্য,আর সগৌরবে সে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে।দূর থেকে অনেক বেশি রহস্যময় মনে হয় আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গকে।তাছাড়াও এটি ইটালির সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি।এই পাহাড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার টুরিস্ট আসে। এই আগ্নেয়গিরি সবচেয়ে ভয়ানক ভাবে অগ্নুৎপাত করেছিল ১৯৯২ সালের ২৩ মে।এরপর আর এত বড় অগ্নুৎপাত হয়নি।আর সর্বশেষ অগ্নুৎপাত হয় ২০১৩ সালে।’৯২ এর অগ্নুৎপাতে ইটালীকে গুণতে হয় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি।
এই পাহাড় নিয়ে অনেক রূপকথার গল্পও আছে,বিশেষ করে গ্রীক পুরাণে।সেখানে বলা হয়েছে,টাইফুন নামের এক ভয়ানক দানব এই পাহাড়ের নিচে দেবতা জিউস আটকে রেখেছিলেন।জিউস হলেন সকল দেবতাদের রাজা এবং আকাশ ও বিজলীর দেবতা।Hephaestus এর কামারশালাও এই পাহাড়ের নিচে আছে বলে গ্রীক মিথোলজিতে বলা আছে।সম্ভবত তখনকার মানুষ এমন ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের কারণেই এ ধরণের কাহিনী রচিত করেছিল।
এই পাহাড়ের সবচেয়ে বড় রিফিউজি আছে যার নাম “সাপিয়েঞ্জা রিফিউজি”।এখানেই মূলত টুরিস্টরা আসেন।এছাড়া আরো দুটো স্কি রিসোর্ট আছে,চাইলে সেখানেও মানুষ যেতে পারে।
মাউন্ট এটনার ব্যাপারে এতক্ষণ ধরে এই বিশদ বিবরণ শুনাচ্ছিল রাইফ জেসমিনকে।এখানে ঘুরতে এসে তখন থেকে জেসমিনকে ইতিহাসের গল্প করেই যাচ্ছে।জেসমিন যতটা না ইতিহাস শুনছে,তার চেয়ে বেশি দেখছে রাইফকে,ওর অঙ্গভঙ্গি, কথার সুর,চোখ ঘোরানো,হাত দিয়ে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করার একটা বৃথা চেষ্টা। ওর ৫.১০ উচ্চতা,বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ,কালো সিল্কি চুল, মুখ ভরা গোছানো দাড়ি ওর পুরষত্বের ছাপকে স্পষ্ট করেছে।যখন সে হাত পা নেড়ে বান্ধবীকে পাহাড়, বিভিন্ন দুর্গের ইতিহাস,ভাস্কর্যের পেছনের গল্পগুলো বোঝাচ্ছে,তখন তার বান্ধবী আড়চোখে পুরো সৌন্দর্যটা দুচোখ দিয়ে গিলছে।সকাল থেকে এই শেষ বিকেল পর্যন্ত সারাদিনই মনে হয়েছে,সূর্যের আলো যেন একেকটা সময়ে ওর রূপ একেকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।যদিও বলা হয়,নারী সৌন্দর্যের প্রতীক,কিন্তু সব বেলায় সেটা সত্য নয়।পুরুষদেরও সৌন্দর্য আছে যা শুধু একজন নারীই ধরতে পারে,যেমন এই মুহূর্তে এই গল্পের নায়িকা জেসমিন।
জেসমিনের কাছে রাইফকে এই শহর,আকাশ,বাতাস,পাহাড়,সাদা রঙের ছোট ছোট বাড়ি সবকিছুর চাইতেও বেশি সুন্দর সৃষ্টি মনে হচ্ছে। ওর লোমে ঢাকা হাত ছুঁয়ে দেয়ার ইচ্ছাটা বার বার বুকের ভেতর চাপা দিচ্ছে।একটা ছেলের লোমশ হাতও কি কারো এত ভালো লাগতে পারে?জেসমিনের সেটা জানা ছিল না!অবশ্য জানবে কি করে?আজই যে প্রথম রাইফ ওর হাত ধরল!গতকাল জাফার চলে যাওয়ার পর ওরা অনেকটা সময় একসাথে ছিল।রাইফ নিজে ড্রাইভ করে জেসমিনকে হোটেলে নামিয়ে দিয়েছে। আজ সকাল সকাল হোটেলের সামনে এসে হাজির,একসাথে নাস্তা করবে বলে।জেসমিনকে একটি ব্রেসলেট আর একটি বই গিফট করেছে।সবচেয়ে ভাল লেগেছে যখন রাস্তা পারাপারের সময় রাইফ ওর হাত ধরে পার করেছে।রাইফ তো কখনো এতটা কেয়ারিং ছিল না।তবে কি একারণেই ওর ব্যক্তিত্ব জেসমিনকে আরো বেশি টানছে?
জেসমিন ভাবছে,রাইফকে আগে কেন এভাবে খেয়াল করা হয় নি?ও তো খুব বেশি বদলায় নি।অবশ্য ভার্সিটি জীবনের শুরুর দিকে ওর চেহারায়,দেহে ছেলে ছেলে ভাব ছিল বেশি।ধীরে ধীরে পুরুষত্ব এসে ভর করেছে ওর সমস্ত দেহ আর মনে আর সেসময়টায় রাইফ জেসমিনের কাছ থেকে দূরে ছিল।সব মেয়ে হয়ত ওর প্রেমে পড়বে না,কিন্তু ভাল ভাবে খেয়াল করলে ওর কাছে ভেড়ার কথা না ভেবেও থাকতে পারবে না!অন্তত জেসমিনের এই মুহূর্তে সেটাই মনে হচ্ছে।হয়ত এটা ওর পুরুষত্ব আর কেয়ারিং আচরণের জন্যেই মনে হচ্ছে।নীল রঙের রহস্য ঘেরা ঐ পাহাড়ের চাইতেও পাশে ভারী জ্যাকেট পড়ে দাঁড়ানো রাইফ বেশি আকর্ষণ করছে।আল্লাহ নারী পুরষকে তো এভাবেই সৃষ্টি করেছেন,তারা যত কাছে যাবে,আকর্ষণ ততই বাড়বে,তার উপর যদি কারো মনে অন্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়, সেখানে তো কথাই নেই!
সাপিয়েঞ্জা রিফিউজিতে গিয়ে ওরা ঘুরতে থাকে।চাইলে স্কি করতে পারে ওরা,কিন্তু সময় নিয়ে আসতে হবে এখানে যেটা জেসমিনের হাতে একদমই নেই!আজকেই যা দেখা হয়েছে,সেটাই অনেক।আর পুরো ট্রিপের সব খরচ রাইফ দিচ্ছে,হাজার হোক,বান্ধবী কি আর প্রতিদিন আসবে?তার উপর অনেকদিন পর কাছের কাউকে পাওয়া গেল।এই আনন্দের কাছে টাকার কোন কাজ আছে নাকি?
দুকাপ কফি এনে এককাপ নিজে রেখে আরেকটা জেসমিনের হাতে দিতে দিতে বলে,
“এই ধর,তোর কফি।তা ভেনিসে রওনা হবি কবে?”
“তোকে না বললাম আগামীকাল আমার ছুটির শেষদিন?”
“ওহ,হ্যাঁ, তা কখন যাবি?ট্রেনের টিকিট কেটেছিস?”
“কাল যেহেতু শেষ দিন,তাই আজ রাতেই টিকিট কেটে রেখেছি।৭ দিন বাসায় না থাকায় নিশ্চিত যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে আছে।তার উপর বিশ্রামের একটা ব্যাপার আছে না?আজ রাতের ট্রেনে উঠে যাব,কাল বিকালের মাঝে পৌঁছাব ইনশাআল্লাহ। বাসায় গিয়ে বিশ্রামও নেয়া হবে,টুকিটাকি কাজগুলোও গোছানো হবে”
“হুম,ভালোই!তাহলে আজ কয়টার ট্রেনে উঠবি?”
“রাত ১২টার আগে আর ট্রেন নেই বলল,তাই ১২টার টিকিটই কেটেছি”
“হোটেল থেকে বেরোবি কখন?”
“১১টার আগে বের হয়ে লাভ নেই।১১টার পর পর বেরুব।এত প্রশ্ন করছিস কেন তুই?”
“পরিমাপ করার চেষ্টা করছি,তুই আমার সাথে আর কতক্ষণ আছিস!”
রাইফের শেষ কথাটায় জেসমিনের মনে হয়, খুব হাল্কা কষ্ট মিশে আছে এতে।কিন্তু রাইফের মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না,সে পাহাড়ের পেছনে প্রায় অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে।রাইফের কি খারাপ লাগছে?লাগারই কথা,হাজার হোক,ওরা খুব কাছের বন্ধু।জেসমিনের মনটা খারাপ হয়ে যায়।ঘড়িতে দেখে,ওর হাতে আর মাত্র পাঁচ ঘন্টা আছে।এই পাঁচ ঘন্টাই ওর সম্বল।তারপরের প্রতিটা ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ড,ন্যানো সেকেন্ড, সবটা সময় জুড়ে থাকবে জাফার,সেলিম আর রাইফের স্মৃতি।এই সাতটা দিনে যতটা আনন্দ পেয়েছে,ততটা আবার কবে পাবে,আল্লাহ জানে।
এদিকে রাইফের মনেও একই প্রশ্ন চলছে,এই পাঁচটা ঘন্টা ঠিক মত কাজে লাগানো যাবে তো? জেসমিনের দিকে আজকে আড়চোখে অনেকবার তাকিয়েছে,মেয়েটা বদলে গেছে অনেক।আগেও ফ্যাশন সচেতন ছিল, এখন আরো সচেতন হয়েছে।আগে তেমন হিজাব পড়ত না,এখন অনেক সুন্দর করে হিজাব বাঁধে।ওর চুল দেখার ভাগ্য হয়নি রাইফের,কিন্তু আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।ভার্সিটি জীবনে জেসমিন বেশিরভাগ সময় চুল ছেড়ে আসত,তেমন একটা বাঁধত না।ওকে সেভাবে দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গিয়েছিল,আলাদা করে সৌন্দর্য্যটুকু চোখে পড়ে নি।ওর হাসি,বড় বড় এক জোড়া চোখ,খাড়া নাক,সুগঠিত ঠোঁট,কিছুই সেভাবে নজরে আসে নি।গতকাল থেকে জেসমিনকে যতবার দেখছে,স্নিগ্ধ কোমলতায় মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে,মেয়েটা খুব নাজুক,ছুঁয়ে দিলেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মত উবে যাবে।রাস্তা পার হওয়ার সময় ইচ্ছে করেই হাত চেপে ধরেছে,নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।সুযোগটা ভালভাবেই কাজে লাগানো গিয়েছে,আশা করছে,জেসমিন কিছু আঁচ করতে পারেনি। তবে নিজেই ভেবে অবাক হচ্ছে,ওর কি জেসমিনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেল? ঠিক বুঝতে পারছে না।
অনেক ভেবে মুখ খুলে রাইফ,
“আর কিছুদিন থেকে গেলে হয় না?”
জেসমিন হাসে,
“একটাই তো কাজ করি।সেই কাজে যা ছুটি পেয়েছি,সব শেষ তোকে খুঁজতে খুঁজতেই।কত যায়গায় খুঁজেছি,বান্ধবীদের বলেছি,সেভাবে কোন খোঁজ কেউ দিতে পারে নি।যদি এরকম লাপাত্তা না হতি,তবে কয়েকটা দিন ঠিকই পেতাম।”
“আমাকে ফেসবুকে নক দিলে তো পারতি!”
“আচ্ছা…শেষ কবে আমাকে নক দিয়েছিলি মনে আছে?…নেই,না?আমি জানি।আসলে তোর সাথে কি বলব,সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।তাই জিজ্ঞাসা করিনি।চার বছরে যে কখনও একবারের জন্যও আমার খবর জানতে চায়নি,তাকে নক করে কি বলা উচিত আমি জানি না!”
“কিন্তু তুইও তো আমার খোঁজ নিসনি!আমিও কি একই কথা বলতে পারি না?”
“আমি দেইনি কারণ তোর উপর চাপা অভিমান ছিল!”
“অভিমান!আমার উপর! কিন্তু কেন!কি করেছি আমি??!”
“তোর মনে আছে ওশানার কথা?…ঐ যে,তোর প্রেমিকা? তুই ওর কথা আমার কাছে কেন লুকালি একটু বলবি?”
রাইফ একটু নড়ে বসে।কথাটা যায়গামত লেগেছে।এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,
“আমার পার্সোনাল জীবন নিয়ে কারো কাছে কিছু বলতে ইচ্ছে করে নাই।তাছাড়া ওশানা সুবিধার মেয়ে ছিল না।ভাল মেয়ে হত,সবাইকে জানাতাম,পরিচয় করিয়ে দিতাম।এইসব মেয়ে মানুষের কথা বাদ দে,প্লিজ।”
“ওকে ওকে,থাক,বাদ দে।তুই আমার কাছে লুকিয়েছিস,এটা ভাল লাগে নি,তাই…কিছু মনে করিস না”
“আরে ধুর,মনে করার কিছু নেই।”
আচমকাই রাইফ জেসমিনের হাত ধরে ফেলে,তাতে ও কিছুটা চমকে যায়।হাতখানা নিয়ে হাতের তালুতে এলোমেলোভাবে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,
“তুই এত অভিমানী হলি কবে থেকে বল তো?”
জেসমিনের এই মুহূর্তে সব কথা গলায় এসে দলা পাকিয়ে আটকে গেছে।কি বলবে কি করবে,কিছুই বুঝতে পারছে না,রাইফ কি সত্যিই ওর হাত ধরেছে?! কিন্তু এভাবে…মানে…জেসমিন আর ভাবতে পারে না।এক টানে হাত ছাড়িয়ে ফেলে।রাইফ বেশ আশাহত হয় এতে। জেসমিন দ্রুত বলে,
“আমি আগে থেকেই এমন ছিলাম!…চল,উঠি,দেরী হয়ে যাবে,শহরের দিকে যাওয়া দরকার!”
রাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়।জেসমিন আগে আগে হাঁটছে,মনে সাইক্লোনের ন্যায় ঝড় চলছে,রাইফও তবে ওকে নিয়ে…???
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria