#Journey episode 12

0
223

#Journey episode 12

#১২

রাইফের সাথে পুলের পানিতে বসে আড্ডা দিতে অন্যরকম ভালো লাগছিল জেসমিনের,মনে হচ্ছিল ভার্সিটি জীবনে ফিরে গিয়েছে।হাসাহাসি,দুজন দুজনকে পচানো,পানি ছিটানো, চার বছরের পুরোনো দুষ্ট নাম গুলো ধরে ডাকা,এসব কিছুই দুটো মানুষকে টেনে নিয়ে যায় ইউরোপের অন্যতম প্রধান দেশগুলোর একটি দ্বীপ শহর সিসিল থেকে সেই সবুজ শ্যামল মেটে বাংলার স্মৃতিতে।একবারের জন্যেও মনে হয় না এতদিন ওরা নিজেরা নিজেদের দেখেনি,তাদের মাঝে এক বারের জন্য কথা হয় নি।মনে হচ্ছিল না ওদের যে,অনলাইনের একপাশে কত অভিমান নিয়ে জেসমিন এক সময় অপেক্ষা করেছে,আর রাইফ শুধুই নিজেকে গুছিয়ে গেছে চারটা বছর ধরে,নিজেকে নিয়েই ভেবে গেছে,বন্ধু বান্ধব কারো কথা ভাবার সময় তার হয়নি।দুজন হাসি আনন্দে যখন ডুবে আছে,তখনই চকিতে জাফার আর সেলিমের কথা মনে পড়ে জেসমিনের।এ কি!ওরা কি একা একা বসে আছে??

“দোস্ত,তুই একটু বস,আমি আসছি”
জেসমিনের কথায় রাইফ অবাক হয়।
“সে কি,কোথায় যাবি?”
“ঐ যে,জাফার ভাই এসেছে আমার সাথে,উনার কাছে যাব,তুই বস”
“ঐ যে লম্বা সুন্দর করে লোকটা,ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে যে? হা হা হা”
“চুপ!উনি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত, টুকটাক বাংলা বলতে পারে।যাই হোক,আমি গেলাম,তুই একটু থাক এখানেই”
বলেই জেসমিন উঠে যায় পুল থেকে জুতো হাতে নিয়ে।রাইফও পুল থেকে উঠে দ্রুত ওকে অনুসরণ করে,এখানে বসে থেকে আর কিই বা হবে।

জেসমিন এদিক ওদিক খুঁজে খুঁজে ও সেলিমকে নিয়ে যে টেবিলে বসে ছিল,সেখানে পৌঁছায়,কিন্তু সেখানে ওরা কেউ নেই।জেসমিন চারপাশে তাকায়,কোথাও ওদের চোখে পড়ছে না।দু’একজনকে জিজ্ঞাসা করে,কোকড়া গাঢ় বাদামী চুলের সাদা ডেনিম শার্ট পড়া কাউকে ছোট ছেলে নিয়ে যেতে দেখেছে কিনা।তারা বলে,এক লোক ছিল,সে বাইরে চলে গেছে।জাফার কি বিরক্ত হয়ে চলে গেল?ইশ,আগেই উনাকে ডাকা দরকার ছিল!রাইফকে পেয়ে মাথাটা একেবারে গেছে।

বাইরে এসে দেখে জাফার সেলিমকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, একটা আইসক্রিম কিনে দিয়েছে কিন্তু সেলিম মানছে না,ও কেঁদেই চলেছে।জেসমিন দৌড়ে কাছে চলে আসে।
“আব্বুটা কেন কাঁদছে!!”
জেসমিনের কন্ঠ শুনে বাবা ছেলে দুজনেই ঘুরে তাকায়।সেলিম লাফ দিয়ে জেসমিনের কাছে চলে যায়।জেসমিন বুকে চেপে ধরে দুগালে চুমু খায়,চুলগুলো এক হাতে নেড়ে দেয়,সেলিমও জেসমিনের গলা দুহাতে চেপে ধরে। জাফার হাসে,
“ও তো কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না,ও নাকি তোমার সাথেই থাকবে এখানে!”
“আব্বু!তুমি আমার সাথে থাকতে চাও?আন্টিকে রেখে যাবা না?”
সেলিম আধো আধো বুলিতে বলে,
“আমি যাব না,পাপা আমাকে তোমাল কাচে তাকতে দে না!আমি যাব না!”

জেসমিনের সাথে কয়েকদিনে ভালোই খাতির হয়ে গেছে।সেলিম ঘুম ছাড়া বেশিক্ষণ ওকে ছাড়া থাকেও নি।জাফার অবাক হয়ে ভাবছে,যে মেয়েকে আজ থেকে চারদিন আগেও চিনত না,সেই মেয়ের সাথে ওর ছেলে কতটা জড়িয়ে গেছে! ঘুম থেকে উঠেই জেসমিনের কাছে যেতে চায়,খাওয়ার সময় আন্টির হাতে খাবে বলে বসে থাকে,সারাদিন শুধু জেসমিনের নামই জপতে থাকে।আজকাল জাফারের মনে হয়, সেলিম ওকে চেনেই না,ও আসলে জেসমিনেরই ছেলে! হাসিমুখে দুজনের দুষ্টুমি গুলো জাফার উপভোগ করে।বিকেলের রোদে দুটো মানুষের খুনশুটি ওকে ভীষণরকম প্রশান্তি দিচ্ছে।এতক্ষণ যে ছেলেকে আইসক্রিম শান্ত রাখা যাচ্ছিল না,সেই ছেলে এক কি সুন্দর হাসছে,অবাক কান্ড!

রাইফ এসে জেসমিনের পাশে দাঁড়ায়, জাফার আর রাইফের চোখাচোখি হয়,বিনয়ের হাসি বিনিময় করে দুজন।রাইফের উপস্থিতি টের পেয়ে জেসমিন ওদের দিকে তাকায়।
“জাফার ভাই,চলেন,কোথাও খেতে বসি।বিকেল হয়ে গেল,অথচ আজ লাঞ্চ করাই হল না!”
রাইফ অবাক হয়ে বলে,
“কি বলিস!তোরা দুপুরে খাস নি?এই বাবুটাও না খেয়ে আছে?!গড,চল চল!”
জেসমিন রাইফের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো দেয়,
“সব তোর জন্য!ফাযিল ছেলে,তোকে খোঁজার চক্করে আমার খাওয়া দাওয়া একেবারে শিকে উঠেছে! জিজ্ঞেস কর জাফার ভাইকে,আমি কত খাই!সেখানে আজকে দুপুরে একটা দানাপানিও খাওয়া হয়নি!”
“ও বাবা!এখন আমার দোষ?”
“অবশ্যই! তা নয়তো কার!”
“ঠিক আছে,চল,আমি তোদের খাওয়াই,চল”

জাফার ওদের বাঁধা দেয়।
“আমি আর সেলিম খেয়ে নিয়েছি,চিন্তা করতে হবে না।…জেসমিন,তুমি রাইফকে নিয়ে কিছু খেয়ে নাও,তোমার তো কিছুই খাওয়া হয়নি নাস্তার পর থেকে।”
“সে কি!আপনারা কখন খেলেন আবার!”
“তুমি যখন তোমার বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে,তখনই। এত ভেব না,তুমি যাও,খাও”
“তা খাব,কিন্তু জাফার ভাই,চলেন না,আপনিও আমাদের সাথে বসবেন,প্লিজ!”
“আরে নাহ,আমার খাওয়া হয়ে গেছে!আর… ভুলে গেছ তুমি জেসমিন?আমার তো এগেডিয়ান দ্বীপে যেতে হবে,আমার বন্ধুর কাছে।…তার উপর… আমার তো এখানে কাজও শেষ”

জাফারের শেষ বাক্যটা জেসমিনের বুকে এসে ধাক্কা দেয়।জাফার চলে যাবে?আজই?এখনই? সত্যিই চলে যাবে? কোলে থাকা পিঙ্গল রঙের চোখ দিয়ে সেলিম এক সমুদ্র মায়া নিয়ে জেসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটাকে কোল থেকে নামানোর এক বিন্দু ইচ্ছাশক্তিও জেসমিনের নেই,তবুও ওকে জাফারের কোলে দেয়।সেলিমের হাতের আইসক্রিম সেই কখন গলে গলে হাত থেকে পড়ে গেছে,সেদিকে ওদের কারো খেয়াল নেই।জাফার সেলিমকে কোলে নিতে নিতে বলে,
“তুমি যাওয়ার পর অনেক ক্ষণ কেঁদেছে ও,ওর ওখানে একদম ভাল লাগছিল না,কিছুতে থামছিলও না।তাই বেরিয়ে এসেছি।এসে খাইয়েছি,ঘুরিয়েছি,কিন্তু ও তবুও শান্ত হল না।এখন এই তোমাকে দেখে হেসেছে।এখান থেকে যাওয়ার পর ওকে মনে হয় ফোনে তোমার কন্ঠ শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে!হা হা হা!”

যদিও জাফার হাসছিল,জেসমিনের ভাল লাগছিল না।জাফারের প্রতিটা কথায় বিষাদের ছোঁয়া,কারণ বিদায় সবসময় বিষাদময় হয়।খারাপ লাগছে জেসমিনের।জাফার আর একদিন থাকতে পারবে না?ওর ভাবনা এলোমেলো করে দেয় রাইফের কন্ঠ,মনেই ছিল না যে এই মানুষটারও এখানে অস্তিত্ব আছে!
“আপনি এখান থেকে ছেলেকে কোথায় যাবেন?”
“হোটেলে যাব,সব কিছু গোছাতে হবে।সেখান থেকে দ্বীপে রওনা দিব।আমার বন্ধুকে জানিয়েও দিয়েছি যে আমরা এখনই যাচ্ছি”

জেসমিন করূনভাবে বলে,
“জাফার ভাই,আর একটা দিন থেকে যান,প্লিজ?…মাত্র তো রাইফকে পেলাম!আমরা এক সাথে আড্ডা দিব,ঘুরব,তারপর নাহয় গেলেন?”
জাফার মাথা নাড়ে,
“নারে বোন,হবে না।কাজ আছে আমার।মনে আছে বলেছিলাম,তোমাকে আর রাইফকে একসাথে করে এরপরই এই শহর ছাড়ব,বলেছিলাম না? আমার কাজ শেষ হয়েছে।আমাকে এখন যেতে হবে যে!”

সেলিম ওদের সব কথা বুঝতে পারছে না,তবুও বাবার কোলে মোড়ামুড়ি শুরু করে দিয়েছে,আন্টির কোলে যাবে বলে।জেসমিনের ঘাড়ের উপর দিয়ে কাঁধে এ সময় রাইফ হাত রাখে,জাফারের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলে,
“অনেক কষ্ট করলেন ব্রো,থ্যাংকস আ লট!আপনার কারণেই আমার বান্ধবীর সাথে দেখা হল এত বছর পর, আপনি ওকে সঙ্গ দিয়েছেন,আমি সত্যিই খুশি হয়েছি!”
জাফার আর রাইফ হাত মেলায়।রাইফ হাত ছাড়িয়ে সেলিমের দিকে হাত বাড়ায়,সেলিম চুপ করে আছে।সে হাত বাড়ায় না,ফিরায়ও না।জেসমিন রাইফকে খোঁচা দেয়,
“সেলিম তোকে পছন্দ করেনি!”
রাইফ জেসমিনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে জাফার শুনতে পায় না,এমন গলায় বলে,
“ওর তো রুচি খারাপ,তোর মত পেত্নীকে ওর ভাল লাগে,আমার মত হ্যান্ডসামকে না!”
জেসমিন রাগে কটমট করে তাকায়।

জাফার এবার জেসমিনের কাছে আসে,
“It’s a pleasure to meet you,and we had a wonderful journey. Hope someday we will meet again. Keep connected please!”
“I will!anytime you need me,please,let know”

বিদায় নেয়া শেষে সেলিমকে কোলে নিয়ে যখন জাফার চলে যাচ্ছে,জেসমিনের খারাপ লাগা শুরু হয়। কত বছর পর একটা ছোট বাচ্চার সংস্পর্শ পেয়েছিল,আজ সেই বাচ্চাটা চলে যাচ্ছে।জেসমিনের খারাপ লাগার কারণে নাকি আবার একা হয়ে যাওয়ায়,চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল পড়ে যায়।রাইফের অলক্ষ্যেই সেটা মুছে ফেলে।ভেজা চোখে হাতে নেড়ে ওদের বিদায় জানায়।টেক্সিটা যতক্ষণ চোখে পড়ে,ততক্ষণ জেসমিন তাকিয়ে থাকে।

ওর মনে হয়, জার্নিটা এখানেই শেষ,একদিন থাকবে রাইফের সাথে,আরেকদিন চলে যাবে,সেই পুরোনো গন্তব্যে।সেই ট্রেনে জাফার আর সেলিম থাকবে না,একাকী সময়গুলো সেলিমের দুষ্টুমিতে মুখর হবে না।

কিন্তু কে জানত যে, এই জার্নি কেবলই শুরু?

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here