#মালিনী পর্ব ২+৩
#(নূর নাফিসা)
.
.
এপাশ ওপাশ না তাকিয়ে নাক বরাবর হেটে যাচ্ছে। মাঝপথে হঠাৎ করেই পা থেমে গেলো! মলি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো জুতো ছিড়ে গেছে!
– উফফ! মরার জুতা, এখনই ছিড়তে হলো! যাচ্ছি একটা ভালো কাজে, তার মধ্যেই একের পর এক বাধা!
এই মাঝ রাস্তায় এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মলি! খালি পায়ে কি আর কারো বাড়িতে যাওয়া যায়! এদিক সেদিক তাকিয়ে কাথার ব্যাগটা একপাশে রেখে মলি হাটু ভেঙে বসে পড়লো। ওড়নায় গাথা ক্লিপ সেফটিপিনটার সাহায্যে কোনোমতে ছেড়া জুতা আটকে নিলো। সম্পূর্ণ ভার না ছেড়ে অল্প ভাড় দিয়ে পা আলগা আলগা করে হেটে যাচ্ছে।
প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেটে এসেছে সে। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে বাড়িটা পেয়ে গেছে। দেয়ালে টানানো বাড়ির নম্বর দেখলো। ঠিকানা মিলিয়ে নিশ্চিত হলো এটাই সেই বাড়ি। গেইটের বাইরে থেকেই ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখছে । দোতলা বাড়িটা, দেখতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! সুন্দরভাবে রঙ করা পুরো বাড়িতে। হঠাৎ গেইটের একপাশ থেকে কেউ ধমকে বললো,
– এই মেয়ে এদিকে কি? এমন কইরা কি দেহছ? চুরি করার ধান্দা খোজছ?
হঠাৎ ধমকে উঠায় মলি ভয় পেয়ে গেছে! লোকটা বাড়ির দারোয়ান, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এতোক্ষণ কোথায় ছিলো! সে এসে তো কাউকে দেখছিলো না। হঠাৎ করেই চামচিকার মতো এসে ধমকে উঠেছে! মলি স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– এটা ফাহিমা আন্টির বাসা না?
– হ, কে?
– তিনি আমাকে আসতে বলেছেন। বাসায় আছেন তিনি?
– আইতে কইছে কে?
– প্রয়োজন আছে বলেই তো আসতে বলেছেন! বিশ্বাস না হলে এই যে, দেখুন!
মলি লিখে দেওয়া ঠিকানার কাগজটা দেখালে দাড়োয়ান ঢুকতে দিলো। মলি আশেপাশে দেখতে দেখতে হেটে যাচ্ছে। বাড়িটা দেখতে ছোটখাটো একটা প্রাসাদ মনে হচ্ছে। পরিধি বেশি বড় না, তবে ডিজাইনটা খুব সুন্দরভাবে করা। সম্পূর্ণ বাড়ির অর্ধেকটা ভবন করা আর সামনের অর্ধেক জায়গা ফাঁকা! এতো বড় জায়গা এভাবে ফেলে না রেখে দালান তুলে ভাড়া দিয়ে রাখলেও পারতো, সেটা মলির ভাবনা!
ফাকা জায়গায় করা বাগান দেখে মলি আশ্চর্য হয়ে গেছে! খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! পুরো বাগান জুড়ে রংবেরঙের ফুল ফুটে আছে! যেন তার দিকেই মুগ্ধভাবে তাকিয়ে আছে!
ফুল খুব ভালোবাসে মলি! তারও খুব শখ ছিলো একটা বাগান করার! কিন্তু জায়গার অভাব! বাবার যেটুকু জমি আছে সেটাতে কোনোমতো ঘর এঁটেছে! সেখানে আবার বাগান করবে কোথায়!
বাড়ির মেইন দরজা খুলা ই আছে। মলি দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। ভেতরে প্রবেশ করবে নাকি কাউকে ডাকবে বুঝতে পারছে না! হঠাৎ দেখলো একজন মহিলা “জিহান” নাম ধরে ডেকে ডেকে বাচ্চার পিছু পিছু দৌড়ে যাচ্ছে!
– জিহান, দাড়াও! জিহান, মোবাইল দাও বলছি!
মলিকে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলাটি দাড়িয়ে গেলো এবং তার দিকে এগিয়ে এলো।
– কে আপনি? এখানে এলেন কিভাবে? কাকে চাই?
– জ্বি, ফাহিমা আন্টি আমাকে আসতে বলেছেন।
– কেন?
– নকশিকাঁথা দেখানোর জন্য।
এমনি পেছন থেকে মেয়েলি কণ্ঠ বললো,
– ওহ! এসে গেছো তুমি! জেরিন, আমিই বলেছি ওকে আসতে। এসো, ভেতরে।
মলি জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ফাহিমা সোফায় বসে মলিকে বসতে বললো। মলি প্রথমে বসতে চায়নি, পরে আবার বলায় বসেছে। ধনী লোকের বাড়িতে এসে তার কেমন যেন অসস্তি লাগছে! ফাহিমা জিজ্ঞেস করলো,
– নাম কি তোমার?
– মলি আক্তার।
– বাহ! সুন্দর নাম। বাসা কি এদিকেই?
– জ্বি।
– আচ্ছা দেখাও দেখি নকশিকাঁথা। জেরিন, এসো এদিকে। দেখো তোমার পছন্দ হয় কি-না!
মলি নকশিকাঁথা দেখালো। ফাহিমা আর জেরিন নেড়েচেড়ে দেখছে। কিন্তু জেরিন মলির প্রতি কেমন যেনো নাক ছিটকাচ্ছে!
– এই মেয়ে, তুমি কি বস্তিতে থাকো?
মলি মুখটা মলিন করে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
– এসব নিজে তৈরি করো?
– হ্যাঁ।
জেরিন ফাহিমাকে বললো,
– মা, এগুলো ফেরত দিয়ে দিন। আমি বসুন্ধরা থেকে এনে দিবো।
ফাহিমা একটু ধমকের সুরেই বললো,
– চুপ থাকো তুমি! বস্তিতে থাকে বলে কি হয়েছে? বসুন্ধরা থেকে এনে দিবে! বসুন্ধরার নকশিকাঁথা কোথা থেকে আসে? বসুন্ধরার মালিক বসে বসে বানায়? ওদের হাতে তৈরি জিনিসই তো বসুন্ধরার মতো কমপ্লেক্সে পাও!
জেরিন আর কিছু বললো না! এখান থেকে উঠে চলে গেলো। চার/পাচ বছরের পিচ্চিটা দৌড়ে এসে ফাহিমার কোলে বসে পড়লো।
– দাদু, উনি কে?
– উনি, তোমার আন্টি হয়।
– হ্যালো, আন্টি?
মলি মুচকি হেসে বললো,
– হ্যালো। কেমন আছো?
– আই এম ফাইন। এন্ড ইউ?
– আলহামদুলিল্লাহ। আন্টি, আপনি কি কাথা রাখতে চান?
– অবশ্যই। আমি আপাতত একটা নেই। আমার ছেলেদের দেখিয়ে তারপর আরও লাগলে তোমাকে জানাবো।
– আচ্ছা। কোনটা রাখবেন?
সেরা সব গল্পের লিংক All Best Story Link
ফাহিমা কাথাগুলো আরেকবার নেড়েচেড়ে বললো,
– তুমি নাহয় কাথাগুলো আজ রেখে যাও। আমার ছেলেরা বাসায় ফিরলে তাদের দেখাবো। তারা পছন্দ করে যেটা রাখবে সেটা রেখে দিবো। কাল এসে নিয়ে যেও। আমি না হয় তোমাকে এখন একটার দাম দিয়ে দিচ্ছি। রেখে যেতে অসুবিধা হবে?
মলি একটু ভেবে বললো,
– ঠিক আছে।
ফাহিমা কাথার দাম জেনে টাকা আনতে চলে গেলো। কোনো দরদাম করেনি। মলি যত বলেছে ততই দিতে রাজি হয়েছে! পিচ্চি জিহান এখানে বসে কাথা নাড়ছে আর “ওয়াও, ফ্যান্টাস্টিক, খুব সুন্দর ” এমন কিছু শব্দ করে যাচ্ছে! ফাহিমা টাকা এনে দিলে মলি টাকা নিয়ে বললো,
– আন্টি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– হ্যাঁ, বলো?
– একটু আগে যে এলেন তিনি কি আপনার মেয়ে?
ফাহিমা মুচকি হেসে বললো,
– আমার কোনো মেয়ে নেই। শুধু দুইটা ছেলে আছে। আর তুমি যার কথা বলছো সে হচ্ছে আমার বড় ছেলের বউ। আর এই পিচ্চিটা হচ্ছে আমার বড় ছেলের সন্তান।
– ওহ! আচ্ছা, তাহলে আমি আসি আন্টি।
– ওকে। কাল এসে নিয়ে যেও।
– আচ্ছা।
মলি বেরিয়ে গেলো। গেইটের দিকে যেতে যেতে আবার বাগানটাকে দেখতে লাগলো। ইচ্ছে তো করছে ছো মেরে এক দৌড়ে সবগুলো ফুল ছুয়ে দিতে! কিন্তু সেই সৌভাগ্য যে তার নেই! হঠাৎ কোথাও আটকে গেলো! সামনে আর হাটতে পারছে না! তাকিয়ে দেখলো তার সামনে বাধা দিয়ে দাড়িয়ে আছে গাড়ি! কেউ একজন মাথা বের করে বললো,
– এই মেয়ে! চোখ কোথায় থাকে! এখনই তো এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো! জহির….! এসব পাগল টাগল বাড়িতে ঢুকে কিভাবে!
দারোয়ানটা দৌড়ে এসে বললো,
– ভাইজান, আম্মায় নাকি কইছিলো আইতে।
– যত্তসব পাগল ছাগল!
মলি গাড়ির একপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো। ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে ঢুকছে। অনেক হ্যান্ডসাম দেখতে! হঠাৎ জিহান নামের পিচ্চিটা “আব্বু” বলে দৌড়ে বেরিয়েছে। লোকটা কোলে করে জিহানকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে।
মলি বুঝতে পেরেছে এটা তাহলে আন্টির বড় ছেলে। এক একটা কিউটের ডিব্বা! যেমন সুন্দর লোকটা তেমন সুন্দরী বউটা, তার চেয়েও বেশি সুন্দর পিচ্চিটা! আন্টিও অনেক স্মার্ট, বুঝাই যায় না তিনি এতো বড় ছেলের মা!
মলি নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাটছে। এই জুতাটা অনেক বিরক্ত করছে তাকে! আর সহ্য করতে না পেরে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিলো! এবার দ্রুত পায়ে হাটতে লাগলো!
বাসায় ফিরে দেখলো বাবার অবস্থা খারাপ! সকাল থেকেই নাকি পেট ব্যাথা করছে! এখন তো যন্ত্রণায় এক প্রকার চিৎকারই করছে!
– ভাবি, ওষুধ দাওনি তুমি?
– না, ওষুধ দিতেই তো এলাম। বাবা বলছে পেট অনেক ব্যাথা! ওষুধ খেতে চাচ্ছে না!
– বাবা, অনেক খারাপ লাগছে?
– হ্যাঁ, রে মা! ভেতরটা কেমন যেন লাগছে! খুব যন্ত্রণা! বাচবো না মনে হয়!
– কি বলো এসব! চুপ করো! ভাবি তোমার মোবাইলটা দাও, ভাইয়াকে বলে দেখি কি বলে!
মলি তার ভাইকে কল করে বাবার অবস্থা বললো। মুহিত বললো সে জরুরি কাজে আটকে গেছে এখন আসতে পারবে না। মলিকে বললো রিকশা ডেকে বাবাকে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে। মলি আর অপেক্ষা না করে রিকশা নিয়ে বাবাকে ক্লিনিকে নিয়ে গেলো। ডাক্তার জানালো তিনি আলসারে আক্রান্ত!
সারাদিন বাবাকে এখানেই রাখলো। কাথা বিক্রি করে আনা টাকা ক্লিনিকেই খরচ করে ফেললো। দুপুরে মুহিত ছুটি নিয়ে এসেছে, বিকেলে বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে।
একের পর এক যন্ত্রণা এসে চোখের সামনে ভাসে! কোনো মুক্তি নেই! টানাপোড়েনের এই সংসারে সুখ জিনিসটা কমই আসে! কারোরই মনমেজাজ ভালো না! এভাবেও জীবন চলে, ভাবতেই মগজে হোচট খায়!
পরেরদিন একই সময়ে ও বাড়িতে গেলো মলি। আজও বাগানের দিকে তাকাতে ভুলেনি সে! বাগানের সতেজ ফুলগুলো যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে! প্রতিদিন ফুলগুলো যেন তাকেই অভ্যর্থনা জানায়!
সে হেটে হেটে বাড়ির দরজার সামনে এলো। আজ বাড়িতে লোকজন বেশি! শুক্রবার হওয়ায় মনে হয় সবাই বাড়িতে আছে! মলি কাকে কি বলবে ইতস্তত বোধ করছে! আজ না এলেও পারতো!
ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো,
– কে তুমি? মালিনী নাকি?
এই লোকটাকে গতকাল দেখা লোকটার মতোই লাগছে অনেকটা! তাহলে হতে পারে এটা আন্টির ছোট ছেলে! আর কন্ঠটা তো পরিচিত লাগছে! হসপিটাল যাওয়ার সময় আন্টির সাথে গাড়িতে হয়তো তিনিই ছিলেন। মলি আমতা আমতা করে বললো,
– ন..না, আমি মলি! মলি আক্তার!
– তোমার নাম জানতে চাইনি। এখানে কেন এসেছো সেটা জানতে চেয়েছি!
ভেতর থেকে জেরিন জবাব দিলো,
– ফরহাদ, মা এর কাছ থেকে কাথা রেখেছে। সেজন্যই এসেছে।
– ওহ! আমি তো ভেবেছি আমাদের বাগান দেখাশোনার জন্য মালিনী ঠিক করা হয়েছে!
জেরিন হেসে বললো,
– ভালোই হতো মালিনী হলে! নামও নাকি মলি! মলি আর মালিনী শুনতে তো একই রকম মনে হয়!
ফরহাদ জেরিনের কথা উপেক্ষা করে মলিকে বললো,
– ভেতরে এসে বসো। মা, তোমার কাথাওয়ালী এসেছে।
মাকে ডেকে সে দোতলায় চলে গেলো। মলি ভেতরে এসে দাড়িয়ে আছে একপাশে। সোফায় বসে আছে কাল দেখা সেই লোকটি সাথে বয়স্ক একজন লোক! হয়তো উনার বাবা! এ বাড়িতে দেখা সকলেই খুব স্মার্ট আর সৌন্দর্যের কথা না বললেই নয়! জিহান বয়স্ক লোকটার সাথে বসে খেলছিলো। মলিকে দেখে দৌড়ে এলো।
– আন্টি, তুমি আজকেও কাথা নিয়ে এসেছো?
– না, আমি কাথা নিতে এসেছি।
– নিয়ে যাবে কেন?
জিহানকে মলির সাথে কথা বলতে দেখে জেরিন এসে টেনে নিয়ে গেলো। ফাহিমা এসেছে এখানে। মলিকে দেখে বললো,
– এসো মলি। বসো এখানে।
মলিকে সোফায় বসতে বলায় বড় ছেলে উঠে চলে গেলো। মলি বয়স্ক লোকটিকে সালাম দিলো। তিনিও হাসি মুখে সালামের জবাব দিলো। ফাহিমা লোকটিকে বললো,
– কোনটা রাখবেন, বলুন তারাতাড়ি। বাকিটা দিয়ে দিবো।
– আরেকটা কোথায়?
– আরেকটা ফরহাদ নিয়েছে।
– আমার তো ওটাই পছন্দ হয়েছে, তোমাকে না আগেই বললাম!
– আমিও না আপনাকে আগেই বললাম, ওটা আপনার ছোট ছেলে পছন্দ করেছে!
– ফারদীন কোনটা নিয়েছে?
– ফারদীন নেয়নি! তারও ফরহাদেরটা ই পছন্দ!
সবাই একটাই পছন্দ করেছে বিধায় নেয়ামত উল্লাহ নামের লোকটি হেসে বললেন,
– তাহলে আর কি! তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই রেখে দাও।
ফাহিমা একটা রেখে আরেকটা মলির কাছে দিয়ে দিলো। যেটা রেখেছে সেটার টাকা দিয়ে বললো, ফরহাদের রাখা কাথার ন্যায় যেনো আরও একটা বানিয়ে আনে। মলি অর্ডার নিয়ে নিলো। তাদের কাছে বিদায় নিয়ে খুশি মনে বেরিয়ে গেলো। বাইরে এসে বাগানটা দেখে কিছু একটা মনে করে আবার দরজার সামনে এসে দাড়ালো মলি। এখান থেকেই বললো,
– আন্টি কিছু কথা ছিলো, আসবেন একটু এদিকে?
ফাহিমা কোল থেকে কাথাটা নামিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– হ্যাঁ বলো।
মলি ইতস্তত বোধ করে বললো,
– আন্টি, আপনাদের বাগানে কি দেখাশোনার জন্য লোক রাখবেন?
– হ্যাঁ, একজন প্রয়োজন ছিলো। খুজছিলাম আরকি। কেন, তুমি করবে নাকি!
মলি যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে! সে উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– জ্বি আন্টি, আপনি বললে আমি করতে রাজি আছি!
.
.
“মালিনী”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
মলি যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে! সে উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– জ্বি আন্টি, আপনি বললে আমি করতে রাজি আছি!
– তুমি এসে বসো, আমি ফরহাদকে ডেকে কথা বলছি। কাজের সময়, বেতন সব ঠিক করে যাও।
– না আন্টি, আপনি কথা বলে রেখেন। কাল আমি এলে আমাকে জানিয়ে দিয়েন।
– সেকি, সবকিছু জেনে রাজি হবে না তুমি?
– যেমন বেতন দিবেন আমি সেটাতেই কাজ করতে রাজি। আমাকে একটু মার্কেটে যেতে হবে। আল্লাহ হাফেজ।
– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
মলি চলে গেলো। তার তো খুব আনন্দ হচ্ছে! বাগানে কাজ করে সে সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারবে! একবার বাগানটা ঘুরে যেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু এটা বেশি বেহায়াপনা হয়ে যায় তাই ইচ্ছেটা সংযত রেখে বেরিয়ে গেলো। বাসায় ফেরার পথে হাতে থাকা কাথাটা আংকেলের দোকানে দিয়ে গেলো।
যেটা শুরু করেছিলো সেটা রেখে অর্ডার নেওয়া ডিজাইন অনুযায়ী নতুন একটা বানানো শুরু করে দিলো।
সারাদিন কাথার পেছনে সময় ব্যয় করছে। তাছাড়া বাবার দেখাশোনা, হৃদয়কে দেখে রাখা আর নিজের কাজকর্ম তো আছেই। রান্নাঘরে কমই যায়, সেদিকটা ভাবি আর মা সামলায়!
যথাসময়ে সে ও বাড়িতে গিয়েছে। ফাহিমা জানালো মলিকে সকালবেলা একবার ও বিকালবেলা একবার বাগানে পানি দিতে হবে। মাঝে মাঝে বাগানের অতিরিক্ত ঘাসগুলো পরিষ্কার করে দিতে হবে। মাটি আলগা করে পরিচর্যা করতে হবে। মাস শেষে বেতন পাবে চার হাজার টাকা।
সময়টা বিকেলে হওয়ায় মলি একটু টেনশনে পড়ে গেলো! এতে তো বাচ্চাদের পড়াতে পারবে না! তারপর নিজেই সিদ্ধান্তে অটুট হলো বাচ্চাদের পড়ানো ছেড়ে দিবে। কেননা, বাচ্চাদের পড়িয়ে মাস শেষে তার আয় হয় মাত্র দু হাজার টাকার মতো! সংসারে যেহেতু অভাব, এর চেয়ে ভালো এখানে চার হাজারে লেগে থাকুক! মলি রাজি হয়ে গেলো। আজ থেকেই এখানে লেগে গেলো কাজে! খুব ভালো লাগছে তার এখানে কাজ করতে! ফুলগুলো স্পর্শ করতে পেরে মন আরও বেশি উৎফুল্ল হয়ে গেছে!
“মনে হচ্ছে,
সে কোন এক অজানা জগতে হারিয়ে গেছে!
আর প্রকৃতি তাকে কুড়িয়ে পেয়েছে!
বেলি ছড়িয়েছে মিষ্টি গন্ধ!
সাদা, লাল আর হলুদ গোলাপ করেছে তাকে মুগ্ধ!
রজনীগন্ধা ছড়িয়েছে মাতাল সুবাস,
আর গাদা ফুল তীক্ষ্ণ!
শিউলী, জবা হেসে যেন,
দিয়ে যাচ্ছে তাকে শীতল আবাস!
সে যে ভেবে নিচ্ছে নিজেকে এ রাজ্যের রানী!
কিন্তু হঠাৎ করেই মনে পড়লো, সে তো এক মালিনী!”
.
ডালপালার আগাছা গুলো মনে হচ্ছে কেউ কেটে রেখেছে। সে নিচের ঘাসগুলো পরিষ্কার করে নিলো। একটু ঘুরেফিরে বাগানটা দেখে নিলো। এবার ঠিক আছে সবটা। বাগানে পানি দিয়ে সে এখানেই হাতমুখ ধুয়ে নিলো। তারপর ফাহিমার কাছে বলে বাসায় ফিরে এলো।
বিকেলে আবার এসেছে বাগানে পানি দিতে। ফাহিমা বাগানের দিকে ঘুরতে এসেছে। সাথে জিহান, জেরিন আরও একটা মেয়ে। জেরিনের মতোই চেহারা মেয়েটার! অনেক সুন্দরী! আন্টির সাথে কথাবার্তাও বলছে খুব সুন্দর করে। এটা কি ছোট ছেলের বউ নাকি, জানতে ইচ্ছে করছে খুব! বউ হলে মন্দ হয় না! মানাবে খুব!
মলির পানি দেওয়া শেষ হলে সে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। ফাহিমার কাছে বিদায় নিতে যাবে তখন জেরিন বললো,
– মালিনী, এদিকে আয়।
– জ্বি ভাবি?
– ভাবি বলবি না। মেডাম বলবি। দুইটা বেলিফুল এনে দে। পাতা সহ ছিড়ে নিবি। সেলফি তুলবো।
ফাহিমা বললো,
– আগে বললে না! এখন কাদা হয়ে গেছে কিভাবে আনবে!
– কেন, কাদায় হেটেই তো আনতে পারবে! আগে বলবো কিভাবে, এসে তো দেখলাম পানি দিয়েই ফেলেছে!
মলি জুতা খুলে কাদা দিয়ে হেটেই চলে গেলো ফুল আনার জন্য। পাশের মেয়েটা বলে দিলো তার জন্য একটা গোলাপ আনতে। মলি ফুল এনে জেরিনের হাতে দিলো। আবার বিদায় নেওয়ার সময় মলি ফাহিমার কাছে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
– আন্টি, উনি কি ছোট সাহেবের বউ?
ফাহিমা মুচকি হেসে জবাব দিলো,
– না, ও জেরিনের ছোট বোন।
এদিকে জেরিন বললো,
– মালিনী তুই ঠিক ধরেছিস, বউ হয়নি তবে হতে আর বেশি দেড়ি নেই!
সবার মুখেই মুচকি হাসি। মলি পা ধুয়ে জুতা পড়ে নিলো। ফাহিমা বললো,
– মলি, তোমার বাসা থেকে আসতে এখানে কতক্ষন সময় লাগে?
– বিশ পঁচিশ মিনিটের মতো।
– তাহলে তো আসা যাওয়ায় প্রায় এক ঘন্টা! বাকি সময় বাসায় কি করো?
– নকশিকাঁথা বানাই শুধু আর কিছু না।
– তাহলে তো এখানেই সারাদিন কাটাতে পারো। মাঝখানে আর তোমার এক ঘন্টা সময় নষ্ট হয় না!
– ওই যে, কাথা বানাই।
– কাথা নিয়ে এসে পড়বে। এখানে বসে বানিয়ে ফেলবে। তুমি থাকলে একটু গল্পও করা যায়!
মলি শুধু মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো আর এদিকে জেরিন বললো,
– মা, গল্প করার লোকের অভাব পড়ে গেলো! আমি আছি, জেনিফা আছে!
– জেনিফা তো মাঝে মাঝে আসে। তোমাকে আর কতক্ষণ পাই!
– তাহলে জেনিফাকে একবারে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করুন।
– বলো ফরহাদকে।
– ফরহাদ তো রাজিই আছে। আপনি আর বাবা বললেই সব ঠিক।
– আমি বললে ঠিক হয় নাকি! ফারদিনকেও তো আমার বলতে হয়নি! নিজেরই পছন্দ হয়েছে তোমাকে। ফরহাদও নিজেই পছন্দ করবে।
– মা, আপনার কি আমাকে পছন্দ নয়?
– কি বলছো তুমি, পছন্দ হবে না কেন! আমি তো সেটা চাচ্ছি, যে সংসার করবে সে ই নিজের জীবনসঙ্গী ঠিক করবে। সন্তান ভালো থাকলেই বাবা মা ভালো থাকবে। মলি তুমি যাও, সময় নষ্ট হচ্ছে শুধু শুধু।
মলি চলে গেলো। ওদিকে জেনিফা জিহানের সাথে সেলফি তুলায় ব্যস্ত। আর এদিকে তারা শ্বাশুড়ি বউ কথা বলছে।
ফাহিমার কথা অনুযায়ী পরেরদিন মলি সেই কাজই করলো। কাথা এখানে নিয়ে আসে। বাগানের কাজ শেষ করে এখানেই বসে কাথার কাজ করছিলো। ফাহিমা মলির খোজে বাইরে এসে দেখলো মলি দোলনায় বসে কাথা বানাচ্ছে। তিনি পাশে এসে বসে বললো,
– এখানে বসে অসুবিধা হচ্ছে না?
– না। ঠিক আছে।
– ভেতরে চলো আমার সাথে।
– না আন্টি, এখানেই ঠিক আছে। সেখানে গেলে আপনাদের আরও সমস্যা হবে।
– কারো সমস্যা হবে না। চলো, বসে বসে গল্প করবো আর দুজনেই কাজ চালাবো। তুমি তোমার কাজ করবে আমি আমার কাজ। বাসায় কেউ নেই, একা একা ভালো লাগছে না।
– মেডাম বাড়িতে নেই?
– না, কাল সন্ধ্যায় বাবার বাসায় গেছে।
খালি বাড়িতে যেতে তো আরও বেশি অসস্তি লাগছে! তবুও ফাহিমার জোড়াজুড়িতে মলি বাড়িতে ঢুকতে রাজি হলো। ফাহিমা আগে চলে গেছে, মলি তার পিছু পিছু যাচ্ছে। ঢুকতে যাবে এমন সময় বাড়ির ছোট ছেলে ফরহাদ সামনে! ফাহিমা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
– একটু পর না চলে যাবি, এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?
– আসছি একটু বাইরে থেকে।
ফাহিমা চলে গেলো। মলি তার মুখোমুখি হলো! এপাশ দিয়ে ঢুকতে যাবে তো ফরহাদ এপাশ দিয়ে বের হতে যাচ্ছে, মলি ওপাশে যেতে নিলে ফরহাদ আবার ওপাশে! এভাবে দু-তিনবার এপাশ ওপাশই করলো! এবার মলিই একপাশে দাড়িয়ে গেলো। ফরহাদ মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো!
– যত্তসব ফালতু লোকজনের সম্মুখীন হতে হয়! জামা-কাপড়ের বিশ্রী অবস্থা, চলাফেরারও কোন ঠিক নেই!
মলি মুখটা মলিন করে মনে মনে বললো,
– মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না! চেহারা আর বেশেবুশে সুন্দর হলেই কি, মনটা একেবারে কুৎসিত! অহংকারে ভরপুর! একমাত্র আন্টি ছাড়া এই বাড়ির সব লোকের বদমেজাজ! নিজেরা ধনী বলে গরিবদের দেখতে পারে না!
ফাহিমা কিচেনে থেকে জোর গলায় ডেকে বললো,
– মলি, এদিকে এসো।
মলি কিচেনে চলে গেলো তার বোচকাবুচকি নিয়ে! ফাহিমা রান্নার আয়োজন করছে আর মলির সাথে গল্প করছে। মলির ও তার পরিবার সম্পর্কে জানছে। এতো আয়োজন দেখে মলি বললো,
– আন্টি, এ সময়ে কিসের রান্না? তাও আবার কেউ বাড়িতে নেই! মেহমান আসবে?
– না, ছোট ছেলে চিটাগং চলে যাবে। তাই একটু ভালো রান্নাবান্না করে দিচ্ছি। আবার কবে না কবে আসে!
– চিটাগং কেন?
– সেখানে তার বাবার ব্যাবসা সামলায়।
– চিটাগংএ আংকেলের ব্যবসা?
– ঢাকাতেও আছে। দুই জায়গায় দুই কোম্পানির অংশীদার। ফারদীন এখানকারটা সামলায় আর ফরহাদ চিটাগংএর টা।
– ওহ!
মলি তার কাজ চালাতে লাগলো আর ফাহিমা নিজের কাজ। মলি লক্ষ্য করছে ফাহিমা তাড়াহুড়ো করে কাজ করছে! একা হাতে সামলাতে পারছে না তেমন! তাই সে নিজের ইচ্ছাতেই কাথা রেখে ফাহিমাকে সাহায্য করতে এলো। মাছসহ, সবজি কুটে দিলো। আর এদিকে ফাহিমা রান্না শেষ করলো।
বাসায় ফিরে ফরহাদ সবকিছু গুছিয়ে রেডি হয়ে গেছে। লাঞ্চ করার পরপরই বেরিয়ে গেছে সে। ছেলে বিদায় দিয়ে ফাহিমা আঁচলে চোখ মুছলো। মলি লক্ষ্য করেছে বিষয়টি! ফাহিমা আবার কিচেনে ফিরে এলে মলি বললো,
– আন্টি, আপনার ছেলেকে কি বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন?
ফাহিমা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– মানে?
মলি মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– মানে, আপনি যে ছোট সাহেবকে বিদায় দিয়ে কাদছিলেন! মনে হয়েছে বিয়ের কনে বিদায় করছেন!
ফাহিমা হেসে বললো,
– পাজি মেয়ে! সন্তান দূরে চলে গেলে কষ্ট লাগে মায়ের কাছে! যেদিন মা হবি, সেদিন বুঝবি!
কথাটার স্টাইলটা মলির খুব ভালো লেগেছে তাই বললো,
– আন্টি, আপনি আমাকে তুই করেই বলবেন। ভালো লাগছে শুনে!
ফাহিমা হেসে বললো,
– আচ্ছা, বলবো। চল, আমার সাথে খেয়ে নে।
– না, আমি বাড়িতে ফিরে খাবো।
– বাড়িতে ফিরবি সেই বিকেলে, এতোক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে থাকবি! এখন খাবি, চল। আর এখন থেকে প্রতিদিনই দুপুরের খাবার এখানে খাবি।
– তা কি করে হয়!
– হয় না কেন?
– না, কিছু না। আন্টি ছোট সাহেব কি বছরে একবার আসে?
– না, কাজের সুযোগ বুঝে তার যখন ইচ্ছে হয় চলে আসে। সপ্তাহ কাটে আবার মাসও কেটে যায়।
– ওহ্!
মলির ইচ্ছে না থাকলেও খেতে হলো এ বাড়িতে! নিজের কাছে এতোটাই অসস্তি লাগছে, ধনীদের ভাত যেনো তার গলা দিয়ে নামছে না! কিন্তু বাধ্য হয়ে অন্ন গিলছে! বিকেল পর্যন্ত এখানেই কাটিয়ে বাগানে পানি দিয়ে আবার বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফিরে আবার বাবার যত্নাদি সাথে হৃদয়ের দেখাশোনা, এভাবে কাটছে তার ব্যস্ত জীবন।
https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318