#মালিনী পর্ব ৪

0
668

“মালিনী” পর্ব ৪

(নূর নাফিসা)
.
.

মলির ইচ্ছে না থাকলেও খেতে হলো এ বাড়িতে! নিজের কাছে এতোটাই অসস্তি লাগছে, ধনীদের ভাত যেনো তার গলা দিয়ে নামছে না! কিন্তু বাধ্য হয়ে অন্ন গিলছে! বিকেল পর্যন্ত এখানেই কাটিয়ে বাগানে পানি দিয়ে আবার বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফিরে আবার বাবার যত্নাদি সাথে হৃদয়ের দেখাশোনা, এভাবে কাটছে তার ব্যস্ত জীবন।
প্রায় দু সপ্তাহ কেটে গেছে সে এ বাড়িতে মালিনী হিসেবে নিযুক্ত আছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকে, কাথা এখানেই সেলাই করে, ফাহিমার কাজেও সাহায্য করে। কৌশলে জেরিনও তাকে দিয়ে কাজ করায়! মলি না করে না কারো কাজেই। অর্ডারকৃত কাথা সেলাই হয়ে যাওয়ার পর আবার জিহানের জন্য ছোট সাইজের একটা অর্ডার করেছে ফাহিমা। এ বাড়িতেই চারটা কাথা বিক্রি হয়ে গেছে মলির। বেশ কিছু টাকা আয় হয়েছে আর তা দিয়ে বাবার ওষুধ করাচ্ছে।
বাড়িতে বাজার নেই। ভাইয়ের ডিউটি খুব সকাল থেকে শুরু হয় বলে সাপ্তাহিক বাজার মলিকেই করতে হয়। মাঝে মাঝে সময় পেলে ভাই মুহিত ই করে আনে। আজ আবার বাজারে যাচ্ছে মলি। লুচুদের হাত থেকে বাচতে ওড়না মাথায় দিয়ে তারপরই বাজার করেছে। গরমকে আর প্রাধান্য দিলো না। সেদিনের পর থেকে সবসময়ই চেষ্টা করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার। তবে বাড়িতে থাকলে বা কাজের ক্ষেত্রে সুবিধামতো ভিন্নভাবে রাখে।
বাড়িতে বাজার দিয়ে ও বাড়িতে কাজে এসেছে। আজ ফাহিমার সাথে দেখা না করে সরাসরি কাজে লেগে গেছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে ফাহিমা বাইরে এসেছে। মলিকে বললো,
– কিরে, আজ আমার সাথে দেখাও করলি না যে!
মলি মৃদু হেসে জবাব দিলো,
– ভাবলাম কাজ সেড়েই দেখা করতে যাবো।
– আজ আমার একটু কাজ করে দিতে হবে। কাথা বানানোর পারিশ্রমিক নাহয় আমিই দিবো। পারবি করতে?
– পারিশ্রমিক লাগবে না। কি কাজ বলুন আন্টি।
– চল আমার সাথে।

সেরা সব গল্পের লিংক All Best Story Link

মলি হাতমুখ ধুয়ে ফাহিমার সাথে বাড়িতে প্রবেশ করলো। ফাহিমা তাকে দোতলায় ফরহাদের রুমে নিয়ে এলো।
– এই রুমটা একটু ঝেড়ে মুছে দে। ফরহাদ কাল সন্ধ্যায় বলেছিলো আজ আসবে। ময়লা হয়ে গেছে রুমটা। ঘাড় ব্যাথার জন্য আমি পারি না এসব । ডাক্তার নিষেধ করেছে তবুও নিজেরটা করি।
– আচ্ছা আন্টি, আমি করে দিচ্ছি।
মলি ওড়নাটা ভালোভাবে বেধে কাজে লেগে গেলো। রুম ঝাড়ু দিয়ে মুছে দিলো। ফাহিমার রুমসহ ড্রয়িং রুম পরিষ্কার করে দিলো। নেয়ামত উল্লাহ মাত্রই স্কুল থেকে জিহানকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে। সেই শুরু হয়ে গেছে জিহানের খেলাধুলা, দুষ্টুমি। কাজ শেষ হলে ফাহিমার কাছে কিচেনে এসে বললো কাজ শেষ।
জিহান জেরিনের ফোন এনে দিলো। জেনিফা কল করেছে তাই জেরিন কাজ ছেড়ে উঠে মলিকে বললো তরকারি কেটে দিতে। সে চলে গেলো আর মলি কথামতো তরকারি কাটতে বসে পড়লো। জেরিনের কান্ড দেখে ফাহিমা বিরক্তিকর নিশ্বাস ছাড়লো!
একটু পর ফরহাদ বাসায় হাজির। প্রথমেই কিচেনে এসে মায়ের সাথে দেখা করলো তারপর রুমে গেলো। আবার রুম থেকে নিচে কিচেনে এসে বললো,
– মা, আজ আবার তুমি ঘর মুছে দিয়েছো!
– না, মলি মুছে দিয়েছে।
পেছন থেকে জেরিন বললো,
– আরে, ফরহাদ এসে গেছো!
– ভাবি, তোমার চোখে সমস্যা নাকি! ডাক্তার দেখাও।
জেরিন হেসে বললো,
– চোখে সমস্যা না। দেখতে পাচ্ছি তোমাকে। মালিনী, আমার রুমটাও মুছে দিস তো আজ।
ফরহাদ রুমের দিকে যাচ্ছিলো কিন্তু জেরিনের কথা শুনে দাড়িয়ে গেলো।
– কেন ভাবি? মালিনীকে কি বেতন দিয়ে তোমার কাজে রেখেছো?
– কেন, মালিনীকে বেতন তো দেয়া ই হয়! টুকটাক কাজ করবে না!
– মালিনীকে তোমার কাজ করার জন্য বেতন দেওয়া হয় না। বাগান দেখাশোনা করার জন্য বেতন দেওয়া হয়।
– মায়ের কাজ তো টুকটাক করে দেয়ই তাহলে আমারটা দিতে সমস্যা কি!
– অনেক সমস্যা! মা তাকে কাজে রেখেছে, তুমি রাখোনি।
ড্রয়িং রুমে নেয়ামত উল্লাহ বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলো। ফরহাদ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোর গলায় ফাহিমাকে বললো,
– মা, বাবাকে জিজ্ঞেস করো তো মালিনীর বেতন কতো দিবে?
ফাহিমা কিচেন থেকে বললো,
– চার হাজার।
– মাত্র চার হাজার টাকার বিনিময়ে একটা মানুষ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ বাড়িতে থাকবে, বাগানের পরিচর্যা করবে আবার তোমাদের কাজও করে দিবে! বাড়ির দাড়োয়ান সারাদিন বসে থেকে বারো হাজার টাকা বেতন পেলে মালিনীর বেতন চার হাজার কিভাবে হয়! সে তো তোমাদের এতো কাজ করে দেয়! তোমাকে বলেছিলাম কাজের লোক রাখতে সেটা তো রাখলে না। তাহলে মালিনীকে কাজ করাও কেন! আর করাবেই যখন, বেতন চার হাজার কেন?
নেয়ামত উল্লাহ ছেলের কথার যুক্তি দেখে জবাব দিলেন,
– ফাহিমা, মালিনী তোমার কাজ করে দেয় বিধায় ওর বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে। বলে দাও তোমার ছেলেকে।
জেরিন বললো,
– ফরহাদ, এবার নিশ্চয়ই তোমার কোনো প্রব্লেম নেই।
– আছে প্রব্লেম। বেশি সুখ কারো ভাগ্যে স্থির হয় না জানো তো সেটা? বাড়ির বউ তুমি, আর কারোটা তো করোই না, নিজের কাজটা অন্তত নিজে করো। তাছাড়া নিজের কাজ করতে যদি তোমার অসুবিধা হয় তাহলে ভাইয়াকে বলো তোমার জন্য চাকরানি জোগাড় করে দিতে। মালিনী এখানে শুধুমাত্র বাগানের কাজ করতে আসবে আর মায়ের কাজে সাহায্য করবে। চাকরানী হিসেবে রাখা হয়নি তাকে।
জেরিন হনহন করে রুমে চলে গেলো। মলি কিছুই বললো না, সব তো তারা নিজেরাই ঠিক করে দিলো! সে আর কি বলবে! যে কাজ করবে তার মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করলো না ফরহাদ! মলি শুধু তাকিয়ে দেখছে আর শুনছে! জেরিন যাওয়ার পরপরই ফরহাদ নিজের রুমে চলে গেলো। ফাহিমাও কিছু বললো না, নিজের কাজে ব্যস্ত। মলি জিজ্ঞেস করলো,
– আন্টি, ছোট সাহেব কি আংকেলের সাথে কথা বলে না?
ফাহিমা মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– তুই বুঝলি কিভাবে?
– ওই যে, ছোট সাহেব আংকেলকে না বলে আপনাকে বললো জিজ্ঞেস করতে আবার আংকেল সরাসরি না বলে পরোক্ষভাবে আপনার ছেলে বললো!
– ফরহাদ আমেরিকাতে যেতে চেয়েছিলো পড়াশোনার জন্য। তার বাবা যেতে দেয়নি, সে থেকেই বাবার সাথে কোন কথা বলে না। যা বলার আমার মাধ্যমে বলে! ছেলের এতো বড় অভিমান দেখে বাপেরও একই কান্ড!
আজব কান্ড শুনে হাসলো মলি। তরকারি কেটে নকশিকাঁথা নিয়ে বসলো সে। দুপুরে খাওয়ার সময় নেয়ামত উল্লাহ এক ডাক দিতেই জেরিন হাজির। এ বাড়িতে নেয়ামত উল্লাহর উপর কেউ কথা বলতে পারে না। জেরিন রেগে আছে তবুও ছুটে এসেছে। মলি কাথা নিয়ে বাইরে দোলনায় চলে গেলো। কেউ আপত্তি করতে পারে সেই সংকোচে ফাহিমা আর মলিকে খাওয়ার জন্য বলেনি। অবশ্য মলিও এখানে বসবে না সেটাও খুব ভালো জানেন তিনি। তাদের খাওয়াদাওয়া শেষে ফাহিমা মলিকে খাওয়ার জন্য ডাকলো। মলি জানালো সে খাবার নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে এবং খেয়ে নিয়েছে। ফাহিমা প্রতিদিনই বলে দুপুরে এখানে খেতে কিন্তু মলি খাবার নিয়ে আসে। আর মাঝে মাঝে না আনলে জোর করে খাওয়াতে পারে।
কাথা আজ বেশি সেলাই করতে পারেনি।
বিকেল হয়ে এলে মলি বাগানে পানি দেওয়ার জন্য এলো। ফুলগুলো না ছুলে তার ভালো লাগে না! আজকের জিনিয়া ফুলগুলো খুব সুন্দরভাবে সেজেছে! পরিপূর্ণ ফুল সজাগ দৃষ্টি দিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে! যেনো অহংকার নিয়ে বলছে, “দেখো আকাশ, অপরূপ সৌন্দর্যে সজ্জিত হয়েছি আমি!” ফুলের পাপড়ি আলতো স্পর্শ করে মলি বললো,
– এই, এতো অহংকার কিসের তোর? দুদিন বাদেই তো ঝড়ে পড়বি! অহংকার করিস না কখনো, ভোগে নয় ত্যাগেই আনন্দ!
জিনিয়া ফুল ছেড়ে লজ্জাবতী গাছের কাছে এলো। স্পর্শ করতেই পাতাগুলো লজ্জায় নিভু নিভু! মলি হেসে বললো,
– এতো লজ্জা কেন তোর? লজ্জা তো নারীর ভূষণ! তুই কেন কেড়ে নিচ্ছিস? নারীকে হার মানাতে চাচ্ছিস? একদম তা করবি না! নিজের রূপে বাগিচাকে সজ্জিত করে দে, এতেই হবে তোর সার্থকতা!
পরক্ষণেই মলি চলে গেলো গাদা ফুলের কাছে! ফুলগুলোতে হাতের কোমল স্পর্শ দিয়ে বললো,
– সুবাস মিষ্টি নয় বলে কি মন খারাপ? একদম মন খারাপ করবি না! আমি খুব পছন্দ করি তোদের! ভেবে দেখ, তুই সবচেয়ে ভিন্ন রূপের অধিকারী! জানিস? সে দূর থেকে বাগানে চোখ বুলালে তোকেই দেখা যায় সবার আগে! বাগিচা একেবারে উজ্জ্বল হয়ে থাকে শুধুমাত্র তোর কারণে! ভেবে দেখ, মানবের ব্যাবহারে অধিক পরিমাণে তোকেই প্রয়োজন হয় সবার!
ফুলের সাথে কথা বলে আনন্দ পায় মলি! তার মনে হয় ফুলগুলো তাকে ডাকে, তার সাথে গল্প করতে চায়, অন্যজাতের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়! এক অদ্ভুত ভাষা খুজে পায় গাছ ও ফুলগুলোর মাঝে! হয়তো সে ছাড়া কেউ বুঝে না তাদের ভাষা!
[আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓
https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]
একে একে সব ফুল স্পর্শ করে মলি পানির পাইপ নিয়ে এলো। হঠাৎ করেই দোতলায় চোখ পড়লো! বারান্দায় ফরহাদ দাড়িয়ে আছে। বাগানের দিকেই ফরহাদের রুম। তার হাতে এখন মোবাইল আছে। মোবাইলের দিকে দৃষ্টি আর মুখে ফুটে উঠা হাসি! অসম্ভব সুন্দর লাগছে! মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে মনে হচ্ছে! মোবাইলও মানুষকে হাসাতে পারে, মলির কাছে অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা! হতেই পারে হাস্যকর, মোবাইলে তো অনেক কিছুই থাকে! কিন্তু এই মোবাইল নাশকতা মলির একদম পছন্দ না! বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়ে এই মোবাইল নেশায় আক্রান্ত মানুষ গুলো।
মোবাইল নিয়ে নানান কথা ভাবতে ভাবতে মলি পানি দিতে লাগলো। হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ ভেসে এলো। তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ! এই মাত্রই না দোতলায় দেখলো এতো তাড়াতাড়ি চলে এলো! হাতে এতো বড় কাচি! ফোনে কথা বলছে। মলি তাকাতেই ফরহাদ ফোনে কথা বলতে বলতে তাকে ইশারা করলো পানির পাইপ বন্ধ করার জন্য। মলি সাথে সাথে বন্ধ করে দাড়িয়ে রইলো।
” হ্যাঁ, বাসায়ই আছি। দুপুরের আগেই ফিরেছি। ওকে, এসো। ওকে বায়!”
ফরহাদ কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখলো। কাচিটা মাটিতে রেখে প্যান্ট ফোল্ড করলো। জুতা একপাশে রেখে কাচি নিয়ে বাগানে ঢুকে পড়লো। আগাছা কেটে দিচ্ছে সবগুলোর। মলি দাড়িয়ে মনযোগ দিয়ে দেখছে। খুব সুন্দর করে গাছগুলো ছেটে দিলো। ভালোই দেখাচ্ছে এখন। কিছু অংশ ভিজিয়ে কাদা করে ফেলেছিলো, ফরহাদ কাদায় হেটেই নিজের কাজ করলো। কাজ শেষ করে ফরহাদ তার কাছে চলে এলো। মলি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফরহাদও তার দিকেই তাকিয়ে আছে! ঘুম থেকে উঠলে তো মানুষকে এমনিতেই অন্যরকম ভালো লাগে সেখানে ফরহাদের মতো এতো সুন্দর একজন মানুষ হতে মলি চোখ ফেরাতে পারছে না!
হাতে টান পড়লে মলির ধ্যান ভাঙলো! ফরহাদ তার হাত থেকে পানির পাইপ নিয়ে পা ধুতে লাগলো। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসলো,
– হেই, ফরহাদ! আমি এসে গেছি। কেমন আছো তুমি?
– ওহ, জেনিফা! এইতো ভালো। তুমি কেমন আছো?
– তোমাকে দেখে অনেক ভালো! তুমি এখানে কি করছো! বাগান দেখাশোনার জন্য মালিনী রেখেছো তো!
ফরহাদ হাতের পানি ছিটিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসতে লাগলো বাগান থেকে। ছিটানো পানি এসে মলির চোখেমুখে লাগলো! ফরহাদ জেনিফার প্রশ্নের উত্তর দিলো,
– মালিনীর কাজ মালিনী করেছে আর আমি আমার কাজ করেছি।
– মানে?
– মানে সবটা তো আর সবাই পারেনা! বাদ দাও, তুমি মাত্র কল করে বললে আসছো। এতো তারাতাড়ি এসে গেলে যে!
– আমি মাঝপথে থেকেই কল করেছি তোমায়!
জেনিফা ফরহাদের হাত ধরে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। দুজনকে একসাথে দেখে এদিকে মালিনীর উক্তি, (https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318)
– বাহ! মানিয়েছে খুব ছোট সাহেবের সাথে! বড় সাহেবের পাশে যেমন জেরিন ম্যাডামকে ভালো মানিয়েছে ঠিক তেমনই ছোট সাহেবের পাশে জেনিফা ম্যাডামকে মানিয়েছে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here